লাশ
মাগুরা জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম বাগডাঙা। এ গ্রামের এক অখ্যাত বাউল কবি হারান মন্ডল। গ্রামের হাটে হাটে গান গেয়ে যা পায়, তাই দিয়ে কোনো মতে কষ্টে-ক্লেশে দিন চলে যায়। সেদিন শনিবার। রামনগরের হাটবার। হারান মন্ডল গাছ থেকে গোটা চারেক কাঁঠাল কেটে ঝাঁকায় করে শেষ দুপুরে রামনগর হাটের উদ্দেশে রওনা হলো। যাবার আগে হারান মন্ডল স্ত্রী মালতীকে বলে গেল : বউ, চুলোয় জল গরম দিয়ে রাখিস, হাট থন চাইল আনলি ভাত বসায় দিস।
এটা ওদের নিত্যদিনের বিষয়। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ওরা। হারান মন্ডল হাটে গেলে মালতী জল ফুটাতে থাকে। হাট থেকে চাল এলে ভাত চড়িয়ে দেয়। তাতে করে ভাত তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।
বাগডাঙা থেকে রামনগর হাট তিন কিলোমিটার দূরে। ঢাকা-খুলনা হাইওয়ে ধরে যেতে হয়। কাঁঠালের ঝাকা মাথায় নিয়ে ‘গুরু উপায় বল না, কপাল পোড়া জনম দুখী গুরু আমি একজনা’ গান গাইতে গাইতে হাইওয়ে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে হারান মন্ডল। জন্ম থেকে ওর একটা পা ছোট। এ জন্যে গ্রামের মানুষ ওকে ‘হারান খোঁড়া’ বলে ডাকে। গান পাগল মানুষ হারান। গানই তার জীবন।
অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হারান মন্ডলকে চাপা দিয়ে চলে গেল। বেচারা হারানের নাকমুখ এমনভাবে থেতলে গেল যে, চেনারই উপায় থাকল না। লোক জড়ো হতে সময় লাগল না। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। তার আগেই অবশ্য হারানের প্রাণ-পাখিটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে লাশ থানায় গেল। থানা থেকে মর্গে। লাশ কাটাছেঁড়া হলো। লাশের ওয়ারিশের খোঁজ পড়ল। কোনো খোঁজ মিলল না। লাশের পকেটে একটা চিরকুট পাওয়া গেল। আশ্চর্য, তাতে একটা কবিতা লেখা। তাতে করে ওসি শমসের আনোয়ার ধরে নিলেন, লাশটি একজন কবির। ওসি সাহেব জেলা কবিতা পরিষদের সভাপতিকে ফোন করলেন। কবিতা পরিষদের সভাপতি থানায় এলেন। ওসি সাহেব তাঁকে লাশটি বুঝে নিয়ে সৎকার করার জন্যে অনুরোধ করলেন। কিন্তু সভাপতি তা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি বললেন : “আপনি বললেই তো আর লোকটা কবি হয়ে যাবে না! আগে তো প্রমাণ করতে হবে সে কবি! কী নাম, ক’টা বই বেরিয়েছে, ক’টা পুরস্কার পেয়েছে; সে সব আগে জানতে হবে, তারপর তো সৎকার!” ওসি সাহেব তো হতবাক। এ সব এখন কে প্রমাণ করবে? সভাপতিকে বিদায় করলেন ওসি সাহেব।
বসে বসে ওসি সাহেব ‘কী করা যায়’ ভাবছিলেন। এমন সময় হাবিলদার রমেশ শীল এসে বলল : স্যার, লোকটা কিন্তু হিন্দু।
ওসি সাহেব বললেন : কী করে বুঝলে?
ওর ধুতি-ফতুয়া দেখে।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
রমেশ শীল চলে যেতেই ওসি সাহেব ফোন করলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মাগুরা শাখার সভাপতিকে। সব শুনে হিন্দু পরিষদের সভাপতি বললেন : একটা বিষয় বুঝতে পারলাম না ওসি সাহেব, কেবল ধুতি-ফতুয়া দেখেই রায় দিয়ে দিলেন লোকটা হিন্দু। ধুতি-ফতুয়ার সাথে ওর পকেটে যদি একটা টুপি থাকতো তাহলে কী বলতেন, হিন্দু না মুসলমান? কী নাম, বাড়ি কোথায়, কোন্ জাত এ সব আগে জানতে হবে। তারপর তো সৎকার! আপনি স্যার মুসলমান মানুষ, সৎকারের নিয়ম-কানুন জানেন না। আপনি বললেই তো আর সৎকার হবে না! নিয়ম-কানুন মেনে তবেই তো আমাকে করতে হবে!
তার মানে আপনি পারবেন না? জানতে চাইলেন ওসি সাহেব।
সরি স্যার, আমাকে ক্ষমা করবেন। নমস্কার।
এরপর ওসি শমসের আনোয়ার ফোন করলেন স্থানীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন পরিষদের সভাপতিকে। তিনি বিষয়টি ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছেন। আর তাই ওসি সাহেবের ফোন ধরেই বললেন : স্যার, আমি তো মাগুরাতে নেই। কাল ঢাকায় এসেছি। মাগুরা এসে আপনার সাথে দেখা করব।
এ হেন ঘটনায় যারপরনাই হতাশ হলেন ওসি শমসের আনোয়ার। ‘মাগুরা বার্তা’র সম্পাদককে ফোন করলেন। তিনি এসে ছবি-টবি তুলে নিয়ে গেলেন। একে একে তিন দিন হয়ে গেল। লাশে গন্ধ ধরে গেছে। ফুলতে শুরু করেছে। লাশ আর রাখা সম্ভব নয়। তখন নিজের উদ্যোগে ওসি শমসের আনোয়ার লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করলেন।
লাশ সৎকারের দিন তিনেক পরে ‘মাগুরা বার্তা’য় ছবি ও খবর দেখে মালতী থানায় এলো। কাপড়-চোপড় দেখার পর সনাক্ত হলো, লাশটি বাগডাঙা গ্রামের বাউল কবি হারান মন্ডলের ছিল। যার বাড়িতে তখনও চুলোয় জল ফুটছিল হারানের চাল নিয়ে আসার অপেক্ষায়।*
*সদ্য ঘটে যাওয়া একটি সত্য ঘটনা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন