শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০৩) অমিতাভ প্রহরাজ

ভার্ষাস-১ (ক্রিয়াভিত্তিক)



আগের একটি লেখায় শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলেছিলাম... আমরা অতিশয় ভাগ্যবান যে, বাংলাভাষায়, এই ২০১৩ সালে এসে, হরিচরণবাবুর সুযোগ্য উত্তরসূরীরা ভাষাটিকে উৎসস্থান থেকেই বিস্তৃত করার কাজটি নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন।

কলিম খান-রবি চক্রবর্তী। এঁদের কথাও বহু বাংলাভাষাচর্চাকারী জানেন না। যে অকল্পনীয় প্রকল্পটি ওনারা সম্পূর্ন করেছেন, তার নাম ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’... যার দুটি খন্ড প্রকাশিত ও নিঃশেষিত... আমি বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি না করে বলছি এবং সজ্ঞানে বলছি, যে কোনো বাংলাভাষাচর্চাকারীর কাছে গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও আবশ্যিকতার দিক দিয়ে রবীন্দ্র রচনাবলীর পরেই এই প্রকল্পটি অতি আবশ্যিক হয়ে স্থান নিতে পারে...

কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ভাষাতত্বের দার্শনিক প্রয়োগগুলি নিয়ে আমার মতবিরোধ থাকলেও কাজটির বিশালতা ও গভীরতা স্তব্ধবাক করে রেখে দেয়। ভাষার জন্য শ্রম ও ভালোবাসা কোন্‌ পর্যায়ে যে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তা এই প্রকল্পটি দেখার আগে ধারণা ছিল না।

কি আছে এতে? জটিল তাত্ত্বিক কচকচি সরিয়ে রেখে সহজভাবে কয়েকটি কথা বলি, তাহলে হয়তো খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। বাংলাভাষায় যে কোনো শব্দে ধ্বনিভিত্তিক / বর্ণভিত্তিক একটি বিভাজন করা যায়। এবার সেই এক একটি শব্দে প্রযুক্ত বর্ণের সেই বিশেষ ধরন এক একটি ক্রিয়াসংকেত বা অর্থ বহন করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো শব্দের যে বিশ্লেষণ আমরা পাই, তা অভূতপূর্ব ও অসংখ্য চিন্তা ট্রিগার করে। একটা উদাহরণ হয়ে যাক।

যেমন এখানে আমি দেখলাম ‘বিশ্ব’, ধ্বনিভিত্তিক বিভাজন করলে হয় ‘বিশ্‌’+ ‘ব’,

এবার ‘বিশ্‌’- প্রবেশ, ‘ব’- বহন করে যে। এটি জানার পর তৎক্ষণাৎ যে দ্বারোদঘাটন হয় আমার মনে, তার মধ্যে দিয়ে পাই - ‘বিশ্ব’- ‘প্রবেশকর্ম / প্রবেশন বহন করে যে’, আরো দু পা এগিয়ে গেলে পাই “প্রবিষ্ট সত্ত্বা ও তার প্রবেশন যে বহন করে”... মানে সোজা বাংলায় যার মধ্যে অন্য কেউ, অন্য কোনো অস্তিত্ব তার সত্ত্বার অংশ বা শক্তি প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে, এবং সে তা বহন করে চলেছে। এটি যখন ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা তাঁর শক্তি প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন যেখানে এবং সে তা বহন করে চলেছে, তখন এই শব্দ দিয়ে আমি জগত বা ব্রহ্মাণ্ড নির্দেশ করবো।

আবার, লেখাপাগল আপনি আপনার চেতনা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন যার মধ্যে এবং সে তা বহন করে চলেছে, তখন সেটাও বিশ্ব। ভেবে দেখুন লেখা বা কবিতা কি আপনার বিশ্ব নয়?

আবার, যে ছেলেটি রসায়ন শিখতে চায়, জানতে চায় এবং সে তার মেধা ও শ্রম রসায়নবিদ্যার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে এবং সেটি তা বহন করে চলেছে, এবং যার ফলে ছেলেটি প্রথম শ্রেণীতে স্নাতক হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও তারপরে গবেষণা করার স্বপ্ন দেখে, তার কাছে রসায়নই বিশ্ব।

আবার যে রাজনৈতিক নেতা তার ক্ষমতা, বুদ্ধি, প্রভাব আপনার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে এবং আপনি তা বহন করে চলেছেন বলে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে পড়ে তাকে আসন গ্রহণ করতে সাহায্য করেছেন, তার কাছে এই সংজ্ঞা অনুযায়ী দেখলে আপনারা অর্থাৎ জনগণই বিশ্ব।

বিশ্ব শব্দের আদি অর্থ দেখলে দেখা যাবে “অদৃশ্য কিন্তু বিশেষভাবে সক্রিয় সত্ত্বা” (এটি ওই ব্যাকরণগুলিতে পাবেন) এই প্রত্যেকটি অর্থ বিস্তারকে সমর্থন করে। কারণ তখন ভাষা ক্রিয়াভিত্তিক। আজ লোগোসেন্ট্রিক ইংরেজির দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার ফলে ‘বিশ্ব’ শব্দের মানে এসে দাঁড়িয়েছে ‘পৃথিবী’ বা ‘world’। কী পরিমাণ সংকুচিত হলো ভাষা, খেয়াল করুন। কিন্তু এই সংকোচন কি আপনি মেনে চলেন কবিতা লেখার সময়? একেবারেই নয়... সেখানে আপনি একটি শব্দকে নানামাত্রিক করে তোলেন, অভাবনীয় ব্যবহারের কথা ভাবেন। সুতরাং আপনি লেখার সময় অজান্তে ক্রিয়াভিত্তিক বাংলার সাথে নলবন-ভিক্টোরিয়া যাচ্ছেন, আর পড়ার সময় ঘোমটা পরা লোগোসেন্ট্রিক বাংলা ও তার বাবা-মা’র সাথে ড্রয়িংরুমে বসে মিটিমিটি হাসছেন আর চা সিঙাড়া খাচ্ছেন। কী প্রবল হিপোক্রেসি আপন সন্তানের চেয়েও আদরে লালন পালন করছেন।

ক্রিয়াভিত্তিক বাংলা ভাষায় পড়ার ও ভাবনা চিন্তা করার অভ্যেস রাখলে জীবন থেকে সাহিত্য সব কিছুকে নতুন চোখে দেখা যায়। যে কোনো শব্দ থেকে তার বাপ- ঠাকুর্দার আন্দাজ পাওয়া যায় নিজে থেকেই। আর তার সাথে সামান্য সংস্কৃতজ্ঞান থাকলে তো কথাই নেই। ভাষা যে আপনার নিজস্ব সম্পত্তি, এই উপলব্ধির অভিজ্ঞতা অতুলনীয়।

মানে আরো সহজে আপনার মধ্যে সুপারম্যানটিকে দেখুন। এতে ৪৬টি বর্ণের (অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল শ ষ স হ ং ঃ ঁ) প্রত্যেকটির অর্থ উদ্ধার করে যেমন প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি ‘কার’ ও ‘ফলা’ শব্দের অর্থও উদ্ধার করে ব্যাখ্যাসহ প্রকাশ করা হয়েছে। এই ৪৬টি বর্ণের অর্থ এবং কার ও ফলার অর্থ মনে থাকলে এবং তার প্রয়োগবিধি জানা থাকলে আপনি যে কোনো বাংলা শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করে নিতে পারবেন। এবং সেই অর্থ কোনো বদ্ধ অর্থ নয়, মুক্ত; চেতনার সম্প্রসারণ অনুযায়ী একটি শব্দের চরিত্র বা পার্সোন্যালিটি বলা যেতে পারে। এই চিন্তাপদ্ধতিতে মনকে অভ্যস্ত করলে ভাষাবৈজ্ঞানিক বারীন ঘোষালের যে ইজমিক রাইটিংগুলি আপনার কাছে নিছক তত্ত্বের কচকচি বলে মনে হয়, সেগুলি থেকে শুধুমাত্র ভাবনাচিন্তা নয়, সাহিত্যসৃজনের ঝকঝকে স্পার্ক প্লাগ, একাধিক, চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেখতে পাবেন। ঘটনাটি আমার সাথেই ঘটেছে। একসময় বারীন ঘোষালের ‘অতিচেতনা’ শব্দটি শুনলে কটিদেশে দমকল প্রয়োজনীয়তা বোধ হতো। এটি অস্বীকার করবোই, এমন একটা স্টান্স নিয়ে ওপেন করতে নামতাম। আর বাংলাভাষার যে দুটি বিভাগ, একটি বলার ও আরেকটি বোলার, তার দ্বিতীয় অবতারটির মুখোমুখি হতাম। সৌভাগ্যবশতঃ (আগে বহুবার বলেছি, পুনরাবৃত্তি মার্জনীয়) ল্যাটারাল থিংকিং-এর অভ্যেসটি ছিল আর মাথার ভেতরের জমির আকাশছোঁয়া দাম বলে ওখানে তৈরি বাড়িটিতে ভিত ছাড়া দেওয়াল বা ছাদ কিছুই রাখিনি। এবং আরেকটি মূল্যবান কো-ইন্সিডেন্স যে, এই সময়েই কলিম খান আর রবি চক্রবর্তী তাঁদের মহাকান্ডটি ঘটাচ্ছিলেন। ফলে একদিন উপলব্ধি হলো যে, যেটিকে আমি আমার বাড়ি বলে ভাবতাম, সেটি একটি জলজ্যান্ত মহকুমা। যাকে আমি আমার জামা বলে ভাবতাম, সেটি একটি ফোর মেন টেন্ট... এরপর লেখা বদলাবে না তো অমিতাভ বচ্চনের উচ্চতা বদলাবে??!!



প্রসঙ্গতঃ আরো কয়েকটি শব্দার্থ থেকে নতুন কনসেপ্ট খুঁজে পাওয়ার উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। শুধু কয়েকটি বর্ণ ও উচ্চারণের ডিম ও সেই ডিমের পোচ থেকে মুর্গির মুর্গ মসল্লম রূপে জন্মগ্রহণ অকল্পনীয়।

কচু - কচ (…স্বত্বাধিকার)/ উ- নবরূপে উত্তীর্ণ যাহাতে (অশ্লীল পোস্টটিতে ছিল) অর্থাৎ যা কোনো প্রকার কচ্‌ বা মালিকানা/মূল্যায়ন উত্তীর্ণ/নেই।

(আমি একটিতেও অভিধানগত মানেটি বলবো না, কারণ আমি জানি আপনি তা অবগত। আমি এই ক্রিয়াভিত্তিক চিন্তাধারা দিয়ে শব্দের অর্থ বিস্তারটি, যা আমি করার চেষ্টা করেছ্‌ সেইটি বলে যাচ্ছি। শব্দের রাজত্ব কতদূর বিস্তৃত তা উপভোগ করুন)

ঘাগু - ঘা ক্রিয়াটি, উ - নবরূপে উত্তীর্ণ যাহাতে; মানে যে ঘা (পিটুনি) খাইয়াও থামে না,

নব নব রূপে চলাটি বজায় রাখে।(এই পোস্টটির লেখক খুদ)

তন্দ্রা - তন যাহাতে দ্রা। তন - তারী অনকৃত হওয়া বা সত্তার সচেতনতা (পাঠক ভেবে দেখুন তন যখন শরীর বা দেহ, তা কিন্তু সত্তার সচেতনতাকেই নির্দেশ করে, কতো গভীর ও ব্যাপক এই শব্দ-ধ্বনি সম্পর্ক), দ্রা- পলায়ন করে (মনে পড়ে দ্রাক্ষা ফল ও শৃগাল?)... অর্থাৎ "সত্তার সচেতনতা পলায়নরত" মানে সম্পূর্ণ পালায় নি। এবার এই কথাটি মনে রেখে ‘নিদ্রা’কে নিজে হাতুড়ি মেরে দেখুন।

ফোড়ন – ‘ফোড়’ (সংহত রূপ বিনষ্ট করা, এফোঁড়-ওফোঁড় জানা আছে) অন (চলমান) যাহাতে; অর্থাৎ যে কথার দ্বারা আলোচনা দ্বারা গড়ে ওঠা সংহতি নষ্ট করা হয়; কিংবা, যা দিয়ে ঘৃতে বা তেলে যে লঙ্কা তেজপাতা মৌরী ইত্যাদি দিয়ে পূর্বপ্রস্তুত সংহতি ভেঙে দেওয়া হয় এবং যার ফলে স্বভাবতই নতুন সংহতি গড়ে ওঠে।

এবং আখরী অনবদ্য

লা -

১) ল-এর (লেন-দেনের) আধার যে;

২) অথবা, লালিত হওয়া বা লালন করা চলে যাতে;

৩) কিংবা, যে (অন্যকে লালনের জন্য) দান করে বা (নিজেকে লালনের জন্য) গ্রহণ করে

৪) লইবার বা লয় করিবার আধার যে।

এবার উপসর্গ যোগে

-লা : (যেহেতু প্রত্যেক মানুষই দানকারী বা গ্রহণকারী হতে পারেন, গ্রামবাংলায় সে কারণে অন্যদের সম্বোধন করেন-) হ্যা-লা, কী-লা… ইত্যাদি। অর্থাৎ হে দানকারিণী, হে গ্রহণকারিণী।

লো - ল-এর (অবলালিত থেকে অতিলালিত অবধি সর্বপ্রকার লালনের) সার্বিক আধার যে

অথবা, মনের সার্বিক বাহক যে;

কিংবা, যে সত্তা বিন্দু হইতে সিন্ধু অবধি কিছু না কিছু বহন করে নিয়ে যাচ্ছে বা মানেবাহক।(‘লোক’ শব্দটিকে নিজে ভেঙে দেখুন, মানেবাহকের কাজ করে যে। এর থেকে অপূর্ব কোনো সংজ্ঞা হয় ‘লোক’ বা ‘মানুষের’)

এবার উপসর্গ যোগে

-লো : (মানুষ মনপ্রধান প্রাণী, প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা তা জানতেন। অন্যেরা সেই উত্তরাধিকার অনেকখানি বিস্মৃত হলেও গ্রামবাংলায় আজও সেই উত্তরাধিকার বহন করেন। তাঁরা অন্যদের সম্বোধন করেন-) ও-লো, অর্থাৎ, ‘হে মনিনী বা মনোবহনকারিণী!’ □ওলো, হ্যাঁলো, কীলো, হ্যালো (hallo)

(একটা ছোট্ট ল এ ও-কারের মধ্যে কত কিছু আছে! কবে থেকে জানেন বা শুনেছেন ও-লো, ইত্যাদি। কখনো ভেবেছন ‘গো’ এর বদলে ‘লো’ কেন ব্যবহার করা হয়)



আগে একটি পোস্টে বলেছিলাম “ইজ্‌ম ইজ ডেড”... শেষ যে ইজ্‌ম রাজত্ব করে গেছে তা আমার নাম দেওয়া, ইজমিজম... গুগল রাজত্ব শুরু হওয়ার পরে জ্ঞান থেকে ইনফর্মেশান ও তার সহজলভ্যতা একেকটি মানুষের নিজস্ব ইজ্‌ম তৈরি করে দিয়েছে... সেই ভ্যাকুয়ামে ইজমিক রাইটিং সহ আর যা যা এসেছে তার পূর্ণ সদব্যবহার করার জন্য ক্রিয়াভিত্তিক পদ্ধতিতে ভাবা, পড়া ও লেখা অত্যন্ত জরুরী...



(কৃতজ্ঞতা স্বীকার - কলিম খান / রবি চক্রবর্তী)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন