গখ ও গঁগ্যা : একটি আততায়ী আত্মীয়তা
ছবিটা ছিল একটা কাঠের আর্মচেয়ারের। বাদামি আর গাঢ় লাল। সবুজ খড়ের বসার জায়গায় লোকটি নেই শুধু। লোকটির থাকার কথা ছিল অথচ লোকটি নেই, আর তার অনুপস্থি্তির জায়গায় বসানো মোমদানে একটি মোমবাতি; পাশে কয়েকটি জেগে থাকা উপন্যাস। শূন্যতা সুস্পষ্ট অথচ আলোয় কি দেখানো হলো রিক্ত প্রখর এক শুন্যতার মাঝেও কোনো এক প্রাণ ও প্রজ্ঞার আশ্চর্য সমুচ্চয়! ১৮৮৮তে ভান গখ এমনই একটি ছবি এঁকেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘গঁগ্যাস আর্মচেয়ার’। স্যাঁ রেমির উন্মাদআশ্রম থেকে অসুস্থ নিঃসঙ্গ গখ আলব্যের অ্যরিয়েরককে চিঠিতে লিখেছিলেন --“গঁগ্যা, সে এক বিচিত্র শিল্পী, এক আশ্চর্য মানুষ, যার চেহারা আর চালচলন দেখলে গালেরি লাকাজ-এ রেমব্রান্টের ‘পোর্ট্রেট অফ আ ম্যান’এর কথা আবছা মনে পড়ে। সে এক অদ্ভুত বন্ধু, যে অন্যদের এই কথা অনুভব করাতে চায় যে, একটা ভালো ছবি আর একটা মানবিক সুকৃতি প্রায় সমার্থক। এ যে শুধু মুখের কথা তা নয়, বস্তুত তার সঙ্গে থাকলে এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে উদাসীন থাকা অসম্ভব।… আমাদের বিচ্ছেদ ঘটার কিছু দিন আগে, যখন অসুস্থতার কারণে আমি উন্মাদাশ্রমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম ওর ‘শূন্যস্থান’টা আঁকার”। এ কোন শূণ্যস্থান? একজন শিল্পীর ফেলে রাখা অনুভূতি ও জীবন, নাকি অন্যজনের খুঁজে না পাওয়া আত্মসমীক্ষণ! গঁগ্যার ছেড়ে যাওয়া চেয়ার আঁকার মধ্য দিয়ে আমরা জানি না নিজেরই রক্তপাত মোছার চেষ্টা করলেন কিনা গখ, কিন্তু এ যেন চেনা অচেনার মধ্যে দিয়েও আমাদের নিয়ে চলল শিল্পীর ভেতরের জীবনের দিকে, বিশাল এক প্যারাডক্সের দিকে, হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকা অ্যান্টিক এক আঁধার-মানুষের দিকে। মানুষের মন - সে সীমিত নয় বরং স্বচ্ছন্দচারী, দর্পনের মতো সে নিজেকেই পড়তে চায় বারবার আর প্রতি মুহূর্তেই আঁকড়ে ধর আরো কিছু কুয়াশাময় মানুষের হাত পা তথ্যচিত্র। আর গখের মতো শিল্পী হলে তো কথাই নেই, যিনি জন্মের মুহূর্ত থেকে তীব্র চিৎকার করে উঠছেন বঞ্চিত পৃথিবীর দিকে, একজন শিল্পী যেন গতজন্মের রাস্তায় এসে পড়ছেন আর সেখান থেকে বর্হিগমণের পথ খুঁজে চলেছেন। যতক্ষণ এই খোঁজ ততক্ষণই সে এক জীবিত রহস্য। এক অরচিত ফর্মূলা। শিল্পী শিল্পীকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আবার কালো গর্তে ফেলে দিয়ে নিজেকেই হাত ধরে টেনে তুলতে চায় শিল্পী। এই অতীন্দ্রীয় রহস্যময় এলাকাই তার নিজস্ব মুক্ত এলাকা। এখানে এসে সে পাগল, সে প্যারানইয়াক, সে পর্যটক। শিল্পী আসলে এক ‘ইমমর্টাল বার্ড’ যার কাছে কোনো রওনা নেই, কেবল অপর্যাপ্ত এক রানওয়ে আছে, সেখানে দৌড় জন্মাচ্ছে উড়ন জন্মাচ্ছে। গা ঘেঁষটে শুয়ে আছে একটা ‘নেই’ জগত। জীবন ও মৃত্যুর পাঁজর ফাটানো আঁশটে ‘আছে’ গন্ধের মধ্যে এই ‘নেই’ যেন স্পষ্ট করে তুলছে শিল্পীর ক্রমবিবর্তনকে, প্রকট করে তুলছে নিজেকে ঘিরে নিজেরই নৈঃশব্দ পাহারাকে। ১৮৮৯এ আরও একটা শূন্য চেয়ার আঁকলেন গখ। তবে এবার বিন্যাসে বর্ণে কিছুটা মলিন ও নির্লিপ্ততা। নাম দিলেন ‘ভিনসেন্ট চেয়ার উইথ হিজ পাইপ’। কেবল আঙ্গিক আলাদা। তেরছা সীমিত আলোময় বাদামী টাইলসের ওপর হলুদ রঙের চেয়ার। সামান্য কাঠের এবং মোটা হাতলের। ছোট্ট রান্নাঘর আর তার নীল ভঙ্গুর দরজার সামনে রাখা সামান্য চেয়ারে কিছু ধূসর কোঁচকানো তামাকপাতা আর একটি ধূলো রঙের নীরব পাইপ। ছবিটার সারা শরীরে দূরবীন কষে কোনো নিরীক্ষা নেই কোনো গথিক কারুকাজ নেই, কেবল খুব তাড়াতাড়ি রং ঢেলে দেওয়ার নিঃশব্দ তর্জনী। কি আঁকতে চাইলেন গখ? অস্বীকার করতে চাইলেন কোনো একটা স্থানের শূন্যতাকে, নাকি ভরাতে চাইলেন মিথ্যে আরও একটা মিথ্যে ভরের বিলাস দিয়ে, আর্তি দিয়ে? আসলে ক্ষুধা দারিদ্র্য ব্যর্থতার মতো একাধিক শূন্যের ওজনে গখের শিরদাঁড়া কোথাও আগেই ভেঙে গেছিল, তিনি রং দিয়ে ভরাট করতে চাইছিলেন দোসরশূন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। জীবনের শেষ দিন অবধি গঁগ্যাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন গখ, হয়তো কাউকে বলেননি, হয়তো সূর্যমুখী আর সাইপ্রেস দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন তাঁর যন্ত্রণা তাঁর বিচ্ছিন্নতার কাহিনী। কেবলই কি বিচ্ছিন্নতার নাকি শিল্পীর অন্তর্লীন একাকীত্বের কাহিনীও? আর্লে গঁগ্যার সাথে গখের মাত্র আট সপ্তাহের যে নিরুপম প্রেম ও পুড়ে যাওয়া তার শুরু শিল্পের জন্য স্বপ্নের জন্য তাঁদের যৌথ বানানো হলুদ বাড়ি(yellow house)র মিলিত আনন্দ দিয়ে, আর তার সরকারী পরিসমাপ্তি বলতে গখের কান কেটে ফেলা এবং স্যাঁ রেমির অ্যাসাইলমে দাখিলার মতো মলিন দীনতা দিয়ে। কিন্তু পরিসমাপ্তিই বা বলি কী করে? বন্ধুত্বে ছেদ পড়লেও জীবনের শেষদিন অবধি গঁগ্যার শিল্পভাবনাকে আন্তরিক স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন ভিনসেন্ট। অ্যাসাইলামে থেকেও ভাই থিওর মাধ্যমে গঁগ্যার ছবি নিয়ে চিত্রকল্প নিয়ে বিচলিত থেকেছেন। ভ্যান গখের নাকি মানসিক অস্থিরতা ছিল, ডিপ্রেশন ছিল, আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন একাধিকবার। কিন্তু কেন? আসলে গখের জীবন সরলরখায় মেলানো সম্ভবপর নয়। তার জীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একাধিক মানুষ যাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গখ ভারসাম্য খুঁজেছেন আশ্রয় খুঁজেছেন আর বারবার প্রত্যাখাত হয়েছেন কালো অন্ধকার প্লাস্টারে ঢাকা এই পৃথিবীর কাছে। সংসারে থেকেও হয়ে উঠেছেন অন্ত্যেবাসী। জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল নরম ডালের মতো, যা জানতেন না তা হলো ডাল ভাঙলে সাদা কষও বেরোবে। না হলে তিনি গৃহকর্ত্রী কন্যা উশুলের প্রেমে কেন পড়বেন? যে প্রেম উদাসীন, অপাংক্তেয়, বাতিল। কেনই বা সদ্য বিধবা সম্পর্কিত বোন কীভোসকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন, যা সে মুহূর্তে চূড়ান্ত ছেলেমানুষি! আর কেনই বা গখ গঁগ্যাকে তাঁর নির্বান্ধব আত্মানুসন্ধানের নায়ক করে তুলবেন মাত্র কয়েক মাসে! বোঝা যায় না যাপনের অফুরান সমারোহে শুকিয়ে আসা রক্তের দাগটা ঠিক কোথায়! জীবন আসলে এক ফাঁকা মাঠ, সেখানে হিম পড়ে যাবেই, পাখিরা তুলে নিয়ে যাবে প্রকৃত শস্য। কাঁটালতা জড়িয়ে ধরবে জীবনের ঐশী সংগীতগুলোকে। অথচ পূর্ণাঙ্গ জীবনের খোঁজে প্রতিদ্বেষ রেখে দিয়ে হাড় রাস্তার দূরত্বে হাতগুলো আমরা আবার জড়িয়ে ধরব। মিথ্যে, মিথ্যে জেনেও এই অনেকটা জায়গা আমাদের আত্মসমর্পণের, সম্ভাব্য অনেকটা অধরার। প্রায় একই সময় একই শিল্পীর আঁকা ছবি দুটোকে পাশাপাশি রাখলে অর্থাৎ ‘ভিনসেন্ট চেয়ার”কে বাঁদিকে আর ‘গঁগ্যাস চেয়ার’কে ডানদিকে রাখলে সম্পূর্ণ ফ্রেমে ভেসে ওঠে মুখোমুখি বসে থাকা সাবধানী স্নেহের সংকেত, যেন নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে একগোছা সখ্যতা। অথচ এই একই ছবি কেবল দিক বদল করে দিলেই(অর্থাৎ ‘গঁগ্যাস চেয়ার’কে বাঁদিকে আর ‘ভিনসেন্ট চেয়ার’কে ডানদিকে) মনে হবে এ ছবি কি তবে পলায়নের ভূমি? স্বপ্ন থেকে সখ্য থেকে বোধ থেকে বেড়া থেকে রোজ রোজ নিজেকে নির্বাসিত করার ভয়ংকর ভাঙা দেওয়াল! বাঁদিকে ‘গঁগ্যাস চেয়ার’ ও ডানদিকে ‘ভিনসেন্ট চেয়ার’ রাখলে আশ্চর্যভাবে ভেসে উঠবে একটি নিঁখুত বন্ধুত্বের ধীর মৃত্যু, একটি দেহাতি আত্মহত্যা, সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত, ঠিক যেমন অ্যবের-এর কাছে শালগম আর সাইপ্রেসের কোনো সাহজিক গাঁয়ে খড়ের গাদায় ঠেস দিয়ে ইজেল রেখে বুলেট শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন গখ, ঠিক যেমন হৃৎপিন্ড থেকে সাঁতার কেটে বেরিয়ে গেল হেরে যাওয়া এক মানুষের সামগ্রিক গাঁথুনি, মশলা, সিঁথি কেটে আছড়ানো বন্ধুত্ব কবুল করতে করতে উড়ে গেল আর বলে গেল তুমি একা, একা, স্বেচ্ছানিবার্সিত, এক জীবন থেকে আরেক জীবন ধরে চিরবন্ধুর মিলনে অপারগ।
অ্যারিস্টটল থেকে দেরিদা, অথবা
রবীন্দ্রনাথ থেকে আয়ুব-সখ্যতা প্রসঙ্গে বন্ধুতা প্রসঙ্গে চূড়ান্ত
শান্তির পাশাপাশি আলোচিত হয়েছে অন্তঃর্নিসহয়তার কথাও। একদিকে দেরিদাকে
বলতে শুনি-“O my friend, there
is no friend”, আবার অন্যদিকে গালিব বলে ওঠেন-“লমহা লমহা করকে জিন্দেগী বানায়ি/জিন্দেগী বানায়ি তো দোস্তি কি ইয়াদ আয়ি/দোস্তি কো ঢুন্ডা
তো তুমকো পায়া-এ-দোস্ত/অউর তব সে ইয়ে জিন্দেগী তুঝমে সিমট গায়ি/” -যেন বেড়ার গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে বন্ধুত্বের হাতছানি। কিন্তু বন্ধুত্ব
কি! কোথায় বা লেগে থাকে এমন এক বেকুব ভাষা, এমন এক বৃহৎ
জিজ্ঞাসা! শিল্পী বরাবরই অভিমানী, আত্মবোধে কিছুটা হলেও অহংকারীও। ফলে শিল্পের বন্ধ্যা কালিকে পেরিয়ে আসতে যেমন তার বন্ধু হয়, তেমনি তার স্বাধিকার কখনও কখনও অতিক্রম করে সখ্যতার সান্নিধ্য। শরীর তো একই থাকে। চোখ দিয়ে দেখে বাক দিয়ে কথা কয় কান দিয়ে শোনে, তবে কোন্ দাবীতে গোঁসা করে ঝুঁটি নাড়াতে নাড়াতে বন্ধু ফিরে যায়? যে নিঃসঙ্গ শরীর শাশ্বত সখ্যের কথা বলে, সেই আবার স্বাতন্ত্র্যময় হতে চায়। অ্যারিস্টটলের ‘Nicomachean Ethics’ যে তিন রকমের সখ্যতার কথা বলে, অর্থাৎ
প্রয়োজনের বন্ধু, সখের বন্ধু আর প্রকৃত ভালোবাসার বন্ধু – তাদের শরীরী ভাষা
পৃথক এবং মানসিক পিপাসাও পৃথক। আর তিন বন্ধুতার শুরুয়াৎও পৃথক। আর্লে গখ
এসেছিলেন শিল্পের নতুনের খোঁজে। চেয়েছিলেন নিভৃতে শিল্পচর্চার জন্য সমমনোভাবাপন্ন আরও কিছু
সখ্য বন্ধু, বাঁচার পরিসরটিকে তীব্রভাবে সুস্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন গখ আর সেখানে তাঁর ও ভাই
থিওর বন্ধু গঁগ্যা হয়ে উঠেছিলেন সেই সুবিবেচিত কান্ডারী। যার সাথে দ্বিধা
ও সংকোচ পেরিয়ে মনের কথা বলা যায়, ইম্প্রেশনিস্ট
শিল্পের উৎস থেকে বুৎপন্নে পৌঁছানো যায়। দিনের পর দিন গঁগ্যার সান্নিধ্যে নিজেকে
খুঁজেছেন গখ, তাঁদের ‘হলুদ বাড়ি’তে মদ্যপান করেছেন দুজনে একসাথে, রঙ আর প্যালেটে নিজেকে নিজের সৃজনী
অনুভূতিকে গুলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের যাবতীয় সম্পর্কেই এমন কিছু সুগভীর লেগে থাকে, যা এক থেকে তাকে বয়ে নিয়ে চলে সফেন বহুধায়। শিল্পের লালা
দিয়ে জুড়তে চাওয়া সম্পর্ক গখকে ছেড়ে দিয়ে গেল সখ্যতার গভীর বনে। অথচ গঁগ্যা
কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন ইম্প্রেশনিজমে তাঁর মৌলিক শিল্প প্রতিষ্ঠিত নয়, শিল্পী এমিল বার্ণাডের সংস্পর্শ তাকে শিল্পের আরও সরলীকৃত স্বরূপটির দিকে নিয়ে
চলে; বস্তুকে বস্তুর বাইরে ছবিকে ছায়ার বাইরে নিয়ে আসাতেই পথ খুঁজে পায় তাঁর মুক্তির
উল্লাস। তিনি আকারের বাইরে বেরোতে চাইলেন রঙ-এর নিটোল শরীরের বাইরে। গখের ‘সানফ্লাওয়ার’-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন গঁগ্যা, এমনকি মানের সানফ্লাওয়ারের
থেকেও কিছুটা এগিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বারংবার ছবিতে ছবির উপস্থিতি তিনি মানতে পারেননি, গখের তুলিকে তিনি চাইছিলেন প্রতীকের
বাইরে অপেক্ষারত আরও কিছু একটা প্রতিন্যাসের ভূমিকা হিসেবে দেখতে, আরও কিছুটা বেহিসেবী কল্পনায় বোনা। কিন্তু গখ ছবিতে অস্তিত্বের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আকাশকে আকাশের
রঙে গমখেতকে গমখেতের রঙে নির্বাচনই ছিল তাঁর ছবির ঘরানা। ‘হলুদ বাড়ি’ থেকে গঁগ্যার বেরিয়ে আসার আগে ভাই থিওকে লেখা গখের একটি
চিঠিই যথেষ্ট প্রামাণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যেখানে গঁগ্যার
শিক্ষকতায় ব্যক্তিসত্তায় কীভাবে আত্মস্থ হয়ে উঠছিলেন গখ, আবার সাথে সাথে সম্পূর্ণ সহমতও হয়ে উঠতে পারছিলেন, না মেনে নিতে পারছিলেন না প্রতীকিনির্ভর চক্ষুগ্রাহ্য রূপকল্পের বাইরের সবটুক নির্যাস।–“ Gauguin has brought me to see
that it’s about time I varied my work… Now I work from memory. Gauguin gives me courage to use my
imagination, and it’s true enough that paintings
of this kind have something mysterious about them… Gauguin and Bernard don’t ask what
the exact shape of a tree is, but
they do insist that one should be clear whether the shape is round or square, and
they’re right. They are fed up with the photographic but empty perfection of
certain painters. They don’t ask what the exact shade of the mountains is-they
say, ‘By God, the mountains were blue, weren’t they? All right, then chuck on
some blue and don’t bother to tell me that the blue was rather like this or
that. Make the mountains blue and that’s enough….” ‘গঁগ্যাস চেয়ার’ ও ‘ভিনসেন্ট চেয়ার’ এর দিকে লক্ষ্য করলেও দেখা যাবে, কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই রং তুলির টান এবং ফর্মে পার্থক্য রেখেছেন গখ, দুটি মানুষের দুটি শিল্পীর ব্যক্তিত্বের পার্থক্য বোঝাতেই কি? ‘গঁগ্যাস চেয়ারে’ রয়েছে পারফেকশন, ভিরিলিটি, স্ট্রেন্থ আর ফ্ল্যাশিনেশ যেখানে ‘ভিনসেন্ট চেয়ার’ সাদামাটা অনুজ্জ্বল যেন এক সামান্য ছাত্র তাঁর দীর্ঘদেহী শিক্ষকের নাগাল পেতে
ডুবসাঁতার কাটছে উচ্চতার সামনে। গখের কিছু ছবিতে প্রতীকি ব্যাখ্যা ছবির ওয়াইড
স্প্রেক্ট্রাম জুড়ে রয়ে গেছে। যেমন ‘Still
life with the bible’-যা ১৮৮৫তে বাবার মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরেই আঁকা। বিশেষ করে
ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠায় শেষের দিকে বাবার সাথে তাঁর
মানসিক বিরোধ চরমে পৌঁছয়; ছবিতে বাইবেল গ্রন্থটি রূপকার্থে আসলে তাঁর বাবা এবং বাবার ব্যক্তি
স্বাতন্ত্র্যকে রিপ্রেজেন্ট করছে, আর তার পাশে থাকা ছোট
হলুদ বইটা যা কিনা জোলার ‘La
Joie de Vivre’ বারবার বাইবেলকে অমান্য
করার অনুকৃতি হয়ে উঠছে, উঠছে ভিনসেন্টের স্বরূপ। একইভাবে ভিনসেন্টের আঁকা চেয়ার দুটিও কোথাও যেন বন্ধুত্বের
পাশাপাশি দুটো স্বতন্ত্র্ ব্যক্তিত্বকে বেছে নিয়েছে, যেখানে বন্ধুতাও স্বতন্ত্র, বিনিময়ের
ট্রাপিজের খেলা শেষ হলে রেশনাল শব্দটাকে যেখানে হয়তো শেষমেশ চয়েস
করা যায় না।
‘হলুদ বাড়ি’তে তাঁদের দ্বৈত যাপনের প্রথম ক-মাস ভাই থিওকে লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কতটা স্বতঃস্ফূর্ত সঙ্গময় ছিলেন গখ। সেসময়কার
প্রতিটা চিঠিই যেন গঁগ্যা নামের একটি মুখের সমগ্রতায় ভরপুর। কীভাবে
আঙুরখেতের মেয়েদের তিনি আঁকেন, কিংবা ধোপার
মেয়েদের আঁকতে তাঁর তুলিরা রঙের মাঝে খুঁজে নেয় নিঃশব্দ বিরল। আগামী ছ’মাসের মধ্যেই ‘হলুদ বাড়ি’তে তাঁদের স্বপ্নের স্টুডিও নিয়ে তীব্র আশাবাদীও ছিলেন গখ। আজীবন আপসহীন
প্রতিবাদী গখ জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিলেন, ইন্ধন খুঁজে
পেয়েছিলেন নতুন সৃজনীর। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাদেই যে গঁগ্যার সাথে তাঁর ঐতিহাসিক
মনোমালিন্য, রক্তিম বিচ্ছেদ হতে চলেছে, সেই গঁগ্যাকেই তিনি বিশ্বাসের
দোহাট দরজা খুলে দিয়েছেন, উল্লেখ করেছেন- “Gauguin, a very great artist and
a friend in a million… a very, very interesting man, and
I’m sure that with him about we shall do heaps of good things”। গঁগ্যার প্রতি
গখের ছিল একজাতীয় অন্ধ হিরো-ওরসিপ। গখ তাঁর অন্ধ চোখ দিয়ে হড়হড়ে শীতলতায় খুঁজে ফিরছিলেন সপ্রাণ
বন্ধু। অথচ এ যে শীতল স্বর্গ, দুবোর্ধ্য পচা মাংসে ভরা মানুষের
নির্মোহ অনুসন্ধান শুধু; শুরু হলো প্রিন্সিপালস আর পেনটিংস নিয়ে তাঁদের অসহিষ্ণুতা আর ধৈর্যহীনতার আঁশটে
অধ্যায়। ছবির ফর্ম নিয়ে ধারাবাহিক মতান্তর গঁগ্যাকেও
কোথাও তিতিবিরক্ত করে তুলেছিল ভিনসেন্টের মানসিক অস্থিরতা আর নিতান্ত শিশুর
মতো তাঁর নিজস্ব সৃজনাবেগের কাছে। গখ খুঁজছিলেন বেড়া আর গঁগ্যা একটা চওড়া বারান্দা। গখ ধরা পড়তে
চাইছিলেন সামান্য আলোর বিনিময়ে যেখানে গঁগ্যার উদ্দাম জীবন আলো থেকে ছিটকে যেতে
অভ্যস্ত ছিল নতুন আলোর দিকে। ছোটোবেলা থেকে সঙ্গবিমুখতা গখের চেতনায় ইন্ধন যুগিয়েছিল
প্রবল মানসিক বৈকল্যের, যা প্রায়শঃই ধ্বংসের কিনারা পর্যন্ত
পৌঁছে দিত গখকে। জান্তব অভিমানে একাধিকবার গঁগ্যার প্রতি সশস্ত্র প্রতিবাদে সামিল হওয়ায় বন্ধু
থিওকে গঁগ্যা লিখে ছিলেন– ভিনসেন্ট তাঁর খুব প্রিয় এবং তাঁর শিল্পের প্রতিও তিনি সমান সশ্রদ্ধ, কিন্তু তাদের মানসিক দলিল কোনোভাবেই একে অপরের পরিপূরক নয় এবং থিও
যেন তাঁর প্যারিসে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়।
জীবনের মাঝে দরজা খোলাই থাকে। অনুভবের বধিরতা আর শূন্যতা শুধু আমাদের এগিয়ে দেয় বিচ্ছেদের
মতো এক দূরারোগ্য অসুখের দিকে। প্রতিদিনই আমরা অপেক্ষা করি কিছু স্থুল আশাবাদ নিয়ে, যেন এক ঝটকায়
সব ঠিক হয়ে যাবে, চূর্ণ বিচূর্ণ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। অথচ হয় না। দুটি ফুল দুটি
পাতা যেমন কেবল মাথা ছুঁয়ে মিলিয়ে দেয় তাদের রেণু আর ফল পাড়তে
গিয়ে মিশে যায় বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভবঘুরে ফুসফুসে, সম্পর্কও ঠিক তেমন, কোথাও কেবল চেনা মানুষ চেনা ছবির মাঝে ছেড়ে যায় উড়ে যাওয়ার বিন্যাস। এ এক ভৌতিক নেশা। ভূগোলের মাঝেই বন্ধুত্বের মতো কিছু একটা মৌলিক সেঁধিয়ে আছে ক্ষুধা তৃষ্ণার মতো যৌগিক হয়ে। বেড়ে আরও বেড়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। আর আমরা বুঝতে
পারছি চলে এসেছি, দূর, এতদূর, যোগ আর বিয়োগের থেকে কেবল ফলাফলে ফসিলে হয়ে উঠেছি একটিমাত্র স্মৃতি। সম্পর্কের
স্মৃতি। গঁগ্যাও নাগরিক হট্টগোল থেকে পালাতে চাইলেন আত্মবৃত নির্জনতায়। রুদ্ধদ্বার থেকে
উড়ে যেতে চাইলেন নির্ভার সাঁতারের দিকে। সিদ্ধান্ত নিলেন প্যারিসে চলে যাওয়ার। এবং বন্ধুত্বের
ওপর মুহূর্তেই নেমে এলো সদ্য আবিষ্কৃত বিরাগের এক নতুন মুখ।
এই অনাবিষ্কারও কি সখ্যতা? যেখানে নিরুপায়
শিল্পী কেবলমাত্র একটি মানুষকে ধরে একটি স্বল্পস্থায়ী মানবিক ধারণাকে ধরে বাঁচতে চাইছে, তর্কাতীত এক ‘আমি’কে অনুমান করতে চাইছে, আত্মগুপ্তির
অসহয়তার তার একান্ত আশ্রয়ের পথটা খুঁজে পেতে চাইছে! শেষমেশ ২৩ শে ডিসেম্বর ১৯৮৮, গঁগ্যা তাঁর ‘হলুদ বাড়ি’ ছেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিলেন ভিনসেন্টকে। নিজের ছায়ায়
দাঁড়িয়ে থাকা এক পতনশীল মানুষ শূন্যতাকে বাজিয়ে বাজিয়ে কী বলতে পারত সে মুহূর্তে? রক্তমাংসের জন্য প্রার্থনা করতে পারত? একরকম অনন্ত জেগে থাকার ভেতর হাত দুলিয়ে দুলিয়ে দেখাতে পারত
হেরে যাওয়া সীসার শরীর থেকে কীভাবে গড়িয়ে আসছে রক্ত! যে রক্ত বইছে যে রক্ত বহন করা যাচ্ছে না যে রক্ত
বনগর্ভের আঁধার নিয়ে বিনীতভাবে নিজ হাতে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে
সম্পর্কের প্রতিটা ঘরের! সে সব মুহূর্ত সত্যিই কি গখ দেখাতে পারত যাপনের মধ্যবর্তী শূন্যতাগুলো, স্বপ্নদের হারিয়ে যাওয়াগুলো! নাকি স্রেফ
যন্ত্রণা পেরিয়ে যেতে যেতে অসহায় নিরুত্তাপ গলা
শান্তভাবে ঢেলে দিত -
“I
heard the roar of a wave that could drown the whole world
I heard one hundred drummers whose hands were a-blazing
I heard ten thousand whispering and nobody listening
I heard one person starve, I heard many people laughing
Heard the song of a poet who died in the gutter
Heard the sound of a clown who cried in the alley
And it's a hard, it's a hard, it's a hard, it's a hard
And it's a hard rain's a-gonna fall…”
না এসব বৃষ্টি দেখা যায় না, ধরা যায় না পলকা জালে। ক্ষণকালের মাঝে আমরা ফাঁক
করে দেখি জল-জল-জলের ভাষা নিয়েই ভেসে চলেছি মানুষের মতো প্রান্তীয় পাখিরা। গঁগ্যার চলে যাওয়ার মুহূর্তে বিশেষ কিছুই
করেননি গখ, হয়তো রাগে হতাশায় কিছু করারও ছিল না। কেবল সামনে পড়ে থাকা প্রাত্যহিক খবরের কাগজ থেকে একটি টুকরো
কেটে ধরিয়ে দিয়েছিলেন গঁগ্যার হাতে। তাতে লেখা ছিল –“The Murderer Took flight”। এ কেমন আততায়ী? আসলে গঁগ্যা শব্দটির মধ্যে নিজেরই অচিরে ঢুকে পড়েছিলেন গখ, সে যেন বেঁচে থাকার এক বুঁদ, নতুনের এক চিলতে
রঙ। ‘হলুদ বাড়ি’তে বসে বসে সারাজীবন যে নতুনের খোঁজ করতে চেয়েছিলেন ভিনসেন্ট, তার স্থির স্তব্ধ অনড় দেওয়াল দরজা জানালায় ইজেলে অতিজীবিত আনন্দই ছিল গঁগ্যা। আসলে প্রয়োজনের সাথে গখের ভালোবাসা এখানে একাকার, প্রীতির সাথে একাকার সম্মোহ। গঁগ্যার পেছন পেছন দৌড়ে এসেছিলেন গখ, দৌড়ে এসেছিলেন সারাজীবনের এক দুর্বোধ্য স্বপ্ন দুর্বধ্য শ্বাসকষ্টের
পেছন পেছন। কিন্তু মৃত সম্পর্কের কাছে এ দৌড় যে
সামান্য এক ফাঁকির সমান! রাগে হতাশায় পাগল গখ নিজের কান কেটে উপহার দিয়েছিলেন
বারবনিতা Rachelকে। আসলে উপহার দিয়েছিলেন তাঁর নিজের ব্যর্থতা ,যন্ত্রণায় নুয়ে পড়া তাঁর অসহনীয় জীবনপিপাসাকে। ‘হলুদ বাড়ি’র বিছানায় অচৈতন্য গখের কান বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল লাল থকথকে
রক্ত, যা আসলে হয়তো রক্ত নয়, কেবলমাত্র অস্তিত্বের হেরে যাওয়া রোদ্দুর। গখের কান কাটা
নিয়ে শিল্পইতিহাস আর তাত্ত্বিকদের মধ্যে হাজার মতবিরোধ থাকলেও এবং গখের মানসিক
উন্মাদনাকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, যা বারবার অন্ধকারে থেকে গেছে তা হলো গখের নিজের
অস্তিত্বকেই আক্রমণের প্রশ্নটি। সম্পর্কের চোরাবালিতে একাধিকবার ডুবতে ডুবতে গখ কোথাও ভেসে
ওঠার প্রয়োজনীয়তাই হয়তো স্বীকার করতে চাননি, সহসা মুখগুলো
মানুষের উত্তাপগুলো তাঁর হাত পিছলে চলে যেতে যেতে
তাঁকে নিজের কাছে, সুস্থ জীবনের কাছে অপারগ প্রমাণ করে গেছিল। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে তিনি কোথাও নিজেকেই দায়ী করছিলেন
হয়তো, আত্মকেন্দ্রিক
গ্লানি থেকে প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন নিজেরই বিরুদ্ধে, শাস্তি দিতে চাইছিলেন স্ব-কে। গখের তীব্র ধর্মীয় চেতনাও হয়তো কিছুটা হলেও এক্ষেত্রে সজাগ। যিশুর প্রতি জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার পর যেমন মৌলিক পতনের
প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে রোমান সেনার কান কেটে নিয়েছিল পিটার, কিম্বা ১৮৮৮এর
ঘটনার কয়েকমাস আগেই জ্যাক দ্য রিপার যেমন কান কেটে নেন এক মহিলার, হয়তো তেমনই এক ভ্রষ্ট ধারণাকে পূর্বকৃত পাপের সাজা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন গখ। সর্বব্যাপী
যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে খুঁজে ফিরছিলেন আপতিত আলোর পথ, অথচ এ পথ নঞ্ছর্থক শূন্যের পথ। এ পথ সাদা নিস্তরঙ্গ চির নিভৃত অভিশাপের পথ।
ভিনসেন্ট গখের মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত শিল্পী জীবন আমাদের একাধিক
প্রশ্নের সন্মুখীন করে যায়। ঠিক কতখানি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন গখ? তাঁর মানসিক অস্থিরতাকে আমরা কি কেবল মনোবিকলনে আবদ্ধ রাখতে
পারি, নাকি তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর নতুনের খোঁজে ক্রমাগত পিষে
যাওয়া শিল্পীর অপ্রদর্শিত চেহারাটাও! গখ যেতে চেয়েছিলেন শিল্পের কেন্দ্র অব্দি, চোলাই হতে চেয়েছিলেন মৌলিক সৃষ্টির শরীরে ও মনে। ভাই থিওকে লেখা
অজস্র চিঠি তাঁর শৈল্পিক উদ্ভাসনকেই বারবার বাজিয়ে তোলে, বাজিয়ে তোলে অপ্রাপ্তি আত্মবিরোধিতা আর অতিক্রমের আসক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক
শিল্পীকে। জীবদ্দশায় যে একটিমাত্র ছবি ভিনসেন্টের
বিক্রী হয় তার নাম ‘রেড ভিনায়ার্ড’। কিনেছিলেন মিস
আন্না বোক। ক্রিমসন লাল আঙুর খেত, আর হলুদ সূর্য, দীর্ঘ ঘাসজমি পেরিয়ে ধূসর হয়ে যাচ্ছে মানুষের
গল্প। কেবল রাস্তা ফুরোচ্ছে না। গোটা ছবি জুড়ে ফেলে আসা একটা ভারী বাতাস যেন প্রতিনিয়ত জীবনব্যাপী এক দহনের সাথে
ভিনসেন্টের সহবাসের আদর্শ অবস্থাকেই চিহ্নিত করে যায়। ছবির জন্য
জীবনকে দাওয়ে লাগিয়েছিলেন তিনি। আত্মপ্রতিষ্ঠার সীমানা পেরিয়ে সেখানে কেবল এক দীক্ষিত
শিল্পীর আত্মহনন-ক্ষুধা দারিদ্র্য নিঃসঙ্গ লড়াইয়ের সাথে
সাথে প্রকৃতিকে মন্থন করতে চেয়েছিলেন গখ। আর হতাশ আর নিষ্ফলের মতো বারবার
মুখোমুখি হয়েছেন স্ববিরোধিতায়। জিংক হোয়াইট, কোবাল্ট, ম্যালকাইট গ্রিন, ক্রিমসন লেক, ক্রোম, এমারাল্ড গ্রিনের মতো একাধিক রঙের অভাবের
কথা ভাই থিওকে লিখলেও তাঁর ছবি ছিল জীবনের রঙে পরিপূর্ণ। সে এক মোটা রঙ, শুকিয়ে গেলে সেখানে আত্মনিরীক্ষিত শিল্পীর ধ্রুবপথটি, পরিক্রমিত ফসলটিই ভেসে ওঠে। বাহ্যাড়ম্বরের বাইরের শিল্পী গখ, যিনি বলেন-“I have a terrible lucidity at moments when nature is so
beautiful, I am not conscious of myself any more,and the pictures come to me as
if in a dream…
সত্যিই তো চেতনা থাকলে বারবার কেন বন্ধুত্ব? নাকি চেতনা আছে বলেই সখা আছে সখ্যতা আছে সখ্যচ্ছেদ আছে? সম্পর্কের ঠিক কোন্ ঘাসের বাগান জমি পেরোলে মানুষ একটি ঠান্ডা অনুভব পায়! কোন্ দিব্যতাময় নদীর বুকে ভাসিয়ে দিতে পারে বিচ্ছেদের বৃষ্টি! নাকি মেঘ থাকবেই ঘূর্ণি ধরে ধরে ঘাম ধরে ধরে কেবলমাত্র
বৃষ্টি আসবে বলে বন্ধু আসবে বলে নুন ধোবে বলে! জানি না ঠিক কোন্ প্রত্যাবর্তনের আশা থেকে গন্ধ শুঁকতে
শুঁকতে সন্ধিক্ষণের মানুষের হাত ধরে চলেছে এমন এক ফাঁসুড়ে অস্তিত্ব! যে অস্তিত্ব মৃত্যুর শেষদিন অবধি গঁগ্যাকে খোঁজায়, যে অস্তিত্ব গখকে
কোনোদিনও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না, যে অস্তিত্ব স্বপ্নময় মানুষকে বিশ্বাস করায় জড়জগতে সে একা নয়, আবার যে
অস্তিত্ব মাংসের ভেতরেও রেখে যায় মানুষটিকে একা। ২৭ জুলাই ১৮৯০-এ এক অসহনীয় নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে নিজেরই গুলিতে আত্মহত্যা করেন গখ। নিজেরই হাতে এক
অগ্রজ অন্ধকারের দিকে নিজের রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহকে উসকে দেওয়ার আগে ২৩ জুলাই
১৮৯০তে ভাই থিওকে লেখা তার শেষ চিঠিতেও গঁগ্যার প্রশংসায় আপ্লুত গখ লেখেন – “I noted with pleasure that the
Gauguin from Brittany I saw is very beautiful, and it seems to me that the
others he has done will probably be so as well.”…
রঙ এর মতো জীবনের রসায়ন আমরা কেই বা জানি! কেবল অনুসরণ
করতে পারি খুব লম্বা একটা সাইপ্রেস, হলুদ একটা ঘোড়ায়
টানায় গাড়ি কিংবা পুরনো আড়াআড়ি একটা মেঘের আনাগোনা। নতুন একটা রং
ততক্ষণ অবধি আবিষ্কার করতে পারব না যতক্ষণ অবধি সে জেগে থাকা মানুষকে ঘুমের আকার দিচ্ছে, যতক্ষণ অবধি না সে গুলিয়ে দিচ্ছে আলোর মাঝে জেগে থাকা সখ্যতার সম্পর্কের কিছু
স্টারি নাইট। কখনও কখনও মনে হয়, জীবনের সংশ্লেষণ সত্যিই বড় স্বল্পজলের পুকুর, ছিপ ফেললে ছিপছিপে এক ফালি আনন্দ উঠে আসে, অগাধ ওঠে না, ফাতনা ডুবে যায় ফুস করে আর জলের ওপরে অপেক্ষা করে ভুলযাত্রা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন