সুর
বাঁশি বাজাচ্ছে বিদ্যেধর। যমুনা-নই-কুলে। না এখানে আর যমুনা কই! কালিনী-নই-কুলে। না এখানে কালিন্দীই বা কই! গঙ্গা-নই-কুলে। গঙ্গার ছিন্ন অংশ পড়ে আছে হেথা। তালে কাটিগঙ্গা-নই-কুলে! হ্যাঁ, সে রকমটাই নাম এখানে
গঙ্গার। আদি গঙ্গা বহমান ছিল। বন্দর ছিল। বন্দর কাশিমবাজার। খুব অসুবিধে হচ্ছিল
সাহেবদের, তা ছাড়া পলি পড়ে পড়ে
জাহাজ আনা-যানা
বড়ই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তাই কেটে ছেঁটে দেওয়া হলো গঙ্গাকে। পড়ে রইল ছিন্নগঙ্গা
কাটিগঙ্গা অশ্বক্ষুরাকৃতি কশিমবাজারকে বুকে জড়িয়ে। সেই ছিন্নগঙ্গা নই কুলে বসে বাঁশি
বাজাচ্ছে বিদ্যেধর। আপন মনে একমনে। গরু চড়ায় কি? না। পাশেই বিস্তির্ণ আখের ক্ষেত, দেখাশোনা করে। কাঠ- চাঁপা গাছের নিচে
বসে গঙ্গায় নামার সিঁড়ির পাশ ঘেঁষা ভাঙ্গাচোরা একটা পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে।
দোহারা পেটানো হিলহিলে দেহখানা বিদ্যেধরের। শ্যাম রঙটুকু আছে। বাঁশিও বাজায়। যায়গাটা পোড়ো একটা। চারপাশে বন-বাদাড় আর পুরনো লাল ছোট ইঁট বের করা ভাঙ্গা মন্দিরগুলো। আর
সর্দারদের বসতি। সর্দার মানে এক আদিবাসী শ্রেণী। সাঁওতাল গোষ্ঠীর সঙ্গে
এদের চেহারা মুখের ভাষার খুব মিল। আমাদের বিদ্যেধররা’ও সর্দার। বিদ্যেধরের নাম আসলে বিদ্যেধর ছিল না। টুকুনের বাবা নাম দিয়েছিলেন ‘বিদ্যেধর’। ওর বিদ্যের বহর
দেখে। সর্দারদের বসতি পেরিয়ে এসে তবে
কাশিমবাজারের সাধারণ মানুষজনের ঘরবাড়ি। দু’পাশে দুটি রাজবাড়ি। রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর
রাজবাড়ি আর রাজা কমলারঞ্জন রায়ের রাজবাড়ি। মাঝটুকুতে সভ্য মানুষের বাস। সেখানেই টুকুনদের
বাড়ি। সর্দাররা মাঝে মাঝেই আসে বাবুদের বাড়ি একরোজ দু’রোজ খাটতে।
বিদ্যেধরও আসে। কত আর বয়েস তখন ওর! টুকুনের বাবা যাই জিজ্ঞেস
করেন, ঘাড় কাত করে বলে ‘হ্যাঁ বাবু’। গাছে উঠতে পারিস? হ্যাঁ বাবু। নারকেল
গাছে? হ্যাঁ বাবু। দেওয়াল
চুনকাম করতে পারিস? হ্যাঁ বাবু।
সবেতে একই জবাব। কিন্তু টুকুনের বাবা ওকে দিয়ে কখনো ওসব
করাননি। কিছু কাজ না করিয়ে টাকা দিতে চাইলে সর্দাররা
আবার নেবে না। চরম আত্মসম্মানবোধদ। তাই বিদ্যেধরের কাজ ছিল
টুকুনের সঙ্গে খেলা আর সামনের ছোট্ট বাগানটা’র গাছের গোড়ায় জল
দেওয়া টুকুনকে সাথে নিয়ে। টুকুনের বয়েস চার-পাঁচ,
আর বিদ্যেধরের বয়েস তখন দশ বারো। গাছে জল দিত বাচ্চা দুটি ছেলে। সে সব রবিবারে সকাল থেকে
টুকুনের পড়াশোনায় ছুটি। বিদ্যেধররা এলেই টুকুনের খুব মজা সেদিন।
সর্দাররা দল বেঁধে বেরোত বাবুদের বাড়ির কাজে। তা হয়তো মাস-দেড় মাসে একদিন। টুকুনের খুব আনন্দ সেদিন। ওর কাছে
বিদ্যেধর যেন দেবদূত।
সেই বিদ্যেধর এখন বাঁশি বাজায় আর আখের ক্ষেত পাহাড়া দেয়। বাবুদের বাড়ির কাজ়ে যায় না
আর সর্দার রা। বিদেশে খাটতে যায়। তাতে পয়সা
অনেক। রোগ ভোগও অনেক। বিদ্যেধর যায় না। বাঁশি বাজায়। বড় আকুল করা বাঁশি। বেশ ক’বছর কেটে গেছে। ওর মা’টা মরেছে। ওরা বাপ
মরেছে ও জন্মানোর দু’মাস আগেই। আর কেউ নেই। ঘরটুক আছে। বাগানটুক
ছিল। মা’য়ে পো’য়ে সবজি ফলাতো। মাঝে মাঝে বাবুদের বাগানে
জল দিয়ে আসত, বাবুদের ছেলেটার সঙ্গে হুটোপাটি করে খেলে আসত। দিন
চলে যেত মা ব্যাটার। কিন্তু বিদ্যেধর বাঁশি পেল কী করে? এমন সুর পেল কী করে? জিজ্ঞেস করলে একটা
ঝোপঝাড় ঘেরা মনসার থানের দিকে আঙ্গুল
তুলে দেখায় ‘হুই
হোথা’। আর কিছু বলে না। সর্দারদের মধ্যে মনসা পুজোর চল আছে। ওরা বলে নাগমাতা নাগদেবী। মনসা পুজোর দিন সারারাত
জাগার পর ভোরের দিকে সবাই যখন অকাতরে ঘুমোয়, তখন না কি নাগমাতা নামেন। নিশান হিসেবে কিছু না
কিছু ফেলে যান। যে প্রথম সকালে থানে আসে, সে ঠিক পায়।
সেবার মনসা পুজোর আগ দিয়ে, বিদ্যেধরের তখন চোদ্দ পনের বছর বয়েস, ওর মা বিয়ে ঠিক করে বসল কিছুদূরে বাড়ি আরেক সর্দারের এগারো
বারো বছরের মেয়ে বেউলার সঙ্গে। সর্দারদের মধ্যে বাচ্চা
বয়েসে বিয়ের চল। ভারি চঞ্চল মেয়ে বেউলা। একদন্ড স্থির থাকে না কোথাও। ধরতে গেলেই মুখ
বেঁকিয়ে দৌড়ে পালায়। শুধু কালো পানপাতা মুখে চিকন চোখের
ঝিলিক, নাকের নথের
দুলুনিটুকু চোখে পড়ে। বিদ্যেধরকে দেখে হেসে কুটোপাটি। ঐ ছেলেটা না কি ওর বর! মানতেই চায় না। সর্দারদের প্রথা মতো বিয়ে হলো বিদ্যেধর আর
বেউলার। মনসা পুজোর আগ দিয়ে। বিয়ে শেষ করে, হুল্লোড় শেষ করে বর
কনেকে নিয়ে সবাই যখন বাসর ঘরে ঢুকতে যাবে, দরজার সামনে পড়ে
থাকে চকচকে কিসের ওপর যেন পা পড়ল বেউলার। নিহরের মতো ঠান্ডা। আর সঙ্গে
সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল বেউলা। বাচ্চা কেউটে ততক্ষণে তরল
বিষ ঢেলে দিয়েছে বেউলার পায়ে। সরসর করে মাটির ঘরের দরজার কোণে একটা সরু গর্তের
মধ্যে ঢুকে গেল সাপটা। বিদ্যেধরের পায়ের কাছে লুটিয়ে বেউলা ছটফট করছে। বেউলার বাপ ছুটে এসে ধুতির পাড় ছিঁড়ে
বাঁধন দিতে থাকে। ভ্যানে চাপিয়ে বেউলাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়
সকলে। বিদ্যেধর দাঁড়িয়ে থাকে। বিদ্যেধরের মা উঠোনে লুটিয়ে পড়ে। বেউলার মা’র চিৎকার শোনা যায়। হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই বেউলার
শ্বাস বন্ধ হয়। মুখে ফেনা। হাসপাতালের ডাক্তার নার্সরা সর্দারদের যা তা বলেন, ‘কতবার বলেছি তোমাদের
ঘর দোর পরিচ্ছন্ন রাখতে, হাসপাতাল থেকে
ব্লিচিং পাউডার ফিনাইল নিয়ে গিয়ে ছেটাতে!’ পরদিন বেউলার সৎকার
সারে বিদ্যেধর। তার পরের দিন মনসা পুজো। সবাই রাত জাগে সর্দাররা। শুধু বেউলার মা ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারায়। বেউলার বাপ চুপ বসে থাকে ঠেস দিয়ে
দাওয়ায়। নাগমাতা নিল বেউলাকে। বিদ্যেধরের খোঁজ পায় না কেউ
দিনমান। ওর মা কেঁদে চলেছে, লুটিয়ে পড়ছে।
নাগমাতা নিল বউটাকে।
মনসা পুজোর রাত ভোর। কারো আর চেতন নেই। কাটিগঙ্গার ধার ঘেঁষে কাঠ-চাঁপা গাছের নিচে একলা বসেছিল নিশুত রাত-ভর বিদ্যেধর। হটাৎ সরু বাঁশির সুর কানে
আসে। এমন বাঁশি ভোরবেলা কে বাজায়! বাঁশির সুর ধরে
এগোতে থাকে ও। সুর ভেসে আসছে
মনসার থানের থেকে। যাবে ও ওদিক পানে? নাগমাতা নিল বেউলাকে। থানের কাছাকাছি আসতেই আবছা দেখে এক বেদে আর
বেদেনি বসে আছে থানে। ওকে দেখেই হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। বেদেটি বাজাচ্ছিল বাঁশি। বিদ্যেধর দেখেছে
রাজবাড়ির মাঠে বেদেদের ডেরা হয়েছে। বিদ্যেধর এগিয়ে যেতেই
ওরা দৌড়ে পালায়। পড়ে থাকে বাঁশিটা। ঠিক নাগমাতার মূর্তির পায়ের একটু দূরে।
হাতে তুলে নেয় বিদ্যেধর। ফুঁ দেয় বাঁশিতে। সুন্দর
সুর তুলতে পারছে তো ও। নিজেই চমকে ওঠে। তারপর আপন মনে বাজাতে
থাকে। সকাল হলে সর্দাররা সবাই এসে দেখে। ‘উয়াকে নাগমাতা
বাঁশিখান দিইছেন, বেউলাকেও ফিরত পাঠাইবেন মত্তভূমিতে ঠিক’। কিছু বলে না বিদ্যেধর। বাঁশিখান নিয়ে উঠে চলে যায়।
তারপর থেকে কাটিগঙ্গার ধারে
বসে বাঁশি বাজায় বিদ্যেধর। সর্দারদের মাথা সুবল সর্দারের আখের জমি
দেখাশোনা করে। একদিন টুকুন গেছিল বাবার সঙ্গে
বিদ্যেধরের সঙ্গে দেখা করতে। টুকুনরা সব খবর পেয়েছিল অনেক পরে। এখন টুকুন আরেকটু বড়। পড়ার চাপ বেড়েছে। টুকুন হাঁফিয়ে ওঠে। ওর দেবদূত বিদ্যেধর আর যায় না। খোঁজ করতে করতে কাটিগঙ্গার
কাছে যেতেই শোনে বাঁশির সুর। কাছে যায়। ওদের দেখতে পায়
বিদ্যেধর। তবু উঠে আসে না, বাঁশি থামায় না। আকুল বাজিয়ে চলেছে। কে
দিল ওর বাঁশিতে সুর? টুকুন ভাবে। টুকুনের
বাবা ধীরে ধীরে টুকুনকে নিয়ে ফিরে আসেন। টুকুন ঘুমোনোর সময় যেন বিদ্যেধরের বাঁশির সুর শুনতে পায়। ভাবে বড় হয়ে শিখে নেবে বিদ্যেধরের কাছে। ভাবে ততদিনে ঠিক
বিদ্যেধরের বেউলা ‘মত্তভূমিতে’ নেমে
আসবে ঠিক। বিদ্যেধরের কোনো দুঃখ আর থাকবে না। ঘুমিয়ে পড়ে বাবাকে আঁকড়ে ধরে
ছোট্ট ছেলে টুকুন। দেবদূত বিদ্যেধর বাঁশি বাজিয়ে চলেছে। বিদ্যেধর জানে, বেউলা কোনোদিন আর ‘মত্তভূমি’তে ফিরবে না। বেদেরা দলবল গুটিয়ে রাজবাড়ির মাঠ ছেড়ে চলে গেছে
অন্য কোনো দেশে। বাঁশিখান ফেলে গেছে নাগমাতার থানে। কিন্তু বিদ্যেধরের বাঁশিতে
এমন সুর দিল কে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন