অভিজিৎ সেনের ‘রহু চন্ডালের হাড়’
অভিজিৎ সেনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘রহু চন্ডালের হাড়’। এক অজানা অস্পষ্ট ধর্মের ধারক ও বাহক ‘রহু চন্ডালের হাড়’এর এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী – অভিজিত সেন যাদের ‘বাজিকর’ বলেছেন। যাযাবর বাজিকরদের জীবন সংগ্রাম বিষয়ে লেখা এই সময়ের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসের মধ্যে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার ইতিহাস উঠে এসেছে। শুধু বিষয়বস্তুর জন্য নয়, আখ্যান উপস্থাপনের অভিনবত্বের জন্য তা চমক সৃস্টি করে। কখনও আত্মকথার ঢঙে তিনি তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেন, যার মধ্যে বরিশাল–ঝাড়্গ্রাম-পুরুলিয়া-বালুরঘাটের কথাও আছে।
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ যাযাবর বাজিকরদের সংগ্রামের কাহিনী। সুদূর অতীতকাল থেকে ১৯৬৭-র নির্বাচন পর্যন্ত - এই সময় কালের মধ্যে একদিকে বাজিকরদের রহু চন্ডালের হাড়কে ঘিরে স্বপ্ন-বিশ্বাস, অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের গ্রাম সমাজে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী বিভক্ত মানুষদের ক্রিয়াকলাপ। অভিজিৎ সেন জীবন জীবিকা, অভিজ্ঞতা সূত্রে বেছে নিয়েছেন এক একটি অঞ্চল। আগেকার দিনে হয়তো এদের আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হতো। তবে বিশেষ অঞ্চলের ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক-সামাজিক চিত্র হিসাবে নয় -‘প্রখর বাস্তবতার শিল্পিত রুপ’ হিসেবে দেখতে হবে উপন্যাসকে।
হয়তো গ্রাম এবং গ্রামীন জীবন এখানে স্থান পেয়েছে, হয়্তো আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার দেখা গেছে, তবু এগুলি আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। এগুলি স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতার সঠিক ব্যবহার, নির্ভুল পর্যবেক্ষণ। ইন্দো-ইরাণীয় যাযাবর জনগোষ্ঠী এভাবেই মধ্যে এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল। পীতেম বাজিকর গোষ্ঠীর দলপতি – সে দিক নির্দেশ খোঁজে। পীতেম বাসযোগ্য ভূমির প্রত্যাশায় আবাদযোগ্য জমি খোঁজে। পূর্বপুরুষ রহুর সাবধান বাণী সত্বেও, তার উত্তরপুরুষ সমগ্র উপন্যাসে আশ্রয় খোঁজে। স্বস্তি চায় আর্থ–সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিতে, সমাজের মূল স্রোতের প্রতিবেশী হয়ে।
এক যাযাবর জনগোষ্ঠীর কৃষি সভ্যতায় উত্তরণের সংগ্রামময় ইতিহাস এটি। রহু চণ্ডালের মিথের আবহে এভাবেই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। লুবিনি ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের কথক ঠাকুরুণ। রহুর বংশধরদের তিন চার পুরুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সূত্রধর তিনিই। আখ্যানের পর আখ্যান জুড়ে যে ইতিহাস তৈরি হয়, তার শ্রোতা ছোট্ট নাতনি শারিবা।
উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে বাজিকর যাযাবর সম্প্রদায়ের দেড়শ বছরের কাহিনীতে এসেছে অজস্র লোকউপাদান। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা তাদের বাসস্থানের চিত্রটি দেখতে পাই। নিচু দাওয়ায়, তালপাতার বেড়া দেওয়া ঘর ও শনের চালা। যাযাবর বাহিনী আটমাস দশমাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, ভঁইস চুরি করে পথে বেরিয়ে পড়ে। সেই মোষের পিঠে থাকত বাচ্ছা আর বুড়ো বুড়িরা। নদীর পাড়ে, শহরের বাইরে, প্রাচীন বটের তলায় তারা বাস করত।
এই বাজিকররা বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করত, যেমন বাঁদর- ভাল্লুকের খেলা, দড়ির খেলা, কাঠের ময়ূর নাচানো, ভানুমতীর খেলা, পিচলু বুঢ়া পিচলু বুঢ়ির কাঠের পুতুল নাচানো, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়ে কাঁচা হাঁস কাঁচা মুরগী কড়মড় করে খাওয়া, নাচা গাওয়া -- এই সবের মাধ্যমে রোজকার করে তারা জীবন যাপন করে। ভানুমতীর কাজ কিছুটা বিচিত্র ও ভয়ানক। কুড়ি হাত উঁচু বাঁশের মাথায় সোজা দাঁড়িয়ে ছুঁচে সুতা পরানো। দু’ধারে মোষের সিং-এ দড়ি বেঁধে বাঁশ দিয়ে দিয়ে ঠেলে সে দড়ি টান টান করা হতো। মাটি থেকে কুড়ি হাত উঁচুতে বাঁশ হাতে হাঁটাচলা নাচ দেখানো প্রভৃতি। ভানুমতীকে হাত দেখিয়ে ভবিষ্যৎ গণনা করা - এও এক বিশেষ ধরনের লোকউপাদান।
সুদূর অতীতে বাজিকর এবং বানজারা এই দুই যাযাবর গোষ্ঠীর পাশাপাশি সহাবস্থান ছিল। বাজিকরদের সারাজীবন ধরে যাযাবরী বৃত্তির পেছনে একটি মিথ তথা লোকবিশ্বাস কাজ করে। মিথটি হলো এই রকম – হাজার বছর আগে এই জনগোষ্ঠী কোনো এক বিশাল নদীর ধারে বসবাস করত। তাদের মধ্যে কোনো এক প্রাচীন পুরুষ ‘পুরা’ নর্তকী পালির প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়। তখন থেকে অন্তর্কলহ শুরু হয়। কারণ পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবী তুলেছিল যে, এ বিয়ে হতে পারে না, কারণ পালি তার বোন।
অপরদিকে পুরার সমর্থকরা দাবি করেছিল যে, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন তার প্রমাণ নেই। তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের ওপর। অন্তর্দ্বন্দ্বে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়াতে থাকে। কোথাও তারা আশ্রয় পায় না। দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে নিরাশ্রয় করে দেয়। তাদের ওপর এই অভিশাপ বর্ষায় যে, তারা একই বৃক্ষের ফল দু’বার খেতে পারবে না। এক জলাশয়ের জল দু’বার খেতে পারবে না। এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক, এক মৃত্তিকায় দু’বার পদার্পণ করতে পারবে না – এই ছিল দেবতার অভিশাপ। সেই থেকে বাজিকর পথে প্রান্তরে ঘুরছে।
জীবিকার সন্ধানে বাজিকর যুবকরা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঘ শিকার করে। একজনের হাতে রক্তমাখা পশু; তুমদা ও ধামসা বাজিয়ে শিকার-নৃত্য করে। অস্ত্র হিসাবে তারা হাঁসুয়া ব্যবহার করে। নেশা করার সময় খায় পচানি ও তালের রস।
এই যাযাবর সম্প্রদায় নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সাঁওতাল পাড়ায় যায়। সেখানে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন সাঁওতালদের গ্রামগুলিতে ঢোকার মুখে দেখা যায় গরুর চামড়া ও আড়াআড়ি একজোড়া বাঁশি টাঙানো। মোড়ে মোড়ে পুঁতে রাখা ঝান্ডা, ঘণ্টা ও ভাঙা কুলো। অঘ্রাণ মাসে গোয়ালঘরে মারাংবুরু এবং ঠাকরাণের পুজো হয় - আতপ চাল, মেথির গুঁড়ো, তেল সিঁদুর দিয়ে গোলাকার খড় সাজানো হয়। মোষ, শূকর, সাদা মোরগ বলি দেওয়া হয়।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গোষ্ঠপতিকে বলা হয় পারগানা। শস্য উৎসব উপলক্ষে সাঁওতাল যুবক যুবতীরা আঞ্চলিক ভাষায় নাচ গান করে। সিঁদুরের দাগ দেওয়া পাথর দিয়ে ধান ওজন করে সাঁওতাল চাষীদের ঠকিয়ে বোকা বানানোর যে চিত্র আমরা এই উপন্যাসে পাই, সেই একই দৃশ্য আমরা পেয়েছি বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবিগর্জন’ নাটকে।
রাজমহল পাহাড়ে কালীপুজোর সময় বাজিকর সম্প্রদায়ের যাবতীয় শারীরিক কসরৎ ও বিচিত্রমুখী খেলাধূলার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। রহু চন্ডালের হাড়ের কেরামতিতে নিমেষে টাকা দ্বিগুন হচ্ছে। যদুদন্ডের ছোঁয়ায় যুবতীর লম্বা বিনুনি মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠছে সোজা হয়ে, আবার কোথাও নিমেষে গাছ থেকে ফল, ফল থেকে গাছ তৈরি হচ্ছে। কোথাও বা বীভৎস নরকযন্ত্রণার মহড়া – এইসব কিছুর প্রযোজনায় একজন চতুর কথক থাকে, যে সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সংস্কার-কুসংস্কার বিষয়ে অনর্গল কথা বলে গ্রাম্য মানুষকে আকর্ষণ করে। বাজিকরদের সব থেকে উত্তেজক ও রোমহর্ষক খেলা হলো একটি যুবতীকে কাঠের পাটাতনের সামনে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার চারপাশে জ্বলে মশাল। দশ হাত দূর থেকে অত্যন্ত দ্রুত ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে ঐ পাটাতনে।
অলৌকিক ঘটনার নিরীখে পীতেমকে দেখা দেয় দনু। রহু চন্ডালের হাড়ের ইতিহাস শোনায় দনু। রহু তার হাড় দিয়েছিল বাজিকরকে, যেন সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে। দনু পীতেমকে জানায় যে, রহু বাজিকরদের সঙ্গে থাকেন। নতুন ভূখণ্ডে তাদের সুস্থিতি না করানো পর্যন্ত তাঁর মুক্তি নেই।
সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রভাব এই জনগোষ্ঠীর উপরেও পড়ে। তাদের জীবনধারা, বাসস্থান, পোশাক–পরিচ্ছদ সমস্ত কিছুতেই আসে আমূল পরিবর্তন। তাদের দেহে প্রাচীন নুগরু, কুর্তি, ঘাঘরা কাচের কাজ করা বস্ত্র। গলায় পাথর প্রভৃতির পরিবর্তে স্থান নিয়েছে ধুতি লুঙ্গি প্রভৃতি এদেশীয় বস্ত্র, গলায় মালা করা মুর্শিদাবাদী সিক্কাগুলিও তাদের জৌলুষ হারিয়ে ফেলে। হাজার বছর এর ধূসরতা ও মলিনতা তাদের গ্রাস করে, তাদের পথ চলা থামে না । তাদের একান্ত প্রার্থনা-
‘‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু।’’
বাজিকর গোষ্ঠীর আজীবন সংগ্রাম গৃহস্থ হতে চাওয়ার মধ্যে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো কিছুতেই তারা গৃহস্থ হতে পারে না। একবার সাঁওতাল, একবার মুসলমান – এই দুই জাতির সঙ্গে মিশ্রিত হতে চেয়েও বারবার পিছিয়ে আসে তারা। এইখানে মুসলমান সমাজের একটি বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই - শহরের জমিদার বদিউল ইসলাম। তার আস্তাবলে সব থেকে ভালো ঘোড়াটি হলো সাদা রঙের আরবি মাদি ঘোড়া, তার নাম দুলদুলি। কেউ চড়ত না এই ঘোড়ায়, এটি বদিউলের সৌভাগ্যদায়ী জিনের মাদার। জিন তুষ্ট থাকে এই ঘোড়ার আশ্রয়ে, অথবা, ঘোড়া তো স্বয়ং জিন। তাই তার এরকম ব্যবস্থা। ঘোড়ার প্রভাবে জিনের কূদৃষ্টি কেটে যায়।
বাজিকর সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি সুন্দর ছবি পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। লাল সুতোয় ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে সম্পূর্ণ বাজিকর রীতিতে ষোল জোড়া বালক বালিকার বিয়ে হয়। মেয়েরা গান গায়-
‘লাল পাড়াঙ্গি রেশকি ডোরি –
দেও আওয়েতে দেওরে ভাই’।
বাজিকরদের পাশাপাশি মালো এবং ঝালো সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। মালোরা নৌকা টেনে তুলে উপুড় করে গাব আর আলকাতরা লাগায়, নিজের গায়ে মাথায় তেল মেখে চকচকে হয়। তারপর একদিন গলুইয়ের ওপর ফুল পাতা সিঁদুর ধূপ দিয়ে ‘জয় মা গঙ্গা’ বলে নদীতে ভেসে পড়ে।
আর ঝালো সম্প্রদায় মাছ ধরে পুকুর অথবা নালাতে। লম্বা লাঠির ভেতরে গলানো কয়েক হাত মাত্র সুতোর কারিগরী, নিতান্ত আটপৌরে জাল। পুরুষের পরনে অধিকাংশ সময়েই একফালি ত্যানা, আর মেয়েদের খাটো শাড়ি। মাছমারা সম্প্রদায়ের চড়ক উৎসবেরও পরিচয় পাওয়া যায়। নীলুই হয় প্রধান সন্ন্যাসী। তাকে ঠাকুরের কাঠ ঘাড়ে নিয়ে একমাস বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করতে হয়। ঠাকুরের মূর্তির স্বরূপটি হলো এই প্রকার – মসৃণ ও চকচকে কালোকাঠের নৌকা। তার উপরে খোদাই করা শিবের ও তার বাহন ষাঁড়ের মূর্তি। অন্য পাশে হাত জোড় করা দুই ভক্ত। মাঝখানে একটি শঙ্খ। এই কাঠের ঠাকুরকে নিয়ে সারা মাস ধরে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হয়। সঙ্গে থাকে ঢোল, ঢাক ও কাঁসি। দোতারা নামের বাদ্যযন্ত্রের নামও পাওয়া যায়।
এই নীলুই আবার ‘হাজরা ছাড়া’ নামক মন্ত্রের ধারক ও বাহক। সংক্রান্তির আগের রাত্তিরে মন্ত্র পড়া তেল সিঁদুর দেওয়া খড়্গ দিতে হয় কোনো ভক্তকে। ভক্ত তখন দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই খড়্গ হাতে ছুটে যায়। শশ্মান মশানে ঘোরে সারারাত্তির। সেই সময় তার সামনে যাওয়া খুব বিপদের। বাবার নামে সে তখন যা খুশী তাই করতে পারে। ভূতপ্রেতেরা তখন তার সঙ্গী। ভোর হওযার আগে মড়ার মাথার খুলি নিয়ে তাকে হাজির হতে হয়। এর নাম ‘হাজরা ছড়া’।
পরবর্তী ক্ষেত্রে নলুয়া বাদিয়ার দলের পরিচয় পাওয়া যায়। যাদের মূল জীবিকাই হলো পাখি ধরা ও পাখি মারা। এক গোছা বাঁশের নল থাকে প্রত্যেকের হাতে। প্রথম নলটির মাথায় থাকে একটা লোহার ছুঁচলো কাঁটা। গাছের পঁচিশ ত্রিশ হাত উঁচুতে পাখি থাকলেও তারা অদ্ভুত নিপুণতায় পাখিকে বিদ্ধ করে।
মুসলিমদের সহায়তায় বাজিকর চাষ করার চেষ্টা করে। ধান, তরমুজ প্রভৃতির ফলন করে। বাজিকর ‘গেঁহু আর সেঁকা’ নিয়ে ভিক্ষা আর করে না। দনুর অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ শারিবাকে তার নানি লুবিনি শোনায় রহু চন্ডালের হাড়ের কেরামতির কথা-
‘‘ঘোর অমাবস্যায় এক বিটিছেলের এক ছেল্যা হবে। সি হবে একই বেটা। সি বেটাক্ মরব্যা হবে অমাবস্যার দিনোৎ আর লাশ ভাসান হবে অমাবস্যার আতোৎ। তবি সি লাশ গহিন আতোৎ থিকা উঠবা হবে। তা বাদে তার কন্ঠার হাড়ে বানাবা হবে ভান্মতির হাড়। সি হলো রহু চন্ডালের হাড়। সে হাড় হাতেৎ রাখ্যে তুমু হয়কে লয়, লয়কে হয় করতে পারবা।’’
চাষ আবাদ যখন বাজিকরদের জীবনে স্থায়ী হয়নি, তখন পেটের তাগিদে তাদের ফিরে যেতে হয়েছে সেই আদিম সংস্কার ও জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে। কারণ বেঁচে থাকাটাই আসল। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আবার ঢোলকে বাড়ি পড়ে -‘‘ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ লাগ্ ভেলকি লাগ্, চোখে মুখে লাগ, হামারে ছাড়ে সবারে লাগ’’। এই ভাবেই রহু চন্ডালের হাড়ের কিসমৎ দেখায় জনসাধারণকে।
ধর্মভাবনা, দেবদেবীকে সব কিছুতেই বাজিকর আলাদা। না হিন্দু না মুসলমান। গরুও খায় আবার শুয়োরও খায়। জ্বর হলে বাজিকর বলে ‘হাতপাক’ হয়েছে। তাদের দেবী বিগামাই রুষ্ঠ হলে নাকি এরকম রোগ হয়। গলা থেকে যখন ‘লোই’ ওঠে কাশি হয় তখন তাকে বলা হয় লোইরোগ। এই রোগই নাকি বাজিকরের নিয়তি।
তাদের ধর্মস্থান হারুরান। ওলামাই, বিগামাই, কালিমাই - এই সমস্ত অজ্ঞাত দেবতা বাজিকরের রাস্তার সংগ্রহ, তার নিজস্ব কিছু নয়। তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের গানগুলি এরকম-
“দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
বান্ধনা তো সারিমাদে
দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
মাকরানা সারিমাদে
দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
সাপনারা সারিমাদে।’’
লুবিনির মৃত্যুর সঙ্গেই বাজিকরদের একটি যুগ শেষ হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় নতুন যুগ হিন্দুস্থান-পাকিস্থান বিভাজনের প্রাক্ মুহূর্তে এবং তেভাগা আন্দোলনের পরবর্তীকালে। বাজিকরদের উত্তরসূরী শারিবা অল্প বয়স থেকেই হাপু গান গায়। হাপু একটি দীর্ঘ ছড়া। গান ও আবৃত্তির মাঝামাঝি একটি সুরে গাওয়া হয়। হাতে থাকে একটি মোটা পাঁচন লাঠি আর মুখ নাখ ও বগল ইত্যাদি নির্গত বিভিন্ন বিকৃত ধ্বনি, শীৎকার। গানের সঙ্গে লাঠি দিয়ে গায়ক, শরীরের যেসব অঙ্গে আঘাত করলে শব্দ বেশি হয়, সেখানে আঘাত করে। গানের শেষাংশে লাঠির বাড়ি এমন দ্রুত হয় যে, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অনেক সময় লাঠি কেড়ে নেয়। এইভাবে শারিবা উপার্জন করে।
বাজিকর বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে অকৃতকার্য হয়ে বারবার নিজেদের আদিম শেকড়ের কাছে ফিরে আসে ও আশ্রয় পায় দুর্দিনে। বাজিকর নারীর সতীত্বের বড়াই নেই। একই রক্তের মধ্যে বারবার মিশ্রণ হয়, যদিও জামির নির্দেশ দিয়েছিল মেয়েদের দূরে পাঠাবে আর ছেলেদের বউ আনবে দূর থেকে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ফলশ্রুতি – শিশুমৃত্যু, অকাল মৃত্যু। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ তাদের ভাষায় হয়ে যায়-‘শোগর মরি আর ইওয়া’।
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শাহজী-অন্নদাদিদির মতো রূপা বাজিকর সাপুড়ে বৃত্তি অবলম্বন করে উপার্জন করে। সাপুড়ে গোষ্ঠীর বিভিন্ন তুক্তাক ও বাচনভঙ্গি উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। দেশ বিভাজনের ফলে বাজিকর আর স্বতন্ত্র হিসাবে থাকতে পারে না। তারা ঠাঁই পায় মুসলমান সমাজে। নতুন করে তারা মুসলমানদের ধর্ম ভাবনা ও আচার আচরণের সঙ্গে মিলিত হয়। শুধু রূপা বাজিকর মুসলিম হয় না। কারণ হিন্দুকে বিয়ে করে তার রক্তে হিন্দুত্বের সংস্কার ঢুকে গেছে। বিষহরির গান বাজিকর গায় না। কিন্তু রূপা গায়। মুসলমানদের সঙ্গেই বাজিকরের বেশি মিল। নামের দিক থেকেও, খাদ্যের দিক থেকেও। হিন্দুর সঙ্গে নাম বা খাদ্যে মিল নেই।
অবশেষে অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে হয়তো তারা থিতু হয়। কিন্তু বাজিকরের অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। তারা অবহেলিত অচ্ছুত জাতি, যাদের নিজস্ব কোনো বাসস্থান নেই এই পৃথিবীতে। সব বাজিকর জানে ‘রহু চন্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও তারা বিশ্বাস করে, স্বপ্ন দেখ্ এবং তার সার্থক অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা ভাবে। ‘রহু চন্ডালের হাড়’ তার সঙ্গে সম্পর্ক ঘোর অমাবস্যার। পীতেম, জামিরের মতো শারিবাও জানে, রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূ-খন্ডের মাটির গভীরে। সে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি বের করার জন্যই তাদের পথে পথে ঘোরা। সকলেই সেই হাড় নিজের মতোন করে খোঁজে; এবং সেই ভূ-খন্ডেই হবে তাদের স্থিতি, স্থায়িত্ব, স্বস্তি ও শান্তি।
একটি জাতির সংগ্রামের কাহিনী ও তাদের বিভিন্ন সংস্কার - এই দুটি মৌল উপাদানের ওপর নির্ভর করে, অভিজিৎ সেনের ‘রহু চন্ডালের হাড়’ উপন্যাসে এসেছে আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়ানো এক চিরায়ত জীবনের উপলদ্ধি। বোদল্যেয়র বলেছিলেন-কুৎসিতেরও সৌন্দর্য আছে। তাই বিশিষ্ঠ জনজাতি-জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস হয়েও আসলে এটি এক সার্বজনীন উপন্যাস।
অভিজিৎ সেনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘রহু চন্ডালের হাড়’। এক অজানা অস্পষ্ট ধর্মের ধারক ও বাহক ‘রহু চন্ডালের হাড়’এর এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী – অভিজিত সেন যাদের ‘বাজিকর’ বলেছেন। যাযাবর বাজিকরদের জীবন সংগ্রাম বিষয়ে লেখা এই সময়ের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসের মধ্যে একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার ইতিহাস উঠে এসেছে। শুধু বিষয়বস্তুর জন্য নয়, আখ্যান উপস্থাপনের অভিনবত্বের জন্য তা চমক সৃস্টি করে। কখনও আত্মকথার ঢঙে তিনি তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলেন, যার মধ্যে বরিশাল–ঝাড়্গ্রাম-পুরুলিয়া-বালুরঘাটের কথাও আছে।
‘রহু চণ্ডালের হাড়’ যাযাবর বাজিকরদের সংগ্রামের কাহিনী। সুদূর অতীতকাল থেকে ১৯৬৭-র নির্বাচন পর্যন্ত - এই সময় কালের মধ্যে একদিকে বাজিকরদের রহু চন্ডালের হাড়কে ঘিরে স্বপ্ন-বিশ্বাস, অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের গ্রাম সমাজে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী বিভক্ত মানুষদের ক্রিয়াকলাপ। অভিজিৎ সেন জীবন জীবিকা, অভিজ্ঞতা সূত্রে বেছে নিয়েছেন এক একটি অঞ্চল। আগেকার দিনে হয়তো এদের আঞ্চলিক উপন্যাস বলা হতো। তবে বিশেষ অঞ্চলের ভৌগোলিক-প্রাকৃতিক-সামাজিক চিত্র হিসাবে নয় -‘প্রখর বাস্তবতার শিল্পিত রুপ’ হিসেবে দেখতে হবে উপন্যাসকে।
হয়তো গ্রাম এবং গ্রামীন জীবন এখানে স্থান পেয়েছে, হয়্তো আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার দেখা গেছে, তবু এগুলি আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। এগুলি স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতার সঠিক ব্যবহার, নির্ভুল পর্যবেক্ষণ। ইন্দো-ইরাণীয় যাযাবর জনগোষ্ঠী এভাবেই মধ্যে এশিয়া থেকে ভারতে এসেছিল। পীতেম বাজিকর গোষ্ঠীর দলপতি – সে দিক নির্দেশ খোঁজে। পীতেম বাসযোগ্য ভূমির প্রত্যাশায় আবাদযোগ্য জমি খোঁজে। পূর্বপুরুষ রহুর সাবধান বাণী সত্বেও, তার উত্তরপুরুষ সমগ্র উপন্যাসে আশ্রয় খোঁজে। স্বস্তি চায় আর্থ–সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিতে, সমাজের মূল স্রোতের প্রতিবেশী হয়ে।
এক যাযাবর জনগোষ্ঠীর কৃষি সভ্যতায় উত্তরণের সংগ্রামময় ইতিহাস এটি। রহু চণ্ডালের মিথের আবহে এভাবেই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। লুবিনি ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ উপন্যাসের কথক ঠাকুরুণ। রহুর বংশধরদের তিন চার পুরুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সূত্রধর তিনিই। আখ্যানের পর আখ্যান জুড়ে যে ইতিহাস তৈরি হয়, তার শ্রোতা ছোট্ট নাতনি শারিবা।
উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে বাজিকর যাযাবর সম্প্রদায়ের দেড়শ বছরের কাহিনীতে এসেছে অজস্র লোকউপাদান। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা তাদের বাসস্থানের চিত্রটি দেখতে পাই। নিচু দাওয়ায়, তালপাতার বেড়া দেওয়া ঘর ও শনের চালা। যাযাবর বাহিনী আটমাস দশমাস দুনিয়া ঘুরে বেড়াবার নেশায় ভাল্লুক বাঁদর সংগ্রহ করে, ভঁইস চুরি করে পথে বেরিয়ে পড়ে। সেই মোষের পিঠে থাকত বাচ্ছা আর বুড়ো বুড়িরা। নদীর পাড়ে, শহরের বাইরে, প্রাচীন বটের তলায় তারা বাস করত।
এই বাজিকররা বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে জীবনযাত্রা অতিবাহিত করত, যেমন বাঁদর- ভাল্লুকের খেলা, দড়ির খেলা, কাঠের ময়ূর নাচানো, ভানুমতীর খেলা, পিচলু বুঢ়া পিচলু বুঢ়ির কাঠের পুতুল নাচানো, বাঁশবাজি, দড়িবাজি, নররাক্ষস হয়ে কাঁচা হাঁস কাঁচা মুরগী কড়মড় করে খাওয়া, নাচা গাওয়া -- এই সবের মাধ্যমে রোজকার করে তারা জীবন যাপন করে। ভানুমতীর কাজ কিছুটা বিচিত্র ও ভয়ানক। কুড়ি হাত উঁচু বাঁশের মাথায় সোজা দাঁড়িয়ে ছুঁচে সুতা পরানো। দু’ধারে মোষের সিং-এ দড়ি বেঁধে বাঁশ দিয়ে দিয়ে ঠেলে সে দড়ি টান টান করা হতো। মাটি থেকে কুড়ি হাত উঁচুতে বাঁশ হাতে হাঁটাচলা নাচ দেখানো প্রভৃতি। ভানুমতীকে হাত দেখিয়ে ভবিষ্যৎ গণনা করা - এও এক বিশেষ ধরনের লোকউপাদান।
সুদূর অতীতে বাজিকর এবং বানজারা এই দুই যাযাবর গোষ্ঠীর পাশাপাশি সহাবস্থান ছিল। বাজিকরদের সারাজীবন ধরে যাযাবরী বৃত্তির পেছনে একটি মিথ তথা লোকবিশ্বাস কাজ করে। মিথটি হলো এই রকম – হাজার বছর আগে এই জনগোষ্ঠী কোনো এক বিশাল নদীর ধারে বসবাস করত। তাদের মধ্যে কোনো এক প্রাচীন পুরুষ ‘পুরা’ নর্তকী পালির প্রতি আসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়। তখন থেকে অন্তর্কলহ শুরু হয়। কারণ পুরার বিরুদ্ধবাদীরা দাবী তুলেছিল যে, এ বিয়ে হতে পারে না, কারণ পালি তার বোন।
অপরদিকে পুরার সমর্থকরা দাবি করেছিল যে, এ বিয়ে হবেই, কেননা পালি যে পুরার বোন তার প্রমাণ নেই। তারপর পুরা ও পালির বিয়ে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দেবতার অভিশাপ নেমে আসে তাদের ওপর। অন্তর্দ্বন্দ্বে সমস্ত মানুষ নষ্ট হয়। পুরা ও পালি দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়াতে থাকে। কোথাও তারা আশ্রয় পায় না। দেবতা তাদের অভিশাপ দিয়ে নিরাশ্রয় করে দেয়। তাদের ওপর এই অভিশাপ বর্ষায় যে, তারা একই বৃক্ষের ফল দু’বার খেতে পারবে না। এক জলাশয়ের জল দু’বার খেতে পারবে না। এক আচ্ছাদনের নিচে একাধিক রাত্রি বাস করতে পারবে না এবং সব থেকে ভয়ানক, এক মৃত্তিকায় দু’বার পদার্পণ করতে পারবে না – এই ছিল দেবতার অভিশাপ। সেই থেকে বাজিকর পথে প্রান্তরে ঘুরছে।
জীবিকার সন্ধানে বাজিকর যুবকরা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঘ শিকার করে। একজনের হাতে রক্তমাখা পশু; তুমদা ও ধামসা বাজিয়ে শিকার-নৃত্য করে। অস্ত্র হিসাবে তারা হাঁসুয়া ব্যবহার করে। নেশা করার সময় খায় পচানি ও তালের রস।
এই যাযাবর সম্প্রদায় নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সাঁওতাল পাড়ায় যায়। সেখানে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন সাঁওতালদের গ্রামগুলিতে ঢোকার মুখে দেখা যায় গরুর চামড়া ও আড়াআড়ি একজোড়া বাঁশি টাঙানো। মোড়ে মোড়ে পুঁতে রাখা ঝান্ডা, ঘণ্টা ও ভাঙা কুলো। অঘ্রাণ মাসে গোয়ালঘরে মারাংবুরু এবং ঠাকরাণের পুজো হয় - আতপ চাল, মেথির গুঁড়ো, তেল সিঁদুর দিয়ে গোলাকার খড় সাজানো হয়। মোষ, শূকর, সাদা মোরগ বলি দেওয়া হয়।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গোষ্ঠপতিকে বলা হয় পারগানা। শস্য উৎসব উপলক্ষে সাঁওতাল যুবক যুবতীরা আঞ্চলিক ভাষায় নাচ গান করে। সিঁদুরের দাগ দেওয়া পাথর দিয়ে ধান ওজন করে সাঁওতাল চাষীদের ঠকিয়ে বোকা বানানোর যে চিত্র আমরা এই উপন্যাসে পাই, সেই একই দৃশ্য আমরা পেয়েছি বিজন ভট্টাচার্যের ‘দেবিগর্জন’ নাটকে।
রাজমহল পাহাড়ে কালীপুজোর সময় বাজিকর সম্প্রদায়ের যাবতীয় শারীরিক কসরৎ ও বিচিত্রমুখী খেলাধূলার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। রহু চন্ডালের হাড়ের কেরামতিতে নিমেষে টাকা দ্বিগুন হচ্ছে। যদুদন্ডের ছোঁয়ায় যুবতীর লম্বা বিনুনি মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠছে সোজা হয়ে, আবার কোথাও নিমেষে গাছ থেকে ফল, ফল থেকে গাছ তৈরি হচ্ছে। কোথাও বা বীভৎস নরকযন্ত্রণার মহড়া – এইসব কিছুর প্রযোজনায় একজন চতুর কথক থাকে, যে সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সংস্কার-কুসংস্কার বিষয়ে অনর্গল কথা বলে গ্রাম্য মানুষকে আকর্ষণ করে। বাজিকরদের সব থেকে উত্তেজক ও রোমহর্ষক খেলা হলো একটি যুবতীকে কাঠের পাটাতনের সামনে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার চারপাশে জ্বলে মশাল। দশ হাত দূর থেকে অত্যন্ত দ্রুত ধারালো ছুরি নিক্ষেপ করে ঐ পাটাতনে।
অলৌকিক ঘটনার নিরীখে পীতেমকে দেখা দেয় দনু। রহু চন্ডালের হাড়ের ইতিহাস শোনায় দনু। রহু তার হাড় দিয়েছিল বাজিকরকে, যেন সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে। দনু পীতেমকে জানায় যে, রহু বাজিকরদের সঙ্গে থাকেন। নতুন ভূখণ্ডে তাদের সুস্থিতি না করানো পর্যন্ত তাঁর মুক্তি নেই।
সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রভাব এই জনগোষ্ঠীর উপরেও পড়ে। তাদের জীবনধারা, বাসস্থান, পোশাক–পরিচ্ছদ সমস্ত কিছুতেই আসে আমূল পরিবর্তন। তাদের দেহে প্রাচীন নুগরু, কুর্তি, ঘাঘরা কাচের কাজ করা বস্ত্র। গলায় পাথর প্রভৃতির পরিবর্তে স্থান নিয়েছে ধুতি লুঙ্গি প্রভৃতি এদেশীয় বস্ত্র, গলায় মালা করা মুর্শিদাবাদী সিক্কাগুলিও তাদের জৌলুষ হারিয়ে ফেলে। হাজার বছর এর ধূসরতা ও মলিনতা তাদের গ্রাস করে, তাদের পথ চলা থামে না । তাদের একান্ত প্রার্থনা-
‘‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু।’’
বাজিকর গোষ্ঠীর আজীবন সংগ্রাম গৃহস্থ হতে চাওয়ার মধ্যে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো কিছুতেই তারা গৃহস্থ হতে পারে না। একবার সাঁওতাল, একবার মুসলমান – এই দুই জাতির সঙ্গে মিশ্রিত হতে চেয়েও বারবার পিছিয়ে আসে তারা। এইখানে মুসলমান সমাজের একটি বিশ্বাসের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই - শহরের জমিদার বদিউল ইসলাম। তার আস্তাবলে সব থেকে ভালো ঘোড়াটি হলো সাদা রঙের আরবি মাদি ঘোড়া, তার নাম দুলদুলি। কেউ চড়ত না এই ঘোড়ায়, এটি বদিউলের সৌভাগ্যদায়ী জিনের মাদার। জিন তুষ্ট থাকে এই ঘোড়ার আশ্রয়ে, অথবা, ঘোড়া তো স্বয়ং জিন। তাই তার এরকম ব্যবস্থা। ঘোড়ার প্রভাবে জিনের কূদৃষ্টি কেটে যায়।
বাজিকর সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি সুন্দর ছবি পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। লাল সুতোয় ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে সম্পূর্ণ বাজিকর রীতিতে ষোল জোড়া বালক বালিকার বিয়ে হয়। মেয়েরা গান গায়-
‘লাল পাড়াঙ্গি রেশকি ডোরি –
দেও আওয়েতে দেওরে ভাই’।
বাজিকরদের পাশাপাশি মালো এবং ঝালো সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। মালোরা নৌকা টেনে তুলে উপুড় করে গাব আর আলকাতরা লাগায়, নিজের গায়ে মাথায় তেল মেখে চকচকে হয়। তারপর একদিন গলুইয়ের ওপর ফুল পাতা সিঁদুর ধূপ দিয়ে ‘জয় মা গঙ্গা’ বলে নদীতে ভেসে পড়ে।
আর ঝালো সম্প্রদায় মাছ ধরে পুকুর অথবা নালাতে। লম্বা লাঠির ভেতরে গলানো কয়েক হাত মাত্র সুতোর কারিগরী, নিতান্ত আটপৌরে জাল। পুরুষের পরনে অধিকাংশ সময়েই একফালি ত্যানা, আর মেয়েদের খাটো শাড়ি। মাছমারা সম্প্রদায়ের চড়ক উৎসবেরও পরিচয় পাওয়া যায়। নীলুই হয় প্রধান সন্ন্যাসী। তাকে ঠাকুরের কাঠ ঘাড়ে নিয়ে একমাস বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করতে হয়। ঠাকুরের মূর্তির স্বরূপটি হলো এই প্রকার – মসৃণ ও চকচকে কালোকাঠের নৌকা। তার উপরে খোদাই করা শিবের ও তার বাহন ষাঁড়ের মূর্তি। অন্য পাশে হাত জোড় করা দুই ভক্ত। মাঝখানে একটি শঙ্খ। এই কাঠের ঠাকুরকে নিয়ে সারা মাস ধরে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হয়। সঙ্গে থাকে ঢোল, ঢাক ও কাঁসি। দোতারা নামের বাদ্যযন্ত্রের নামও পাওয়া যায়।
এই নীলুই আবার ‘হাজরা ছাড়া’ নামক মন্ত্রের ধারক ও বাহক। সংক্রান্তির আগের রাত্তিরে মন্ত্র পড়া তেল সিঁদুর দেওয়া খড়্গ দিতে হয় কোনো ভক্তকে। ভক্ত তখন দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে সেই খড়্গ হাতে ছুটে যায়। শশ্মান মশানে ঘোরে সারারাত্তির। সেই সময় তার সামনে যাওয়া খুব বিপদের। বাবার নামে সে তখন যা খুশী তাই করতে পারে। ভূতপ্রেতেরা তখন তার সঙ্গী। ভোর হওযার আগে মড়ার মাথার খুলি নিয়ে তাকে হাজির হতে হয়। এর নাম ‘হাজরা ছড়া’।
পরবর্তী ক্ষেত্রে নলুয়া বাদিয়ার দলের পরিচয় পাওয়া যায়। যাদের মূল জীবিকাই হলো পাখি ধরা ও পাখি মারা। এক গোছা বাঁশের নল থাকে প্রত্যেকের হাতে। প্রথম নলটির মাথায় থাকে একটা লোহার ছুঁচলো কাঁটা। গাছের পঁচিশ ত্রিশ হাত উঁচুতে পাখি থাকলেও তারা অদ্ভুত নিপুণতায় পাখিকে বিদ্ধ করে।
মুসলিমদের সহায়তায় বাজিকর চাষ করার চেষ্টা করে। ধান, তরমুজ প্রভৃতির ফলন করে। বাজিকর ‘গেঁহু আর সেঁকা’ নিয়ে ভিক্ষা আর করে না। দনুর অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ শারিবাকে তার নানি লুবিনি শোনায় রহু চন্ডালের হাড়ের কেরামতির কথা-
‘‘ঘোর অমাবস্যায় এক বিটিছেলের এক ছেল্যা হবে। সি হবে একই বেটা। সি বেটাক্ মরব্যা হবে অমাবস্যার দিনোৎ আর লাশ ভাসান হবে অমাবস্যার আতোৎ। তবি সি লাশ গহিন আতোৎ থিকা উঠবা হবে। তা বাদে তার কন্ঠার হাড়ে বানাবা হবে ভান্মতির হাড়। সি হলো রহু চন্ডালের হাড়। সে হাড় হাতেৎ রাখ্যে তুমু হয়কে লয়, লয়কে হয় করতে পারবা।’’
চাষ আবাদ যখন বাজিকরদের জীবনে স্থায়ী হয়নি, তখন পেটের তাগিদে তাদের ফিরে যেতে হয়েছে সেই আদিম সংস্কার ও জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে। কারণ বেঁচে থাকাটাই আসল। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আবার ঢোলকে বাড়ি পড়ে -‘‘ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ ডুগ্ লাগ্ ভেলকি লাগ্, চোখে মুখে লাগ, হামারে ছাড়ে সবারে লাগ’’। এই ভাবেই রহু চন্ডালের হাড়ের কিসমৎ দেখায় জনসাধারণকে।
ধর্মভাবনা, দেবদেবীকে সব কিছুতেই বাজিকর আলাদা। না হিন্দু না মুসলমান। গরুও খায় আবার শুয়োরও খায়। জ্বর হলে বাজিকর বলে ‘হাতপাক’ হয়েছে। তাদের দেবী বিগামাই রুষ্ঠ হলে নাকি এরকম রোগ হয়। গলা থেকে যখন ‘লোই’ ওঠে কাশি হয় তখন তাকে বলা হয় লোইরোগ। এই রোগই নাকি বাজিকরের নিয়তি।
তাদের ধর্মস্থান হারুরান। ওলামাই, বিগামাই, কালিমাই - এই সমস্ত অজ্ঞাত দেবতা বাজিকরের রাস্তার সংগ্রহ, তার নিজস্ব কিছু নয়। তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানের গানগুলি এরকম-
“দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
বান্ধনা তো সারিমাদে
দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
মাকরানা সারিমাদে
দেও আওয়েতো দেওরে ভাই
সাপনারা সারিমাদে।’’
লুবিনির মৃত্যুর সঙ্গেই বাজিকরদের একটি যুগ শেষ হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় নতুন যুগ হিন্দুস্থান-পাকিস্থান বিভাজনের প্রাক্ মুহূর্তে এবং তেভাগা আন্দোলনের পরবর্তীকালে। বাজিকরদের উত্তরসূরী শারিবা অল্প বয়স থেকেই হাপু গান গায়। হাপু একটি দীর্ঘ ছড়া। গান ও আবৃত্তির মাঝামাঝি একটি সুরে গাওয়া হয়। হাতে থাকে একটি মোটা পাঁচন লাঠি আর মুখ নাখ ও বগল ইত্যাদি নির্গত বিভিন্ন বিকৃত ধ্বনি, শীৎকার। গানের সঙ্গে লাঠি দিয়ে গায়ক, শরীরের যেসব অঙ্গে আঘাত করলে শব্দ বেশি হয়, সেখানে আঘাত করে। গানের শেষাংশে লাঠির বাড়ি এমন দ্রুত হয় যে, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অনেক সময় লাঠি কেড়ে নেয়। এইভাবে শারিবা উপার্জন করে।
বাজিকর বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করে অকৃতকার্য হয়ে বারবার নিজেদের আদিম শেকড়ের কাছে ফিরে আসে ও আশ্রয় পায় দুর্দিনে। বাজিকর নারীর সতীত্বের বড়াই নেই। একই রক্তের মধ্যে বারবার মিশ্রণ হয়, যদিও জামির নির্দেশ দিয়েছিল মেয়েদের দূরে পাঠাবে আর ছেলেদের বউ আনবে দূর থেকে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। ফলশ্রুতি – শিশুমৃত্যু, অকাল মৃত্যু। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ তাদের ভাষায় হয়ে যায়-‘শোগর মরি আর ইওয়া’।
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শাহজী-অন্নদাদিদির মতো রূপা বাজিকর সাপুড়ে বৃত্তি অবলম্বন করে উপার্জন করে। সাপুড়ে গোষ্ঠীর বিভিন্ন তুক্তাক ও বাচনভঙ্গি উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। দেশ বিভাজনের ফলে বাজিকর আর স্বতন্ত্র হিসাবে থাকতে পারে না। তারা ঠাঁই পায় মুসলমান সমাজে। নতুন করে তারা মুসলমানদের ধর্ম ভাবনা ও আচার আচরণের সঙ্গে মিলিত হয়। শুধু রূপা বাজিকর মুসলিম হয় না। কারণ হিন্দুকে বিয়ে করে তার রক্তে হিন্দুত্বের সংস্কার ঢুকে গেছে। বিষহরির গান বাজিকর গায় না। কিন্তু রূপা গায়। মুসলমানদের সঙ্গেই বাজিকরের বেশি মিল। নামের দিক থেকেও, খাদ্যের দিক থেকেও। হিন্দুর সঙ্গে নাম বা খাদ্যে মিল নেই।
অবশেষে অপর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে হয়তো তারা থিতু হয়। কিন্তু বাজিকরের অস্তিত্ব হারিয়ে যায়। তারা অবহেলিত অচ্ছুত জাতি, যাদের নিজস্ব কোনো বাসস্থান নেই এই পৃথিবীতে। সব বাজিকর জানে ‘রহু চন্ডালের হাড়’ কথাটাই ঐন্দ্রজালিক, বুজরুকি। তবুও তারা বিশ্বাস করে, স্বপ্ন দেখ্ এবং তার সার্থক অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা ভাবে। ‘রহু চন্ডালের হাড়’ তার সঙ্গে সম্পর্ক ঘোর অমাবস্যার। পীতেম, জামিরের মতো শারিবাও জানে, রহুর হাড় লুকিয়ে আছে কোনো এক ভূ-খন্ডের মাটির গভীরে। সে স্থানটি বাজিকরকে খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানটি বের করার জন্যই তাদের পথে পথে ঘোরা। সকলেই সেই হাড় নিজের মতোন করে খোঁজে; এবং সেই ভূ-খন্ডেই হবে তাদের স্থিতি, স্থায়িত্ব, স্বস্তি ও শান্তি।
একটি জাতির সংগ্রামের কাহিনী ও তাদের বিভিন্ন সংস্কার - এই দুটি মৌল উপাদানের ওপর নির্ভর করে, অভিজিৎ সেনের ‘রহু চন্ডালের হাড়’ উপন্যাসে এসেছে আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়ানো এক চিরায়ত জীবনের উপলদ্ধি। বোদল্যেয়র বলেছিলেন-কুৎসিতেরও সৌন্দর্য আছে। তাই বিশিষ্ঠ জনজাতি-জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস হয়েও আসলে এটি এক সার্বজনীন উপন্যাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন