শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০১) সমীর রায়চৌধুরী ও নাসের হোসেন


কালিমাটি ১০০ সংখ্যা



ভূদেব ভকতের করা এমন রঙিন ব্রাশের স্ট্রোক আগে দেখিনি। কালিমাটি ১০০ সংখ্যার প্রচ্ছদে এই ছবি দেখে মন প্রাণ আনন্দে ভরে যায়। সম্পাদক কাজল সেনের লেখা সম্পাদকীয়র প্রথম প্যারাগ্রাফটি এখানে উদ্ধৃত করতে লোভ হচ্ছে –

‘কালিমাটি’র ১০০তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। এটা একটা ম্যাজিক সংখ্যা। একটা মাইলস্টোনও বলা যেতে পারে। এই ম্যাজিক সংখ্যা বা মাইলস্টোনকে ছুঁতে পঁয়ত্রিশটা বছর লেগে গেল আমাদের। সময়টা নেহাৎ কম নয়। ‘কালিমাটি’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩৮৬ সালের বৈশাখ মাসে। আজ পঁয়ত্রিশ বছর পিছিয়ে গিয়ে যখন সেই সংখ্যাটির পাতা ওল্টাই, তখন সত্যি সত্যি ভেবে আশ্চর্য হই, এটা কীভাবে সম্ভব হলো! স্বপ্ন দেখছি না তো! বহির্বঙ্গে বসবাস ক’রে, যেখানে প্রতিদিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বাংলা ভাষার প্রসার, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিকে সমানেই গুটিয়ে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে, ভাষা শিক্ষার অভাবে ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য পড়ার কোনো প্রস্তুতি নিতে পারছে না নতুন প্রজন্ম, সেখানে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের এত বছর ধরে বেঁচে থাকা, আমাদের মনেও এনে দেয় এক আশ্চর্য চমক, মুগ্ধতা। আমরা উপলব্ধি করি, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে আমরা কখনও বিচ্যুত হইনি। এবং সেইসঙ্গে আমরা চেষ্টা ক’রে এসেছি, ‘কালিমাটি’কে কীভাবে আরও মননশীল ক’রে তোলা যায়, কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায় বৃহত্তর বৃত্তের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে”।

প্রথমেই যে কবিতা, সেটি স্বদেশ সেনের। ‘দারুবসন্ত’ কবিতাটিতে মদ্যপানরত নাটুবুড়োর থলি ভরেনি, পাহাড় চেয়ে পাথরে মিটে গেছে সাধ এবং ধানজমিকে প্রণাম, “সস্তায় গান বাজছে বাহারে”। প্রভাত চক্রবর্তীর ‘দ্রোহ’ কবিতায় “মরশুমি হাওয়ায় মাথা নাড়ে সবুজ পাতারা / - চলবে না, চলবে না”। ভূমেন্দ্র গুহ’র ‘তিন বার’ কবিতাটিতে “অভিশপ্ত শরীরের অভিশাপ শোক হচ্ছে আগুনের পবিত্র নির্মোকে”। সুবীর সরকার তাঁর ‘আখ্যান’ কবিতায় লিখেছেন – “রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিদের ডানার নিচে কাচপোকা, ফড়িং”। বারীন ঘোষালের ‘তরীভাস’ কবিতায় – “মানুষমারা জঙ্গলের ওপর দিয়ে / বিলিয়ে মধুবিষের স্মৃতি / মৌমাছির ডেডবডি দেখে মনে পড়ে গেল”। সুকুমার চৌধুরীর ‘মহিমা’ কবিতায় – “কাদাবিছানায় পদ্মকে প্রতিষ্ঠা করে / সে কোন্‌ মুক্তির কথা বলে?” অনিন্দ্য ঘোষের ‘অন্ধকারে আগ্নেয়’ – “দেখেছি এক শীর্ণ কিশোর মৎসকন্যার সমাধিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে জলের অন্ধকার...”। রত্নদীপা দে ঘোষের ‘কবিতাওয়ালা’য় – “একটি গাছ যেন উপরে ফেলে দিল চুনরির গায়ে স্টেপল করা হাজারখানেক উশ্রী। পাঠক ভুল বুঝবেন না। উশ্রী নদী নয় কোনো, শিরীষের সালোয়ারে অন্য কামিজের ঘোরানো সিঁড়ি...”। দেবযানী বসুর ‘ইউবাঁক’ শীর্ষক প্রথম কবিতায় – “ঢিপিরা অনাথ... চিরকাল ন্যাড়ামাথা”। দ্বিতীয় কবিতায় – “আমরা কেউ কেউ নন্দনের মুক্তপীঠে ছড়ানো চায়ের ভাঁড়”। অলোক বিশ্বাসের ‘সম্পর্ক’ কবিতায় – “ট্রলারগুলো ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে নার্ভ সিস্টেম ও উচ্চফলনশীল ফসলের সম্পর্ক রচিত হয়”। তন্ময় ভট্টাচার্যের ‘বিপন্ন সভ্যতা’ – “সেই বিংশ শতাব্দীর বর্ষাতি, সেই / সভ্যতার ছাউনির তলায় হয়েছিল / আমাদের প্রথম সহবাস”। সাঁঝবাতির কবিতা ‘দহনের দিন’ – “চুম্বন দূরত্ব জমে থাকে তোর / ঠোঁটের ওপর। নরম ঘাম”। দেবরাজ চক্রবর্তীর ‘মানুষ পাখির মতোন উড়তে পারে না’ কবিতাটিতে – “পুরুষদের দল, সন্তানের গালে চুমু খেয়ে / লাল বাতিওয়ালা কোনো বাড়িতে ঢুকে পড়ে”। রমিত দে’র ‘অনুসরণ’ কবিতা – “এ পর্যন্ত জেনেই লাফিয়ে ধানক্ষেতে নামলাম / এখন আমরা দেখব কেঁচোর দেহে মাটি কেমন ঘুমোয়”। রঞ্জন মৈত্রর ‘মেসেজ’ – “আর পথগুলি ওহো বৃষ্টি নোকিয়া”। দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর ‘দৃষ্টিবিভ্রম’ শীর্ষক প্রথম কবিতায় – “এখন বালিতে কোনো ঘোড়া নেই”। দ্বিতীয় কবিতায় – “দূর থেকে, ভাটিয়ালি গেয়ে ওঠে / রক্ত-মাংসহীন চাঁদের নাবিক”। বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের ‘আলস্যের দিন’ – “আলস্য যে সম্পূর্ণ আকাশ, বিস্তীর্ণ বাতাস, আর”। উমাপদ কর-এর ‘যখন আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা’ কবিতায় – “নিজেকে এক নির্জনতায় ফাগুন নির্ভরতা দেওয়া”। প্রণব পালের ‘ফাইনিজের ধুন’ কবিতায় – “গৃহপালিত নিসর্গের ব্যক্তিগত সর্বনাশ জুড়ে”। অনুপম গুপ্ত-র ‘নীললোহিতের চোখের সামনে’ কবিতায় – “এখনো ছায়াঘন পৃথিবীর বুকে”। স্বপন রায়ের ‘আবহাওয়া’ কবিতাটিতে – “রঙ এক ধারণায় এসে জিরোন”। শংকর লাহিড়ীর ‘সেই বাড়িটার রঙ’ – “কেননা শব্দই আমাদের ধারণ করেছে সেই”। অমিতাভ মৈত্র’র ‘ইস্কাপনের রাজা’ কবিতায় – “আমার হেরে যাওয়া যুদ্ধমোরগ লাল হয়ে যায়”। দেবরাজ রায়চৌধুরীর ‘স্বীকারোক্তি’ – “যদিও কবিতা না লেখা সময় থেকে / কবিতা লেখা সময় পর্যন্ত”। প্রভাত মিত্র’র কবিতা ‘মানচিত্র’ – “আঁকাবাঁকা গন্ডির মাঝে, এই অনুরতি”। অজিত বাইরীর ‘অসতী’ – “আর হিলহিলিয়ে সাপের মতো কাঁপে বাঁশপাতা”। ধীমান চক্রবর্তীর ‘যাত্রা’ কবিতায় – “বই না খুলেও আলুথালু জলের জন্মদিন”। সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অশেষ’ কবিতাটিতে – “ফুরায় না কোনো অন্ধকারে”। দ্বিতীয় কবিতা ‘সরল’ – “শহরও ফুরিয়ে যায় এইখানে, শেষে”। উদয় চট্টোপাধ্যায়ের ‘উত্তর সত্তর’ কবিতায় – “আউটার ইলেক্ট্রন হয়ে বসে থাকি”। নবেন্দুবিকাশ রায়ের প্রথম কবিতা ‘ল্যান্ডস্কেপ’ – “একটাও পাখি শব্দ করছে না...”। দ্বিতীয় কবিতা ‘একটি স্টুপিড সন্ধ্যায়’ – “বেদনার গন্ধ বোরোলিনের মতো”। তৃতীয় কবিতা ‘ফেব্রুয়ারীর তিন তারিখে দেওয়াল যেরকম থাকে’তে আমাদের প্রাপ্তি – “সম্ভবত গুপ্তপ্রেম ও বাজেট”। ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর ‘বৃষ্টি’ – “একটা ঘাসের জন্ম”। সুমিতরঞ্জন দাশ’এর ‘সুইসাইডাল’ কবিতায় – “রক্তে মিশে আছে সব সমানুপাতিক হারে...”। ঊষসী ভট্টাচার্য’র ‘আত্মজ’ কবিতায় – “আজ তোমায় ডাকছি”। সোনালি বেগমের ‘জ্বালানি’ কবিতায় – “মহাবিস্ময় উন্মুক্ত দরজার কপাট খন্ডিত পরিণতি”। শমীক ষান্নিগ্রাহীর ‘পরিচিয়’ কবিতায় – “আনুষঙ্গিক নদী রং বদলালো”। তানিয়া চক্রবর্তীর ‘দূষণ’ কবিতায় – “কিছু আলো কিছুদূর অবধি তোমাকে দেখায়”। মধুছন্দা মিত্র ঘোষ-এর ‘কলাবতী’ – “দীর্ঘ ভণিতায় কলাবতী আদলে / চিহ্নিত ছিল অভিমান”। উল্কার ‘ডটস্‌’ কবিতায় – “ষোড়শী প্রেরণা / বিছানা রোমিং / ও টয়ট্রেন / পেরোচ্ছে মহারাষ্ট্র / মাড়ওয়ার / মহেঞ্জোদারো!” অরূপরতন ঘোষ-এর ‘মাথানগুড়ি’ – “দেখা গিয়েছিল রঙের প্রাচুর্য, ক্রমিক নদীতীর”। প্রণব বসু রায়-এর ‘ঘন ঘুম’ – “নক্ষত্রের হিসেব জানা নেই, কৃষ্ণরাত্রির যামে”। বিশ্বজিৎ-এর ‘ওরিজিনাল’ – “ঘোড়ার শব্দে হুমড়ি খাওয়া বত্রিশটা সিংহাসন”। সব্যসাচী চন্দ’র ‘দেহ ভেসে যায় উৎসবে’ – “আলপথ পেরিয়ে আসা জন্মান্তরের আবহ”। রোশনি ইসলাম-এর ‘ছুটির শৃঙ্খলে’ কবিতায় – “মুঠোফোন বিদেশী বন্ধু আত্মীয়স্বজন”। সব্যসাচী হাজরা-র দীর্ঘ কবিতা ‘ক্রস ও খৃষ্টবীণা’ – “ডোরাকাটা মানুষের বেদানা বাগান”।

প্রতিটি কবিতাতেই অনুভবের মণিমুক্তো ছড়ানো আছে। তাঁরা প্রকৃতির নিহিত সত্তাকে সংযুক্ত করেছেন, আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন রকম দ্যোতনা ও দিকচিহ্ন।




এবার আসা যাক গল্পে। অসাধারণ সব গল্পের কিছু স্পর্শ তো উচ্চারণ করতেই হবে এই অনতিদীর্ঘ প্রতিবেদনে। বাংলাভাষা এবং বাংলাকবিতা সম্পর্কিত গল্প, তাই সমীর রায়চৌধুরী তাঁর গল্পের নাম দিয়েছেন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। সেখানে ফার্সি শব্দের প্রসঙ্গ, গণিতজ্ঞ মিহির চক্রবর্তীর গণিতচর্চা, শব্দের ম্যাজিক এবং অধুনান্তিকতা। গল্পের শেষ দুটি বাক্য লক্ষ্যণীয় – “প্রত্যেক মানুষ কি তাহলে মানুষিক শব্দের মতো নিজেই জাদুকর! রেলিং-এর ওপারে মাইম-অভিনয়, মানে মূকাভিনয় শেখানো হচ্ছে”। মলয় রায়চৌধুরীর ‘পৌঁছে-যাওয়া মানুষ’ আসলে এমন এক মানুষ, যিনি “পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয়”। মলয় জানিয়েছেন, “মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে। সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট লক্ষ্যে”। আসলে সেই সাধু সন্তটি হলো বুন্দেলখন্ডের এক ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার তার মাথার দাম রেখেছে এক লক্ষ টাকা। সরকারী কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনা ও প্রতিবেদন তৈরির কাজে পরিদর্শনে গিয়ে এই ডাকাত সর্দারের সঙ্গে দেখা হয় লেখকের। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘অথ মানুষ-কথা’ গল্পটি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজ দৈনিকের সংবাদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। হুবহু খবরটির ভাষান্তর ঘটানো হয়েছে। ১লা জুলাই ১৯১৩, সোমবার, জনৈক মার্কিন ডাক্তার জানালেন, কয়েক যুগ ধরে যত্নে রাখা একটি কাটা হাত আসল মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো। একজন ভিয়েৎকং গেরিলাযোদ্ধার হাত। প্রায় চল্লিশ বছর আগে, ভিয়েৎনামের রণক্ষেত্রে এই হাতটির জরুরি ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্র গুহ’র ‘জাফর আলি ফুট ফুট কর রোঁয়ে’ গল্পে অসুস্থ জাফর আলিকে আরোগ্যলাভের নিদান দিয়েছে এক ফকির – তিনকুড়ি মুরগি হালাল করনি পড়েগি। জাফর আলির বিবি এককুড়ি মুরগি জোটালো। এক মাস পর মুরগিরা আন্ডা দিল। বাচ্চা হলো। দিন যায় মাস যায়। আবার মুরগিরা আন্ডা দিল। বাচ্চা হলো। বাচ্চাগুলো জাফর আলির দিকে আড়ে আড়ে তাকায়। যথা সময়ে তিনকুড়ি মুরগি হালাল করার জন্য যখন চাকু হাতে তিনজন যুবক তৈরি, জাফর আলি নিষেধ করলো মুরগিগুলোকে মারতে। রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মালিকানা’ গল্পে বিতান ও অঞ্জু লিভটুগেদার থেকে পৌঁছে গেছে শুভবিবাহে। মানসিক পরিবর্তনগুলো চমৎকার ফুটেছে। শ্রাবণী দাশগুপ্ত’র ‘জনাদুই নিঃসঙ্গ’ গল্পে – “নিশিগন্ধা এবং ধীমানের সহসম্মতিতে আইনি বিচ্ছেদের পর নাবালক রিদমের অধিকার রইল তার মায়ের”। উইলহেম এবং ধীমান – দু’জনেরই একসময় পরিবার ছিল, বিচ্ছেদের পর নিঃসঙ্গ। অলোকপর্ণার ‘মনে মনে’ গল্পে – “সুদিনের কোনো অসাধারণত্ব নেই। তাই নেই কোনো গল্পও। সে তার সাধারণ জীবনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে”। লিপিকা ঘোষ-এর ‘উড়ান’ গল্পে সাহারুলের আব্বা জীবন্নেষার সঙ্গে সাহারুলের বিয়েতে মত দেয়নি। ফলে জীবন্নেষার ফুফাতো বহিন রোশনারার সঙ্গে নিকাহ করলো সাহারুল। চার বছর পর দেখা। ততদিনে পঞ্চায়েত অ্যন্ড রুরাল ডেভলপমেন্টে চাকরি করছে জীবন্নেষা। এবার সরকারি উদ্যোগে জীবন্নেষাকে পাঠানো হবে বিশ্বের দরবারে। অনিশ্চয় চক্রবর্তী’র ‘এক স্বকীয়া প্রেমের গল্প’তে চিঠির আকারে এক পুরুষ আর এক পুরুষকে জানাচ্ছে – ‘তোমার দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনো পরকীয়ার নয়, বরং গভীর এক স্বকীয়ার। তার সঙ্গে আমার জীবনচেতনা ও বোধ, অনুভব, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সৌজন্য, শরীর ও মনের সাহচর্যের, বিনিময়ের যে অসাধারণ মিল, সেই মিলনকে কিছুতেই পরকীয়া বলা যায় না”। অনুপম মুখোপাধ্যায়ের ‘ইন্দ্রযোনি’ গল্পে – “হেম... বলতেই পারি তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এক কলোনিয়াল নাম। ঢের বেশি শ্যামলীর চেয়ে। শ্যামলী নাম্নী মেয়ে বিধবা হয় না। হেম-রা হয়”। অচিন্ত্য দাশের ‘পাঁঠার মাংস’ গল্পে, সত্তর বছর বয়সী সাধারণ মধ্যবিত্ত রাখালবাবুর জীবন ও ভাবনাপ্রবাহের কিয়দংশ। সুপ্রিয় বাগচীর ‘থ্রি ডাইমেনশনাল ভীমরতি’ গল্পে অনুপম, অনিন্দ্য, উপমা – এই তিন চরিত্র নিয়ে মৃত্যুযোগের খেলা। নীতা বিশ্বাসের ‘কিছু পলাশের নেশা’ গল্পে তমাল, অনন্যা এবং একটি বাথটব, গল্প বয়ে গেছে অজানা এক পরিণতিতে। ভূদেব ভকতের ‘ক্লেপ্টোম্যানিয়াক’ গল্পটি শেষ হয়েছে এইভাবে – “নাতি রুহান একছুটে বিয়ের কার্ডখানা নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে উদগ্রীব চোখে চেয়ে থাকলো শেষটুকু শোনার জন্য। আমি বললাম, সেই যে ফুলদানির সঙ্গে সন্দীপনের শিশুকন্যা বসুন্ধরার ছবি তুলেছিলাম, সেই বসুন্ধরা বড় হয়েছে। আজই তার বিয়ে। এবার সময় এসেছে ঐ ফুলদানির নিজের ঘরে ফিরে যাবার। সুন্দর এক রঙিন কাগজে মুড়ে আজ সন্ধ্যায় বসুন্ধরার হাতে তুলে দেব তারই মায়ের বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া সেই সোনালি ড্রাগন আঁকা লালরঙের ফুলদানিটি”। সুবিমল বসাকের ‘আধিব্যধি সংক্রান্ত’ গল্পে বিহারীদের চোখ ওঠা ‘আঁখ আনা’য় ছটপট করছে বাচ্চারা আর চলছে তাদের চিকিৎসা। তেমনি খোস-পাঁচড়া-খুজলি, তারও চিকিৎসা। বড়দের দাদ ও চুলকানি – তারও চিকিৎসা। আম-বিহারীদের জীবনের এক অন্যদিক তুলে ধরেছেন লেখক তাঁর গল্পে। কাজল সেনের ‘খেলা’ গল্পে – রণজয় ও চন্দ্রিমার একটা গোপন খেলা আছে, আজ রণজয় অপেক্ষা করছে সেই খেলায় একটা অন্য রঙ আনার জন্য। কিন্তু চন্দ্রিমা আসছে না। হরনাথবাবু ইদানীং অদ্ভুত একটা খেলায় মেতেছেন। ছেলেবেলা খুঁজে দেখা। পুরনো পাড়ায় পৌঁছে দেখলেন সব বদলে গেছে। রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কর্ণার্জুন’ গল্পে – কর্ণ এবং অর্জুনকে পৃথক চিঠি বা আত্মগত চিঠিতে প্রণিপাত আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন কৃষ্ণা বা দ্রৌপদী।

প্রতিটি গল্পই বিভিন্ন মানসিক এলাকা থেকে উদ্ভূত ও নিজস্ব পরিসরে পরিবেশিত হয়েছে।



বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়


প্রভাতরঞ্জন রায় প্রণীত ‘বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়’ পুস্তিকাটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় দেওয়া হয়েছে – উত্তর ভারতীয় কথাসাহিত্য সম্মেলন ১৯২৩ সালে বারানসীতে হয়েছিল ৩ থেকে ৫ মার্চ। এবং এরকম নানা তথ্য। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখক-প্রস্তাবিত বর্ণ-সংক্ষেপ বিন্যস্ত রয়েছে। পরের পৃষ্ঠাতেও রয়েছে তাঁর আর একটি প্রস্তাব, নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন সম্পর্কিত। পরবর্তীতে বিবৃত করা হয়েছে ১৯২৩ সালের প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের উদ্দেশ্যগুলি। ১৯২৩ সালের উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য প্রথম সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বছরেই ডিসেম্বর ২৬-২৭ যে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন এলাহাবাদে হয়েছিল, সেখানে সভাপতি ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়; কিন্তু তাঁর অসুস্থতাহেতু এসেছিলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ।

UNESCO-র বার্ষিক অধিবেশনে সমাগত সুধী-সান্নিধ্য লাভের জন্য ১৯৫৬ সালের ১-৩ নভেম্বর ৩২তম অধিবেশন হয় আগ্রায়। সেখানে সভাপতি হুমায়ুন কবীর তাঁর ভাষণে বলেছিলেন – “আকবরের দরবারে নানা দেশের নানা ধর্মের নানা ভাষাভাষী সুধী ও পন্ডিত ধর্ম ও দর্শন নিয়ে বিচার করেছেন – আমাদের এই সাহিত্য সম্মেলনও তাই...”। শ্রীমতি আলভা মার্দেল (সুইডেন) বলেছিলেন – “একদা যৌবনকালে আমার বাগদত্তা প্রণয়ীকে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘মালঞ্চ’ উপহার দিই, তার বদলে তিনি ‘চিত্রা’ উপহার দিয়েছিলেন। দুটিই ছিল সুইডিশ তর্জমায়”।

প্রভাতরঞ্জন জানিয়েছেন – “বাংলাসাহিত্য ও বাঙালির জীবনবোধে নিহিত সাংস্কৃতিক চেতনায় বিশ্বমানবতাবোধের উপস্থিতি স্বীকৃত সত্য। সাত দশক আগে গৃহীত সম্মেলনের উদ্দেশ্য উক্ত বোধের দ্বারা প্রাণীত বলেই এখনও সমান প্রাসঙ্গিক”। প্রাসঙ্গিক সংযোজনে শ্রীরায় জানিয়েছেন – “ভাষা বংশলতিকা এবং ইতিবাচক বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর কোনো ভাষাকেই বিদেশি ভাষা বলবার যুক্তি খুঁজে পাই না”।

এই পুস্তিকায় শ্রীরায় ভারতীয় ভাষার উৎস ও বিকাশ সম্পর্কে যেমন জানিয়েছেন, তেমনি বাঙালি জাতির উদ্ভব বিষয়টিকেও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন, সেইসঙ্গে জানিয়েছেন সংস্কৃতি বলতে আসলে কী বোঝায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন