সুফী ও শূন্য
“এই বেলা তোর মনের মানুষ চিনে সাধন কর / মানুষ পলাইবে
দেহ ছেড়ে পড়ে রবে শুধু ঘর / ঘরের মধ্যে তোর তিন তের আর / কোন দরজা করেছ
সার / ঘরের মধ্যে
বাস্ত খুঁটি / সেইটা কর গে
মূলাধার / ডুবে থাক গে
রূপসাগরে / বসত কর গে জুতোর
ঘরে / লালন বলে, মনের মানুষ; / চিনা হলো ভার”- এখন এই ‘মনের মানুষ’টি কে? এ কি কেবল ঈশ্বর বা আল্লা নামের চিদচিৎকার? নাকি ক্রমাগত পরিধির দিকে যেতে যেতে একটা ফেরাকে ভালোবাসা দিয়ে
পাওয়া! দার্শনিক শূন্যবাদ
বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু নয়, সেই বেদ থেকেই শূন্যতার আদি ভাবধারার একটি ধারণা পাওয়া যায়। ঋকবেদেই তো বলছে –
....“নাসদাসীন্নো
সদাসিত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য
শর্ময়ংভঃ কিমাসীদগহনং গভীরং..."
অর্থাৎ আদিতে সৃষ্টির সৎ বা অসৎ রূপ বা অরূপ বলে কোনো পৃথক আধার ছিল না, এমনকি অস্তিত্ববিহীন গভীর অন্ধকারের কোনও আবরণও ছিল না। অর্থাৎ চেতনা বলতে সেখানে মুহূর্তের এক ধরনের ফাঁকা যার মাঝে অভাবও নেই স্বভাবও নেই। কেবল পরাবাক এক স্তরের কথা উপনিষদেও বলা
হচ্ছে। ইতি ভাবকে অতিক্রম
করতে বলা হচ্ছে- “প্রেত্য, ন প্রেত্য সংজ্ঞা অস্তি” অর্থাৎ চেতনাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে যে শূন্য
যার কোনো সংজ্ঞা নেই। এই শূন্য সেই বিন্দুবোধ যেখানে চৈতন্য ও আনন্দ একই তত্ত্ব, দুই সেখানে নিস্তরঙ্গ আবার তরঙ্গায়িত। শূন্যের মধ্যেই স্বরূপ
আর স্বরূপের মধ্যেই তো সহজের অবস্থান। কেবল
বৈদিক সাহিত্য নয়, বৌদ্ধসাহিত্যেও
আমরা দেখতে পাই কীভাবে একের পর এক ধ্যানভূমি
ছেড়ে রূপ অরূপ খসিয়ে বুদ্ধ হয়ে উঠছে- ‘নৈব সংজ্ঞা নৈব অসংজ্ঞা’। আবার বৌদ্ধ ও
জৈন ধর্মের পরবর্তী যুগের দোঁহাকোষ সাধন ভজন বা চর্যাপদেও আমরা দার্শনিক শূন্যের নিদির্ষ্ট
সংজ্ঞা পাই। কৃষ্ণাচার্যের দোঁহাতে মহাসুখের ভেতর চারটে
পদ্ম ও চারটে পত্র আছে, আর ঐ চারটে পদ্মের মৃণাল
শূন্য, অতিশূন্য, মহাশূন্য এবং সর্বশূন্য এই চার রকমের শূন্যতার বাহক।
পরবর্তীকালের বৈষ্ণব সাহিত্য বা নাথসাহিত্যেও শূন্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নিজকীয়া
সাধনা। হাজার হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে এভাবেই মরমীয়াবাদি
বা অতীন্দ্রিয়বাদিদের শূন্যমন্ডলকে
ঘিরে এই যে এক তরঙ্গায়িত আনন্দ, মূল প্রকৃতি থেকে বুদ্ধি অহংকার থেকে রূপ রস গন্ধ থেকে
মুক্ত হবার জন্য এই যে শূন্যযোগ, তা আমরা
পরবর্তীকালে সুফী তত্ত্বের ভেতরও আস্বাদন করতে পারি। অন্নময় স্থূল শরীরের বাইরে শূন্যময়
স্থিতির সপক্ষে তাদের বলতে শুনি- “শূন্য ভরে একটি কমল আছে কি সুন্দর / নাই তার জলে গোড়া, আকাশ জোড়ে সমানভাবে নিরন্তর”। সুফীদের মতে “অসীম অনন্ত ও অব্যক্ত এক শক্তি হতে অনুলোম
গতিতে সূক্ষ্ম হতে স্থূলরূপে সৃষ্টির প্রকাশ, তদ্রুপ আবার বিলোম গতিতে স্থূল হতে সূক্ষ্ম
বা শূন্যে পরিণতিমুক্তি” -
নিতাই, জালাল চাঁদ, মনসুর, শিতালং শাহ, মোকসেদ আলী সাঁই থেকে শুরু করে পরান ফকির, কাঙাল হরিনাথ, জামাল শাহ, দ্দুদ্দু শাহ, ফুলবাসউদ্দীন, করিম শাহ, খোদা বকশ শাহ কিংবা ভবা পাগলা – বাংলার জনপদ এভাবেই সমৃদ্ধ হয়েছে সুফী মুরশিদ ও মরমীয়া সাহিত্য
সংগীতে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সুফী মতবাদে মুসলিম ভাবধারার সাথে
একে একে বৈদিক বৌদ্ধিক গূহ্যতন্ত্র সহজিয়া বা বৈষ্ণব ভাবধারার সংযোগ সাধিত হয়ে তার
মাঝে একদিকে দর্শন ও অন্যদিকে মরমীয়াবাদের সৃষ্টি হয়। দর্শন জানতে চাইল
জগতের অনিত্যতা আর স্বরূপের সংজ্ঞা, যেখানে মরমীয়াবাদ সেই সন্ধানী পথটুকুতেই প্রবেশাধিকারের উপায় বাতলাতে সচেষ্ট হলো। অথচ বাউল বা সুফির মতো লোকায়ত দর্শনের
কোনো শাস্ত্রগ্রন্থ নেই, কারণ স্বরূপের সন্ধানে সুফীপন্থীদের স্থির
সাধনার কোনো অর্থ নেই, বরং ঈশ্বরের দিকে
এক ধরনের পর্যটনই সুফীর তারিকাৎ বা মরমিয়া মার্গ। এ যেন জেন অনুশীলনের সাতোরি প্রাপ্তির মতো, জেনে যেমন কোয়ান বা একাধিক আত্মপলোব্ধির মধ্যে দিয়ে আকস্মিক শূন্যে পৌঁছোনকেই উত্তরণ মনে করা হচ্ছে, তেমনি সুফীমতবাদেও পর্যটনটাই সারাৎসার, পথ চলতে চলতে হঠাৎই পরম বিচ্ছেদে পৌঁছোনো। আর এই নির্মেদ শূন্যে পৌঁছতে ঈশ্বর ও মানুষের
মাঝে নাকি বিকার ও বোধাবোধের সাত হাজার পর্দা বিছানো; শূন্যকে নিবিড় করতে
অনন্তকাল ধরেই জন্ম থেকে মৃত্যু মানুষ যেন এই পর্দা সরিয়ে সরিয়ে আপন প্রতিচ্ছবি
বর্জন করতে করতে কখনও আলো থেকে অন্ধকারে তো কখনও অন্ধকার থেকে আলোর দিকে
প্রত্যাগমন করছে। আর এই পর্যটনের গূঢ়তত্ত্বে সম্প্রদায়ের
সাধন ভজন আচারই সুফীকে তার সাঁইদয়ালের উন্মার্গগামী করে তোলে। সুফীতত্ত্বের মূলে যে আল্লাহর প্রতি প্রীতিজাত
বৈরাগ্য এবং যে বৈরাগ্যের আটটি গুণ হিসেবে জুনেইদ বলেন- ইব্রাহীমের মতো ত্যাগ, ইসমাইলের মতো আনুগত্য, আয়ুবের মতো ধৈর্য, জ্যাকারিয়ার মতো বাকসংযম, জনের মতো আত্মপীড়ন, ঈসার মতো ভোগবিমুখতা, মুসার মতো পশমী পরিধেয় গ্রহণ এবং হযরত
মহম্মদের মতো দারিদ্র্য বরণ। অর্থাৎ প্রাথমিক স্তর থেকেই
সুফীমতে ছিল এক ধরনের
প্রবৃত্তির বর্জন এবং জীবাত্মার প্রসুপ্তি ভঙ্গ করে ক্রমাগত শূন্যের রহস্য সাধনা।
আজ যখন ‘মনের মানুষের’ সন্ধানে লালনকে আমরা বলতে শুনি, ঈশ্বর ‘অধর মানুষ’ এবং তাকে আবিষ্কার
করতে হলে কেবল মাত্র যোজন যোজন মহাশূন্যের শ্রুতি, যেখানে দাঁড়িয়ে কেবল বলা যেতে পারে –
“আমি আর সে অচিন
একজন
এ জগতে থাকি দুজন
ফাঁক দেখি লক্ষ যোজন
গেলে ধরিতে”-
তা কিন্তু ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের উচ্চারণের উত্তরাধিকারীই
বহন করে। কারণ বাউল মরমীবাদে রসুল নবী বা আল্লাহের যে উল্লেখ, তা কিছুটা হলেও সুফীপ্রভাবেরই প্রতিফলন। যে খাঁচা ভেঙে অচিন পাখির হদিশে অতীন্দ্রিয়
অভ্যেসেকে তাদের মার্গসাধন করে তুলেছেন বাউলেরা, সেই খাঁচা-ভাঙার পরিভাষা অনেক আগেই সুফীতে অনূদিত হয়েছে ফানা
বা অহংবোধের বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্যেই। সনাতনী ইসলামের অনুমোদিত
ক্রিয়াবাদের বাইরে সুফীদর্শন নিষ্ক্রিয়াবাদের কথা বলেছে। বলেছে
বৈরাগ্যের কথা। দেহতত্ত্বের কথা
বলতে বলতে বারবার সে উঠে গেছে দেহ ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয়ের দিকে; শূন্যই হয়ে উঠেছে তার সাধনা; যেমন কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের লেখায় আমরা
পাচ্ছি- “এই মানব জীবন
ভাই / এই আছে আর – এই নাই / যেমন পদ্মপাত্রে জল টলে সদাই / তেমনি দেখিতে
দেখিতে নাই / আজ গেল আমার / পরে যাবে কেহ / অনিত্য এই
মানবদেহ / তবে কেন অহংকারে বল মত্ত সদাই”-। শব্দ স্পর্শ রূপ
রস গন্ধ থেকে বিষয় থেকে উঠে আসছে এক ধরনের প্রত্যাখান; বিত্ত অন্তের শেষে এভাবেই সুফী মরমীয়াবাদ খুঁজেছে
তার সত্য আশ্রয়, আত্মার চরমোৎকর্ষতা
হিসেবে স্বীকার করেছে শূন্যের নিত্যতা। দেহ যে কেবল দেহসর্বস্ব নয়, তা যে আত্মার সম্পদ, সে কথাই বারবার সুফীপ্রন্থীদের নিত্য দোহার হয়ে উঠেছে। জড়কে যে
প্রথম থেকেই ভিড়ে একলা করে ফেলতে হবে, সুফীর এই মনস্তত্ত্বের ঠিকানা পেতে গবেষক রমা চৌধুরীর
সুফী দর্শন ও বেদান্ত বিষয়ক আলেখ্যের সুফী মনস্তত্ত্বে সরাসরি আমরা প্রবেশ করতে
পারি। –“সুফীমতে, মানব জড়দেহন্দ্রিয় ও অজড় আত্মার সমাহার। মানবই সৃষ্টির চরমোৎকর্ষ... মানবই ঈশ্বর স্বরূপের পূর্ণ অভিব্যক্তি, কিন্তু জগত ঈশ্বরের আংশিক অভিব্যক্তি মাত্র। অতএব আংশিক প্রতিচ্ছবি জগৎও পূর্ণ প্রতিচ্ছবি মানবের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ
মানবরূপ ক্ষুদ্র জগতে(microcosm) বিশ্বব্রহ্মান্ডরূপ
বৃহৎ জগৎ(macrocosm) প্রতিফলিত হইয়া আছে...। প্রথমটিকে ‘আজ্ঞাকৃত জগৎ'(আলাম-ই আমর) এবং দ্বিতীয়টিকে 'সৃষ্টিকৃত জগৎ' (আলাম ই খাল্ক) নামে অভিহিত করা হয়, কারণ প্রথমটি
ঈশ্বরের আজ্ঞা “সৃষ্ট হও” হইতে এক নিমেষে সম্ভূত, কিন্তু দ্বিতীয়টি পূর্ব্ববর্ত্তী আদিভূত হইতে
ক্রমান্বে সৃষ্ট...। জড় জগৎ হইতে সে অগ্নি, জল, বায়ু, পৃথিবী এবং জড় আত্মা(নাফস) প্রাপ্ত হইয়াছে। অগ্নি প্রভৃতি চতুর্ভূত তাহার জড়দেহের উপাদান কারণ। জড় দেহ ও
জড় আত্মার সমাহারই মানবের পার্থিব স্বরূপ। অজড় জগৎ
হইতে সে হৃদয়( কালব), আত্মা(রুহ), প্রগাঢ় আধ্যাত্মিক
জ্ঞানশক্তি(সির), গভীরতর উপলব্ধি শক্তি (খাফী) এবং গভীরতম অনুভূতিশক্তি (আখফা) প্রাপ্ত হইয়াছে।
ইহাই মানবের আধ্যাত্মিক স্বরূপ। ...এই দশবিধ উপাদানে গঠিত মানুষ পৃথিবীর হইয়াও
পৃথিবীর উপরে। অতএব পার্থিব
স্বরূপকে বশীভূত করিয়া আধ্যাত্মিক স্বরূপের যথাযথ উন্নতিই মানবের প্রধান কর্তব্য"। -এই নাফসকে বশীভূত করে নাদ-এ পৌঁছনোই সুফীর স্বরূপমন্ত্র। সেখানে পূর্ব থেকে অপূর্বে গমন, দেহ নির্মাণের উপাদানগুলো থেকেই দেহকে
অনির্মাণের কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত করা। আর
এই বস্তুজগতের বিবিধ থেকে গাঢ়তম ব্রাত্যে যেতে সুফীদের স্বেচ্ছাকৃত বৈরাগ্যই
শূন্যের ধারণাতে সত্ত্বাকে ধার্ণ করার পক্ষে জোরদার সওয়াল করে। সত্ত্বা
ও শূন্যের মাঝে ওই যে সাত হাজার পর্দা তা পেরোতে সমাধি, মিলন, আত্মজ্ঞান, বৈরাগ্য বা
অতীন্দ্রিয়তার মতো কিছু অভাবের দৃশ্যই হয়ে ওঠে সুফীপন্থীদের আত্মান্বেষণ। আত্মাতত্ত্ব সন্ধানে যখন মরমীয়া কবি বলে ওঠেন- “আতমার এ চারি নাম এ চারি প্রকার / রুহু ‘নাথকী’ বৈসে মনুষ্য শরীরে / রুহু ‘হামি’ পাইল যথেক জানোয়ার / ‘জির্মি’ নামে রুহু বকশিয়াছে ধরান্তরে / ‘ছঙ্গ’ নামে রুহু দিয়াছে পাথরেরে / শরীরে আতমা বৈসে ব্যাপিত মন / বধির সহিতে যেন রহিয়াছে কান / দুগ্ধের মধ্যেত যেন ব্যাপিত লনী / শরীর আতমা মধ্যে এতিন বাখানি / ......শরীর বিলাত আত্মা
তার রাজা / আর যথ বৈসে জান
তারা সব প্রজা”- তখন স্বরূপোলব্ধিতে
সুফীদের সাধনমার্গ বা সোপান বা মোকামগুলির স্বাভাবিক পার্থিব থেকে শরীর থেকে
শূন্যের দিকে হাতড়ে বেড়ানো আঁচড়গুলোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মুহম্মদ
মনসুরউদ্দীনের ‘হারামনি’র মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন লেখেন- “আমার অনেক গানে
অন্য রাগরাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে”, তেমনি বাউল ভাবগানেও অস্পষ্ট জন্মসূত্রের মতো লেগে রয়েছে সুফীদর্শন সঞ্জাত একটি
সত্তা। কিন্তু সুফীর মারফতির সাথে বাউলের
মরমীয়াতে মানুষ ও ঈশ্বর তত্ত্বের মধ্য দিয়ে শূন্যকে সংজ্ঞায়িত করার যে সাদৃশ্যতা, সেই সাদৃশ্যতা
বহুবিধ উৎস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে; বাংলাদেশের সুফীরা হিন্দু যোগ, বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া বা বৌদ্ধমরমির পাশাপাশি
ইসলামিক অতীন্দ্রিয়বাদ ও নাথপন্থীদের শূন্যদর্শনের সান্নিধ্যে
আসে। বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে দেখলে অধিকাংশ সুফীর মতেই সুফী শব্দটি আরবী ‘সফা’ হতে উৎপন্ন। ‘সফা’ অর্থে পবিত্রতা
অর্থাৎ যিনি স্বয়ং এবং ঈশ্বরের প্রতি অকপটভাবে শুদ্ধ সাধু ও সত্যের পিয়াসী।
পাশাপাশি গ্রীক sophisma বা জ্ঞান শব্দের
সাথেও অনেকে সুফীর সংমিশ্রণ ও সম্বন্বয়ের কথা বলেন। কিন্তু
অধিকাংশ তাত্ত্বিকের মতে আরবী ‘তসাউওফ” বা মূল বিশেষ্য ‘সুফ’ শব্দ হতে সুফীর উদ্ভব। ‘সুফ’ অর্থ পশম আর যে সব সমুদায় লোক ইসলামের প্রাথমিক যুগে
পশমের জামা পরে সংসার হতে একেবারে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করতেন তাঁহারাই ‘সুফী’ নামে পরিচিত হতেন। আবদুল করিমও প্রায় একই মত
ব্যক্ত করে লেখেন- “তসাউওফ বা সুফী
শব্দটি আরবী সুফ শব্দ থেকে উদ্ভুত। ‘সুফ’ শব্দের অর্থ হলো উল বা পশম এবং প্রাথমিক যুগের
ধর্মতাত্ত্বিকেরা পশমী বস্ত্র পরিধান করে সাধনা করতেন বলে তাঁদেরকে সুফী বলা হতো। পন্ডিতরা সুফী শব্দের মূল বের করতে গিয়ে আরও
কয়েকটা শব্দের অবতারনা করেছেন, যেমন কেউ কেউ বলছেন যে, ‘আহল-উস-সুফকা’ অর্থাৎ হযরত মহম্মদের সময়ে যাঁরা মসজিদের
মেঝেতে বসে সাধনা করতেন, তাঁদের থেকেই সুফী শব্দের উৎপত্তি। আবার
কারও মতে ‘সফ-ই- আউয়াল’ অর্থাৎ যারা সামনের সারিতে সালাত আদায় করতেন, তাঁদের থেকেই সুফী শব্দের উৎপত্তি। আবার সুফী শব্দের উদ্ভব
সম্পর্কে ভিন্নমত হচ্ছে- মদিনায় ইসলাম প্রচারের
প্রাথমিক যুগে মদিনার মসজিদ সংলগ্ন নির্জন স্থানে অবস্থানরত সংসার নির্লিপ্ত
আল্লাহ প্রেমিক একদল লোক ‘আলহুস সাফফা’ নামে পরিচিত হন; এদেরই উপর আরোপিত এই সাফফা শব্দ থেকে সুফি
শব্দের উদ্ভব বলে ধরা হয়"। -কিন্তু সুফী
উদ্ভবের কারণ হিসেবে যে মতই দর্শানো হোক, সুফী শব্দের মধ্যে এবং সুফীর রূপ স্বরূপ সৃষ্টি
পুষ্টির মাঝেই যেন বিদম্যান এক ধরনের নিস্পৃহতা, উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা এবং জাগতিক বৈরাগ্য। ঈশ্বরের সাথে মানুষের সেখানে বাধাহীন মিলন।
ইসলামি সুফীবাদের মোনাজাত বা প্রার্থনায় প্রেমই মূল বিষয়। কিন্তু এই প্রেম কার
সাথে! কেবল বাহ্যিক
কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টিমাত্র নয় সুফীবাদ; হজরতের সময় থেকেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের
প্রেমে আত্মার সংযোগ খুঁজেছিলেন ইসলামী মরমীয়াবাদীরা। তাই ইসলামের সময় থেকে শুরু করে
আধুনিক সুফীবাদে সচেতনভাবে মনকে প্রাণে লয়
করে শূন্যসারে পৌঁছে যাবার মানসঅঞ্চল বিদ্যমান। যেমন আলি রজা ওরফে ওয়াহেদ কানু ফকির যিনি
কিনা চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানা এলাকার ওশখাইন গাঁয়ের সাধক তাত্ত্বিক কবি ও পীর
হিসবে প্রখ্যাত ছিলেন, তাঁর ‘জ্ঞানসাগর’ গ্রন্থে লিখেছেন-
“সংসারে ফকির
শূন্য জপে শূন্য নাম
শূন্য হস্তে ফকিরের সিদ্ধি সর্ব কাম
নাম শূন্য কাম শূন্য শূন্য যার স্থিতি
সে শূন্যের সঙ্গে করে ফকির পিরীতি
শূন্যেত পরম হংস তথা যোগ ধ্যান
যে জানে হংসের তত্ত্ব সেই সার যোগী
সেই সব শুদ্ধ যোগী হএ শূন্য ভোগী
সিদ্ধা এক শূন্য এক এই সে যুগল
যে সবে এই তত্ত্ব পালে সে তনু নির্মল"।-
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আলি রজার এই পদাবলীতে উর্ধ্বস্রোতা হয়ে রয়েছে বৌদ্ধশূন্যতত্ত্ব। বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ে শূন্যতা নিয়ে ভেদ রয়েছে। ‘পুদগল শূন্যতা’ আর ‘ধর্ম শূন্যতা'- শূন্যতা সেখানে দু' প্রকারের। ‘পুদগল’ মানে আমিত্ব আমার জীবত্ব, সেখানে আমার ভেতরে সব শূন্য। মূলত হীনযানীরা এই ‘পুদগল শূন্যতা’ বিশ্বাসী ছিলেন এবং যেহেতু আমি শূন্য হলেও আমার ভেতর
আমাকে নিয়ে যে জগত যে ইষ্ট সে পূর্ণ, তাই হীনযানীরা সমাহিত হওয়ার কথা বলতেন অর্থাৎ শূন্যের মাঝে একটা জগৎ ভাসছে এবং
যে মুহূর্তে তুমি সমাধিস্থ হচ্ছো সে মুহূর্তে তুমি শূন্য। কিন্তু মহাযানীরা এই নির্মাণাকার শূন্য থেকে
বেরিয়ে পরিপূর্ণ শূন্যতার প্রসঙ্গ তোলেন। সেখানে আমিও নেই
জগৎও নেই আমিও শূন্য জগৎও শূন্য বিষয়ও শূন্য বিষয়ীও শূন্য। মহাযান বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্রে বারবার যে ‘অবাকশাখ’ বা ‘ঊর্ধ্বমূল’ বৃক্ষের বর্ণনা এসেছে, তা তো দেহবৃক্ষ আবার তাই বোধিবৃক্ষ। গাছটির
মূল তার ওপরের দিকে আর শাখাপ্রশাখা নিচের দিকে। ওপরের দিকের
বিস্তার চৈতন্যের আর নিচের দিকের বিস্তার জড়ের এবং দু'দিকের শাখাপ্রশাখা ও মূলের চিত্রন একে ওপরের
প্রতিবিম্ব স্বরূপ অর্থাৎ চিৎ ও জড়ে কোনো তফাত নেই সেখানে। নিজের
ভেতরেও সেখানে ফাঁকা আবার নিজের বাইরেও ফাঁকা - মহাযানের ভাষায়
এটা অতিশূন্য, যার ভেতরে তলিয়ে যেতে পারলেই পরম স্থিতি বা
নাদরূপতার উন্মেষ ঘটে। পাশাপাশি উপনিষদে রয়েছে অতিমুক্তি যা অতিশূন্যেরই উদ্দীপন, সেখানে ব্যক্তি বদ্ধ, ব্রহ্মা মুক্ত, জগত মুক্ত আর ওই মুক্ততির ভেতরই প্রাণকে
আশ্রয় শিখতে হবে। হিন্দুতন্ত্রের উদ্ভব হয় বৌদ্ধতন্ত্রের
উপর ভিত্তি করে আর হিন্দু আর বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রের প্রভাবে গড়ে ওঠে বাঙালী সুফীর
বিশ্বাস ও ভাবজগতটি, যার ফলে
শূন্যবাদ, অদ্বৈতবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, দেহতত্ত্ব, বৈরাগ্য, গুরু বা পীরবাদ, মায়াবাদ, ফানাতত্ত্বের মতো একাধিক ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটেছে
সুফী সাধনায়। শূন্যতার আদি ভাবধারার উদাহরণ পাই আমরা বেদ উপনিষদে।
কেনোপনিষদে আমরা পাই নৈরাত্ম শক্তি বা শূন্যময়ী প্রকৃতির সাধনা। হিন্দু যোগশাস্ত্র ও শক্তি সাধনাও কিন্তু
সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের দেহের মধ্যে এক ধরনের শূন্যের এক ধরনের ভাসমানতার বা সহজতার সাথে ঈথারের সাথে
জড়িত আত্মার কথা বলে এসেছে। মানুষের দেহের মধ্যেই রয়েছে একটি ঘুম এবং একটি চির
জাগরণ বা মুক্ত পিপাসা। কুন্ডলিনীর মতো নিদ্রিত হয়ে
আছে সুপ্তশক্তি, সে বদ্ধ গতিহীন নিষ্ক্রিয় আর তাকে মূলাধার থেকে
স্বাধিষ্ঠানে, স্বাধিষ্ঠান
থেকে মণিপুরে, মণিপুর থেকে অনাহত বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র পার হয়ে সহস্রারে
প্রবেশের মাধ্যমেই ঘুমন্ত প্রকৃতির পরম স্থিতি পরম
মুক্তি। এভাবেই শূন্যকে হাজারো
সম্ভাবনা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস হয়েছে আদিকাল থেকে। বৌদ্ধতন্ত্রেও আমরা পাই ‘নির্মাণ চক্র' নামের প্রাথমিক শক্তিস্তর পেরিয়ে ক্রমাগত ‘ধর্মচক্র’, ‘সম্ভোগচক্র’ অতিক্রম করে সাধকের ‘উষ্ণীষকমলে' পৌঁছে মহাসুখ বা সহজানন্দরূপ শূন্যতা প্রাপ্তির
আকুলতা। আবার বৈদিকী ও তান্ত্রিকী থেকে যে হিন্দু
পৌরাণিক ধর্মের উৎপত্তি, সেখানেও শূন্যতা কিন্তু কেবল নিহিলিজম নামে অভিহিত হয়নি
বরং অভাববস্তু ও ভাববস্তু এই দুইয়ের মধ্যে যখন আর কোনো মীমাংসা থাকে না, মত থাকে ন্ মায়া থাকে না, তখনই শূন্যের ইঙ্গিত আসছে, অনুসরণ আসছে ভেতরের আরও ভেতরের নিঃশব্দের আরও
নিঃশব্দের। আবার বোধিসত্ত্ব ও দশভূমির আলোচনা
করলে আমরা দেখব বুদ্ধও কিন্তু শূন্যতা প্রাপ্তির জন্য সাধককে দশটি ভূমি বা স্তরের
মধ্যে দিয়ে উর্ধ্বদিকে প্রসারণের কথা বলেছেন। এই দশ ভূমি হলো ১- প্রমুদিতা, ২- বিমলা, ৩- প্রভাকরী, ৪- অচিস্মিতা, ৫- সুদুর্জয়া, ৬- অভিমুখী, ৭- দূরঙ্গম, ৮-অচলা, ৯-সাধুমতী বা সদিচ্ছা এবং ১০- ধর্মমেঘ। প্রতিটা ভূমি বা স্তরের বিশদ বিবরণে
না গিয়েও বলা যেতে পারে, বোধিসত্ত্বের
নিগুঢ় তত্ত্বে ছিল চরম স্থিতি বা শূন্যতা অবধি পৌঁছবার আকুতি। ‘অচলা’ হলো সেই ভূমি যেখানে জড়ের আর পতনের ভয় নেই, আর ‘ধর্মমেঘ’ সেই ভূমি যেখান থেকে সে শূন্যকে শুদ্ধ
শক্তিরূপে গ্রহণ করে বিলীন হয়ে চলেছে। বৌদ্ধিক
শূন্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা নাগার্জুনীয় শূন্যবাদেও
শূন্যই সারবস্তু অবিনাশী এবং অচ্ছেদ্দ্য হিসাবে অভিহিত হলো। এখন সুফীবাদ এবং তার
যোগধর্ম সম্বলিত সংস্কারগুলির কাছে ফিরে এলে আমরা দেখব বৌদ্ধ বেদান্ত জৈন শৈব
বৈষ্ণব তন্ত্র লোকায়তের মতো কর্মমার্গ জ্ঞানমার্গ ভক্তিমার্গের বিবিধ স্তরের
মধ্যে দিয়ে মোক্ষলাভের বিষয়টিকে সেখানেও জীবনদর্শনের মূলপন্থা করা হয়েছে। আউলা বাউলাদের সাঁই যেমন শূন্যের দিকে তুরীয়
আনন্দ লাভ করতে শিখিয়েছেন তেমনি সুফীবাদে মুরশিদ বা পিরই সেই
গুরু, যার বাণী
বারবার আত্মবোধকে বিসর্জন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শরিয়তি ও মারফতি এই দুই পথে পার্থিব প্রেম
দেহজ থেকে অপার্থিবে উত্তরিত করে নিজেকে নিজের মধ্যে বিলীন করে নিজেকে সম্পূর্ণ
হারিয়ে ফেলাই হয়ে উঠেছে সুফীসাধনার গুপ্তদর্শন।
আল্লাহর অহি প্রাপক
এবং আল্লাহর বাণী প্রচারক ও নবী হজরত মহম্মদ, যিনি ইসলাম ধর্মমতের প্রবক্তা, ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর কিছু কালের
মধ্যেই খারিজি, শিয়া, মুরজিয়া আর কাদেরীয়ার মতো বেশ কিছ
সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়, যারা মহম্মদ কর্তৃক প্রণোদিত
ইসলামের বিধি নিষেধ অনুশাসন ও ধর্মাতাত্ত্বিক কর্মকান্ডে বারংবার নতুন বিশ্লেষণ নিয়ে আসে। এদের
মধ্যে প্রভাবশালী ছিল মোতাযিলা সম্প্রদায়, যারা ইসলামকে যুক্তি
ও ধর্মের মিশেল হিসেবে পরিভাষিত করতে চেয়েছিল। এরা ছিলেন র্যাশানলিস্ট, যুক্তিবাদী। সব তত্ত্বের বিচার যুক্তির সাহায্যে করতে হবে, এমনকি ধর্মেরও, এমনই ছিল তাঁদের মত। দয়ালতত্ত্বের ভাবপেক্ষা মানব জীবনে অতি মাত্রায় গুরুত্ব আরোপ
করার জন্য স্বভাবতই জীবনের প্রতি অপেক্ষাকৃত নিরাসক্ত ইসলামিক মরমীয়াদের সাথে
মোতাযেলাদের দ্বন্ধ ছিল স্বাভাবিক, আর এই দ্বন্ধ থেকেই ইসলামে এল সুফীর মতো নতুন ভাবধারা
যা মোতাযিলাদের বিজ্ঞান ও দর্শনের থেকে বেরিয়ে প্রেম ও সত্যের
অভিধ্যান চাইল। এই সুফীরা আসলে মুরশিদের সাধনা করেছেন মারফতির গুঢ়তত্ত্ব শেখার
জন্য। মারফতি সাধনার সেই স্তর যেখানে খাঁটি সত্যে বিলীন হওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। আর এই মারফত থেকেই আরও একধাপ বা একস্তর অতিক্রম করলেই
বাকায় পৌঁছে রিপু দমন করে সাধক মরমীয়ারা মহাসত্যের সন্ধান করেন। অর্থাৎ সুফীর প্রাথমিক মননতন্ত্রেই পাওয়া যায় শূন্য হওয়ার
বাসনা, আধার ত্যাগ করার আকাঙ্ক্ষা। বৌদ্ধ সহজিয়া বা
নাথসাহিত্যে কিন্তু এই শূন্যবাদ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। নাথধর্ম হলো নিরীশ্বরবাদী
ধর্ম এবং শূন্য নিরঞ্জনের উপাসনাই এই
ধর্মের নীতি এবং যোগাবলম্বনে সর্বশূন্যতা লাভই ছিল তার কাম্যবস্তু। বৌদ্ধমতে
সর্বত্রই শূন্য বিরাজ করছে এবং সংজ্ঞানের স্বরূপ চিনতে গেলে চিনতে হবে ওই অনন্ত
প্রসারিত শূন্যের স্বরূপকে। চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত শূন্যপুরাণ হতে আমরা এই নামরূপহীন শূন্যের সমর্থনে শুনি-
“নহি-রেক নহিরূপ নহি ছিল বন্নচিন
রবিশশী নহি ছিল নহি রাতি দিন
নহি ছিল জল থল নহি ছিল আকাশ
মেরুমন্দার নহি ছিল নহি ছিল কৈলাস
নহি ছিল সৃষ্টি আর না ছিল চলাচল
দেহারা দেউল নহি পরবত সকল
দেবতা দেহার ছিল পুজিবাক দেহ
মহাশূন্যর মধ্যে পরভুর আর আছে কেউ,
শূন্যপুরাণ ও নাথসাহিত্যে
কেবল শূন্যের সংজ্ঞা নয়, সাথে সাথে শূন্যের স্বরূপ স্বত্ব স্বভাবে পৌঁছতে
বাহাত্তর হাজার নাড়ির মধ্যে ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা সুষুন্মা চিত্রা হস্তিনী বারুশী
গান্ধারী পূষ্যা সরস্বতী অলম্বুসা যশস্বিনী কুহু তপস্বিনী বিসন্ধরী ও শক্তিনী এই পনেরোটি নাড়ীর উপর
বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছ; এই নাড়িচক্রভেদই
ছিল নাথযোগীদের যোগসাধনা ও যোগলব্ধ প্রণালী। আশ্চর্যভাবে দেখা যায় পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে
প্রচারিত সুফী সাধক গানে মরমীয়াতে নাথপন্থীদের পনেরোটি নাড়ি ও ছয় চক্রের
ভিতর দিয়ে শূন্যদেশে সাধনার কথা বারবার উঠে এসেছে। ইসলামের প্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা সুফীতত্ত্বের ভেতর বহতা নদীর মতো ক্রমাগত ঢুকে
পড়েছে ভারতীয় পৌরাণিক ও বৌদ্ধিক মননতত্ত্ব। ইসলামী
আবরণে গড়ে ওঠা সুফীতেও অচিরেই বৌদ্ধ হিন্দু যোগতান্ত্রিক সাধনার অনুরণন
জোরালো হয়ে উঠেছে। আরবী ফারসী পরিভাষায় সীমিত না থেকে ক্রমাগত সুফীর সর্বেশ্বরবাদ
আর বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদও একাকার হয়ে গেছে সুফীপন্থী মুসলমান সাধকের ভাষায়। সুফী
সাধক কাজী শেখ মনসুর বিরচিত 'সির্নামা’য় আমরা ইসলাম ও বাঙলার সুফীমতের সমন্বয় দেখতে পাই, ষোলো সতেরো বা আঠারো শতকেঙ্কীভাবে সুফী
মতবাদে মিশে গেছে হিন্দুয়ানী অধ্যাত্মসাধন, তা ‘সির্নামার’ পীরতত্ত্বেই উল্লেখিত। নাথসাহিত্যের কুন্ডলিনী জাগরণ সেখানেও হয়ে
উঠেছে সুফী সাধনার মূল বিষয়, শূন্যত্ব প্রাপ্তির একমাত্র পথ-
“শরীরের রগ সব
তিনশত ষাইট
শোণিতে ভরিয়া আছে সমুদ্রের মত
তার মাঝে দশ নাড়ী আছএ প্রধান
যেখানে যে আছে কহি লও পরিমাণ
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা দুই সুষুন্মা আর
গান্ধারী, কুহু, হস্তিজিহ্বা, পুষা নাম তার
পক্ষিনী শঙ্খিনী মুষা কুন্ডলিকা দশ
ধক দশ ব্রহ্মনাড়ী হএ একাদশ
যে যে নাড়ী যেইস্থানে, রহিয়াছে নিত
সে সব কহিব আমি শুন দিয়া চিত
ব্রহ্ম নাড়ী মেরুদন্ড ভেদিছে নিশ্চিত
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা দুই মেরু দুই ভিত
তালু মুলে হস্তীজিহ্বা মুখে বৈসে মুষা
শিরেত পক্ষিনী লিঙ্গে কুন্ডলিকা বাসা
.........
নদ নদী খাল যেন পৃথিম্বিত
নাড়ী সব শরীরেত শোণিত পূরিত
যেহেন দরিয়া সব পৃথিম্বী মাঝার
শরীরের মধ্যে আছে তেমত আকার
.........
লবনী ক্ষীরোদ হএ আর জলা নদী
শরীরেত এই সিন্ধু রহে নিরবধি”। ...
শরীরের ওই সিন্ধু আসলে শূন্যের। পূর্ণকে ধরে রাখে সে শূন্য। যোগতান্ত্রিক যৌগিক প্রক্রিয়াগুলি
এবং বৌদ্ধ হিন্দু সাধনার রীতিগুলি বাঙালী সুফিরা এভাবেই বারংবার আত্মস্থ করেছিলেন
এবং পরবর্তীকালে চোদ্দোশো বা পনেরোশো শতাব্দীতে সিদ্ধা ও মুসলমান ফকির থেকে উদ্ভূত বাউল
সম্প্রদায়ের দর্শনেও বৌদ্ধসহজিয়া থেকে সুফীদের গৃহীত সাধনের এমত পদ্ধতিগুলো বিশেষভাবে
লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। লালনও কিন্তু সহস্রারে এসেই
তাঁর 'আয়নামহল'এ যাওযার কথা বলেছেন। এবং বাউলের দেহতত্ত্বেও প্রবেশ করেছে সুফীর
গোপন সাধন জগত, সেখানে স্বরূপ
স্বরূপকে সন্ধ্যাভাষায় আক্রমণ করেছে হেঁয়ালিচ্ছলে আর সাথে সাথে চেতনা কেন্দ্রের
দিকে বাড়তে বাড়তে শূন্যদর্শনের সাক্ষাৎ দিয়েছে। মনসুরউদ্দিন মুহম্মদ তাঁর গ্রন্থ ‘হারামনি’তে একটি গান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন
সৃষ্টিতত্ত্বে কীভাবে হিন্দু ও মুসলমানের মিলনের সুর গান অবধি পৌঁছেছিল। -“মাবুদ আল্লার খবর না জানি / আছেন নির্জ্জনে সাঁইনিরঞ্জন মনি, / সেথা নাই দিবা রজনী / অন্ধকারে
হিমান্ত বায় ছিলে আপনি / সেই বাতাসে গৈবী আওয়াজ হল তখনি / ডিম্ব ভেঙে
আসমান জমিন গড়লেন রব্বানি / ডিম্ব রক্ষে আলে, ডিম্বের খেলা আদমে খেলে / অধীন আলেক বলে না ডুবিলে কি রতন মিলে? / ডুবিলে হবে ধনী"। -সাঁই নিরঞ্জন
কিম্বা আল্লা যেমন কোনো মত নয়, কেবল এক একটা সাধনা, শরিয়ত কিংবা শাস্ত্র সেখানে শূন্যের দিকে ক্রমপ্রসারিত
হওয়ারও এক একটি পথ মাত্র। বাউলের উদ্ভবই হয়েছিল মুসলমান ফকির ও সিদ্ধা থেকে, তাই আধুনিক সুফীতে যেমন তার মিশেল তেমনি
ভারতীয় যোগ ও বেদান্তদর্শনের স্পষ্ট প্রভাবের ইঙ্গিত
পাওয়া যায় সুফীর বিভিন্ন মোকাম ও মঞ্জিলে। নাথদর্শনের বা ভারতীয় বেদান্ত দর্শনে
যেমন শূন্য অবধি পৌঁছতে চক্রে চক্রে ভাগ করা হয়েছে দেহকে এবং মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা পেরিয়ে সহ্রসার অবধি জাগরণই যেমন ভারতীয়
তন্ত্রসাধনার চৈতন্যরস হয়ে উঠেছে, তেমনি ইরাণ বা আরবী সুফীরাও উত্তর ভারতে বিস্তৃতি লাভের
সাথে সাথে এসব তন্ত্রসাধনা ও বৌদ্ধসহজিয়া যোগ দ্বারা
বিশেষভাবে আকর্ষিত হয়। মূলাধার থেকে সহ্রসারের মতোই সুফী সাধকেরাও
মানুষকে বা সংসারকে শূন্যের সম্যক দর্শন বা ইন্ট্রিগাল
ভিউ দেখাবার জন্য ভারতীয় যোগের আলোকেই দেহকে, সৃষ্টির আধারকে কয়েকটি মোকাম বা মঞ্জিলে ভাগ করেন।
-নাসুত বা দেহলোক,
-মলকুত বা
বৌদ্ধলোক,
-জবরুত বা
শক্তিলোক,
-লাহুত বা ফানা
বা আত্মবিলোপের জগত এবং
-হাহুত বা অদ্বয়
অবস্থা।
এই ফানা ফিল্লাহ বা আত্যোৎসর্গ বা আত্মার বিনাশের মধ্যে দিয়ে সুফীরা স্রষ্টার নৈকট্য লাভের
পথ প্রশস্ত করার কথা বলেছে বারবার; ফানার অর্থ– “ব্যক্তির মানবীয় সত্তা এবং গুণাবলীর বিলয় সাধন
করিয়া নিগূঢ় অনুভূতিতে আত্মবিস্মৃত হওয়ার অবস্থা”। এই জায়গায় এসে
বিষয় ও বিষয়ী উভয়ের ব্যক্তিগত বোধ তিরোহিত হয়। 'বাংলার বাউল-সুফি সাধনা ও সংগীত’ গ্রন্থে আবদুল ওয়াহাব বলেছেন- “সুফিতত্ত্বের
সাধক, পির দরবেশের
সাথে নাথ গুরুদের ধর্মসাধন পন্থার খানিকটা ঐক্য
আবিষ্কার করা দুরূহ নয় এবং সুফিতত্ত্বের দর্শনে ভারতবর্ষের নিজস্ব দর্শন সাংখ্য যোগের
একটি গভীর মিল আছে। কায়াসাধনার যে রীতি পদ্ধতি সুফিবাদে
প্রত্যক্ষ করা যায় তার সঙ্গেও সিদ্ধাচার্যদের কায়া সাধনার মিল আছে"। কেবল নাথপন্থীদের সাথে বা বৌদ্ধসহজিয়াদের
সাথেই নয়, সুফীবাদের
চেতনার মূলের যে জগৎ অর্থাৎ স্থূল থেকে সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্ম থেকে শূন্য
অর্থাৎ স্থূলদেহের ভাবনাকে অতিক্রম করে যে
নিরাকার অধর মহাবিদেহের খোঁজ, সে আসলে হাজার হাজার বছরের ভারতীয়
জীবন দর্শনেরই ফসল। বাংলার সুফীরা উত্তর ভারতীয় সুফীদের তুলনায় অধিকতর উদার বলে
মনে করেন আবদুল ওয়াহাব এবং তার জন্য বাংলার সংবেদনশীল উদারনৈতিক মানবাতাবাদী
সমাজদর্শনের কথা বলেন তিনি। একাধিক ধর্ম একাধিক বাদ
একাধিক দর্শনের যোগে সুফী সংস্কৃতিতে এক ধরনের সমন্বিত জীবনবোধের জন্ম নেয় যা ঈশ্বরকে আল্লাহকে
জানার জন্য যেমন তৃষ্ণার্ত, তেমনি সে শূন্যেরও দ্বারস্থ। মন মনীষা আর হৃদয়ের বহুশ্রুতি দিয়ে এ
শূন্য সুফী সাধকের যুগ যুগান্তের সেই খোঁজ, যেখানে দাঁড়িয়ে সে আদি অনন্ত ব্রহ্মকেই
খোঁজে, স্থূল থেকে যেতে চায় মূলে, স্বরূপ থেকে যেতে চায় শূন্যে। এখানে দাঁড়িয়েই অস্তি থেকে জগত থেকে
সুফীসাধকের শূন্যলিপ্সু উচ্চারণ বারবার খোঁজে শব্দহীন বস্তুহীন সন্ধিৎসারের
সুগন্ধীটুক; না-থাকা কোনোখানে থাকে এ যেন তার আবহমান উচ্চারণ-
“নূর অংশ মোর এই দেহেতে
কোন খানে আছে
শুনি নূরেতে নূর
মিশাইয়া
দেশের সকল অঙ্গ
আমার
আপন আপন নামে
প্রচার
নূর নামে কোন
বস্তু গো তার
কোথায় মিশেছে!...”
*********************
(বেদান্ত দর্শনে ঋণ
স্বীকারঃ শ্রীঅনির্বাণ, রমা চৌধুরী)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন