একদা সেখানে ছিলো নীরবতা
(১)
কবিতা; শব্দের
অন্তর্গত বোধ,
নীরবতা, উড্ডীয়মানতা
- এসবের
মধ্য
দিয়েই হয়তো কবিতার পৃথিবীতে ঝঞ্ঝারত কবিকে অনুভব করা যায়, তার সময়কে
দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকের প্রয়োজন হয় না, কবিতার পাঠ
খুঁড়ে নেয় মমি হয়ে যাওয়া ভাষাকে। ভাষা
তার কালকে শব্দ দিয়ে বেঁধে নেয় কবিতায়। কোনো একজন
কবির দু-একটা
শব্দ, কবিতার চরণ
মাথা ভেদ করে চলে যায়। পাঁজরে বিঁধে থাকে
ত্রিশুল হয়ে অনন্তকাল। শামীম কবীর তেমন একজন
কবি, যার
শব্দে শব্দে ইস্পাতের ধার, কেটে নেয় চোখের ঘুম, রাত্রির
নিকষতা। নব্বইয়ের আগুনঝরা এপ্রিলে জারুল, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়ারা
যখন ফুটছিল শহরের অন্ধগলিতে, তেমন এক সময়েই শামীম কবীরের সাথে দেখা, পরিচয়। তরুণ
বয়সে বন্ধু হয় অনেকেই, তাদের ভেতরকার ক্ষুরধার, পেলবতা, নির্মাণ
করে চলে মানবিক সম্পর্কের স্থাপত্য। দুজন
মানুষ পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার পর
যখন তাদের অন্তস্থ মানস স্ফুলিঙ্গ নিয়ে জ্বলে ওঠে, সৃষ্টি করে কবিতা, গান, চিত্রকলা --
তা এক অনুপম বিস্ময় সৃষ্টি করে, যার মূল্য সময়কে ছাপিয়ে যায়, বেঁচে
থাকে মানুষের মনে। এক ঝাঁক তরুণ কবির স্বপ্ন দিয়ে তৈরি 'নদী'
পত্রিকার সংস্পর্শে যখন আসি, তার আগেই শার্ল বোদলেয়ারের শহুরে ফ্যাকাশে নারীর অবয়ব
মাথায় ঢুকে পড়েছিল। তার সাথে ফ্রানৎস কাফকা, আলবেয়ার কামু, সিলভিয়া
প্লাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে সব একাকার হয়ে মিশেছিল মনে
মগজে। ঢাকা
থেকে প্রকাশিত 'নদী' পত্রিকার
কবি হিসেবেই
শামীমকে প্রথম পড়ি। তাঁর কবিতা- শামীম
কবীর,
খোঁড়া
নর্তকী,
যাওয়া, এখানে
একজন কবি,
ইকারুস, শাসনচিত্র পড়তে পড়তে নতুন এক ঝড়ের সাথে দেখা হয়, যার বসবাস সমুদ্রের নিচের আলোহীন প্রস্তর খণ্ডের হৃৎপিণ্ডে। সকলের
মধ্যে অনন্য সাধারণ হয়ে শামীম আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। রায়ের বাজারের টালি অফিস
রোডে আমার আর বন্ধু আব্দুল্লাহ আল মামুনের বাসা মুখোমুখি। সেও
এক সময় কবিতা লিখত, 'নদী'
পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিল। মামুনের
বাসায় চলে বন্ধুদের আড্ডা। ঐ আড্ডায়
তখন অনেকেই আসত। আদিত্য কবীর, ইকবাল এহসানুল কবীর জুয়েল, তাজুল হক, ওয়াদুদ র্যানি, তানজিয়া
জাহান পলি,
স্থাপত্যের
ছাত্র বায়েজীদ মাহবুব, মামুন সহ অনেকেই। আর
দশটা আড্ডা যেমন নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনায় পূর্ণ থাকে,
টালি অফিসের এই
আড্ডাটাও ছিল তেমন, তার চেয়েও
বেশি কিছু।
(২)
বন্ধুদের
মধ্যে তখন শামীম, বায়েজীদ, তাজুল, আদিত্য, অভী, মামুন সহ আরো অনেকেই কবিতা লিখত। প্রথম
পাঠেই শামীমকে একজন মেধাবী কবি হিসেবে পড়ি। সমসাময়িক
অনেক কবি সেসময়ে তার দ্বান্দ্বিক কবিসত্তার পরিচয় পান। অনেককে
আড্ডায় দেখা যায়, অনেকেই লেখে, সহযাত্রী হয়,
কিন্তু কেন্দ্রে থাকে একজন। সেই আড্ডা
থেকে বেরিয়ে আসে একজন বা দুজন কবি, লেখক, শিল্পী --
যারা পোড়া মদ আর সেঁকোবিষ গলায় ঠেলে হয়ে ওঠে নীলকণ্ঠ, পাহাড়
কেটে বানায় অজন্তা, ইলোরা। শামীমও
আমাদের আড্ডার প্রাণ হয়ে ওঠে। ভেতরে
ভেতরে অশান্ত কবির অবয়ব, কিন্তু বাইরেটা
শান্ত,
ক্যাটস আই
চোখের গৌরবর্ণ ছেলে। কথা বলত খুব কম, কিন্তু খুব ক্ষুব্ধ সে কথা।
স্বভাবে
কোমল আর কঠিনের সমন্বয়। দু-একদিন মামুনদের উঠোনঘেরা
টিনের ঘরে
রাত হয়ে গেলে শামীম গলা ছেড়ে গান করত -- আমার রাজা ঘোরে বনবাসে গো, তারে
কেমনে ফেরাই আমার প্রেমেরও নগরে... অথবা
বন্ধু রঙ্গিলা,
রঙ্গিলা
রঙ্গিলারে... আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলা রে...। শামীমের
গানের গলা চমৎকার, মাঝে মাঝে সাগর সেন শুনতে শুনতে শামীমের মতো
লাগত আবার শামীমের গান শোনার সময় সাগর সেনের কথা মনে পড়ত। রংপুর
ক্যাডেট কলেজ থেকে আটাশি সালে বিজ্ঞান বিভাগ হতে এসএসসি, তারপর রাজশাহী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের
পাঠ। পরে একানব্বই সালে এইচএস সি (পরীক্ষা
অবশ্য এই কলেজ থেকে দেওয়া
হয়নি)। তবে শামীম কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক
পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিল না। অনেকটা
পারিবারিক আর সামাজিক কারণেই যতটুকু করতে হয়,
করত। অল্প বয়স থেকেই সে ভাবত কবিতা লিখবে আর
এই তার একমাত্র কাজ। অল্প কয়েক
বছরের লেখালেখির জীবনে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে সে।
বাংলা
অঞ্চলের নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে শামীমের কবিতা অন্যতম। অবশ্য
কবিকে দশক ধরে দেখাটাও খুব খণ্ডিত একটি বিষয়। সে
অর্থে বলতে গেলে শামীম নতুন কাব্যভাষা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। আধুনিক
নিঃসঙ্গ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ করেছে সে মর্গের দমবদ্ধ ঘরে। সেখান
থেকেই তৈরি হয়েছে ‘ম্যান সাইজ আরশি'
কিংবা 'আত্মহত্যা বিষয়ক গল্প’র মতো
কবিতা।
(৩)
একানব্বই
সাল। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট তখন সবে তৈরি
হচ্ছে। পাঠক সমাবেশ, সন্দেশ
কয়েকটি বইয়ের দোকান গড়ে উঠেছে। মার্কেটের
দোতলা আর তিনতলা উঠবার সিঁড়িতেই ছিল মূল আড্ডা। মাঝে
মাঝে এমন হতো,
সিঁড়ির
শুরু থেকে মাথা পর্যন্ত ভর্তি হয়ে যেত অসংখ্য কবি এবং কবিতায়। আসত
বিষ্ণু বিশ্বাস,
সাজ্জাদ
শরীফ, ব্রাত্য রাইসু, মাশরুর
আরেফিন,
শাহেদ
শাফায়েত,
আয়শা
ঝর্না, জুয়েল মাজহার, ফরিদ
আহমেদ অনেকেই। আড্ডাগুলোতে শামীম সব সময়
থাকলেও অনেক সময়েই আত্মমগ্ন হয়ে থাকত, পকেটে দু-একটা কবিতা। ভিড়ের
মধ্যে সে লিখে যেত। শামীম কবিতা লিখে বন্ধুদের পড়ে শোনাতে পছন্দ
করত। আজিজ মার্কেট তখন ছিল আমাদের বাড়ি-ঘর। পাবলিক
লাইব্রেরিও। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম।
বন্ধু
তাজুলের বড় ভাই আর্টিস্ট সাইদুল হক জুইসের বাসা ছিল ধানমন্ডি পনেরো নম্বর। সেখানেও
আড্ডা হতো। মাঝে মাঝে শাহবাগে মার্কেটের সামনে একা
দাঁড়িয়ে থাকত শামীম, তখন তাকে দেখাত একটা লম্বা নাকওয়ালা ধনেশ
পাখির মতো। গরম শামীমের সহ্য হতো না, লাল হয়ে
যেত,
পানি
খেত খুব। বুয়েটের তিতুমির হলের ২০৮ নম্বর রুমে বন্ধুদের
সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে শামীম। তিতুমির
হলের গেস্ট রুমেও আড্ডা চলত। বুয়েটের
মামুন ভাই,
জয়ন্ত
ভাই এদেরকে মনে পড়ছে। শামীমের ক্যাডেটের এক
বন্ধুও বুয়েটের হলে থাকত, সেখানেও মাঝে মাঝে থাকত শামীম।
সোবাহানবাগের
ডেন্টাল হস্টেলে বগুড়ার ও ক্যাডেট বন্ধুদের সাথে বহু সময় কাটিয়েছে শামীম। ৯১-৯৩এর
দিনগুলোতে শামীম এবং আমাদের বন্ধুরা সকলেই চরম বোহেমিয়ান দিন কাটিয়েছি, যা এক
দুর্লভ সময় হয়ে মিশে আছে রক্ত-মগজে। সমসাময়িক
কবিদের মধ্যে মাসুদ খান, বিষ্ণু বিশ্বাস, সুব্রত
অগাস্টিন গোমেজ,
মজনু
শাহ, রায়হান রাইন সহ
আরো অনেকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল; সে সময়ে একাডেমিক
ডিগ্রী না নেওয়ার বিষয়ে শামীম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল আর সকল ধরনের
প্রাতিষ্ঠানিক বলয় থেকে বাইরে থাকতে চেষ্টা করত। সাহিত্যও
সে করতে চাইত যেখানে খুব স্বাধীনভাবে লেখা যায়, যা
শিল্পোত্তীর্ণ তেমন
কাগজে,
লিটল
ম্যাগাজিনে। কবিতার ধ্যানে নিমজ্জিত হয়ে থাকত সে, ভাষার প্রেমে, শব্দের
প্রেমে। নিবিড় ভাবে
তা ঘটে চলত তার ভেতরে এবং খুব স্বাভাবিকভাবে।
কোনো
আরোপন নয়, এমনকি কবিতা লেখাকে
সে বিশেষ কিছু
ব্যাপার মনে করত না। কেউ ঘুড়ি ওড়ায়, কেউ কাঠ
ছাঁচে,
কেউ
রান্না করে -- এরকমই বা কেউ পদ্য লেখে। মানুষের
মৌলিক ঘটনাগুলোর একটি। শিল্প নিয়ে কচকচানি শামীম
সহ্য করতে পারত না বলে লোকসমাগম থেকে দূরে থাকত। লেখালেখির
পুরো বিষয়টাই তার কাছে খুব সাধারণ ও সহজাত এবং তা আবহমান গ্রন্থি থেকে গ্রন্থিতে ও
বিষয থেকে বিষয়ান্তরে বিরাজমান, এই ছিল তার অভিপ্রায়। বন্ধুদের
সাথে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোতে শামীমের মধ্যেকার
বোহেমিয়ান শিল্পীর সাথে দেখা হয়, যে ভেতরে
ভেতরে নরম তুলোর মতো
উড্ডীয়মান,
নিমগ্ন
নিজস্ব কল্পনার জগতে -- যেখান থেকে উঠে আসত
শব্দ, বিভাস, বিভাসিতধ্বনি। "অতর্কিত
একটি পিছল কাঁখ / আমাকে বহন করে / যুদ্ধের বাহিরে একা
অনবদ্য কন্যকায় / মিঠা সংগঠন /
একটি অচল মগজের মোম
আজ আরো / সত্যি সত্যি জ্ঞানী হ’য়ে ওঠে" -- এইসব চিত্রকল্প তার কবিতায় তৈরি হতে থাকে। যা
শুধু শব্দ নয়,
বাক্য
নয়, এর মধ্যে কবি সন্তরণরত, আকন্ঠ
নিমজ্জিত। করাত দিয়ে পা কাটবার দৃশ্য দেখবার মতো ঋজু কবি
অনন্তর যাত্রা করেছিল অধরা কবিতার পৃথিবীতে আর তাই বুঝি কবিতার সাথে ক্ষণিকের
বিচ্ছেদ তাকে করে তোলে নৃশংস। হ্যাঁ,
নিজের প্রতি। "কী ভীষণ অস্থিরতা
যে নিজেকে এখনও স্থির কাঠির মতো দেখে নিয়ে মাপতে পারলাম না / আর একটা বিশাল করুণ ঘণ্টার মতো একটা মহা
কৌতুক লেগে আছে আমার চোয়ালে, কণ্ঠায় বুকের ওপর দুই পাঁজরে / যাকে প্রাণপণে ভালোবাসি তাকে ভালোবাসতে না পারা" -- এই ছিল কবির নিদারুণ
যন্ত্রণার উৎস।
(৪)
মালিনীকে জল তুলে
দিতে হলে বাগানেই রাত্রিপাত হবে। সহস্র
বছর আর তারও অধিককাল
নিদ্রা গেলেও রাত্রি জেগে থাকে, অনন্তকাল তার ডানা ঝাপটানো। মাথার
ভেতর খেলা করে লক্ষ লক্ষ উইপোকা। তাদের
অন্ধ হওয়ার গল্প সবার জানা। ঝিরঝিরে
বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে রাতের সকাল, সকালের রাত্রি। শামীম
কবীর কবিতায় যে ভূ-খণ্ডে বাস করেছে তা খানিকটা লবণ দিয়ে পোড়া কিন্তু তিতকুটে নয়,
মুখে
দিলে সাই করে একটা তরিৎ-প্রবাহ শিরা-উপশিরায় রক্ত-সঞ্চালন, একঝলক উষ্ণতা। তবে
গ্লাসিয়ারের নির্মম শীতলতাও ভর করে তার কবিতায়। এটা
অনেকটা যুদ্ধের দিনে ট্রেঞ্চের নিচে পথ
খুঁজে বেড়ানোর মতো। হাঁটছো, হাঁটছো
চারদিকে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি, মরকলাগা ইঁদুর, পচা দুর্গন্ধময় গলিত মানুষ। এভাবেও
চলতে থাকে কালের চাকা, সে কখনো নিজের ডানায় জুড়ে দেয় বিদ্যুতের আলো,
কখনো ভেঙে ফেলে কাচের তৈরি হাতদুটো, যে হাত তাকে লাঙলের ফলা ধরতে শেখায়। রং
নং রং নয় রক্ত ঝরিতেছে। এই রং লাল, এই রং সবুজ, এই রং
বর্ণহীন। হ্যাঁ শামীমের কবিতায় সে রঙের দেখা পাওয়া যায়। পাতার
নিচে যে আন্তর্জাল
সে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শিল্পীর
আঁচড়ে কখনো কবিতার অক্ষরে। জন্ম এবং
মৃত্যৃ। এদুটোই অপরিহার্য মানে
এটা একটা চক্র,
চক্রায়ন, চক্রমন। ছোট
শিশু একদিন পক্ককেশ তারপর তার এপিটাফে লেখা থাকে এমন সব ঠিকানা যা ঐ মুহূর্তের
তাকে চেনায় না। শামীম কবীরের কবিতায় এই ঘূর্ণন খুব
নির্বিকারভাবে সন্তরণশীল। তাকে বলতে দেখি--
একটি
পাতার একটি জীবন
গজায়
বা ফোটে
তারপর
বাতাস থেকে কয়লা বনের গ্যাস নেয় গ্যাস
উড়ন্ত
ঝিরিঝিরি বল্লম ফলার মতো
প্রাকৃতিক
দৃশ্যাবলী আড়াআড়ি দেখে
তারপর
মূল পথে পানি টানে
আর
স্ফীত হয়
(প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী)
অন্যত্র--
একদা
সেখানে ছিল নীরবতা
(এবং)ছিল
নিবিড়তা
একজন
দুইজন আর কিংবা তিনজন
ক্রমে
লোকালয় সরে গ্যাছে।
(আরো এক টুর্নামেন্ট)
এই
হচ্ছে শামীমের কবিতার দ্যোতনা। একই সাথে
সময়ের ভেতর সময়ের মন্ত্রণা। কুঁজো খেজুর
গাছের স্মৃতি ভাসে তার মনে যেখানে আজ দাঁড়িয়ে আছে ঠনঠনিয়ার এপিটাফ।
যেখানে
লেখা আছে--
জ্ঞানী
কবরের স্কন্ধে চরে ফিরে এখানে এলাম
ছোটো
ছোটে অট্টহাস্য মাখা ধুলা ঘাস ও বাতাস
এখানের
এই নাম অন্যপুর নিহিত রেখেছে
থাবন্ত
আগুনে ছাওয়া এ যে সেই খাঁ খাঁ পারগেটরী।
(মা’রসঙ্গে
বাক্যালাপ)
শামীমের
কবিতায় শব্দ নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে, ব্যবহৃত
হয়েছে। শব্দের ভেতরের দুয়েন্দে শব্দ ফুঁড়ে অন্য এক
অর্থের ডাইকোটমিতে পরিভ্রমণশীল।
তুমি
কি জ্যান্ত?
তোমাকে
বলেছি চমকাও।
আলতার
দাগে ভরে গেছে নীল মুখটা
চারদিকে
ওড়ে উদ্ধোধনের ঝিলমিল তাতে ছটা নেই
চারদিকে
ভাসে নাকি বমোন
এমন
সব কথার জালে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে কবির পৃথিবী যেখানে সে নিজেই তৈরি করে চক্রবূহ্য। এই
চক্রে আবর্তিত হতে হতে কবি হয়ে ওঠে ধারালো পৃথিবীর মতো সর্পিল। তার
ভাষা আর কবিতা কেটে ফেলে গত শতকের লাল গালিচাকে,
যেখানে পশমের ভাঁজে লুকানো থাকে গোলাপ পাপড়ি, তারাখচিত বসরাই
ঝালর। নিজের তৈরি চক্রবূহ্যকে ভেঙে কবিকে হাঁটতে
দেখি খোলা প্রান্তরে যেখানে রেডিয়োতে গান বাজছে--
যে
মতে ধুলার স্মৃতি হলো ছারখার
সে
মতে ফিরিলা তুমি ফিরিলা আবার
অশরীরী
পুড়ে খাক শরীরী অনলে
আর
তার বায়ুঘের ধিকি ধিকি জ্বলে
(রেডিয়োতে
গান)
(৫)
নির্বাচিত
কবিতা : শামীম
কবীর সম্পাদনা করতে গিয়ে কবির মূল পাণ্ডুলিপি এবং দ্রষ্টব্য থেকে প্রকাশিত 'শামীম
কবীর সমগ্র' বহুবার
পড়েছি। এছাড়া কবির সতেরো বছর বয়সে লেখা একটা বেগুনি
রঙের ডায়েরি,
বেগুনি
মলাটের পাণ্ডুলিপি, বন্ধুদেরকে লেখা চিঠি এসব কবির মনস্তত্ত্ব
বুঝতে অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। বেগুনি
ডায়েরি আর পাণ্ডুলিপির খাতাটা কবি নিজ হাতে তৈরি করেছিল।
মানসিক
জগতে দুরন্ত ঘোড়ার তারুণ্য নিয়ে লেখা আর তা সংরক্ষণের
বিষয়ে কবি অনেকটাই নিঁখুত। তার হাতের
লেখায় যেমন শিল্পীর
ছোঁয়া আছে, প্রতিটি কাজে এবং কথায়ও তাই। সে কথা অন্য কোথাও কোনোদিন লিখব হয়তো। একজন
কবির কবিতাকে পড়তে গেলে যেমন সেই কবিকেও পড়তে হয়,
কথাটা যেন এই কবির ক্ষেত্রে অনেক বেশি সত্য। মনে
পড়ে যাচ্ছে মা’র সঙ্গে
বাক্যালাপের কথোপকথন, যেখানে কবি মা'কে
সমোদরা
জেনে তার যৌবন ছুঁয়ে যাচ্ছে--
মা
আমার যেরকম লাগে
চক্রাকারে
সে রকম মূর্ছা
সিঁড়ি
হারিয়ে আর কে কোথায় পেয়েছিলো কবে
(মা’র সঙ্গে
বাক্যালাপ)
এই
সব বাক্যে কবিকে মা অর্থাৎ নারীর মনন ও দেহের নৈকট্য অনুভব করতে দেখা যায়।
পুরুষতান্ত্রিক
বাঙালি সমাজে কবির উচ্চারণ
তার মনস্তাত্ত্বিক গঠনকে বুঝতে অনেকটা সহজ করে, এখানে মা
অনেক সময় চিরায়ত বন্ধনী ছেড়ে অন্য অন্য সত্ত্বাকে প্রকাশ করে। কবিতায়
কবি নিজের আত্মকে প্রকাশ করেছে। জানি না কথাটা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে,
কিন্তু শামীমের কবিতা পাঠে তার অন্তর্গত অশান্ত আত্মা বা সেই সত্ত্বাকে পাওয়া যায়,
যে ধুলি ঝড়ের শরীর থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে ধুলায় ধুলায়। এই
অনুভব একজন কবির নিজেকে যে কোনো
লিভিং বিয়িং অথবা অবজেক্টের সাথে একাকার হয়ে যাবার চিন্তন প্রক্রিয়ার সাথে দেখা
করিয়ে দেয়।
তোমার
বিপুল গড়নের মধ্যে
কোনোখানে
এক
টুকরো জটিল উল্লাস আছে
তার
স্পর্শে বদলে যায় প্রভাতের ঘ্রাণ
আর
আমি ভয়ে ভয়ে
মানুষ
হয়ে
উঠে
দাঁড়াই
কিন্তু
পা কোথায়
হা
হরতন হো ক্যুইট
(মা’র সঙ্গে বাক্যালাপ)
শামীমের
কবিতায় ক্লাসিক কবিদের ধারাবাহিকতায় নিজস্ব এক স্বর শুনতে পাওয়া যায় যা একান্তই
তার নিজস্ব,
যা
ভাসিয়ে দেয় পূর্বের অনেক লেখনীকে।
চর্যার
কাহ্নুপার প্রতীকি পুত্রবধু সবাক হয়ে ওঠে কবির কবিতায়।
কী
যে ভুল ঘোর লাগে কাহ্নু বাঁশি শুনে দুর্বল গাছের ডালে আমার যে প্রাণ-পাখি বাঁধা
আহা
আগাই পিছাই শুধু হৃৎপিণ্ডে খুন্তি ছ্যাঁকা পুরান কাঁথার নক্সা কতো আর চক্ষে
সয়
জানালায় টিয়া ডাকে তীরন্দাজ কোন সে দূর থেকে বুকে মারে বাণ আমার...
................................................
শান্তি
মনে নাই আমার যে প্রাণে বিষ কেউ
জানলে
সর্বনাশ হবে ওলো সই তোকে কই কাহ্নু প্রিয় এলে
বলে দিস পোড়ামুখী কলস
নিয়ে
যমুনা গিয়েছে (অবলা সংলাপ)
যে
সকল কবিরা বাংলা ভাষায় নতুন চিন্তা ও ভাষার সূচনা
করেছেন, কবি সেখানে নতুন কিছু যোগ করেছেন। সমসাময়িক
বাংলা কবিতায় ভাষা নিয়ে যে এক্সপেরিমেন্ট চলছে,
শামীমের
কবিতা সেখানে অগ্রবর্তী। ইনডিভিজ্যুয়্যালি অনেকেই সে
কাজটি করে যাচ্ছেন। শামীম নব্বইয়ের সূচনাতেই ভাষা নিয়ে কাজ করতে
শুরু করেছিল এবং স্বতস্ফূর্তভাবে যার ধারাবাহিকতায় অনেক কবিই লিখে যাচ্ছেন। সময়ের
সেলাই কলে এসব পোশাক তৈরি হচ্ছে, হবে। নতুন
দিন ও মানুষ সে পোশাক পড়ছে, পড়বে। এটা
ঘটে অনেকটা এক কালচারেশনের মতো করে। সংস্কৃতির
প্রপঞ্চগুলো যেমন স্বতস্ফূর্ত এবং চাপানো দু-প্রক্রিয়াতেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে
যাতায়াত করে তেমন লেখার ভাষা, মুখের ভাষা, কবিতার
ভাষা, গদ্যের ভাষাকে তৈরি করে দেয় সংস্কৃতির সোসিওফ্যাক্ট, আর্টিফ্যাক্ট, ম্যান্টোফ্যাক্ট। সেখানে
একজন শামীম কবীর একটা ভূমিকা রাখে যেমন রাখে চর্যাপদের কাহ্নুপা, রামায়ণের
চন্দ্রাবতী,
ধূসর
পাণ্ডুলিপির
জীবনানন্দ,
পুলিপোলাওয়ের
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তালিকাটা খুব ক্লিশে
হয়ে গেল হয়তো। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। আর
প্রত্যেক কবিই তার লেখার সময়কালে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট, অভিজ্ঞতার
মধ্যে দিয়ে যান। আলোচিত কবির লেখার সময়কালটা যেহেতু আাক্ষরিক
অর্থেই সীমিত, সেক্ষেত্রে তার কবিতা নিয়ে কথা
বলতে গেলে সময়ের একটা মাপের মধ্যে থাকতে হয়। ত্রিশ বছর
বয়সে কবি কি লিখতেন বা চল্লিশে বা পঞ্চাশে, তা দেখার
সুযোগ আমাদের
হয়নি,
হবে
না, কিন্তু সাড়ে চব্বিশ বছর বয়সে তার লেখার যে ভলিউম তা
অনেক সময় আমাদেরকে বিস্মিত করে, বিশেষত তার অন্তর্নিহিত চিন্তা আর
ভাষার ব্যঞ্জনা,
সর্বোপরি
সেই কাব্যিকতা,
কাব্যময়তা।
এই
ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাথা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার
মতো - তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চোখে ধীর লয়ে
শীর্ণ
এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম
শিলাখ - শিয়রে তার -
ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের
মতো : ছিন্নভিন্ন-ছেঁড়া জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী
থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে: পচা ঘায়ে
গোলাপের
মধু ঢালা অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে য্যান। ভীষণ
অস্থির
হাতে
সে ক্যাবল বিষণ্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।
(এইঘরে
একজন কবি)
'এই ঘরে একজন কবি'
কবিতায় কবিকে এত পরিণত আর বিচিত্র অনুসঙ্গের সাথে পরিভ্রমণ করতে দেখি যা প্রকৃত
কবির আত্মার সাথে পরিচয় ঘটায়। গোলাপের
পাপড়ি হতে শীর্ণ নদীর গহবরে কবির যে পরিভ্রমণ। কোথায়
দেবো রাজস্ব পাণ্ডুলিপির অন্যান্য কবিতা- শামীম কবীর, সমুদ্র
দণ্ড,
পৃথক
পালঙ্কে সব যেন এক একটা কাচের টুকরো। সংম্ভূ
আবার বিচ্ছিন্ন। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখা যায় আর তা একজন ধীবরের, একজন
দাবদপ্তরীর,
একজন
চোর,
ব্যাধ, গজারি গাছ সকলের। এরা
প্রত্যেকেই নিজের নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কাচের টুকরায় উদ্ভাসিত হয়। বিভিন্ন
এবং ব্যাপ্ত। এই প্রবণতা কবির সতেরো বছর বয়সে প্রকাশিত
কবিতাতেই দেখা গেছে। কবির প্রথম দিককার কবিতায় রোমান্টিকতার সাথে বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ, আনন্দ একাকার হয়ে আছে। তবে
সে কবিতাগুলোতেও প্রচ্ছন্নভাবে দেখবার একটা বিমূর্ত চোখ আছে; যে মূলত দর্শক, ভ্রমণ-পিপাসী। জার্নি
করছে শরীর হতে অশরীর, সেগুনের কাঁচা ঘ্রাণ হতে নক্সী কাঁথার ভাঁজে, বসন্তের তরুণী জারুলে। তরুণীর
চন্দ্রীল স্তনের স্তাবক, শঙ্খীল যোনি, ছুটন্ত
ষ্টারলেট,
নোম্যানসল্যন্ড, ঘামের
সমুদ্র এসবই কবির চলাচলের জায়গা। প্রথম
দিককার কবিতায় শামীম
কবিতায়
অনেক
সহজবোধ্যভাবে ভাষাকে ব্যবহার করেছে যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমান্তরাল ব্রীজ তৈরি
করেছে,
মৃত্যুর শিহরণ পেয়েছে সে প্রেমিকার স্পর্শে।
বিরানব্বই
পরবর্তী কবিতায় কবির ভাষা আক্ষরিক অর্থেই বদলে যেতে দেখি। ক্রমশ
শীতের পোশাক ছেড়ে সে গায়ে জড়িয়ে নেয় নানা রঙের উদগ্র আকৃতিআলা
ফাটাফাটি গান। কবিকে বলতে দেখি--
আমার
অদৃষ্ট আমি হারিয়েছি আর
আমার
অদৃষ্ট আমি হারিয়ে ফেলেছি
শুধু
আর তোমার আঙুল
হেঁটে
বেড়ায় আমার থ্যাতলানো গরম চাঁদিতে
আর
আর
এই
অদৃষ্টহীন কবি কি খোঁজে, নিজেই হয়তো জানে না। কখনো
টক্সিনের মৃদু মিষ্ট ক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, কখনো ঘুমের
সরবত খেয়ে বেঁচে থাকাটাকেই ফুলে ফেঁপে উঠতে দেখে। শামীমের
দেখবার চোখ অনেকগুলি, লাল কালো অনেকগুলো চোখ চেয়ে থাকে নলাকার কাঠ
থেকে। এই যে দ্রষ্টা, এই যে দেখবার ইচ্ছে, ক্ষমতা, ভ্রমণ এটাই তাকে চেনায় হয়তো। ক্লাসিক
ঘরানার সাথে রোমান্টিসিজমের সংমিশ্রণ ঘটেছে কবিতায়। আবার
নাগরিক পৃথিবীর একক নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা দেখা যায় কবিতায়।
এই
বিষণ্নতা, বিচ্ছিন্নতা কখনো কখনো তার
মধ্যে অনিচ্ছা তৈরি করেছে। বিতৃষ্ণার
জন্ম দিয়েছে। কোনো তৃষ্ণাই যেন নেই কবির, নেই কোনো
ক্ষুধা। আবার অগাধ লবণের
সাগরে তৃষ্ণার্ত
কবি স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায় সুমিষ্ট পানীয়র আকাঙ্ক্ষায়
যা ততোদিনে গ্লাসিয়ারে
পরিণত হয়ে গেছে। বাস্তব পৃথিবীর অভিজ্ঞতা ছেড়ে সে
ধীরে
ধীরে প্রবেশ করে স্যুররিয়াল পৃথিবীতে। যেখানে
বাস্তব, অবাস্তব আর প্রতিবাস্তব পরস্পরকে
বিদ্ধ করে আড়াআড়িভাবে, লম্বাভাবে। এই
অতি বাস্তব পৃথিবী তাকে হয়তো নেশা, বন্ধুত্ব, মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। অধরা
কবিতার পৃথিবীতে যাপন করতে করতে কখনো তাকে ছুঁড়ে ফেলতে দেখি সেই কবিতাকেই। একমাত্র
কবিতার পৃথিবীতেই শামীম কবীরের সন্তরণ, যেখানে
আছে ব্যাধ, হিজড়ে, সমকামী, রানীমা, আরো একটি
চাঁদ, তার প্রেতাত্মা, পঙ্খীরাজ, রক্ত, বীর্য,
যোনি। একজন দ্রষ্টা কবি সময়ের
অতীতে,
বর্তমানে, ভবিষ্যৎ
ভ্রমণ করে আর মর্গের বাহির থেকে শুনতে পায় হাতুরি
ছেনির বিচরণ।
শামীম কবীরের কবিতা
ভোরবেলার স্বপ্ন নিয়ে ভাসা
যা
কিছু প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা
জীবন
যা কিছু ধরে রাখে
এবং
যা কিছু সাঙ্গ করে
রেখে
যাই পাহাড়ী মদের ধারা
আজ
রেখে ঢেকে যাই
অন্যদিকে
শোঁ শোঁ শোঁ বাতাস কাঁপে
মনে
হয় ভ্রাতার হাতে যে ভগ্নিধাম
তার
কথা
এই
যে এতোটা পথ
এসবই
নকল
তবে
পড়া যায় মৌসুমী সাপের সাঁটলিপি
আমার
প্রত্যয় আজ ভেসে যায় আধখানা পা
খণ্ড
ধাবনের যতো সুরেলা প্রতীক ছিলো
ভুলে
গেছি ঢলের পুরান ভাষা
কী
এক ভাষার লোভে বেঁচে থাকি
কী
এক প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা
যা
কিছু সকল শংকা যা কিছু স্বচ্ছল
জীবনের
কে কোথায় ঊষর মলের ভাণ্ড ত্যাগ করে
উদরে
পুরেছে কালো গোলগাল অপোক্ষার বীজ
তার
ধাবনাঙ্ক মনে করি
অন্য
আধা তর্কে বেঁচে থাকে
মাথা
ভেদ করে আছে শীতের গহ্বর
ঐ
পথে ঝেড়ে ফেলি বিদেহী ভষ্মের কারুকাজ
তরল
আগুনে ঢাকা মেঠো পথ
তাক
করা জীবনের মধ্যে দিয়ে চ’লে যাওয়া
সোজা
ও
বক্রল সরল চাকার তুমি অণ্ডকাম
আর
ভেস্তে যাওয়া আধখানা ভরের সহগ
উলো
আমন্ত্রণক্রমে আমি আজ সীমায় এসেছি
যাহার
প্রত্যয় আজ ভেস্তে যায় আধখানা পা
সারাটা
গায়ের সঙ্গে প্রলেপিত দাফন পোড়ার ঘ্রাণ
দিগ্বিদিক
ঘ্রাণের আঘ্রাণে
ভেসে
যাওয়া পৃথিবীতে একা আছি
পরমাংশ
শোধনের কাটা ছেঁড়া সৈকতশালায়
কী
এক আকুল লোভে বেঁচে থাকি ছদ্ম প্রতিদানে
এমন
আতপ মৃত্যু মাটি শুধু
মৃত্তিকাই
পুঁতে রাখা জানে
দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান
অস্থায়ী
সারাক্ষণ
হাতে চাই চাই গানের বাকশো
কতো
রঙের ঢঙের আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান
আর
সাবেক প্রভুত নামে শৌচপর্ব সেরে
দেহ
খুলে ফেলে তারা বাদসঙ্গী
সদ্য
হ’লো তাদের
তা পরিচয় ভুল
মনে
করি ভুল আমি তাই ভুল করে সকলেই
সহজে
সহজ ভুলে ভ’রে যায়
রাফ খাতা
মাথাটি
গোবর ভরা যদি হয় আর
সোজা
যেও মুনমুন ফার্মেসী
এবং
সঠিক মাপে মাপে খাপে খাপে
চাঁদ
ভরে দেবে তারা
তবে
আমি যা কল্পনা করি
নষ্ট
হলে পুনরায় সারাবার সহজাভ
পথ
থাকা চাই
আকৃতি
বিশেষ নয়
যখন
তা মনে হয় তাই হয়
প্রথাভাঙ্গা
দেহ পেয়ে গাইবার জন্য যা যা গান
যে
সবই সতেজ হবে
কাঁখে
বাকশো ও আকণ্ঠ পান
সারাক্ষণ
হাতে চাই গানের বাক্শো খান
স্থায়ী
ফের
ওঠে ভেসে ভেসে খড়ের ভেতর বুনোফল
বৈশ্যদের
অধিকারে আরও দিন দিন
দিবাগত
রাত্র বেলা বিকিরিত কাটা তান শুনে
পুড়ে
যেতে যেতে সোনাভান
বলেছিলো
‘এই চাঁদ
আঁটো হয় গলে
অন্য
একটা ছোটো বদলে দেবে?’ বলে বলে
তবু
আমি চাঁদে চাঁদে গান নিয়ে আরও যাবো চ’লে
Perfect
ice, when they call, O Machine
কচ্ছপের খোলার নিচে
কচ্ছপেরখোলার
নিচে কাটালাম,
দুই
হাজার বৎসর,
তারপর
আজ,মাথা বের
করব। আমার মনে পড়ছে সেই বটগাছটির কথা, যার তলায়
আমি,
পড়ে
আছি,তার, বিশাল
প্রসন্ন ডালপালা ছড়ানো,চূড়াটি তো অনন্ত উঁচুতে উঠে গেছে, না, তা হয় না, কিন্তু
ভেবে,
আমার
বুকে আনন্দ চমকাল। আমি এর বিশালত্ব দেখে আত্মহারা। যেবার
প্রথম,এ অঞ্চলে আসলাম, চারদিকে
কেবল কমলা রঙের কর্কশ,ধুলোটে মাটির, ছোটোবড়
টিলা আর গড়ের বেষ্টনিঅলা,একরের পর একর, ধানক্ষেত, উঠান, আংড়া, তেতালামাটির
ঘর,
প্রতিটাঘরের
পাশে একটা করে তেজপাতাগাছ, নদীনালা, খালআর
মাঠশেষে,
গাড়িয়ালেরসুলিখিত, স্বপ্নপ্রকোষ্ঠ, সূত্রশালীচাকার
ঘর্ঘরস্পৃষ্ট বহরের নিচ থেকে,চাকচাক গোধূলি, আকাশ, অস্তরেখাইত্যাদির
সম্মিলিত,
রহস্য
ও লোভ ঠিকরে পড়া, সাতাশশো’টিগ্রাম, তার মধ্যে,মহাপ্রাণ
এক বৃক্ষ। দেখে, আমি, কিছুকাল তন্ময়
তার প্রেমে,
তারপর
আত্মহারা। আমি ঘুরেফিরে, এসে, এর নিচে
রোদ পোহাতে লাগলাম, প্রতিদিন। প্রতি
সন্ধ্যাবেলায়,
তার
আবছা,
ছাতার
শীর্ষের দিকে,
আমার
ছোট্ট,
বিষণ্ণ
দেহ,
তুলে
ধরে বলতাম,
চমৎকার,আজ যাই। এদিক
সেদিক,ঘরে বেড়াতাম, তারপর ধীরে
ধীরে,
চেনা
হয়ে গেল,বাগানের
আলো লাগা কাচে,
দিন
শেষের আনন্দিত মুখ, দেখতে দেখতে, শেষ চা, টাটকা
পোস্টার,
টিনেরহরিণ, সিফিলিসের
জীবাণু,
পুলিশের
ভ্যান–
সব, চেনা হয়ে
গেল,
সবাই।
আমার ঘর
এখন
সময় হ’লো
আমার
লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার
আমি
দুপায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরবো
আমার
ঘরে
না
কোনো ফুলের ঝাড়
কেবল
মৃত্যু
আমার
ঘরে কী সুন্দর সাজানো
কাঁপন
বৃত্তের
সূত্র :
বৃত্তের
পাশ ছুঁয়ে থাকা হাত
আলগোছে
সরে এসে একটু একটু কাঁপলো
তাকে
কী বলা যায়
আমি
বাহান্নজন বালকের মুখ তৈরি করি
আদলে
আদলে বিদ্যুৎ স্পৃহা চমকায়
আর
হাত নিচু করে যখন সরে আসি
সন্ধ্যার
সুবাস রেখে চলে যাওয়া রুমালের
অগোচরে
জীয়ে থাকা অজস্র কাণ্ডের সাথে
গলাগলি
আর খাড়া থাকবার উন্মাদনা
শেকড়ের
গুপ্ত স্ফিতির চেয়েও
উত্তুঙ্গ
হয়ে ওঠে
আমি
এই পৃথিবীর নই
গোলকের
সূত্র :
কব্জা
খুলে ছুটে ছুটে যাওয়া প্লীহার গন্ধ
ভরাপেট
উগরে গিয়ে বিকেলের হিম মাখানো রোদ
গায়ে
মেখে ক্রমশ উদাস হয়ে যায়
যা
ভাবায়
যা
কাতর করবার জন্য আনাগোনা করে
কবিতাকে
আঁকড়ে থাকতে হয় এক ছোটো
পীত
রঙের হুকের সাথে
আর
হাত ফসকে পড়ে যাওয়া কাঁধের গল্প
আজ
মনে পড়ে যায়
যার
কাছে গচ্ছিত রাখার বেদনা
এক
বোতল উগ্র জেদ আর পাশবালিশের
কান
ছুঁয়ে থাকা স্বপ্নের আঁকাবাঁকা রেখা
আজ
হয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে
যার
কাছে আমার লাল ঘোড়ার গাড়িতে
ফেরার
সময় হয়
হয়
হয় হয়
সেই
গন্ধে আকুল চেতনার একপাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া
এখন
এই বিলয়ের বিনির্মাণ কালে
বৃত্ত
ও গোলকের সমন্বয় সূত্র :
ডাক
পাড়ে ডাকে
খালি
ডাকে
একটু
একটু ঠুকরে বেড়ানো ঠোঁটের পিনবিন্দু
স্থায়ীভাবে
একবার বসতে চায়
তোমার
অন্দরের ভিতর
ঠিক
য্যানো আমি ভুলে গেছি
অথচ
রাজ্যের বিস্ময় চিহ্ন মাখানো ছাতুর পিণ্ড
আকাশ
জুড়ে করতাল বৃষ্টির সাথে ঝরে
ঠিক
য্যানো আমি ভুলে গেছি
ক্ষুধা
আমি ভুলে গেছি
মেশিনের
বরপুত্র আমি
একটি নোম্যানসল্যান্ডের স্বপ্ন
একটি
নোম্যানসল্যান্ডের পথ বেয়ে বসে আছি
অন্য
এক দোল খাওয়া মাঠে
মাঠের
উত্তরে আছে উঁচু এক বিম্বনাশী টিলা
সে
টিলার খাঁজে ভাঁজে ফুটে থাকে দোদুল ফুলেরা
দক্ষিণের
বায়ু এসে পরগায়নের সাথে
পাখি
ও প্রজাপতির দীর্ঘশ্বাস মেশায়
অন্য
সকলও
পূর্বে
আছে পিত্রালয়
পথের
কিনারগুলো কেটে ছেঁটে কুরতি
সেই
পথে বহু মৃদু শ্যাফ্ট্-এর সুরে
ভেসে
আসে মায়েদের ব্যথা
অমরার
নিভু নিভু বিচ্ছুরণ কালে
সে
আসবে পশ্চিমের প্রকাণ্ড পশ্চিমগুলি ভেঙ্গে
আর
আমি সেই নোম্যানসল্যান্ডেতে শুয়ে ব’সে
হস্তমৈথুনের
জন্য ঝোপ ঝাড় তৈরি ক’রে নেবো
আর
আজ আমি উষ্ণ উজ্জ্বল কাঠের জুতোয় ঢুকে
মজা
লুটি সাত-রশ্মি দিবস রজনী
কিন্তু
ভেবেছিলাম
যে কোনো স্রোতের মধ্যেই এইভাবে নির্বিকার
ভাবলেশহীন
যাবো আলাভোলা বাতাসের মতো, যে-রকম
জন্মগ্রহণেরও
আগে,
অনেক
আগেই আমি মায়ের জঙ্ঘার
খুব
গোপন জানালা দিয়ে দেখেছিলাম রৌদ্রের বিভ্রম
প্রতীক্ষার
ভঙ্গি নিয়ে-ভেবেছিলাম পার হোয়ে যাবো ইহকাল
কোনো
মতে,মাঝে
মধ্যে ঘুমন্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে হয়তোবা শুধু
ধরাশায়ী
হোতে হবে,
পথে
ঘাটে ভীষণ নাকাল
তাতে
কী-বা এসে যায় (রক্তের মধ্যেই আছে কাতরতা-ধূধূ
মনোহর
ইয়ার্কি সখ্যতা) আমার উচিত ছিলো শ্মশানের শীত
থেকে
পোড়া কাঠ-কয়লার নিরপে আঁধার জমানো কিংবা ধুলো
আর
নর্দমার গড়াগড়ি দেয়া, সন্ধে হোলে সাচ্চাপুরোহিত
সেজে
উলুকভুলুক মন্ত্রে দুনিয়া কাঁপানো যেতো, নৈশভোজে খাঁটি দেশী
মূলো
ভেবেছিলাম
এভাবেই-নিজস্ব কল্কিতে দেবো কষে টান, হঠাৎধাঁধার
সমাধান
পেয়ে গেলে চৌরাস্তায় উবু হোয়ে বোসে খুব প্রবীণ
ভূতের
মতো ভেল্কিতে দেবো চু ছানাবড়া কোরে আমি নিজেই সবার
কিন্তু–থেমে
দাঁড়াতেই,
কেয্যান
ভেতর থেকে প্রাণপণে
বোলে
উঠলো- এভাবে কদ্দিন ওহে এভাবেকদ্দিন
অবলা সংলাপ
কী
যে ঘোর লাগে কাহ্নু বাশি শুনে দুর্বল গাছের ডালে আমার যেপ্রাণপাখি বাঁধা
আহা
আগাই পিছাই শুধু হৃদপিন্ডে খুন্তি ছ্যাঁকা পুরান কাঁথার নক্সা কত আর চক্ষে
সয়
জানালায় টিয়া ডাকে তীরন্দাজ কোন সে দূর থেকে বুকে মারে বাণ আমার
চোখের
জলে বন্যা নামে বুঝি আমি কি ফ্যালানি ছাই প্রাণসখা আমাকে পোছে না
কতজন
আসে যায় হাট ভাঙে করল্লার লতাটাও কঞ্চিমাচা জড়িয়ে ধরেছেওই কলাঝারে
হাঁটে
বুঝি কেউ মর ছাই আলতা গাই ওটা কী যে ভুল নিঁদ নাই গলায়শাদা নলা নামতে
না
চায় হায় প্রাণনাথ কোন বনে ঘোরে ঘরে শান্তি আমার নাই আমার যে প্রাণে বিষ কেউ
জানলে
সর্বনাশ হবে ওলো সই তোকে কই কাহ্নু পিয়া এলে বলে দিস পোড়ামুখি কলস
নিয়ে
যমুনা গিয়েছে
শামীম কবীর
খুব
ক্রুর মুখোশের মতো মনে হয় এই নাম । অতিকায়
রূপালী তিমির মতো- আমার
মর্মমূলেএই খুব নিবিড়
আপন
নাম নিদ্রিত রেখেছে এক বিশুদ্ধ আগুন (তন্দ্রায়
নিবে
গ্যাছে তার সব তুখোড় মহিমা)-এই প্রিয় সশরীর
নাম
এক দাঁতাল মাছির মতো অস্তিত্বের রৌদ্র কুঁরে খায়
রাত্রিদিন;আষ্টেপৃষ্টে
কাঁটাতার হোয়ে আছে- শামীমকবীর
এই
তুচ্ছতর নাম : গোপনে,ত্বকের নীচে খুবনিরুপায়
এক
আহত শিকারীর নামের মোহন ফাঁসে জড়ায় তিমির।
ইতিহাসে
অমরতা নেই;
পরিবর্তে
রাশি রাশি বুলেটের
দক্ষ
কারুকাজ করোটিতে, দগ্ধ লাশময় দীর্ঘ উপত্যকা
আর
নীলিমার বোঁটা থেকে অনর্গল-নির্ভার নি:স্বদের
জাতীয়
সঙ্গীত ঝ”রে পড়ে।ক্যাবল
কুচক্রী এইনাম- পাকা
নিকারীর
মতো রোয়েছে অমর য্যান, আমার সকল পথে
অয়
জালের ব্যুহ কোরেছে আরোপ কোন দুর্বার শপথে।
এই ঘরে একজন কবি
এই
ঘরে একজন কবি
আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার
মতো-তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চোখে ধীরলয়ে
শীর্ণ
এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম
শিলাখণ্ড শিয়রে তার-ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের
মতো: ছিন্নভিন্ন-ছেঁড়া জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী
থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে;পঁচাঘা-য়ে
গোলাপের
মধু ঢালা-অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে য্যান। ভীষণ
অস্থির
হাতে
সে ক্যাবল বিষন্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।
কবির
আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে
প’ড়ে থাকে
সে-ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে
অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝেই বদ্ধ ঘরময়
গলিত
বাতাস কাঁপে-অন্তর্গত সজীব গর্জনে:বাঁধা গৎ
ভুলে
গিয়ে-নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে
সুরের প্রতিমা,
অথচ
খোলে না তার অন্ধচক্ষুদ্বয়।।
অনুসরণ
একজন
অবিকল আমার মতোন লোক আজ সারাদিন
আমার
সামান্য পিছে চলমান, যে রকম বিশ্বস্ত কুকুর
যে
দিকেই যাই আমি,
এলেবেলে
ঘুর পথে,
খুব
শব্দহীন
পেছনে
পেছনে সে-ও চলে;
পার্কে, নদীর ধারে—শিষ্ট
ময়ূর
য্যান
পেখম গোপন কোরে আমার পেছনে চলে উদাসীন
পথিকের
মতো। অকস্মাৎ পেছনে তাকালে দেখি, অল্পদূর-
আনমনে
ধরাচ্ছে সিগার সে, অথবা কখনো খুব মিহিন
রুমালে
মোছে গরদানের ঘাম; বোঝো সে ক্যামন সুচতুর!
বুঝি
না,
সে
কী কারণে এমন নাছোড় চলে, এ-তার ক্যামন
ব্যবহার
: অবিকল আমার নকল কোরে মুখের গড়ন,
দৃষ্টির
খরতা আর জটদার চুলের বহর, বেশবাস—
ক্যাবল
ভিন্ন চলার প্রকৃতি তার; আমি চলি একা, আপন
খেয়াল, আর সে
আমার নিবিড় পেছনে ধায় জ্বলন্ত শ্বাস
কোরে
সয’ত্ন-গোপনে, অদৃশ্য
সঙ্গীন হাতে,
নিজস্ব
সন্ত্রাস।।
অথচ আমার চোখ
কেউ
কেউ বলে বটে—এ আমার
ভুল প্রেম। এ-রকম—খোঁড়া
নর্তকীর
সাথে রাস্তায় বেড়ানো, আশে-পাশে লক্ষ মানুষের
খুব
ঝাঁঝালো অবস্থিতি অগ্রাহ্য কোরে—খোলা সড়কদ্বীপের
ধারে
পা ঝুলিয়ে বোসে তার তেজী নৃত্যকলাময়—সুতো ছেঁড়া
অতীতের
নিখাদ মলিন গন্ধ শোঁকা, খুব অন্যায়। তা-ছাড়া
যে
সুরের রেশ নেই বর্তমানে, নিহত যে পাখি, এ-তো ঢের
বোকামী—তার দগ্ধ
পালকের নিচে প্রচ্ছন্ন অবচেতনের
ঘোরে
প্রকৃত উষ্ণতা অন্বেষণ; এ-তো অতি স্বপ্নেরও বাড়া।
অথচ
আমার চোখে বিস্ফোরণের মতো লাল-নীল, ঈষৎ
ম্লান
জ্বলে ওঠে দীপ্র ঝাড়বাতি, চন্দ্রালোকি জলসাঘর—
তবলায়
তুফান,
তুমুল
নূপুর ধ্বনি,
তন্ময়
নহবত
কানে
বাজে অবশেষে—কুয়াশায়
নর্তকীর হিল্লোলিত ঊরু,
পদ্মের
পাতার মতো পায়ের কাঁপন আর বক্ষ তোলে ঝড়
আমি
দেখি,
আবার—খোঁড়া
নর্তকীর পায়ে তীব্র নাচের শুরু।।
জন্মান্ধের ভূমিকা
জন্মাবধি
অন্ধ হোয়ে আছি—সশরীর, এড়িয়ে
ধুলোর মতো—
গাঢ়
রৌদ্রালোক দুইচোখে। বয়েসী বটের মূলে গুপ্ত ক্ষত
দেখিনি
তাকিয়ে কোনোদিন,
অথবা
আড়ালে থেকে নির্নিমেষ—
জ্যোৎস্নালোভী
নারীদের পাহাড়ী গ্রীবার ভাঁজে তীব্র অনুদিত
গোলাপ
শিশু;
পরিবর্তে
আমার চৈতন্য স্রোতে কি দগ্ধ শেষ
নিঃশ্বাস
ফেলে ছায়া হয় ইতস্তত ছিন্ন মেঘেরা; ঘুমন্ত
ঈশ্বরের
মতো,
মনে
হয়—বহুকাল প’ড়ে আছি
জলশেষ
শুকনো
কাদায়,
ত্বকের
নিচেও আছেও খুব গাঢ় ছদ্মবেশ।
আমার
গুহার বার্ণিশে সবুজ সতেজ অর্কিড প্রতিদিন
রৌদ্র
খায়,
বাতাসের
উন্মুক্ত গালিচায় নির্ভেজাল প্রাচীন
অশথ্থের
মতো ছড়ায় শেকড়;
ক্যাবল
স্মৃতিনষ্ট আফিমে
আচ্ছন্ন
রোয়েছি বোলে,
গুহার
আঁধারে আমি মায়াবী পিদিমে
খুঁজি
রৌদ্রের প্রতিমা, আর ক্রটিহীন জন্মান্ধতা হেতু—করি
আরাধনা
নর্তকীর : নির্ভুল মুদ্রায় নেচে যদি পাই সিঁড়ি।।
পৃথক পালঙ্কে
(কবি আবুল
হাসানকে নিবেদিত)
তুমি
ঠিক পলাতক নও। আমিতো এখনো দগ্ধ তৃণভূমি
থেকে
পাই উপবাসী ভেড়াদের বিক্ষুব্ধ শিং-সংঙ্কেত; তুমি
কি
উটের মতো জ্বলস্ত ক্যাকটাসের জমাট জল তরঙ্গ
এখনো
শুনতে চাও,
নাকি
ঘুমের ভেতরে শুয়ে—সমকামী
আর
হিজড়েদের ত্রুটিহীন ব্রহ্মনৃত্য দেখবে? স্বপ্ন ভঙ্গ—
জানি
তুমি অক্লেশে সোয়ে নাও, তবু—রাত্রির
মতো নিম্নগামী
কালো
জলে ভেসে যদি যায়—জননীর মতো অসহায়—বঙ্গ
তোমার, তুমিও তো
পারবে না ঠিক এড়াতে যন্ত্রণার সঙ্গ।
তোমার
মর্মমূলে নিসর্গের শীর্ণ লাশ সর্বদা কল্লোলিত
শ্মশানের
প্রেতী গান গায়,
অরণ্য-মঞ্চে
এক অন্ধ নায়ক
রাতদিন
তোমার অনুকরণে করে বৃপজা,স্বপ্নাতঙ্কে
নীল
কিশোরীর বুকে মোহন তোমার বাঁশি বাজে—উন্মোচিত
সত্য-সম
জানি সব,
হে-পাতক
স্বর্গের বাগান পলাতক
নও
তুমি,
নির্বাসিত
হোয়ে আছো—স্বপ্নহীন
পৃথক পালঙ্কে।।
এই ঘরে একজন কবি
এই
ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার
মতো—তার
নিদ্রামগ্ন ‘ভাসমান
চোখে ধীর লয়ে
শীর্ণ
এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম
শিলাখণ্ড শিয়রে তার—ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের
মতো : ছিন্নভিন্ন—ছেড়াঁ জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী
থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে; পচা ঘা-য়ে
গোলাপের
মধু ঢালা—অভ্যেসে
দাঁড়িয়েছে ভ্যান। ভীষণ অস্থির
হাতে
সে ক্যাবল বিষণ্ণ খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।
কবির
আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে
প’ড়ে থাকে
সে—ক্যামন
মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে
অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝে বদ্ধ ঘরময়
গলিত
বাতাস কাঁপে—অন্তর্গত
সজীব গর্জনে : বাঁধা গৎ
ভুলে
গিয়ে—নিদ্রিত
কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে
সুরের প্রতিমা,
অথচ
খোলে না তার অন্ধ চক্ষুদ্বয়।।
রাত
আমি
মেশিনের বরপুত্র, বৈদ্যগিরি জানা ছিলো ভালো
বলো
তুমি কাঁদছো ক্যানো?
এমন
যে কাঁচা কাজ,
শ্বাসাঘাতহীন
কান্না শোনা যায়
তুমি
আমাকে বলছো না ক্যানো কথা?
সারা
বাড়ি রঙ হলো,
এবং
আছে বাতাস নেবার
পেকে
ওঠো
তারপর
অস্ত্র পাচার করি চোখভর
জানালা
খুলেই এক মহাশূন্য
অন্তহীন
আলো
ফলে
কিছুই দ্যাখার বাকি রইলো আর নয়
নুয়ে
এসে মন্ত্র নাও মেশিনের, এতো রাতে
রাজহংস
শিকারের ঊরুজলে ডুবে মরা ভালো
ফাঁকা
শহরে
আগুন লেগে কাণ্ড শুরু হলো
রাস্তা
দিয়ে উঠে এলো ভূগর্ভের ড্রেম বেঁকেচুকে
সবশেষে
কার্বনের ফ্রেম হ’য়ে সবকিছু বয়
কয়েক
শতাব্দী পার করে দিতে
এরকম
সমগ্র পৃথিবী
তার
মধ্যে একা এক কাঁধ
ঘোরে
ফেরে
কোনো
কিছু বহনের নাই কোনো আর
ও চাঁদ
যে
চাঁদ মাস্তুলে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গ্যালো
যে
চাঁদ সাগরে টুকরো টুকরো হ’য়ে
ঝ’রে পড়লো
যে
চাঁদ সমুদ্রের নিচে শুয়ে আছে
খণ্ড
বিখণ্ড হয়ে
সে
চাঁদ তুমি নও
তুমি
তার প্রেতাত্মা
আমার ঘর
এখন
সময় হ’লো
আমার
লাল ঘোড়ার গাড়িতে ফেরার
আমি
দুপায়ের হাড় বাজিয়ে ফিরবো
আমার
ঘরে
না
কোনো ফুলের ঝাড়
কেবল
মৃত্যু
আমার
ঘরে কী সুন্দর সাজানো
বাঁধ
রাত্রি
কি ব্যথায় মোড়া
রাত্রি
কি উত্থান
বিপুল
পাপের ভারে নুয়ে পড়া গভীর স্বপন
আর
আমাদের এই ছোটো ছোটো অসীম জীবন
আজ
এক রেখায় মিলে যায়
নগরীর
প্রাচীন হাড়ের শব্দ লকলকিয়ে ওঠে
ঘেয়ো
কুত্তার মলচাটা জিভের আগায়
এবং
একটি মৃত্যুর সম্ভাবনা দাঁড়িয়ে থাকে
আগাগোড়া
ব্যান্ডেজ জড়ানো বন্ধুর চেতনে
আজ
দেখি নৈশ কালো ট্রেন
তার
যৌনকাতর জীবাশ্ম ফেলে ফেলে
মাতাল
ট্রেন তার উপচানো শিস ঢেলে ঢেলে
তার
অস্থির বৃষ্টির হাওয়া ছেড়ে ছেড়ে
আবছা
আকাশের দিকে যেতে যেতে
ঘোরহীন
পেলব মৌনতা বাজিয়ে চলে যায়
এই
রাত্রি আমাদের
গল্পঘরে
পড়ে থাকা অজস্র খুলির ভীড়
ভেদ
করে কেশর দোলানো
এই
রাত্রি আমাদের সতেজ সূচক
আর
খুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা
পুরোটা
গল্পের জন্ম এই বাঁধ থেকে
স্রোতে... স্যান্ড্রা! ফালি ফালি চাঁদ ভেসে যায়
একবার
জাল ফেলেছিলাম গলুইয়ে ব’সে
তখন
চাঁদ ছিলো না
আমি
আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম পানির জীবন
ক্যামন
নোনতা আর চ্যাপ্টা তার কোষতন্ত্র
আর
উল্লাস রাগে কী রকম থরথরিয়ে কাঁপে তার বাড়
অথচ
উঠে এলো ভাঙাচোরা
একটা
দ্বীপের টুকরো টুকরো অঙ্গ রাশি
আর
তাদের ভেতর শক্ত হয়ে বসা একটা
মৎস্য
দম্পতির বাসা
স্যান্ড্রা
প্রিয় মম
এই
যাত্রায় আমাকে যেতে হবে বহুদূর
প্রায়
অসীমের কাছাকাছি
চক্ষু
কর্ণ জিহ্বা নাসিকা ত্বক আর
সমুদয়
অর্থ সাথে নিয়ে
আর
ঝিমাই হাঁটু গেড়ে রাতের পর রাত
যেখানে
ঢেউ ছিলো এখন সেখানে শুধুই জ্যোৎস্না
সাঁতার
কেটে কেটে ক্লান্ত হয় স্রোতের ওপর
জাল
থেকে একটা একটা করে খুলে
সমস্ত
দ্বীপের টুকরো ছুঁড়ে ফেল্লাম স্রোতে
কিন্তু
ততোক্ষণে দম আটকে মরে গ্যাছে মাছ দুটো
এতো
অনায়াসে তারা মরে গ্যালো
হে
স্রোতের উপর ভেসে থাকা ফালি ফালি চাঁদ
তোমরা
উড়াল দাও
আমাকে
যে জেগে থাকতেই হবে এই জলকষ্ট নিয়ে
দ্বীপ
একটা
সুন্দর শাদা দ্বীপ আছে। তার গা’য় কালো
কালো ছোপ। আমি তার ওপর ব’সে চারপাশের
থৈ থৈ দেখি। একটা বৈঠা আছে ছোটো কদম কাঠের। বৈঠা
বেয়ে একটু একটু এদিকে সেদিকে বেড়ানো যায়। চারপাশে
ভেসে যায় কতো কতো দ্বীপ আরও। দ্বীপগুলি
বাড়ি খায়
না। আলগোছে
একে অপরের পাশ কাটায়। ব’সে ব’সে
চারপাশে দেখি আর বহুবিচিত্রি শুনি...
হঠাৎ
স্বপ্নটি ভাঙার পর দেখি তেপান্তরে লম্বা খাড়া সরু এক আঙ্গুলের ডগায় ব’সে আছি
একা পা ঝুলিয়ে আর দশ পাশে অনর্গল খালি তর্জনী উড়ছে ঝোড়ো বাতাসে। ব’সে ব’সে
তর্জনীয় ঝড় দেখি। দেখিতেছি। অনেক
দূরে প্রায় দিগন্তে এক বিশাল ঢালাই লোহার কড়াই বসানো। তার
মধ্যে চুয়ে এসে জমা হ’চ্ছে সমস্ত আকাশ থেকে অবিরল একধারা নীল। আকাশটাকে
দেখাচ্ছে এক পশলা ফ্যাকাশে হাড়ের মতো এখন।
রেডিয়োতে গান
যে
মতে ধুলার স্মৃতি হ’লো ছারখার
সে
মতে ফিরিলা তুমি ফিরিলা আবার
অশরীরী
পুড়ে খাক শরীরী অনলে
আর
তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে
সুর
ক’রে গায়
সকলে। আনন্দিত নয় উৎকণ্ঠিত নয় ভক্তিতে গদগদ নয় এমনকী
নিস্পৃহও নয়। সকলে সমম্বরে টেনে টেনে সুর ক’রে হায়
চিকন ও ভারি বহু স্বরে। তাদের ভঙ্গি খুব
সাদামাটা ও সাঙ্গিতিক আর উচাটন নয়। স্বর মাঝে
মাঝে ভেঙ্গে যায় আবার তীক্ষ হ’য়ে ওঠে তবে সুর অবিচল টানা টানা।
অশরীরী
পুড়ে খাক্ শরীরী অনলে
আর
তার বায়ুঘের ধিকিধিকি জ্বলে
না
দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা
নকল
ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা
সকলে
গাইতেই থাকে। শুধু গাইতেই থাকে। এমনকি
চোখের পাপড়ি নাড়াতে পর্যন্ত ভুলে যায়। আর শ্বাস
ফেলতেও মনে থাকে না। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ
উত্তরে কেউ পশ্চিমে কেউ কোনোকুনি তাকিয়ে অনর্গল গাইতে থাকে। বাতাস
বয়ে যায় শিরশির ক’রে। সকলের গা
ঠাণ্ডা হয়ে গ্যাছে। কিন্তু তারা নড়ে না চড়ে না খালি গায়।
না
দেখো চর্মের চক্ষে সেই সঙ্গপনা
নকল
ঘরেতে নিশি দিবস যাপনা
ঝুলন্ত
বিষের থলি ঘরের ভিতরে
আরও
আছে সখা সখি উভকাম করে
শুধু
একটানা ও বিলয় বিহীন গাওয়ার শব্দ। তার মধ্যে
আর কিছু নেই। সেই শব্দ বহুস্বর মিশ্রিত হ’য়ে টান
টান ফাঁপা হ’য়ে উঠেছে
আর সেই ফাঁপা নলের মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে গানের পূর্বাপর রেশগুলি। চল্কে
চল্কে যাচ্ছে তার অনুরণন।
ঝুলন্ত
বিষের থলি ঘরের ভিতরে
আরও
আছে সখা সখি উভকাম করে
বাদ্য
বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম
আর
কাহারও নাহিকো লাজ করিছে গরম
বয়স্কদের
হাঁপ ধরে না। কচিদের গলা চুলকায় না। পরনের
কাপড়গুলো যে ধূসর হ’য়ে ঝুমঝুম ক’রে খ’সে যাচ্ছে
তারও খেয়াল নেই। শরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে তারও বোধ নেই।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে
গেয়ে চলেছে সেই একটানা মোচড়ানো সুর মোতাবেক ধীরে ঐকলয়ে। তাল
উৎক্ষেপিত। কী রকম য্যানো। লৌকিক
তবে একঘেয়ে মনে হ’তে পারে। কিন্তু
খুব সরল গতিতে চ’লছে সেটা যে বিরক্তিকর নয়। আনন্দিত
নয়। একটানা। ফেঁসো।
বাদ্য
বাজে বদ্যি গাছে রোগের পশম
কাহারও
নাহিকো লাজ ক’রিছে গরম
অঙুলি
হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে
সে
কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে
মাঝে
মাঝে হঠাৎ বাতাস পেঁচিয়ে গিয়েই বা শিস্ ওঠে। তার
প্রতিধ্বনি হয় আর ফালি ফালি হয়ে যায় বাতাস। কিন্তু
তারা নিরুদ্ধে থাকে। একেকবার শিস্ ওঠে আর
তারপর অনেক বহুক্ষণ চ’লে যায়। আর তারা
গাইতে থাকে অনড় হ’য়ে। মুখ হাঁ।
অঙুলি
হেলিয়া পড়ে দুধের বাটিতে
সে
কেমন সাপ মরে ভঙ্গুর লাঠিতে
আর
তারপরে অন্য কথা পরিচয়
কতোকাল
কেটে গ্যালো হ’য়েছে
প্রলয়
অকস্মাৎ
দুম ক’রে
ব্যাটারীর আয়ু শেষ হয়
গানটির
জন্য পুঁথিপাঠের লোকায়ত সুর টান ও ধ্বনি ভঙ্গিমা সহকারে সমবেত পঠন ও ধূয়াসহ
বিলম্বিত গায়ন প্রযোজ্য।
মা'র সঙ্গে বাক্যালাপ
দেয়ালের
চোখ নেই
কেবলই
স্বচ্ছতা মাখা খাড়া
কতোকাল
আর
এইখানে
মাঠের
মধ্যম কোণে রোপিত রাখাল
ভাসমান
বা
আমি জেনেছি বিন্দু
বিন্দু
কপালের
গোরো বিলীনতা জমেছে বিরাট প্রান্তে
বহু
বছরের খাওয়া
ছাদ
অলা
এ
বিরাট শল্যকেশী হাওয়ার বিরক্ত প্রান্তে
অম্লান
অম্লান
ও
দীঘল
(ফোলা
ফাঁপা)
কাঁপা
কাঁপা)
না
আমি জেনেছি
এই
স্বপ্নমধ্যে অনুষ্ঠিত জাগা
একটি
দুটি তারা ঝরছে এরকম দিনে
তখন
এটা খণ্ডিত পছন্দের ভস্মচিহ্নে চেপে
তোমার
আকৃতি নিয়ে
একটু
একটু হাসি ছড়াতে ছড়াতে
বহু
তীব্র শীর্ষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
এক
ধরনের ভালো ও ভেঙ্গে পড়া জ্যান্ত (শূন্যতা নয়)
আকাশ
ভেদ ক’রে
প্রলেপের
ওপর নেমে আসছি
আমি
শাদা
ছায়া এবং উপরে
নতুন
ঝিল্লীগ্রাণ
অনুলিখন
আধপোড়া
সিগারের খণ্ডটি দূরে ছুঁড়ে দিয়ে
বুড়ো
ভাবলেন শোধ হ’লো
তারপর
গিয়ে ঐ গোল বাড়িটার মধ্যে
উঠানের
নিচের সিঁড়িতে
কাত
হ’য়ে বসলো
তাঁর মায়া
এবার
ফুৎকারের লোভে
কিন্তু
আজ প্রতিবিম্ব বেয়ে ওঠা, মেঘের ফ্রীলের মতো কাজ করা, হরিণাভ, পাটল
মাড়ির কোপ্তা ঘন হ’য়ে এদেহ,গ্রন্থিল
কষ, অভিলাষ, ভেদবমি, দেহতাপ, টাংস্টেন
ফ্ল্যাডের শুভ,
গভীর
গমনকালীনতা লেগে ধাত্র, ভয় লাগে, কী রকম
উঁচু মন চারদিকে,
ভাঙা
মই,
দশদিকে, প্রেম
থেকে ওড়া মাছি,
ক্যানো
বুড়ো
দেখলেন সার করা শাদা বাটখারা মেঝে থেকে
প্রতিটি
ছাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে টন টন তুলা
আর
দশলক্ষ সূর্যকুচি ভরা সিগারের
বলকানো
পেঁজা
নীল
স্ট্র্যাপ (দূরে)
ফিকে
বাতাসের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়ায়
সংক্রামক
গাঢ়
স্বুচ্ছ
ফিলামেন্ট
দ্যাখা
যায় এরা নয়
বৃক্ষ
বৃক্ষা এইসব
তবে
আমি
শিখতে জানি না পুড়ে হওয়া
নুন
জল
ছুঁয়ে ছিলো দেহ
অধিকৃত
শরীরের কায়া
আমার
অদৃষ্ট আমি হারিয়েছি আর
আমার
অদৃষ্ট আমি হারিয়ে ফেলেছি
শুধু
আর তোমার আঙ্গুল
হেঁটে
বেড়ায় আমার থ্যাঁতলানো গরম চাঁদিতে
আর
আর
আর
মাটি
সমোদরা
জেনে মাতা
তোমার
যৌবন
ছুঁয়ে
যাই
দেহ
পেয়ে গাইবার জন্য গান
১
সারাক্ষণ
হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে
যেতে গান গাবো
তাই
সারাক্ষণ
হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে
হবে গান গেতে গেতে
নানা
রঙের উদগ্র আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান
আহা
পথনিদ্রা উৎযাপন
তোরই
টান...
টানের
বিপুল বাঁধা উথলানো চরণেরা যান
যানেদের
পুত্র যান আর
তার
দিকে যে উড়ূক্কু সিঁড়িটাকে আলগোছে পান
ক’রেছি এবং
ভুলে গেছি
তাতে
গোলা গহ্বর ছিলো আমাদের
উষ্ণতম
কিউবিক
ঝালার
পালায়
হায়
যদি
মৃত্যু নির্মাতার ঘরে টিক দিয়ে ছুঁড়ে দিই
অ্যাস্ট্রোলোবানের
আঁকে বাঁকে স্তর ক’রে
...........উঠে
গ্যালো টানা পুল
...........ভেসে
গ্যালো বাঁশের দোকান
............তখন সেই
উৎবিদিত ফাঁকাটায় ঝুলে
মা
আমার
যে রকম লাগে চক্রাকারে
সে
রকম মুর্ছা
সিঁড়ি
হারিয়ে আর কে কোথায় পেয়েছিলো
কবে
২.
সারাক্ষণ
হাতে চাই গানের বাকশো খান
কাঁখে
বাকশো আর আকণ্ঠ পান
কখনও
আবার
কাঁদে
বালিহাঁস
কাঁদে
উঁচু চিল
কাঁদে
মধ্যবর্তিনীরা আর সবুজ ফাঙ্গাস
আমি
জানিনা আমি কী খুঁজি
আমি
ক্যানো যে কাঁদি না
সেনোটাফ
ঞ্জানী
কবরের স্কন্ধে চ’রে ফিরে এখানে এলাম
ছোটো
ছোটো অট্টহাস্য মাখা ধুলা ঘাস ও বাতাস
এখানের
এই নাম অন্যপুর নিহিত রেখেছে
ধাবন্ত
আগুনে ছাওয়া এ যে সেই খাঁ খাঁ পারগেটরি
(তন্ত্র)
এই
কি সাধনা নয়
যে
চিত্ত
হবেনা ক্ষয়
লুপ্ত
মেধের এই সব ঐ গুপ্ত ঔসময়
এবারেও
যদি হেরে যাই গুরু
সে
তোমার দোষে জেনো
এক
পাঠ কাল জনৈক প্রাতে
মৃত্যু
আমার চিবিয়ে খেয়েছো
ঔরসময়
গৃহী সুহৃদেরা দেখেও দেখেছে শুধু
সেই
থেকে আমি মৃদু হ’য়ে গেছি মৃদু
যে
যাই বলুক
ঘাস
কেটে অমি এই সময়ের
শ্রেষ্ঠ
টিকাটি নেবো
অফুরান
হাতে কচি কাঁচা স্বাদু
ঘেসো
প্রান্তর খেয়ে ক্রমে চ’লে যায়.....
এভাবেই
চ’লে চ’লেছে
ঔরসময়
মহৌষধের দিকে
আমার
গোপন প্রাণ গভীরে গিয়েছে না কি
তলিয়ে
গিয়েছে বলে দু:খ হয়
তবু
উচ্চমূল্য
পরিহিত কর্মকারী ও তাহার
আকরবিহীন
সুতা উহ্য হ’য়ে থাক
এসময়
ভাবিতেছি
যেতে যেতে ভিক্ষাক্ষেত উবে গ্যালো কিনা
ভোরটেক্স
আমার
অশান্ত আত্মা
ঐযে......
.........কী
.........ধুলিঝড়
ধুলিঝড়
ধুলিঝড়ে সাজানো গোছানো
ধুলিঝড়
ধুলিঝড়ের ভিতরে ও বাঁকএ
ধুলিঝড়
ধুলিঝড়ের মাজায় প্যাঁচানো
ধুলিঝড়
ধুলিঝড়ের বোঁটায় উদ্যত
আমার
অশান্ত আত্মা
আর
ধুলিঝড়ের শরীর থেকে খ’সে পড়ে যাওয়া
ধুলায়
ধুলায়
সে
থাকে তখনো জলে প্রতিসৃত নানা তৃষ্ণা রং
আমিতো
উন্মাদ মাত্র
আর
বাদবাকী শখের গোসল
১৯
এপ্রিল বারবার
আর
একবার ঘুরে পেছনে তাকাবো
কি
তাকাবো না
ভেবে
সমস্ত
ভাঙ্গা টুকরো গুছিয়ে কুড়িয়ে আবার
আমাকে
জোড়া লাগালাম
কিন্তু
হাত কই
তোমার
বিপুল গড়নের মধ্যে
কোনোখানে
এক
টুকরো জটিল উল্লাস আছে
তার
স্পর্শে বদলে যায় প্রভাতের ঘ্রাণ
আর
আমি
ভয়ে
ভয়ে
মানুষ
হ’য়ে
উঠে
দাঁড়াই
কিন্তু
পা কোথায়
হা
হরতন হো ক্যুইট
জগত
বিশাল এক পটভ‚মিকায় ঠেস
ক’রে
অচেনা
হেলান পেতে শুয়ে আছো
এই
নিরুদ্বেগ স্বকালের মোহে
আর
স্বয়ম্ভু গতির আঁশ বুনে বুনে
ঝিমুনরি
তালে
আ
আ আমার রেশম ক্ষুধা
এটা
খাবো
ওটা
খাবো
সেটা
খাবো
সব
খাবো
তুমি
শ্বেতরোগী
সেবিকা
মা
বুক
দিয়ে মুখ ধুয়ে দাও
জানালায়
কাটা রাইফেল
এই
পথে একদিন চিঠি এসেছিলো
একটা
ভারি ঢিল আর পিঠ ভর্তি স্বচ্ছ কথা নিয়ে
একটা
সরল সোজা ব্যারেলের উষ্ণ গহ্বর নিয়ে
এ
অবধি
ঐ
পার
লম্বা
খাড়া দুই রণপার মাঝে
পড়ে
আছে ঘ্রাণ খোয়ানো খোসা তার
ঘরের
যে কাঠ গর্জায় শুনি
তরঙ্গহীন
ইশারার ধ্বনি
বাটখারা
পেশা হতাশার গান
অদৃশ্যপাতে
হবে খান খান
দেহপাতানোর
গল্পের কোনাকুনি
আঙ্গুলের
মতো
তুলোট
কিন্তু নয়
টেবিল
হারানো যুবা
বারেক
সামনে চেয়েছিলো ঝাপটানো পাল্লা
ক্যানো...........
তোমরা
জানো নি
শীত
পোড়াবার জন্য সে বর্গক্ষেত্র ধার করে
হ’য়ে যায়
তিন কোণা তাঁত
তাতে
বাকশের বাহির থেকে চেয়ে থাকা চোখ
ছাপা
হয়
আরেকটি
জানালা
আরও
অন্যজন আছে শরীর নিয়ে
ঐ
ঐ আকারের
নাম
রোগতাড়ূয়া
তিন
চার তাক ভরা...
যা
যা ভালো লেগেছিলো
মাঠে
মঞ্চে
আর
মহামিলনের
হেন হেন প্রজাতি বা প্রাশনের বহু ফুর্তি
সার
ক’রে রাখা
আছে আছে
একদিন
এক বসন্তের ভয় দৃশ্য করা কাঁচ
সেই
বিনিময় বইতে বইতে ভারি আর
খাটো
হ’তে আছে
বাঁচাপূর্ব
কালের এক লোভে
আর
বা¯Íবিক জেনে
হীন উদস্থিতি মান
২.
শার্সিতে
অর্ধেক কাঁধ সারারাত ঝুলে থাকে
আর
পর্দার ঐপারে লুকানো ছেলেটির
অদৃশ্য
দু পায়
আমি
ছোটো ছোটো কাগজের বল ছুঁড়ে মারছি
ও
যখন টু উ উ দেবে
বাতাস
চাখতে চাখতে এগিয়ে আসবে আরেকজন
যার
ওকে খুঁজে বার ক’রবার কথা
মাঝরাতে
জানালায় কী দেখিতেছিলা
ধনেশ
পাখি
৩.
খেলতে
খেলতে
ধুলা
হ’য়ে গ্যালো
আমাদের
খোলা
এক
রকমের দুটি
ক
১
শতরঙ্গে
ঝালপালা এক গোলকের কেন্দ্র থেকে
গোপনে
বেরিয়ে আসা বিন্দু
তার
অজানা উত্তাপ ছেড়ে ছেড়ে
ঘাসগুলোকে
অবাক ও পলকে আহত ক’রে
বক্রল
মিহিন এক রশ্মিমুণ্ডে চেপে
যেতে
যেতে
যেতে
আছে
সে
জানে দৈর্ঘ্য প্রস্থ বলে কিছু নেই
তবে
তাকে থেকে যেতে হবে
আর
কেন্দ্র হারা গোলক কিছু বুঝবার আগেই
ভিতরের
ফাঁপা চাপে ফেটে
ভিন্ন
ভিন্ন হ’য়ে ছড়িয়ে
পড়লো বিশাল
এক
আত্মকামী শূন্যের ভেতর
শূন্যটি
বিশাল আর আত্মকামী
এবং
চোখা শীর্ষ অলা ঘাসের
একটা
সরু পোড়া লাইন শুধু
এখনও
র’য়ে আছে
তার মধ্যে ভেসে
একটা
কিছু ঘটনার অপেক্ষায়
অথচ
বিন্দুটি জানে না আসলে সে অস্থির
ক২
অনিবার্য
উচ্চতারা আকাশ অবধি
লম্বা
সরু হয়ে একা একা উঠে যেতে আছে
গোড়ালিতে
সুঁই ও রসের দাগ
আর
অবাধ উর্বর কুয়াশা ভেদী মধ্যমার পরে
আর
আমরা কিছু দেখিনি
আমরা
কে কে যে
কজন
বা কতো
ভুলে
হ’য়ে গেছি
আমাদের মতো
ওরা
যাবে আকাশ অবধি
তবে
আমরা তো জানিই যে আকাশটা কতোখানি উঁচু
আর
উচ্চতাগুলি অনিবার্য এবং সরু সরু
আর
পাতাল থেকে ওঠা তাদের ভিত
নিশ্চয়ই
খাঁটি
কারণ
অনেক পুরনো কিছু পাতালের ছাপচিত্রে
অবাক
করা শাক্তমুদ্রা আমাদের বহু দ্যাখা
বহু
পুনর্জন্ম ধ’রে
আর
এইসব ভিতের পাশে শুয়ে বসে
দাঁড়িয়ে
আমাদের অপেক্ষা
অনিবার্য
উচ্চতারা আকাশ অবধি
লম্বা
সরু হ’য়ে একা
একা উঠে যেতে আছে
এবং
যদিও কুয়াশা
তবে
আমরা তো জানিই যে আকাশটা কতো উঁচু
হ’তে পারে
আর
একদিন পাখা কুড়ানোর জন্য
কী
বিশাল একটা ছাদ আমরা পাবো
খোলা
স্বপ্ন
যা
মনে হয় তা মনে করার জন্য যা লাগে
তা
এক অপার উজ্জ্বল উপত্যকা
ওই
সেখানে চ’রে বেড়ায়
ভাঁজে ভাঁজে
তোমার
গন্ধলোলুপ সন্তান
খেয়ে
খেয়ে কর্কশ রুগ্ন
পাথর
ও
প্রকৃতি
আজ
দেখলাম মেঘমন্দ্র উচ্ছ্বলতার দাগ
এবং
বাহান্ন জন প্রপিতামাতার
সেইসব
চেহারা
আমি
আজ
আর
দেখলাম সেই
আজ
পুত্র শোকে ছেয়ে যাক আকাশ
আকাশ
থেকে ঘেমে আসুক
বাতাসের
গর্তে গর্তে ভরা গর্বে
এবং
পাতালের থেকে ওঠা থাক থাক ঈশ্বরলীলার দেহময়
গোপনে
প্রবিষ্ট হও এর প্রাচীনতা
ওঁ
মোজেইক ধাম
ও
পাথরের শিখা
তুমি
আর জ্বালতে জ্বালতে জ্বালতে
পারো
না
হায়
আমি
এ
ই
ভা
বে
ই
কি
ভেসে ভেসে থাকবো প্রান্তরে
তোমার
ঘর আমাকে নিয়েই ছোটে
আর
তার গা’য় মেঘ
জ’মে
জ’মে
জ’মে
ঝাপসা
হ’য়েছে রং
মেঘ
প্রান্তরে শিশুমেষ চমকায়
পুলকে
আলোকে
ঝলকে
উড়ে
থাকো আবহ কাঁকাল
উড়ে
থেকো
থৈ
থৈ
ভেসে
যেতে যেতে যেতে যেতে
শোকএ
এসে ঠেকলো স্কন্ধহীন পায়া
বদ্ধ
শোকে
চারবার
তারপর
তখন
আসলে আর কিছুই ছিলো না
কৃতজ্ঞতা:
শামীম কবীর সমগ্র
নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর
ভালো লিখেছো, নভেরা। কবিতাগুলি আবারও ভালো লাগল। বারংবারই লাগে।
উত্তরমুছুনThanks a lot Dolon....
মুছুন