রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ০৭

সম্পাদকীয়


বাংলা ভাষায় ‘রঙ্গ’ শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হয় কৌতুক অর্থে। এছাড়া হাসি-মস্করা-লাস্য অর্থেও ব্যবহার করা হয়। আমরা এখানে ‘রঙ্গ’ শব্দটিকে একটু ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করতে আগ্রহী। আমরা সাধারণ ভাবে ইংরেজি ‘Drama’ এবং ‘Thetare’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘নাটক’ শব্দটি উচ্চারণ করে থাকি। এবং একথাও ঠিক যে, সেই লেবেডফ-এর সময় থেকে এখনও পর্যন্ত যে বাংলা নাটক পরিবেশিত হয়ে আসছে, তা নিশ্চিত ভাবেই পাশ্চাত্য প্রভাবিত। কিন্তু একই সঙ্গে একথাও স্মরণ করতে হবে যে, আমাদের দেশে সেই প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃত ভাষায় নাটক রচিত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে। এবং তা নিতান্তই দেশি। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন থাক্‌। আমরা এখানে ‘নাটক’ শব্দটির পরিবর্তে ‘রঙ্গ’ শব্দটি বেছে নিয়েছি, আর তার ‘উপসর্গ’ রূপে যোগ করেছি ‘অণু’ শব্দটি, যার পাতি অর্থ হচ্ছে ছোট বা ক্ষুদ্র। অর্থাৎ ‘অণুরঙ্গ’ শিরোনামে যে নতুন বিভাগটি এই সংখ্যা থেকে শুরু করা হলো, তাতে আমরা প্রত্যেক সংখ্যায় এক বা একাধিক ছোট ‘রঙ্গ’ বা নাটক প্রকাশ করব। ‘নাটক’ শব্দটির পরিবর্তে ‘রঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করায় যদি কারও মনে সংশয় থাকে, তাঁকে আমরা এই প্রসঙ্গে ‘রঙ্গমঞ্চ’ ও ‘রঙ্গালয়’, অন্তত এই দুটি শব্দের কথা মনে করিয়ে দিতে আগ্রহী। প্রসঙ্গত এখানে আরেকটি কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। নাটক মূলত লেখা হয় অভিনয় করার জন্য। এবং তার জন্য একান্ত জরুরি একটি মঞ্চ। আর এভাবেই পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষায় নাটক হয়ে আসছে। আর বলা বাহুল্য, তার অনেক শ্রেণীবিভাগ, আঙ্গিকবিভাগ, মাত্রাবিভাগ আছে। এবং এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে একটি নতুন ধারার নাটকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তার নামকরণ হয়েছে ‘শ্রুতিনাটক’। এই শ্রুতিনাটক বস্তুতপক্ষে শুরু হয়েছে ‘আকাশবাণী’ থেকে, ‘বেতার নাটক’ রূপে যা আমাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যাইহোক্‌, যে কথাটা এখানে বলা প্রয়োজন, ‘অণুরঙ্গ’ বিভাগে যে নাটকগুলি প্রকাশ করা হবে, সেই নাটকগুলি কতটা অভিনয়যোগ্য হয়ে উঠবে, আমরা জানি না। এমনকি শ্রুতিনাটক পর্যায়ে উন্নীত হবে কিনা, তাও আমরা বলতে পারছি না। কিন্তু তা যেন পাঠযোগ্য নাটক রূপে সবার কাছে সমাদৃত হয়, এজন্য আমরা সচেতন থাকব। সেইসঙ্গে আমরা আশা করব, আপনারা আমাদের এই নতুন ভাবনার সঙ্গে সহমত হবেন।

‘অণুরঙ্গ’ বিভাগ ছাড়া আমরা আরও একটি নতুন বিভাগ এই সংখ্যা থেকে শুরু করছি। ‘দীর্ঘ কবিতা’। একটা সময় ছিল, যখন সব প্রায় কবিতাই হতো দীর্ঘ কবিতা। তা সে মহাকাব্য, আখ্যানকাব্য, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদকাব্য, জীবনীকাব্য ইত্যাদি যাই হোক না কেন। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল, যেমন বৈষ্ণব পদাবলি। আর এই ধরনের গীতি কবিতার পথ ধরেই এক সময় বাংলা ভাষায় আবির্ভূত হয়েছিল খন্ডকবিতা। ইদানীং দীর্ঘ কবিতা রচনার প্রবণতা খুবই কম। আমরা তাসত্ত্বেও ‘দীর্ঘ কবিতা’ বিভাগটি শুরু করলাম। আশাকরি, এই বিভাগটিও আপনাদের কাছে সমাদৃত হবে।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : kalimationline100@gmail.com / kajalsen1952@gmail.com
প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :  0657-2757506 / 09835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002,
Jharkhand, India.



০১ বৈজয়ন্ত রাহা


আমার চোখে কবি নীরেন্দ্রনাথ
বৈজয়ন্ত রাহা


জীবন যখন রৌদ্র-ঝলোমল,
উচ্চকিত হাসির জের টেনে,
অনেক ভালোবাসার কথা জেনে,
সারাটা দিন দুরন্ত উচ্ছ্বল
নেশার ঘোরে কাটল। সব আশা
রাত্রি এলেই আবার কেড়ে নিও,
অন্ধকারে দু-চোখ ভরে দিও
আর কিছু নয়, আলোর ভালোবাসা।

একদম ছেলেবয়সে, পাড়ার মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে ভয়ে পা ঠকঠক করে কাঁপত, আর একটাই ছোট কবিতা মুখস্ত করার চেষ্টা করতাম... ‘শেষ প্রার্থনা’, কবি নীরেন্দ্রনাথ। উনি সেই থেকেই ভরসা। সত্যি কথা বলতে, কিছুই বুঝতাম না কবিতার অর্থ, কিন্তু পড়তে ভালো লাগতো। ছন্দের ব্যবহার, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত... তাঁর কবিতা থেকেই ধীরে ধীরে বুঝেছি; আজ তাই তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে হাত যে একটু কাঁপছে না, তা নয়।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে আমি চিনেছি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়েই, তাঁর সাথে ব্যাক্তিগত আলাপ করার কোনো সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাই এই লেখাটি তাঁর কবিতা ও গদ্য আমাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তারই একটি ছায়াপাত হবে।

তখন ক্লাস সেভেন-এ পড়ি, বাবা বাড়িতে নিয়ে এলেন ঝকঝকে মলাটের একটি শিশুপত্রিকা – ‘আনন্দমেলা’। ‘সন্দেশ’, ‘শুকতারা’ তো আসতই, এবার তার সাথে যুক্ত হলো ‘আনন্দমেলা’ -- সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। সেই থেকে মাসিক ‘আনান্দমেলা’র ভক্ত হয়ে ওঠা। শুধু মাসিক-এ চলত না, শারদীয়া সংখ্যাও চাইই চাই। অদ্ভুত সুন্দর মলাট, কী সুন্দর কাগজ, হরফগুলিও সুন্দর। আমি আর আমার ছোটবোন কাড়াকাড়ি করতাম -- আজও মনে পড়ে।

একদিন বাবা কিনে নিয়ে এলেন ‘সাদা বাঘ’ -- অবাক হয়ে পড়লাম -- কী অপূর্ব ঝরঝরে ভাষা, কী সাবলীল শব্দনির্মাণ! পড়ে, কয়েকদিন পরেই মাকে নিয়ে কলেজস্ট্রীট দৌড়লাম --‘পিতৃপুরুষ’ কিনব বলে। প্রতিটি কিশোরের পড়া উচিৎ তার শিশুপাঠ্য ও কিশোর পাঠ্য রচনা।

কবিতাকে ভালোবেসেছিলাম, একেবারে ছোট বয়স থেকেই; কী করে, আজও জানি না। জানি শুধু কবিতা পড়তে ও শুনতে ভালো লাগতো। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, কী তার কারণ, আমি কোনো সদুত্তর দিতে পারব না... আর এটা আমি জানি -- সেই ভালো লাগার মূল সুরটি, লাটাই-এর সেই সুতোটি ছিল কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর হাতে।

তখন ক্লাস টেন-এ পড়ি। নিজে থেকেই গিয়ে ভর্তি হলাম পার্থ ঘোষের কাছে। বাড়ির কাছেই তাঁর আবৃত্তি শেখানোর ক্লাস। তিনি প্রথম দিনেই বললেন -- ‘খাতা খোলো, একটা কবিতা আগে লেখ, তারপর দেখাবো’। আমি উঁকি মেরে দেখলাম, তাঁর হাতের বইটার নাম ‘নীল নির্জন’ -- তিনি পড়তে শুরু করলেন,

কেন আর কান্নার ছায়ায়
অস্ফুট ব্যথার কানে কানে
কথা বলো, বেলা বয়ে যায়,
এসো এই রৌদ্রের বাগানে।

এসো অফুরন্ত হাওয়ায়,
স্তবকিত সবুজ পাতার
কিশোর মুঠির ফাঁকে ফাঁকে
সারাটা সকাল গায়ে গায়ে
যেখানে টগর জুঁই আর
সূর্যমুখীরা চেয়ে থাকে।...

কবির নাম পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলাম না... আমি অফুরন্ত হাওয়ায় ভেসে যেতে যেতে মাঠের ঘাসের শিশিরের জল ছুঁয়ে, রোদ্দুর হয়ে ধু ধু আকাশের ঘরে নীরব ছলছল শুনতে লাগলাম...

এই আলো হাওয়ার সকাল--
শোনো ওগো সুখবিলাসিনী,
কতদিন এখানে আসিনি,
কত হাসি কত গান আশা
দূরে ঠেলে দিয়ে কতকাল
হয়নি তোমায় ভালোবাসা।

কী আশ্চর্য ভালোবাসার কথা প্রতি ছত্রে ছত্রে...

সে এক পরম শিল্পী। সংশয়-দ্বিধার অন্ধকারে
সেই বারে বারে
আলোকবর্তিকা জ্বালে, দুঃখ তার পায়ে মাথা কোটে,
তারই তো চুম্বনে ফুল ফোটে,
সেই তো প্রাণের বন্যা ঢালে
তুঙ্গভদ্রায়, গঙ্গায় কি ভাকরা-নাঙ্গালে ।
সে এক আশ্চর্য কবি, পাথরের গায়ে
সেই ব্রহ্মকমল ফোটায়।
হ্যাঁ, সে এক আশ্চর্য কবি! কবি নীরেন্দ্রনাথ!

বাবা টিফিনের পয়সা দিতেন একটাকা করে। পঞ্চাশ পয়সার টিফিন করে বাকিটা জমানো ছিল স্বভাব। জমিয়ে জমিয়ে আট দশটাকা হলেই দৌড়, কলেজস্ট্রীট। সেবারে তিনবন্ধু গেলাম, আর কিনে নিয়ে এলাম ‘অন্ধকার বারান্দা’। বাংলার ক্লাসে শ্যামলবাবু বলেছিলেন, শুধু সুকান্তরই ‘প্রিয়তমাসু’ নেই, নীরেন্দ্রনাথেরও আছে। বইটা পরেরদিনই দেখালাম স্যারকে। তিনি বললেন, এই কবিতা থেকে শিখবি, গদ্যকবিতায় ছন্দ অন্তর্লীন থাকে, গদ্যকবিতায় এতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুব কম কবিরই আছে...

তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।

তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।

তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।

এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।

কী অপূর্ব ছন্দ, যার প্রকাশ নেই, যা অন্তর্লীন, এ এক অসামান্য গদ্যকবিতা, ‘প্রিয়তমাসু’।

১৯৮৫ সাল। তানপুরার বার্ষিক অনুষ্ঠান। পার্থবাবুর সব ছাত্ররা আলাদা আলাদা করে কবিতা উপস্থাপন করবে মঞ্চে। কেউ করবে সুনীল, কেউ শঙ্খ, কেউ রবীন্দ্রনাথ, কেউ নজরুল, আমি কী করব, পার্থদা জিজ্ঞেস করতেই আমি বললাম, কেন? ‘মৌলিক নিষাদ’--

পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটিও তারা আজ।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই -- শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।
এ এক আশ্চর্য সময়।
যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
যখন পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
পিতামহ, আমি এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন আকাশে আলো নেই,
যখন মাটিতে আলো নেই,
যখন সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ -- ভয়।

কী অমোঘ কবিতা, কী চিরন্তন সত্য, যে কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে সমসাময়িক। সমস্ত কলেজজীবন জুড়ে কবিতা চর্চা, আর কবিতা পাঠ, আর পাঠ মানেই অবিসংবাদিত ভাবে নীরেন্দ্রনাথ। তখন টিউশনি করি, নিজের উপার্জন আছে। বাবার কাছে হাত পাততে হয় না, প্রথম খরচাই হলো কবিতার বই কেনা। বইমেলায় যাই, আর অন্তত পক্ষে ৫০০, ১০০০ টাকার বই কিনবই। কিনে ফেললাম ‘নীরক্তকরবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘উলঙ্গ রাজা’; আর লক্ষ্য করতে লাগলাম, তাঁর কবিতার ভাব, ভাষা-শৈলীর কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ‘অন্ধকার বারান্দা’র অমলকান্তি প্রাক-যৌবনে কাঁধে হাত রেখেছিল রোদ্দুর হতে পারেনি বলে, যৌবনে পা দিয়েই পড়লাম—

আমরা দেখি না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ একদিন
পূর্বাকাশে সেই শুদ্ধ উদ্ভাস দেখেছে,
যাকে দেখে মনে হতো, নিহত সিংহের পিঠে গর্বিত পা রেখে
স্বর্গের শিকারী দাঁড়িয়েছে।
আমরা এখন সেই উদ্ভাস দেখি না।(‘নীরক্ত করবী’)

পড়ে চমকে উঠলাম

তোমরা পুরনো বন্ধু। তোমরা আগের মতোই আছো।
আগের মতোই স্থির শান্ত স্বাভাবিক।
দেখে ভালো লাগে।
প্রাচীন প্রথার প্রতি আনুগত্যবশত তোমরা
এখনও প্রত্যহ দেখা দাও,
কুশল জিজ্ঞাসা করো আজও।
দেখে ভালো লাগে।
তোমরা এখনও সুস্থ অনুগত আলোকিত আছ। (‘নরকবাসের পর’)

অদ্ভুত এক গল্পগাঁথার মতো নিজস্ব কথোপকথন, কবিতার ধারা ঘুরে যাচ্ছে নতুন যুগের মোড়ে... বুঝলাম আরও অপেক্ষার পালা।

রাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়কে। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদোর উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল। (‘অন্ধের সমাজে একা’)
অথবা
ফুলেও সুগন্ধ নেই। অন্ততঃ আমার
যৌবনবয়সে ছিল যতখানি, আজ তার অর্ধেক পাই না।
এখন আকাশ পাংশু, পায়ের তলায় ঘাস
অর্ধেক সবুজ, নদী নীল নয়। তা ছাড়া দেখুন,
স্ট্রবেরি বিস্বাদ, মাংস রবারের মতো শক্ত। ভীষণ সেয়ানা
গোরুগুলি। (‘বার্মিংহামের বুড়ো’)

হাত ধরে কবিতার ভাষা শেখাচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ... যে কোনো শব্দের কত রকম যে ব্যবহার, বহুপ্রচলিত শব্দকে একটুও ক্লিশে না করে নতুন ভাবে প্রয়োগ, দেখাচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ...

ভালোবাসলে শান্তি হয়, কিন্তু আমি কাকে আজ ভালোবাসতে পারি?
কবিতাকে? কবিতার অর্থ কি? কবিতা
বলতে কি এখনও আমি কল্পনালতার ছবি দেখে যাব? (‘কবিতা কল্পনালতা’)
কী অসম্ভব নাটকীয়তা তুলে এনেছেন তিনি
‘বাতাসি, বাতাসি’! -- লোকটা ভয়ঙ্কর চেঁচাতে চেঁচাতে
গুমটির পিছন দিকে ছুটে গেল
ধাবিত ট্রেনের থেকে এই দৃশ্য চকিতে দেখলুম।
কে বাতাসি? জোয়ান লোকটা অত ভয়ঙ্করভাবে
তাকে ডাকে কেন? কেন
হাওয়ার ভিতরে বাবরি-চুল উড়িয়ে
পাগলের মতো
‘বাতাসি, বাতাসি’! বলে ছুটে যায়? (‘বাতাসি’)
তুলে নিয়ে আসেন কথ্য পরিমন্ডলে ছন্দের জাদু...
অকস্মাৎ কে চেঁচিয়ে উঠল রক্তে ঝাঁকি দিয়ে
“নিলাম, নিলাম, নিলাম!”
আমি তোমার বুকের মধ্যে উঁকি মারতে গিয়ে
চমকে উঠেছিলাম (‘দুপুরবেলায় নিলাম’)
কবির অন্তর্বর্তী যাত্রা আমাকে মোহিত করে রাখে দীর্ঘদিন, দীর্ঘকাল—
বাইরে এসো, ...কে যেন বুকের মধ্যে
বলে ওঠে... বাইরে এসো... এখুনি আমার
বুকের ভিতরে কার
স্নান সমাপন হলো!
সারাদিন ঘুরেছি অনেক দূরে দূরে।
তবুও বাইরে যাওয়া হলো না। ঘরের
ভিতরে অনেক দূরে দূরে
পা ফেলেছি। ঘরের ভিতরে
দশ-বিশ মাইল আমি ঘুরেছি! এখন
সন্ধ্যায় কে যেন ফের বুকের ভিতরে
বলে উঠল : এসো।
বাইরে এসো... কে যেন বুকের ভিতর ঘড়ির ঘন্টায়
বলে যাচ্ছে। এখুনি আমার
বুকের ভিতর যেন কার
অবগাহনের পালা সমাপন হলো।
কোনো একটিও ছন্দের আভাস পর্যন্ত নেই, কিন্তু কোথাও যেন এক অদ্ভুত ছন্দের ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতময়তাই নতুন দিকের সূচনার আভাস নিয়ে এলো কবিতায়।
কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই কেনা ‘কলকাতার যিশু’

লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল---
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু...

নাটকীয়তা, দৃশ্যকল্প, ও এক অসাধারণ মেসেজ -- যান্ত্রিকতাকে বিদ্রুপ করে উঠল অকুন্ঠিত জীবন... একবার কলমের জোরটা ভাবতে হয়...

১৯৭১ সালের প্রকাশিত বই, আমার হাতে এলো ১৯৮৮তে, ‘উলঙ্গ রাজা’

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহূর্মুহু;
জমে উঠছে স্তাবকবৃন্দের ভীড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।
পরিষ্কার দ্বিধাহীন চিত্তে রাজনৈতিক কবিতাটি উনি লেখেন... আর আমরা ভাবি এভাবেও লেখা যায়!
কবিতা ধীরে সাংকেতিক হয়ে উঠছে -- তিনি লিখে চলেছেন—

এই তো আমার অঞ্জলিতেই মস্ত পুকুর,
কেউ আচমকা ছুঁড়লে ঢেলা
দেখতে থাকি কেমন করে প্রকাশ্য হয়
খুব নগণ্য ছেলেবেলা। ... সাংকেতিক কিন্তু দূর্বোধ্য নয়... তাই প্রিয়।

সমস্ত দেওয়ালে
এখন নিজস্ব হাতে নিজস্ব ভাষায় লিখবার সময়ে
কে ভালোবাসার দিকে তুলেছ বন্দুক,
দূরে যাও।
সময়টা মনে রাখতে হবে -- ১৯৭১ সাল। গোটা বাংলা বিপর্যস্ত, তরুণ যুবকের রক্তে ভেসে যাচ্ছে কলকাতা থেকে তামাম পশ্চিমবঙ্গ...
মুঠি খোল,
কী আছে দেখাও।
কিছু নেই,
পথে-পথে শিশুরা যা কুড়িয়ে বেড়ায়
বারো মাস,
তা ছাড়া কিছুই নেই।
তাঁর লেখার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠি... “স্রোতের টানে, আশির নখ শিউরে ওঠে অন্ধকারে”

তাঁর লেখাকে, তাঁর লেখক-জীবনকে যদি মাপতে চাই ১৯৭৪ সালের সাহিত্য আকাডেমী পুরস্কার দিয়ে, তাহলে এই ৮৯ বছরের ইতিহাসকে মাপতে বড় ভুল হয়ে যাবে। কবিকে, কবির জীবনকে মাপতে নেই, কারণ নীরেন্দ্রনাথের মতো কবিরা জীবনের থেকে অনেক বড় মাপের হন... লক্ষ মানুষের বুকের ভিতর অনেক অনেক নতুন জীবন তাঁদের ধরে রাখে..

তিনি চলতে থাকেন... তাঁর পিছনে চলতে থাকে অফুরন্ত জীবন... যার অপর নাম মৃত্যুহীন প্রাণ, যে কোনোদিন কোথাও পৌঁছয় না, শুধু চলাই যার জীবন, চলার পথে অগণিত ফুল ফোটানোই যাঁর ধ্যান... তাঁকে কী দিয়ে মাপা যায়?

কক্ষনো কি তোমাদের কাউকে
এমন কথা বলেছিলুম যে, আমি
পৌঁছে গেছি?
তাহলে তোমরা ধরেই নিও যে,
কথাটা মিথ্যে,
কিংবা আমার বিশ্বাসে অনেক
ভেজাল ছিল।
আমি শুধু যাওয়ার কথাই বলি
পৌঁছোবার কথা বলি না।
আসলে পৌঁছোনটা যে খুব জরুরী
এমন বিশ্বাসই আমার নেই।
যাওয়াতে যারা বিশ্বাস কর
তারা আমার সঙ্গে চল।
যারা পৌঁছতে চাও, তারা
এসো না।


০২ শমীক ষান্নিগ্রাহী

আমার নষ্টছবি
শমীক ষান্নিগ্রাহী


কবিতার হাত ধরে কত বিকেল পেরোলাম। এক এক সময় ভাবি, কত বিকেল হারিয়েছি ছোটবেলায়... তা কি এখন ফিরে আসছে কবিতা হয়ে! হাইওয়ে জুড়ে আমার কাজকর্ম। রাস্তার পাশ ফিরে বিশাল নদী। এক উন্মাদনায় ছুটতেই থাকি... ছুটতে ছুটতে ঘুম ভাঙে। ফিরে দেখি তখনও ব্রীজের ওপরেই... শুধু নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে শুকনো নদী বহু বছর ধরে। কবিতায় ফিরে আসছি নিয়ম মেনে, তাই হয় নাকি! আগাপাশতলা নিজের মতো করে লিখে যাওয়া কোনো ডিকশন ছাড়াই! রঙ তুলি ছাড়াই পেন্সিল স্কেচে গোটা একটা কবিতা... ভাবতে ভালো লাগে আঁকাআঁকি ভুলিনি এখনও। গান হয়ে ওঠা শব্দগুলো যেন সুর ছাড়া বেজে যাচ্ছে একটানা নিজের মনে। চর্চার মধ্যেই চর্বিতচর্বন... একই ঘাসের জাবর কেটে যাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। কবিতা কেন লিখি? কোনো উত্তর নেই। মনে হয়, যাপনে অনেক কথা বলেও বলতে পারি না, বাকি থেকে যায়। হয়তো এই মূক কথাগুলো শব্দ হয়ে লিখে ফেলে আমায়। অনেক সময় এই বাকি কথাগুলো হারিয়ে যায় জীবনযাপনের অজস্র কথার মধ্যে... আর কবিতাও ফুরিয়ে যায় ধীরে ধীরে। এই চিন্তাভাবনা কতটা সঠিক, যেমন কোন্‌টা কবিতা আর কোন্‌টা কবিতা হয়ে ওঠেনি? বিতর্ক থাক্‌, শুধু ভালোলাগার মধ্যে ডুবে যাই চলো...

কাঁদছি
কেননা ভালোবেসেছি
কেননা হারিয়ে ফেলেছি (সজল বন্দ্যোপাধ্যায়)

০৩ স্বপন রায়

রেলা-১
স্বপন রায়


জিগর থেকে বেরোয় তাই জিগরী দোস্ত! রেল, রেললাইন এই জিগরে জড়ানো এক সমান্তরাল দোস্তানা আমার, যা ফুরোয় না, চাক্কা জ্যাম হলেও চলতে থাকে! জামশেদপুর মামাবাড়ি, ছোট্ট আমার অবধারিত গন্তব্য... তবে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বাবা, মা ছাড়া প্রথম সেই ভারী মজার শহরে যাওয়া, মা আমায় যাতায়াতের ভাড়া আর দশ টাকা দিয়ে বললেন, আর এই দুটো টাকা রাখ, খিদে পেলে কিছু খেয়ে নিবি... আমার হাফ টিকিটের বয়স পেরিয়ে গেছে, তাতে কী? আমি হাফটিকিট কেটেই উঠে বসলাম আমার প্রথম একাকী রেল ভ্রমণের থার্ড ক্লাসে। অজান্তেই রেলবাহিত আমার সেই যাত্রা শুরু হলো ক্লাসলেস আত্মজীবনের দিকে!

এরপর পুরো রাউরকেলা থেকে জামশেদপুর এক অন্তর্গত ধ্বনিপ্রবাহ আমায় রক-এন-রোলে টিউনড করে তুললো! টি.টি দেখলেই ধ্বক ধ্বক আর না দেখলে সনাতনী রেল-রেওয়াজ : ঝিক ঝিক... মা’র দেওয়া দশ টাকা আর হাফটিকিট কেটে বাঁচানো ছ’ টাকা এই ষোলো টাকার মধ্যে পনেরো টাকা আমি হাফ-প্যান্টের গোপন পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম, ৫০ পয়সার চিনেবাদামের চর্ব্য চোষ্য পার করে বাকি ৫০ পয়সা আমার প্যাণ্টের সাইড পকেটে ঢুকে গেলো।

আমার হাফপ্যান্ট এবং নিরীহ চাউনি টি.টিদের নিয়ে এলো না, সন্দেহ করার ন্যূনতম যোগ্যতা আমার না থাকায় এই সুযোগ আমি পেয়ে গেলাম, আমার পাশের লোকটি আমায় ওই একই কারণে স্নেহচোবানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো : “কোথায় জায়গা?”

বাঙালি হিন্দি বলছে, আমায় কি বাঙালি মনে হয় না? অনেকদিন পরে একটি কবিতাসভায় এক ওড়িয়া মহিলাকবি আমায় পাঞ্জাবি ভেবেছিলো। সিকিমে তো আমায় দাজু বলেই ডাকে... এই মুখ-সমস্যা আমার শুরু থেকেই, সেই অনতিমুখর রেলযাত্রাতেও আমায় বাঙালি ভদ্রলোকের হিন্দি সহ্য করতে হচ্ছিল!

-ও টাটা যায়গা? ওখান মে অনেক গুন্ডা হ্যায় না?

-পতা নহি

-একলা একলা যাতা হ্যায় কিঁউ খোকা?

মনে মনে বললাম, তাতে আপনার কি?

মুখে কিছু না!

-তমকো একা একা বাবা মা ছোড় দিয়া? টাটা শুনা হ্যায় খুবই ইয়ে হ্যায়... মানে সাঙ্ঘাতিক হ্যায়... তুম ছোট হ্যায়, বিপদ মে পড়েগা তো ক্যা করেগা?

আমি চুপ করে থাকি। আমার একমাত্র বিপদ টি.টি। যদি ধরেগা তো ক্যা করেগা জানতা নহি!

ট্রেনের যে স্বভাবী বিট রয়েছে, তাতে অনেক কিছুই খাপ খেয়ে যায়। যেমন আমার সদ্য জেগে ওঠা কবিতাপ্রেম! ‘রেল চলে/মন টলে/রেল দোলে/মন বলে/আয় দেখি/ঝিকঝিকি/বাঁক নেয়া/ছাপ দেয়া/এই ট্রেনে/কে জানে/হয় কেনো/ধুকপুকই/আয় খুকি/আয় খুকি... এই জায়গায় থেমে গেলাম, শালার খুকি কোত্থেকে এলো... হেমন্ত আর শ্রাবন্তীর গানটা ঢুকে গেলো নাকি? ওই যে, “আয় খুকু আয়...” দুত্তোর! আমি বাদামে ফিরে আসি...

বাইরে সারান্ডা ছুঁয়ে ট্রেন চলেছে, জলের বিমনে রাখা জঙ্গল, জঙ্গলের সম্মোহনে রাখা অম্বরছাপ নীলাসক্তি, যেখানে কাশব্রাশের ডগায় আঁকা অক্টোবরী মেঘ, আর আমি জানালা দিয়ে এই সব ভাবী কবিতার বিচরণ দেখছি, ট্রেন চললে দৃশ্য সচল হয়ে ওঠে, একজন কিশোর তাতে পদ্য মেশায়, পদ্যে লা জবাব সামোসার গন্ধ ঢুকে যায়, ফেরিওয়ালা চেঁচায়, তার শিরার ফেটানো রঙে মিশে যায় ট্রেনের হর্ন, গতি কমে ট্রেনের, স্টেশন আসছে, চক্রধরপুর! আমার পাশের লোকটি কেন কে জানে তার বং-হিন্দিতে হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করে, -খোকা তোমারা বাপকা নাম কি?

-দেবানন্দ!

-ও... হে হে ফিলিম আর্টিস্ট কা নাম... বাঃ বাঃ... আউর তোমারা নাম?

-বিবেকানন্দ!

লোকটি আমায় দেখে কিছু একটা ভেবে নেয়, মুখ দিয়ে হুম টাইপের আওয়াজ বের করে চা-অলাকে ডাকতে থাকে...

চক্রধরপুরের পকৌড়া আর আলুর দম এক টাকায়, আমার গোপন সঞ্চয় এক টাকা কমে যায় স্বখাত স্বাদুলায়, তবে ওই রেলবিরল দমের ঝাঁ ঝাঁ আর কোথায় পাবো? খেতে খেতে পাশের লোকটিকে দেখতে থাকি। পুরো চুপ, বোলতি বন্ধ একেবারে! ট্রেন আবার দুলে ওঠে, আমি ভাবতে থাকি জামশেদপুর, আস্কারা টাস্কারা মামাবাড়ির, আর জুবিলি পার্ক যাওয়ার সেই রাস্তাটা যেখানে নির্জনতা দেরি করে আসা আলস্যের ছায়ায় শুয়ে থাকে, কাউকে দূর থেকে দেখে মনে হয় হাসছে আর হাসিতে জড়িয়ে যাচ্ছে দুধারা বিনুনী!

তো এসে যায় জামশেদপুর, টাটা! আমি সম্ভবত জুলিয়াস সিজারের হাসি দিয়ে(হাসিটা কেমন?) নেমে আসি আমার প্রথম স্বাধীন রেলযাত্রা শেষ করে। প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক তাকাই, গোঁফের মিহি রেখায় হাত বুলিয়ে শিস দিতে থাকি, ‘এ দিল না হোতা বেচারা...’

হাফপ্যান্ট, বুশসার্ট, কিটস-ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম প্রায়, টি.টি হাত চেপে ধরলো!

-ইয়ে টিকিট তুমহারা

-জী

-হাফটিকিট কিঁউ?

-মেরা ওমর গিয়ারাহ সাল

-আচ্ছা, তো বার্থ সারটিফিকেট দিখা

-ক্যা স্যার... ও তো ঘর মে হ্যায়

আমি বলছি আর ঘামছি, তীরে এসে তরী ডুবতে চলেছে!

-কাঁহা হ্যায় বে তেরা ঘর?

-রাউরকেলা

-তু তো পক্কা খিলাড়ি লগতা হ্যায়... হাফটিকিট... উল্লু বনা রহা হ্যায় হমলোগোঁকো?

-স্যার মেরা ওমর গিয়ারাহই হ্যায়

-প্রুফ ক্যা হ্যায় তেরা পাস? ফাইন লেকে পঁচ্চিশ রপায়া... নিকাল ওউর রাস্তা নাপ

-মেরা পাস কুছ নহি হ্যায় আঙ্কল

-আঙ্কল? মস্কা মত্‌ মার... তু সফর কর রহা হ্যায়... তেরা ঘরবালা কুছ নহি দিয়া তেরে কো?

আমার গোপন পকেটে রাখা পনেরো, থুড়ি চোদ্দ টাকা শিউরে ওঠে... অনেক কষ্টে চোখে জল এনে বলি, ‘আঙ্কল হমলোগ বহুত গরীব হ্যায়... কিসি তরহ টিকিট কা পয়সা জুগাড় হুয়া... মেরা মামাকা ঘর হ্যায় ইঁহা... মেরা পঢ়াই বন্ধ হো গিয়া থা... মামালোগ মা কো বোলা মুঝে ভেজনে কে লিয়ে পঢ়াই কে বাস্তে... বহুত গরীব হ্যায় হম আঙ্কলজী...

আমার চোখে এত জল ছিলো?

টি.টি আমার কান্না দেখে গলার স্বর নরম করে বললো, ঠিক হ্যায়, রোনা বন্ধ কর, পকেট মে কিতনা হ্যায় নিকাল...

আমি কাঁদতে কাঁদতে দুটো পকেট উল্টে দিই... সেই একাকী পঞ্চাশ পয়সা তার আট আনার শরীর নিয়ে খটাং করে পড়ে যায় টি.টি.র জুতোর ডগায়...

টি.টি ওই আটআনা কুড়িয়ে নিয়ে বলে, তু তো সচমুচ গরীব হ্যায়... ঠিক হ্যায় ইসিমে কাম চলা লেতে হ্যাঁয়... অব ফুট ইহাঁ সে...

আমি প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে স্তালিনের হাসিটা দিয়ে গাইতে থাকি, ‘জাগো জাগো সর্বহারা, অনশন বন্দী ক্রীতদাস...’। জামশেদপুরের সন্ধ্যায় আমার পা পড়ে, আমার সেয়ানা হওয়ার ভার নিয়ে...

০৪ উল্কা

অ্যাক্যুরিয়াম
উল্কা



(১)

ঘরের মধ্যে বাড়ি! ওদের জন্য এটাই যথার্থ ব্যঞ্জনা হতে পারে। ওরা মানে আপনাদের তিন ফুট বাই দু’ফুট অ্যাক্যুরিয়ামের একজোড়া সিন্ডারেলা, একটা গোল্ডী, বেশ কয়েকটা মলি, চারটে বিল্লোরানি, আর একটা সার্কবয়। এদের বাড়িতে ফার্নিচার বলতে একটা মাস্তুল ভাঙা জাহাজ আর প্লাস্টার অফ প্যারিসের লাল নীল চালওয়ালা কালো অট্টালিকা। সঠিক ক্যাটেগরিতে নিলামে চড়লে ঠিক কীরকম দাম পাওয়া যায় বা ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে তাদের একদিন বয়েস বারার আগেই, সে সব বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এ সত্ত্বেও ফিস্‌ফাস্‌ বার্তা দেওয়া নেওয়ায় দিন থেকে রাত হয়ে যায় এই মীন রাশিদের। নিঃসন্দেহে আপনার আমার ভাগ্য ঠিক করবার ওরা কেউ নয়। তাই কয়েক মগ জলে বেশ সামলে ফেলা যায়। মগের রঙ যাচাইয়েরও হ্যাপা থাকে না!


(২)

অ্যাক্যুরিয়াম থেকে আপনার শয্যাটি দেখা যায় ফুলস্কেপ সাদা পাতার মতো। রাত বাড়লেই সেই পাতায় ফুটে ওঠে নানান জ্যামিতিক চিত্র। কখনও ত্রিভুজের ভিতর একটি উল্লম্ব সরলরেখা ৭০-৯০ ডিগ্রি কোণে আবার কখনও আয়তক্ষেত্রের কোণ ছাপিয়ে যাওয়া কর্ণ। অঙ্কদেশের উত্তেজিত স্টেপ জাম্প করা গুন ভাগ! একজোড়া সিন্ডারেলা, একটা গোল্ডী, বেশ কয়েকটা মলি, চারটে বিল্লোরানি, আর একটা সার্কবয় অবাক হয়ে এক চোখ মেলে দেখে। ওরা জানে, ঠিক এরপরই আলো নিভে যাবে। ওদের ভেসে থাকতে হবে চোখ কান খোলা রেখে।

(৩)

আপনারা বেড়াল পোষেন না! ওরা বেয়াদপ! ডেটিং-এর নামে মেটিং কল। বছর বছর গণ্ডা গণ্ডা! তাই মা ষষ্ঠীর দোহাই দিয়ে বেড়াল ও আপনাদের পচ্ছন্দ মিলে কাটাকাটি করে হাতে থাকে হয় অথবা নয়। এত কিছুতেও অ্যাক্যুরিয়ামবাসীদের সংখ্যা বাড়েনি বরং পেট ফেঁপে একজোড়া থেকে একটা হয়েছে গোল্ডী। পরিবেশ বদলেছে কিন্তু মীন রাশিদের চূড়ান্ত পরিবেশনা রয়েছে অমলিন। ঠেকনা দিতে ট্রান্সপারেন্ট প্যাকেটে চড়ে এসেছে একটা ফাইটার। কিন্তু ঠেকনা তো দূর, অন্য পরিবেশে অনিমন্ত্রিত অতিথির মতো মান বাঁচাতে সে গিয়ে ঢুকল অট্টালিকায়। দরজা দিয়ে বেরিয়ে রইল কালচে নীল আভা জড়ানো পাখনা। পাত্তা পেল না কারুর থেকে। গোল্ডী গিয়ে ঢুসো মারল ফাইটারকে। বেচারা আরও সিঁধিয়ে গেল ভিতরে।

এখানে জোড়া থাকলেও সংখ্যা বাড়ে না। কারণ এই অ্যাক্যুরিয়ামের প্রত্যেকেই পুরুষ এবং প্রত্যেকেই অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে... থাক গে...

(৪)

“শিশে কে ঘর-ও মে দেখো তো, পাত্থর দিলবালে বসতে হে...” গানটা যেন ওদের প্রতি আরও আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। একটা গবেষণা হতেই পারে, কাচের ঘরের কলজে! তবে ওদের তাতে বয়েই যায়, শুধু অ্যাক্যুরিয়ামের দিকে এগোলেই মনে হবে, আবহের গানটা হঠাৎ বদলে গেল! “অ্যা দিলে নাদান... আরজু কেয়া হে জুস্তুজু কেয়া হে!” পটকায় হাওয়ার চাপ কমিয়ে জলের পেট থেকে ভুস্‌ করে উঠে পড়বে ওপরে। ভাবে, ওই বুঝি কেঁচো এলো, যত খুশি তত গেলো! সে গুড়ে বালি বুঝতে সময় লেগে যায় বেশ অনেকটা। তখন কাচের দেওয়ালের ওপারে খাবি খেতে খেতে ওরা চার অক্ষর দু অক্ষর দেয় কিনা কে জানে! দিলেও ক্ষতি নেই অ্যাক্যুরিয়ামের পাম্পটা সর্বদা সচল...

০৫ অমিতাভ প্রহরাজ

লেখাজ অফ ওয়াসেপুর
অমিতাভ প্রহরাজ



ইজমিক ওয়ান / লেখা সৃষ্টিফিকেশান ও মিষ্টি ফিকেশান-

কবিতার বাবুর্চি থাকে, পাচক থাকে, রাঁধুনি থাকে, শেফ থাকে, ময়রাও থাকে। কলমাক্রান্ত একটি মানুষই বিষ্ণুর নানা রূপের মতো কখনো বাবুর্চি, কখনো শেফ, কখনো ময়রা, এরকম নানা অবতারে যাতায়াত করে আর লেখার মধ্যে নানান প্রকৃতি ঢোকে। ঘটনাচক্রে দেখা যায় এই নানা অবতারের মধ্যে কোনো একটি অবতার নেতা হয়ে বিচরণ করে। লেখাও সেরকম কখনো সিজলার, কখনো আলু পোস্ত, কখনো কাটলেট হয়ে ওঠে। ইদানীং, ইদানীং নয় এই প্রবণতার সূত্রপাত আশির জয় গোস্বামীর হাত ধরে (সত্তরের নয়), ময়রা অবতার একচ্ছত্রাধিপতি হয়ে উঠেছে। প্রথমে যা ছিল শেষ পাতের জিনিস, ক্রমে ক্রমে সেই মিষ্টি ভাত-ডালেরও জায়গা কেড়ে নিয়েছে। ভালো কবিতা মানেই মিষ্টি কবিতা এই ফর্মূলাতে না পৌঁছলেও, মিষ্টি কবিতা মানেই ভালো কবিতা এই হাইপথেসিস, ল হয়ে গেছে। লেখায় মিষ্টত্ব প্রদান "লিরিকাল" ইত্যাদি গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক শব্দের ব্লাউজ-পেটিকোট পরালেও এখন নির্লজ্জ ভাবে উলঙ্গ হয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় লেখাকে মিষ্টি করে তোলা একটা নেশার মতো। এই নেশা মধ্যযুগের এ্যালকেমিস্টদের মতো। বিভিন্ন রাসায়নিক মিশিয়ে মিশিয়ে দেখার মতোই এখানে একরকম শব্দের সাথে আরেকরকম মিশিয়ে একটা চিনিভাব গড়ে উঠছে কিনা দেখা, কোরেক্সের চেয়েও মারাত্মক। 'নরম' এর সাথে 'রমণী', 'দ্রাঘিমা শেখানো'', ''নির্জন বেহালাবাদক'' এই প্রবণতা প্রকটভাবে দেখায়।

বলা হতে পারে লেখা মিষ্টি হলে ক্ষতি কি?? ক্ষতি হচ্ছে অন্যভাবে। স্বাদের মতো একটা লেখার তো গন্ধ, স্পর্শ, আওয়াজ, রূপ এইসবও আছে। এবার এই মিষ্টি করার নেশা এমনভাবে গিলে খাচ্ছে একটা লেখাকে, যে লেখা মানেই লেখার স্বাদ, এরকম বিপজ্জনক গোঁড়ামি গেঁড়ে বসছে। বক্তব্য কবিতার নেই, কোনোকালে ছিলও না। কিন্তু স্বাদ ছাড়া বাকি প্রাণধর্মগুলোতো ছিল। আজ আমরা লেখার গন্ধ ভুলতে বসেছি। চলনটাই এমন হয়ে যাচ্ছে যে প্রবল কবিটি পার্কার দাঁতে করে ভাবছে, ভাবছে... সামনে ফাঁকা কাগজ... হঠাৎ পাশের নিমফুল গাছ (নিমগাছ তো নিমফুল গাছও) থেকে টুপুস করে খসে পড়লো "তোমার গভীর ফুল"... ব্যাস ভাবনার বাথটাব থেকে ন্যাংটো মনের ইউরেকা বলে দৌড়... আবার 'মিথ' লেখার আগে ব্রেক... মিথকে নতুন করলে একটা জম্পেশ ব্যাপার হয় বটে, কিন্তু কি যেন একটা মিসিং, খচখচ খচখচ... হঠাত, আরে নতুনকে নবীন করা হয় যদি!!... "নবীন মিথ", কি কিউট, কি কিঊট... এবার একটি গাছের পাতা, বটপাতা, কুলেখাড়া পাতা হলে চলে?? "পাইনপাতা" হতেই হবে, আর তোমাকে জানালা পরিয়ে দিলে তার থেকে মিষ্টি কিছু হয়??!!!

মুশকিলটা কোথায় হয়, কারোর লেখা পড়ে আমি তাঁর হার্ট আর ব্রেনের সাথের জমাটি আড্ডা মেরে সময় খুন করতে চাই... তার জন্য চাই ওই দুটির মর্ম অবধি প্রবেশের অনুমতি আর দিলখোলা আপ্যায়ন... এগুলো তে হয় কি, ওই মিষ্টত্ব নির্মাণের ফলে, হৃদয় ও মেধা, দুই বান্দায় চা বিস্কুট খাইয়ে বাইরের ঘর থেকে বাই বলে দেয়... আর আমি একটা কবিতার শেষে একটা মিষ্টি গুড-বাই চুষতে চুষতে বাড়ি ফিরি।



ইজমিক টু / বিষয়-

কবিতার বিষয় অনেকটা গায়কের গায়কীর মতো... তুমি বলে কোনোদিন বোঝাতে পারবে না, যে অমুক গায়কীটা এইরকম, প্রথমে চড়ায়, তারপর খাদে, ইত্যাদি, ইত্যাদি... একে ট্যাঞ্জিবল করা অসম্ভব... একমাত্র উপায়ে যা তুমি বোঝাতে পারো সেটা হলো ওই গায়কীটাকে ভেঙিয়ে বা নকল করে... তাতেও পুরোটা বোঝাতে পারবেনা, এইটুকু বলতে পারবে যে 'বিষয়টা হলো অনেকটা এইরকম'... কবিতার বিষয় একটা কবিতা শুরু করার সময় শুরু হয় আর শেষ হলে নিরালম্ব বায়ূভূত হয়ে মিশে যায়... যা পড়ে থাকে তা হলো একটা বিষয় ঘটার রেশ...... মুশকিল হলো, আমরা ভাবি যে আমরা কবিতা লিখি, বা অনেকে আবার দিব্যদৃষ্টি চিবিয়ে বলেন 'কবিতা হয়ে যায়', কারোর কারোর আবার 'কবিতা পায়' (তাদের জন্যই সুলভ সংস্করণ বেরোয় কবিতার), বেসিক্যালি কবিতা তো এই মহাবিশ্বের বাইরের কোন জীব নয়... মহাবিশ্ব এক অফুরন্ত ঘটনা সম্ভার... চেতন, অবচেতন, অতিচেতন, অধিচেতন, সমস্ত রকমভাবে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্প্রসারিত চেতনার দ্বারা যে নাগালমূলক বিশ্ব, তাতে নিরন্তর ঘটমান ঘটনা পরম্পরার কিছু কিছু বিশেষ অংশই তুলে আনি কবিতা রূপে... কবিতা আর কিছু নয়, ওই যে সর্বোচ্চ চেতনার নাগালমূলক বিশ্বের লক্ষ কোটি ঘটনার মধ্যে কয়েকটি... ফলে আমার মনে হয় চতুর্দিকে কবিতার স্রোত ঘটে চলেছে যার মধ্যে আমরা ডুবে আছি, একজন কবির কাজ এই ক্রমাগত ঘটে চলা কবিতগুলির মধ্যে নিজের কবিতাটি খুঁজে নেওয়া... কবিতাটি আছেই, বা বলা ভালো ঘটছেই, কবি শুধু তাকে খুঁজে পাচ্ছেন... ওই শূন্য থেকে কবিতা তৈরী করা জাদুকরের ডিম আনার মতোই ফক্কিকারি... আর গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে কবির 'নিজের' কবিতা খুঁজে পাওয়া... আমার সামনে ঘটে চলা যে ঘটনা কবিতা নয় , সেটা তোমার কাছে কবিতা হতেই পারে... তাই 'সামনে ঘুমায় ছোটবোন' এর মতো অতি সাধারণ ঘটনার মধ্যেই ভাস্কর তার কবিতা খুঁজে পেয়ে যান... আর এই 'নিজে'টা আসে কোত্থেকে? 'নিজের ভাষা' থেকে... ওইজন্যই নিজের ভাষাটি খুঁজে পাওয়া সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান রিকোয়ারমেন্ট...

Unlike · · Unfollow Post · Share · 21 hours ago near Calcutta

Seen by 52

Arjun Bandyopadhyay এটা সম্পূর্ণই Amitava Praharajএর মনে হওয়া। আমার নিজের এরমটা কখনোই মনে হয় না। চারপাশে কবিতার স্রোত বয়ে যাচ্ছে? কবিতা হয়েই আছে চারপাশে? আচ্ছা? ভারি মজা তো!! তাহলে কবিতার উপাদান কাকে বলে?

15 hours ago · unlike · 1

Arjun Bandyopadhyay আমি কখনোই আমার চারপাশে কবিতা ছড়িয়ে আছে—এরকমটা দেখতে পাইনা। ছড়িয়ে আছে কবিতার উপাদান, matter.যাকে আমি সংবেদনে পাই। এ তো ইন্দ্রিয় উপাত্ত। কবিতা নয়। আত্মা যেমন স্বরূপতঃ নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ, চৈতন্যহীন; ভাবলে অবাক লাগে, চৈতন্য আত্মার আগন্তুক ধর্ম। তেমনি, সংবেদনে পাওয়া ইন্দ্রিয় উপাত্ত কবিতার অপরিহার্য উপাদানের অন্যতম মাত্র। এর বিন্যাস চাই। চৈতন্য চাই। আমার বুদ্ধি, জ্ঞান, বোধশক্তি সেই উপাদানে আকার বা form দেয়।

15 hours ago · unlike · 2

Amitava Praharaj অর্জুন, কবিতা ঘটে চলে, নিজের কবিতা খুঁজে নিতে হয়, উপাদান লাগে যখন সেই কবিতাটিকে আমি ট্যাঞ্জিবল করছি... পাঠযোগ্য করছি... একটা ঘটনাকে তো নিয়ে খাতার পাতায় বা স্ক্রিনে বসানো যায়না... তাকে পুনর্গঠন করা হয়, কেউ মানে-ওয়ালা শব্দ দিয়ে, কেউ ধ্বনি দিয়ে, কেউ চিত্রকল্প দিয়ে, আরো কত কি... উপাদান আসে তখন... এটা সংবেদন নয়, এটা বেদন... সংবেদন কখন ঘটে গেছে তুই কি করে জানবি?? তুই সংবেদনের পর সংবেদনশীল ও সংবেদনের আগে সংবেদনপ্রবন হয়ে পড়বি মাত্র...

15 hours ago · Like · 2

Arjun Bandyopadhyay কবিতার tangible করা অসম্ভব। কবিতা non verbal medium.

15 hours ago · Like · 1

Amitava Praharaj তাহলে খাতার পাতায় যেটা লিখেছিস ওটা কি?যেটাকে দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়া যাচ্ছে... কবিতার ফোটোগ্রাফ?? তা বললে সেই কবিতার ফোটোগ্রাফ বানানোর জন্য উপাদান লাগে... কবিতা তো intangible সবাই জানে... এবং intangible বলেই তো তাকে উপাদান দিয়ে ক্রিয়েট করা যায়না...

15 hours ago · Like · 1

Amitava Praharaj বলছো নন ভার্বাল, ইনট্যাঞ্জিবল জিনিস... আবার বলছো উপাদান দিয়ে বানাবে... কি করে সম্ভব??কয়েকটা ট্যাঞ্জিবল জিনিস দিয়ে ইনট্যাঞ্জিবল জিনিস বানানো??? এটা তো ফ্যালাসি...

14 hours ago · Like · 2

Amitava Praharaj আর যদি জিনিসগুলি ইনট্যাঞ্জিবল হয়, তাহলে তা উপাদান হয় কি করে????

14 hours ago · Like · 2

Amitava Praharaj ট্যাঞ্জিবল টু ইনট্যাঞ্জিবল যদি কোনভাবে ঘটেও তাতে তার মাঝখানে বাধ্যতামূলকভাবে একটা ফেনোমেনন থাকবেই... বস্তু আলোর গতিবেগের বর্গ গতিতে ছুটে শক্তি হয়ে যাচ্ছে... ইনট্যাঞ্জিবল শক্তি যে, তার সাথে তার অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওই 'ছুটে চলা'র মতো ঘটনা লেগে আছে... ওকে আলাদা করা অসম্ভব...

14 hours ago · Like · 1

Amitava Praharaj এ তো উপনিষদের কথা, যে বস্তু তুমি দেখছো, তা বস্তু নয়, বস্তুর অস্তিত্বের প্রক্রিয়া মাত্র...

14 hours ago · Like · 1

Amitava Praharaj প্রসঙ্গতঃ আমার নিজেরই করা কমেন্ট একটা কোট করছি (ওঃ নিজে নিজের কোটেশান দিচ্ছি, এতো যে সে হনু নয়, মহা হনুম্যান)... "এইসব লেখাগুলো রিদমিক তো, একটা দৌড়ের মতো... একটা সঠিক দৌড় যেমন সঠিক জায়গায় শেষ হয় আর সঠিক ঘামেরা জন্মায় তারপর, যেন সদ্য অতীত হওয়া গতিবেগ ফোঁটা ফোঁটা জমে উঠছে, আর আগামীকালের গতিবেগ ঈর্ষাতুর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে... এই লেখায় সেই ব্যাপারটি অপূর্ব ভাবে ঘটেছে... কবিতাটা পড়া শেষ হলে কবিতার ঘাম জমে মনে... এমনই সজল সে ঘাম যে এর পরের কবিতাটি, মানে যেকিনা না-লেখা, এই ঘটে যাওয়া কবিতার প্রতি ঈর্ষা রেখে শুরু হয়...... এর থেকে ভালো কি পেতে পারে এই আমাদের মতো লেখালোকেরা???"





ইজমিক-থ্রি / লেখা আপকে হ্যায় কৌন-

(প্রথমে ঝগড়াঝাটি/তারপর দাঁতকপাটি/ডাল-ভাত-শব্দভাতে)

এরপর, এক যে ছিল অর্জুন আর এক যে ছিল প্রশ্ন....

Arjun Bandyopadhyay খাতার পাতায় যেটা লিখছি তা শব্দ (word) । সেটা মাধ্যম। হরিপ্রসাদ যখন বাঁশি বাজান তখন কি বাজান? স্বরলিপিই তো বাজান। এক বা বিবিধ স্বরের সমষ্টি হল সেই সুর যা তুমি আমি শুনছি। সেই সুর কি স্পর্শযোগ্য? Tangible? না, যেটা বলেছি সেটা উপনিষদের কথা নয়, ওটা বৌদ্ধ দর্শনের কথা

অর্জুন, স্বরলিপি আর সুরের যে পার্থক্যের কথা তুই বলছিস, সেটার সমানুপাতে শব্দ আর কবিতার পার্থক্য আসেনা, আসে ধ্বনি বা আওয়াজ আর শব্দের পার্থক্য... শব্দের মূল উৎস ধ্বনি... আসলে ভাষা নিয়ে একটা প্রবল ভুল মিথের জন্ম হয় একটা আমাদের একটা বেসিক শেখানোর ত্রুটি থেকে... আমাদেরকে শেখানো হয় প্রথমে বর্ণমালা, তারপর এক একটা বর্ণ দিয়ে বানানো বহুবর্ণের শব্দ... তারপর বিভিন্ন শব্দ দিয়ে একটি বাক্য... এবার মজার ঘটনা হলো, উৎপত্তির দিক দিয়ে প্রথম জন্ম নেয় বাক্য... নোট ইট ডাউন, এখনো মনুষ্যেতর প্রাণীরা যখন কম্যুনিকেশন করে... হাতি, বাঘ, হনুমান, সিংহ ... ওরা বাক্য দিয়ে কম্যুনিকেশন করে... এবার স্টেপ বাই স্টেপ একটা জায়গায় আসি... বাক্য কি বস্তু? উল্কা? ইঁদুরের কলদাঁত? উটের আলজিভ? জিরাফের হানিমুন? ব্ল্যাক হোল কে রেপ? যেকোন গজগোবিন্দ হোক কি মাধবীলতা, এখানে এসে জলহস্তী টু জলজিরা টাইপের লিমিট যার মধ্যে এনিথিং এর বাড়ি, ভেবে ফেলবার থ্রেট দেবে... কিন্তু না, বাক্য বলতে এ্যান্থ্রোপলজিস্ট এবং লিঙ্গুইস্টরা ক্লিয়ারলি একটা জিনিস বলে দিয়েছেন, একটি কম্যুনিকেশন ইউনিট যার মধ্যে মিনিমাম একটি ক্রিয়া, একটি সাবজেক্ট ও একটি অবজেক্ট আছে... হরিণের পাল চরছে, সেই হালুমহুলুম ভালোবাসার বোঁটকা গন্ধ এলো হাওয়ায়, একটা কাকর হরিণ ডাকলো, "ওই কামড়ুটে (ধরে নিলাম কাকর হরিণ কামড়ুটে জাতীয় শব্দ করে বাঘ ডিনোট করে) কাছে এসেছে"... এই ডাক এলো মদ্দা কাকর হরিণ থেকে মাদী কাকর হরিণের দিকে... এই কমপ্লিট ইউনিটটি একটি বাক্য যার মধ্যে একটি ক্রিয়াবাচক শব্দ (সাউন্ড) 'এসেছে' , একটা সাবজেক্ট সাউন্ড (কামড়ুটে) আর একটি অবজেক্ট সাউন্ড (যা সাইলেন্ট বা উহ্য কারন অভ্যেস বা নিয়মের থেকে সেটা জানা)... এই সাউন্ড ইউনিটগুলিকে বলে ফোনিম (phoneme)... আদিম মানুষের কম্যুনিকেশান ছিল এই ফোনিম একত্র করে তৈরী বাক্য... যা কুকুর, বিড়াল, ডলফিনেরও পদ্ধতি... এই ফোনিম এর উৎপত্তি এক একটি ক্রিয়া বা ঘটনার যে ফোনেটিক্স বা সাদা বাংলায় আওয়াজ, তাকে নকল করে... হোমো পিথেকানথ্রোপাস অবধি ফোনিম চলছে... হোমো ইরেক্টাসে এসে ঘটলো এক লীলাবতী টাইপের ঘটনা... ঠিক যেমন একটা পুচকে বাচ্চা ছিপি আর শিশি নাড়াচাড়া করতে করতে আচমকা শিশিতে ছিপি লাগিয়ে ফেলে, ফেলে বিস্তর অবাক হয়ে যায়, ফের বহু কসরৎ করে খুলে ফেলে, ফের লাগায়, তখন তার কাছে খোলা বা বন্ধের কনসেপ্টই ক্রিয়েট হয়নি... একইরকম ভাবে মানুষের জিভ বা লিঙ্গুয়া (lingua) ফোনিম নাড়াচাড়া করতে করতে,হঠাৎ আরেক ধরণের ইউনিট বানিয়ে ফেলে যাকে বলে মরফিম (morpheme)... মন দিয়ে শোন, এই মরফিম তৈরী করাই হয়েছে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা... কারন এখনো অবধি একটি ঘটনা থেকে উদ্ভূত শব্দের (সাউন্ড) মতো শব্দ করে ঘটনাটি বোঝানো বা কম্যুনিকেট করা হচ্ছিল... কিন্তু মরফিম তৈরী হওয়ার পর, (যা জিভ নাড়তে নাড়তে তৈরী করে ফেলেছে কতগুলি ফোনিম দিয়ে) এই প্রথম এলো এমন একটি ফোনেটিক্স যা ঘটনা থেকে উদ্ভূত শব্দের মতো নয়... বুঝতে পারলি কি ঘটলো? মানুষ অজান্তে নিজের ইতিহাসে এ্যাবস্ট্রাকশান ঢুকিয়ে ফেললো... এই মরফিম হচ্ছে আমাদের শব্দ বা ওয়ার্ড তার আপন বাবা..(খিস্তি দিচ্ছিস, পুরো মহাভারত খুলে বসেছি, বুঝতে পারছি, কিন্তু এটার কারন একটা চালু মিথকে ভাঙা)... বিবর্তনের স্তরে মানুষ হলো প্রথম প্রাণী যারা ফোনিম ও মরফিম, এই ডাবল লেয়ার প্যাটার্নিং দিয়ে কম্যুনিকেট করতে শুরু করলো... ফলে মানুষের মধ্যে কম্যুনিকেশানে এই প্রথম একটা জিনিস ভাঙা সম্ভব হলো যা আগে ভাঙা সম্ভব বলে ভাবাই যায়নি... সেটা হলো কনটেক্সট... প্রাণী বাক্য আর মানুষ বাক্যের মধ্যে প্রধানতম পার্থক্য একটা কনটেক্সট এর আওতায়, আর আরেকটা কনটেক্সট এর বাইরে, ফলে মানুষের কাছে ভাষা আছে, প্রাণীদের ভাষা নেই... মূল কথায় ফিরি, সৃষ্টির দিক থেকে দেখতে গেলে দেখবো (ধ্বনি, উদ্ভূত)>বাক্য>শব্দ>বর্ণ>বর্ণের উচ্চারণ (ধ্বনি, আরোপিত)... আর শেখার সময় আমরা শিখি সম্পূর্ণ উল্টো... ফলে একটা নিজস্ব উৎকট দর্শন তৈরী করে ফেলি যে ভার্বাল আর নন ভার্বাল কম্যুনিকাশান, শ্রুত ও অশ্রুত... বেসিক্যালি নন ভার্বাল কম্যুনিকেশান বলে কোন বস্তুর অস্তিত্বই নেই... মহাপণ্ডিত বার্নেটের মতে "verbal communication is a condition for human existence"... এবারে ধীরে ধীরে গুটিয়ে দেখি কি দাঁড়ালো... যে ধ্বনিকে চিনে আমরা শব্দ বা বাক্যর ধ্বন্যাত্মক রূপটিকে আইডেন্টিফাই করি, সেটা আরোপিত ধ্বনি... সেটা বেসিক্যালি উচ্চারণ (ওই ঋক বেদের শুরুতেই, বেদকে শ্রুতি বা অপৌরুষেয় বলার আগেই, প্রথম কন্ডিশান হচ্ছে, তোমার প্রয়োজন বৈখরী বা স্পষ্ট উচ্চারণের ক্ষমতা)... কিন্তু সেই আরোপিত ধ্বনির একটি অংশ কিন্তু উদ্ভূত ধ্বনি যা হার্ডকোর নাছোড়বান্দার মতো ভেতরে ঢুকে থেকে গেছে... এবং যেমন এক একটি বেশ্যার সাথে লেগে থাকে এক একটি বেবফাই-কাহিনী, একই রকম সেই ফোনিম এর টুকরোগুলোর সঙ্গেও, এক একটি ফোনিম সঙ্গে লেপটে আছে এক একটি ঘটনা... ফলে শব্দ কেন, কোন উচ্চারণই ঘটনা বহির্ভূত নয়... তুই উচ্চারণ করছিস 'র', এর ভেতরে হয়তো ঢুকে আছে জলপ্রপাতের ধারে সিংহ ডাকলে যে শব্দ (সাউন্ড) শোনা যায় তার টুকরো... তাই ভার্বাল কম্যুনিকেশানের বাইরে তুই যেতেই পারিস না আর ঘটনার ক্যাঁক থেকে টুঁটি ছাড়াতে পারিস না... যে প্রবল মিথটির কথা বলছিলাম, সেটা হলো অনেকের বিশ্বাস ধ্বনিগত দিক দিয়ে সেই ধ্বনি যে বস্তুকে রেফার করে, তার গুণ লেগে থাকে... মানে, যদি বলি মহিষ, এই মহিষ আওয়াজটার মধ্যে মহিষ বস্তুটির কোনো ধ্বন্যাত্মক গুণ, ধরা যাক মহিষের হেঁচকি, বা মহিষের প্রতি মহিষীর শীৎকার ঢুকে আছে, এবং এই ধারণা থেকেই আমরা শব্দ থেকে মানের চামড়া খুলে নিতে পারলেও, তার ঘরানার চামড়া ছাড়াতে পারিনা... ঠিকই, যে মহিষ শব্দটিকে ভাঙতে ভাঙতে গেলে একসময় একটি ক্রিয়াভিত্তিক উচ্চারণে পৌঁছব (যেকোন ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক ফান্ডা তাই বলে, হরিচরণবাবুও তাই বলে গেছেন)... কিন্তু সেই উচ্চারণের মধ্যে যে ঘটনা ঢুকে আছে তার সাথে মহিষের কোনও সম্পর্কই নেই হয়তো... হয়তো তার মধ্যে লুকিয়ে আছে মানুষের প্রথম পাথর বাজানোর মতো ঘটনা ও তার আওয়াজের টুকরো...

বড় বেশি হয়ে গেল বোধহয়... সরি, এ্যাকচুয়ালি এই জায়গাটা না ক্লিয়ার করলে ভবিষ্যৎ সাহিত্যের মূল দুই স্তম্ভ বোধবিজ্ঞান বা কগনিটিভ সায়েন্স আর ভাষাদখলের (ল্যাংগুয়েজ এ্যাকুইজিশান) গল্প বলতে পারবো না... বলতো পারবোনা ওয়ার্ডনেট বা মানুষের মাকড়শাগিরির গল্প... সে অন্য এপিসোডে হবে... থ্যাংকস অর্জুন, তোর জন্য এই জায়গাটা লিখে উঠতে পারলাম অবশেষে...

Amitava Praharaj এইবার পুরো জিনিসটাকে যদি কনসেপচুয়ালি দেখিস "অমর পাঁঠার মতো দাঁড়িয়ে থাকা গঙ্গা" খুব উদ্ভট বা দুরের লাগবেনা... বেসিক্যালি তুই সুপার্ব ঘটকালি করার ভঙ্গিতে বিগলিত... এক ঘটনা সাথে আরেক ঘটনার রাজযোটক খুঁজছিস... বেনারসের উৎকট গন্ধময় বোকা পাঁঠার সমবেত গন্ধ দিয়ে বলা ব্যা-এ্য-এ্য তোকে সেই রাজযোটক টুপ

০৬ তন্ময় বীর

হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব পোয়েট্রি
তন্ময় বীর



‘হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব ম্যাথেমাটিকস্‌ আমি বিনয় এখন অশ্বিনী তারায় বসে আছি’ তারপর স্বয়ং গণিতই উদ্বেলিত হয়ে বলে গেল - “আমি হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব ম্যাথেমাটিকস্‌ বলছি, বিনয় মজুমদার, তুমি অশ্বিনী তারায়।” নক্ষত্রের সাথে বিনয়ের চেনা-শোনা তো একদিনের নয়, সেই কবে অত্রি শুনিয়েছিল কবিতার আঙ্গিক আর বিষয়ের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের কথা গণিতের এককের উপমায়--

........................‘বিনয়, শোনো, যে-কোনো যন্ত্রের তত্ত্ব পরিবর্তনের
চেষ্টা যদি করো, যদি পরিবর্তিতই করো তবে সেই যন্ত্রটির অবয়বটিও
স্বঃতই সমমুহূর্তে নিজেই পরিবর্তিত হ’য়ে যায় যথোচিত রূপ পেতে পেতে।
ফের বিপরীতভাবে আকার পরিবর্তিত করো যদি তবে তাতে নিহিত তত্ত্বও
স্বঃতই তদনুরূপ হ’তে-হ’তে যেতে থাকে, কবিতার সঙ্গে তার ভাবের ব্যাপার,
এই একই চিরকাল এই একই সৃষ্টি আর সৃষ্টিধৃত ভাবটির সম্পর্ক ও যোগ।
ভাব আর অবয়ব – এ-দুটিকে কোনোক্রমে পৃথক, বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব ব’লে
ও-দুটি প্রকৃতপক্ষে দুই নামে এক বস্তু, কেবল অদৃশ্য ব’লে ভাবা হ’লে ভাব,
আর দৃশ্য ব’লে যদি ভাবো তবে অবয়ব এবং হয়তো এই প্রকৃত বস্তুটি
অবয়ব নয় কিংবা ভাবও নয় – অন্য-কিছু গণিতের এককের মতো অন্য কিছু।’
এই লাইন লেখার কিছু আগের অনুভব মনে করা যেতে পারে, যা তাঁর কাব্যচেতনার বিশেষণে পরিণত হয়েছে--
‘আমাদের জ্ঞানদণ্ডে এক প্রান্ত শুদ্ধতম গণিত নামক শাস্ত্র আর
অন্য প্রান্ত আমাদের সকলের পরিচিত কবিতা ও কাব্য – কাব্যগুলি।
এ এক নিয়মমাত্র, গণিত যেধারে থাকে আসলে বিশ্বের সব রস–
বিশ্বের সকল রস জড়ো হ’য়ে এসে জমা হ’য়ে থাকে রসের আকারে।
অন্য ধার যেই ধারে কবিতা হয়েছে তার মুখ দিয়ে এই রস পড়ে,
...
খুব ভালো ক’রে যদি এমন মিলিয়ে দিই, দিতে পারি যাতে
মনে হয় মোহনাই, মোহনার বর্ণনাই আসলে সে গণিত কবিতা--
গণিতের কবিতার হুবহু বর্ণনামাত্র,...’

মেলাতে কী পারলেন! একদিন সব নক্ষত্রপরিত্যক্ত হয়ে বিরতিচিহ্নহীন উচ্চারণ করলেন নক্ষত্রবাণী--

‘কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই বিশ্বের মালিক’
একই জ্ঞানদণ্ডে গণিত-কবিতার পারস্পরিক সহবস্থানের বিষয়টি বিষময় হয়ে উঠল। যেভাবে তাঁরই সমসময়ের আর একজনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল--
‘...কবিতা এসে আমার মাথা থেকে তাড়িয়ে দেয় অঙ্ককে। তার ফলে আমাকে অনেক ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। কবিতার সঙ্গে অঙ্কের সম্পর্ক যেন সপত্নীবৎ।’
বিনয়ের দাবি ‘এই খানাই আমার একমাত্র গদ্য-কবিতার বই।’ এবং পাঠকের সমীপে তাঁর নিবেদন-- ‘লক্ষ্য করবেন তো এই বইয়ের কোনও কবিতা সারাজীবন মনে থাকে কিনা।’ মনে রবে কিনা রবে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে দু’শটি কবিতা সমন্বিত ‘এক পঙ্‌ক্তির কবিতা’-র প্রথম কবিতা ‘কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই বিশ্বের মালিক’ পড়ার পর যদি পাঠক একদিকে রচয়িতার চেতনার বৃহত্তর অংশের সঙ্গে উপরোক্ত ভাবনাবিন্যাসে জড়িয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে একটি নির্মম সত্যের সহজ গোলায় বিধ্বস্থ হন, তাহলে চট্‌ করে ভোলার উপায় থাকে না সে উচ্চারণ।

যদিও বলেছি নক্ষত্রবাণী, কারুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, এরকমটাই লিখতে ইচ্ছে হলো। কারণ, কী সংজ্ঞা দেব এই কবিতাগুলির! কবিতা কণিকা, নীতিকণিকা, অণু কবিতা, ম্যাক্সিম? নীতির প্রসঙ্গটি অস্বীকার করাই যায়। ম্যাক্সিম বা প্রবচনের মাত্রা ছুঁয়ে যাচ্ছে কোনও কোনও উচ্চারণ, যেমন ধরা যাক এই লাইনটি —

‘পৃথিবীর সম্রাটের ভয় ভিক্ষা করতে যেন না হয়’

বা, ‘খেজুরগাছে কাঁটা খেজুরগাছেরই সবচেয়ে বেশি কষ্ট’

বা, ‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলে তবে অমর হওয়া যায় — যেমন এভারেস্টে ওঠা’

কিম্বা, ‘মাটি থেকে ফল এইটুকু তো দূরত্ব, কিন্তু কত তফাৎ’
উপরের উদ্ধৃতিগুলিতে তবুও যে যৎসামান্য নীতিদর্শন আছে, নিচেরটিতে তার বিন্দু বিসর্গও নেই, নিবিড় প্রকৃতিপাঠ —
‘যা ঘটে তাই স্বাভাবিক’
কিন্তু তার পাশে যখন দাঁড়িয়ে থাকে —
“আমার দালানে লেখা ‘শান্তিনিকেতন’, শান্তিনিকেতনে আছে বিনয় ভবন”
সামান্য ধর্মের অত্যন্ত সুকৌশলী মেধাবী বিন্যাসের দীপ্তি ঝক্‌মকিয়ে ওঠে। আবার
‘আম ও আমগাছ — আমাদেরই অংশ’
এখানে অনুপ্রাসের নিতান্ত স্বাভাবিক নিরীহ শয়ানে যে প্রকৃতিবিজ্ঞান, তা চোখ এড়িয়ে যাবার নয়। আত্মভোলা স্বভাবোক্তির মোড়কে প্রবঞ্চিত হতেও পারেন তবু কেউ। সে পথ কেটে রাখা আছে এই পঙ্‌ক্তিমালার কোথাও কোথাও, যেমন ধরা যাক্‌ নিম্নোক্ত কয়েকটি পঙ্‌ক্তি —
৭৪.
চীন দেশে চিনি আবিষ্কার হয়েছিল

৭৫.
গাছের পাতা সবুজ সাধারণত

৭৬.
রোদ কিছুতে পড়লে দেখা যায়

৭৭.
নারকেল গাছের নিচে পথ থাকে

৭৮.
দূর্বা ঘাসে ফল হয় না

৭৯.
দূর্বা ঘাসে ফুল হয় না

৮০.
বৃষ্টির জল অধিকাংশ মাটির নিচে যায়

৮১.
গাঁদা ফুল নানা রকমের

৮২.
অনেক গোলাপকে গোলাপ বলে চেনা কষ্ট

৮৩.
শিউলি ফুল সব এক রকমের
সহজ প্রকৃতিপাঠের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে খেয়ালই থাকে না, জ্যোতির্ময় স্ফুলিঙ্গ কখন উড়াল দিয়েছে। ৮২ সংখ্যক পঙ্‌ক্তিতে অত্যন্ত নিরীহ সেই ঈশ্বর শুয়ে আছেন। মনে করুন রবীন্দ্র উচ্চারণ, যে জন্তুকে জন্তু বলে চেনা যায় না, সেই জন্তুই ভয়ঙ্কর। এখানে বিনয়োক্তি বহুমাত্রিক বিন্যাসে দ্যুতিময়।

হ্যাঁ, স্ফুলিঙ্গ, এই বিশেষণটি ভাবা যেতে পারে। কবিতাগুলিকে নক্ষত্রবাণী বলার পশ্চাতে যে স্বতোঃদীপ্ত প্রাকৃতিক পটভূমিটি ভেতরে সক্রিয় ছিল, সেরকমই রবীন্দ্রনির্দেশিত শব্দটিও মনে আসতে পারে, কিন্তু উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবার বহিরাবরণীয় ক্ষীণায়ুর প্রসঙ্গটি ঠিক মনে ধরে না। অগত্যা ফিরে যেতেই হয় স্বয়ং রচয়িতার কাছে। বলতে ইচ্ছা করে কবিতাগুলি প্রকৃতই ‘জ্যোতির্ময়’। ১৬০ সংখ্যক পঙ্‌ক্তিতে লেখা হচ্ছে —

‘জোনাকি পোকাই প্রকৃত জ্যোতির্ময়’
আত্ম-আলোকে ভাস্বর এই কবিতাগুলির প্রেরণা জাপানি হাইকু হলেও, অসীম সাহসিকতায় এদের নিজস্ব সম্বলে পথ চলা সমীহযোগ্য। ধাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে যাঁরা সততই স্পন্দিত, তাঁরা এই বইটি অবশ্যই পাশে রাখতে পারেন। আরও কয়েকটা জ্যোতির্ময় খদ্যোৎ হাতের তালুতে রাখা যাক এবার—
১০১.
সৎ কথাটার মানে যে বেঁচে আছে

১০২.
অসৎ কথাটার মানে যে বেঁচে নেই

১৫৬.
এক নামে একাধিক নদী আছে

১১৬.
আমরা ফুলের গন্ধকে মধুর বলি

৮৫.
কাঁটা বরং খেজুরের চারাতেই থাকা উচিত ছিল

৮৬.
কোনো গাছের চারাতেই কাঁটা থাকে না

৮৭.
ফল পাকলে কখনোই নীল হয় না

৮৮.
সব ফল পাকলে মাটিতে ঝরে পড়ে
পাকা ফল-এর মাটির দিকে ফিরে আসা যেমন শাশ্বত, তেমনি একজন আনতশির কবিতামগ্ন যে হসপিটালে বসে কবিতা লিখবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! কেননা এতো এই এরকমই চিরন্তন--
১৯.
পেঁপে গাছে তক্তা হয় না

২০.
সব মাছই জলে থাকে

২১.
সব গরুই ডাঙায় থাকে

২২.
হাঁস জলে ভাসে

২৩.
মানুষ জলে ডুবে যায় কিন্তু হাত-পা নেড়ে ভাসে

২৪.
কলমীলতা জলে ভাসে, ডোবে না

কাব্যটির রচনার স্থানকাল মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, এজরা ওয়ার্ড; ডিসেম্বর ১৯৮৭।



০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা
অমিতাভ প্রামাণিক



৩ বাংলা পান

পান্নাদের প্রাণনাশ ও অকথ্য অত্যাচারের অবসান ঘটাতে চুনিলাল চুনিবংশের পত্তন করলেন। ‘চ’ আর ‘ন’-এর প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছাড়া প্রথম প্রথম দেখা গেল বেশ ভালো লোক চুনিলাল। চিনি আর চানা মিলতে লাগলো, চান করার জলও। চানাচুর খায় চুনিলাল, আর চীনের গুণ গায়। কিন্তু কিছু সময় গেলে বোঝা গেল চুনিলাল শুধু চুনি নয়, বড় বেশি লাল। লালিত্যহীন লোলচর্ম লালের লালিমায় লোক পাগল হয়ে লালা ঝরাতে লাগলো।

সুযোগ বুঝে এগিয়ে এলো চুনিলালের বৈমাত্রেয় ভগিনী চুনিবালা। কোঁচকানো না-কাচা শাড়ি পরে চীনের নিকুচি করতে করতে কুচো নিমকি খেতে ও খাওয়াতে লাগলেন কচিকাঁচাদের। যাদের লালা ঝরছিল, তারা বালা-র দলে চলে এলো।

কিন্তু দিন ফুরাতে না ফুরাতেই দেখা গেল, চুনিলাল যে চীনা চপস্টিক দিয়ে লালের লীলা দেখাচ্ছিল, চুনিবালার বালা-পরা হাতেও সেই একই স্টিক, শুধু চপটা নেই। চুনিবালা কেবলমাত্র অন্য একটা চুনি, তাই তার স্টিককে লোক বলতে লাগলো ‘অপর-চুনি’স স্টিক’। শিগিগির বালা হয়ে দাঁড়ালো বালাই।

এখন জনগণ বলছে, কী করে অন্যরকম হবে, দুটোই তো চুন-ই! পান-এর সাথে খেলে জিভ পোড়ে, জীব যে পুড়বে, তাতে আর আশ্চর্য কী!

এই অনু‘পান’ খেয়ে লালকমলরা নীলকমল হয়ে গেল। যারা ‘পান না’, তারা বলতে লাগলো, দ্যাখ, সব চুনি-ই লাল, আমিই শুধু সবুজ।

কী বুঝলেন? ইংরেজিতে পি ইউ এন লেখে বটে, তবে আমাদের আজকের চারানা আটানার বিষয়বস্তু হচ্ছে বাংলা পান, ওরফে পিজে। সবুজ রঙের পাতা, চুন খয়ের সমেত খেলেই মুখ লাল! তবে হ্যাঁ, গত দু’সংখ্যার চারানা আটানা কলাম দেখে লোকজন বলাবলি করছে, এই সব ফালতু লেখায় মালকড়ি কিস্যু নেই, এর চেয়ে দু’ লাইন গপ্পো ফেঁদে বসলেও তো পারতো। অভিযোগ মন্দ নয়, তাই সেই চেষ্টাই করছি এবারে। বাংলায় ছোটগল্প লেখা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে নিয়েই এবারের এক গণ্ডা গল্প। থুড়ি, বাংলা পান। রবি ঠাকুরের পান খাওয়া দিয়েই শুরু করা যাক।



১। রবি ঠাকুরের পান-ভোজন




দুপুরে খাওয়ার পর আরামকেদারায় বসে একটা পান খান রবীন্দ্রনাথ, তার সরঞ্জাম নিয়ে মৃণালিনী পায়ের কাছে বসে পান সাজছেন। বাড়ির ঠিকে ঝি মোক্ষদা-র পুঁচকে মেয়েটা এসে বায়না ধরলো, সেও পান খাবে।

মেয়েটার বয়স বছর চারেক, সর্ষের তেলের শিশির মতো তার গায়ের রঙ, মায়াময় চোখদুটি। সারা বাড়ি টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, সর্বত্র তার অধিকার। কিন্তু এই বয়সেই তাকে পানাসক্ত করে তোলা কি ঠিক হবে?

রবি বললেন, ‘তুই পান খাবি কী রে! তোকে আমি ভীমনাগের সন্দেশ খাওয়াবো। এখন ছবির খাতাটা নিয়ে আয় তো, কালারিং কর্‌ দেখি আমার সামনে বসে’।

সে ছুটে গিয়ে তার ছবি রং করার খাতা এনে রবিকে দেখালো, একটাও ছবি রঙ হতে বাকি নেই আর। ঐ খাতারই শেষ পাতায় তাসের একটা ইস্কাবনের আউটলাইন স্কেচ এঁকে রবি বললেন, ‘নে এই পানটাতে রঙ দে দেখি’।

মেয়েটা আবার এক ছুটে গিয়ে নিয়ে এলো তার জলরঙের যাবতীয় কৌটো-সামগ্রী। তার কোনোটাতে রঙ আছে, কোনোটাতে ফুরিয়ে গিয়েছে। লাল, নীল, বেগুনী রঙের কৌটোতে কিছুটা করে রঙ আছে। অবন ঠাকুর তার একটা কৌটোয় কাঁচা হলুদের নির্যাস ভরে দিয়েছেন আর বলেছেন, সেইটা দিয়ে রঙ করা প্র্যাকটিশ করতে। একটা নতুন তুলিও দিয়েছেন। সে রবীন্দ্রনাথের আঁকা স্কেচটার ওপরে ঝুঁকে পড়ে তার কৌটোর তরল আর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙ করতে লাগলো।

এক মুহূর্ত বুঝি অন্যমনস্ক ছিলেন রবি। হঠাৎ স্ত্রীর আর্তনাদ শুনে তাকিয়ে দেখেন, মেয়েটা সেই পানের স্কেচের মধ্যে সবুজের বদলে বেগুনী রঙ বোলাচ্ছে। থতমত খেয়ে গেল বাচ্চাটা, হাতে তুলে নিলো কাঁচা হলুদের কৌটোটা আর ওটা হাত ফস্কে পড়ে গেল মৃণালিনীর হাতে ধরা চুনের ডিব্বায়। চুনের মধ্যে হলুদ পড়তেই সাদা ধবধবে চুনটা হয়ে গেল খুনখারাপি লাল।

দুজনের মুখের হতাশ অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। চার বছরের মেয়ে, সে কীই বা বোঝে! তিনিই তার নাম দিয়েছেন চেতনা।

পাশে পড়ে থাকা কবিতার খাতাটা টেনে নিয়ে লিখলেন -

আমারই চেতনার রঙে
পান না হলো সবুজ,
চুনই উঠলো রাঙা হয়ে...
তাহলে বুঝে গেলেন তো, আপনাদের প্রিয় কবিতাটার প্রকৃত ইতিহাস? ফালতু সময় নষ্ট করে লাভ নেই, এবারে একটা সওয়াল জবাবের গল্প বলি। একালের বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে কোর্ট কেস নিয়ে সবচেয়ে উপাদেয় গল্প ফেঁদেছেন নারায়ণ সান্যাল, তাঁর কাঁটা সিরিজে। উলের কাঁটা, চুলের কাঁটা, কুলের কাঁটা, মাছের কাঁটা, গাছের কাঁটা, শজারুর কাঁটা, সারমেয় গণ্ডুকের কাঁটা, এমন কোনো কাঁটা পাবেন না যা নিয়ে তিনি একটা পি কে বাসুর গল্প নামান নি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় এই নিবেদন –



২। রবির কাঁটা




কুকুরের ওপর আমার খুব যে ভক্তি ছিল, তা নয়, তবে বাবা অত যত্ন করে রাস্তা থেকে যখন কেঁদোকে ঘরে এনে তুলল, আমিই ওর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলাম। বাবা হাইকোর্টের উকিল, বাবার সময় কোথায়? বোন মুমু-টা পুরো মা-র মতো, সে পড়াশোনা নাচ-গান-ছবি এইসব নিয়েই থাকে। তার গাদা গাদা বই-ম্যাগাজিন-এলপি রেকর্ড-পুরনো কারুকাজ-ছাইপাঁশ। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের এডিটিং করা বাতিল সেলুলয়েডের একবাক্স কালেকশন। আরে এখন ডিভিডির যুগ, ঐ ছাতা ঘরে রাখার কোনো মানে হয়?

আফটার অল কেঁদো তো কুকুর, সে তো বইটই পড়তে পারে না বানান করে। একটু না হয় চিবিয়েই দিয়েছে, তো কী হয়েছে, পড়া তো যাচ্ছে। মা-র পুরী থেকে কালেকশনের শাঁখটা অল্প কামড়েছে, তাও দিব্যি আওয়াজ বেরোচ্ছে, শাঁখের মতোই অনেকটা, মোটেই রেফারির হুইশ্‌লের মতো নয়। তারপর মেয়েদের চামড়ার চটির ওপর কুকুরদের জন্মগত দুর্বলতা, কে না জানে! আর ঐ ফিল্মের প্লাস্টিক, কুকুরে মুখ দেওয়ার জন্যেই তো ওর সৃষ্টি। মুমু ঘুমিয়ে ছিল বাঁ-কাতে, ওর ডানদিকের নাকটা একটু চেটেছে, সেখানে সেইজন্যে নাকি ওর ব্লিস্টার গজিয়ে গেছে, ডানদিকের নাসারন্ধ্র দিয়ে নাকি শ্বাস নিতেই পারছে না!

মা-মুমু দুজনেই একযোগে কেঁদোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো, ফলে এক সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে কোর্ট বসলো। বাবা এখানে বিবাদীপক্ষ, আমি বাবার উকিল।

ওরা কেঁদোর এগেইন্সটে ওদের যাবতীয় সমস্যা সাতকাহন করে বলল। বাবা শুধু একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জানতে চাইল, আমার জবাব রেডি তো? নাকি এক্সট্রা সময় চাইতে হবে? আমি চোখ দিয়েই বললাম, চিল ড্যাড।

নারায়ণ সান্যালের মিস্টার পি কে বসু বার-আট-ল’র মতো গলাটা ঝেড়ে আমি মুমুকে বললাম, তোরা যে এত রবি ঠাকুরের গান গাস, সব বৃথা। তোরা ওঁর কথাই বুঝিস না, ওঁকে মানিসও না।

মুমু প্রতিবাদ করে উঠল। মা বলল, অবান্তর কথা বলো না, কী বলতে চাইছ?

আমি বললাম, রবিবাবু কী বলে গেছেন? ‘এ সহে বই-শাঁখ, এ শো হে’। অর্থাৎ বই, শাঁখ এরা সহ্য করতে পারে কুকুরের অত্যাচার। দেখছই তো, চিবানোর পরেও বই পড়া যাচ্ছে, শাঁখও বাজছে। এটা একটা শোয়ের বেশি কিছু নয়।

বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি কন্টিনিউ করলাম, তার পরে আর কী বললেন? ‘তা পোষো, নিঃশ্বাস বাঁয়ে’। অর্থাৎ বলছেন, তবুও কুকুর পোষো, আর নাকের বাঁদিকের ফুটো দিয়ে নিঃশ্বাস নাও। ডানদিকে চেটেছে তো কী হয়েছে, বাঁদিকেরটা তো অক্ষতই আছে। আর কী? ‘মুমুর শ্যু-রে দাও উড়ায়ে’, বলে আমি মুমুর আধখাওয়া চামড়ার জুতোটা উড়িয়ে ছুঁড়ে দিলাম বাইরে। ‘বৎস, Ray-র আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক’, মানে সত্যজিতের ঐ পুরনো প্লাস্টিকের ছাইপাঁশ আজকেই ফ্যাল ঘর থেকে, না হলে কেঁদো আরো কামড়াবে।

এরপর বাবা-মা’র দ্বন্দ্ব বেধে গেল। মা’র মতে, বাবা আমাকে পুরো উকিল বানিয়ে ফেলেছে। বাবার মতে, রবীন্দ্রচর্চায় আমি মারও এক কাঠি ওপরে।

পুরো ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল, না? এ সব রবীন্দ্রচর্চার কুফল। রবীন্দ্রচর্চা তুঙ্গে ওঠে পঁচিশে বৈশাখে, সেটাই স্বাভাবিক। কাদম্বিনীকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইয়াছিল, তিনি মরেন নাই। কবির জন্মদিনেও তাঁকে তেমনি ব্যবচ্ছেদ করা হয় ছুরি-কাঁটা দিয়ে, তার শুরু হয় কিছুদিন আগে থেকেই, মহালয়ার মতো কবিপক্ষ শুরু হতেই। তাছাড়া পয়লা বৈশাখও বেশ লালকালির দিন, বছরের প্রথম দিন বলে কথা, সেদিনও বাঙালিরা সংস্কৃতি নিয়ে চেটেচুষে খায়। সে বিষয়েও একখান গল্প শুনে ফেলুন।



৩। আবাহনী



বলেছিলাম পয়লা বৈশাখ পড়ছে মধ্যে, সেদিন অফিস ছুটি থাকবে, শুনলো না, কলকাতা আপিসে এসে হাজির বিদেশী সাদা চামড়ার বড়বাবু। কী আর করা, গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারটাকে বললাম, বাবু যা খেতে চায়, ভালোমন্দ খাওয়াস। যদি বেরোতে চায়, আমাকে একটা ফোন করিস।

সেই পয়লা বৈশাখে সন্ধ্যে অবধি ফোন আসেনি। আমিই সন্ধ্যেবেলা হাজির হলাম গেস্ট হাউসে।

গিয়ে দেখি, মালটা দিব্যি আছে, টিভিতে বাংলা চ্যানেলের প্রোগ্রাম দেখছেন। হঠাৎ উঠে গিয়ে একটা চিরকুট বের করে আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ শ্যিওর দিস ওয়াজ পেন্‌ড্‌ বাই টেগোর?

দেখি, লেখা আছে, Yes, oh. Hey boy, suck. Yes, o yes, show.

আমি বললাম, হোয়্যার ডিড ইউ গেট ইট ফ্রম?

বললেন, টিভিতে এই চ্যানেলেই প্রোগ্রাম দেখছিলেন। একটা গানের সঙ্গে দুলে দুলে কতগুলো নাইসলি ড্রেস্‌ড্‌ ইয়াং গার্ল্‌স্‌ বডি মুভমেন্ট করছিল। কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলে, সে বলেছে টেগোর সং।

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আই থট টেগোর ওয়াজ অ্যা ফিলোজফার।

আমি আর কী বলি! বৈশাখের আহ্বান-সঙ্গীতের কী দশা করেছে এই ম্লেচ্ছ!

ইংরেজদের হাতে, মানে কানে পড়ে রবি ঠাকুরের বৈশাখী লাইনের দশা তো দেখলেন। ইংরেজরা ভারত শাসন করেছিল একশো নব্বই বছর, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবনের পুরো আশি বছর ছিল। কবি বেশ কয়েকবার ও-দেশে গেছিলেন, বাংলা গীতিকবিতার মর্ম ওদের বোঝানোর জন্যে কষ্ট করে ‘গীতাঞ্জলি’ ট্র্যানশ্লেশন করে নিয়ে গেছিলেন। সেই সময়ের একখান গল্প দিয়ে এবারের বাংলা পানের গল্পগাছা শেষ করব। এ রকম গল্প আমার স্টকে আরো অনেক আছে, সময়মত শোনানো যাবে।


৪। ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথ

ইংল্যাণ্ডে গেছেন কবি, উঠেছেন এবার এক নতুন অতিথিশালায়। আবিষ্কার করলেন, ওহো, সকালে যে বিশাল পেয়ালায় চা নিয়ে তিনি লিখতে বসেন, সেটাই সঙ্গে আনা হয়নি। মহা মুশকিল। রাণীর কাছে খবর যেতে তিনি অর্ডার দিয়ে একদিনের মধ্যেই আর একটি বৃহদাকার পেয়ালা কবিকে উপহার দিলেন। সেই পেল্লায় পেয়ালায় চা নিয়ে কবি কাগজপত্র নিয়ে লেখার টেবিলে বসেছেন, খেয়াল হলো, জোব্বাটা ঠিকমতো ইস্তিরি করা নেই। মখমলি সুতির জোব্বা, কুঁচকে থাকলে কেমন দেখায়? তাঁর খাসকামরায় একটি ইস্তিরি রয়েছে বটে, নিজেই আয়রণ করে নিতে পারবেন, কিন্তু একটু স্টার্চ না দিলে সুতির কাপড়ে ভালো ইস্তিরি হয় না।

চাকরকে বললেন, একটু ভাতের ফ্যান জোগাড় করে আন তো।

চাকর আগের দিনই দেখেছে, কবির ছোটখাটো বা অল্প জিনিসে মন ওঠে না। চা খান একসাথে লিটার খানেক। সে কাছের এক হোটেলে গিয়ে তাদের রান্নাঘর থেকে সাত-আটটা পাচককে দিয়ে বইয়ে আনালো এক বিশাল গামলায় পঞ্চাশ-ষাট লিটার ফ্যান, পুরো হোটেলের আবাসিকদের জন্যে রান্না ভাতের ফ্যান।

কবি চটলেন না, তাঁর মাথায় এসে গেল গান। তিনি লিখলেন, "আমি মাড়ের সাগর পারি দেবো গো..."


বিধিসম্মত সতর্কীকরণ : এই গল্পগুলো বাচ্চাদের সামনে কাউকে শোনানোর হলে সাবধানে করবেন। তারা যদি সত্যি বলে ভেবে নিয়ে পরীক্ষায় ‘ইয়োর ফেভারিট পোয়েট’ রচনায় এসব গুঁজে দেয় আর তার জন্য ল্যাঙ্গুয়েজ টীচার আপনাকে ডেকে পাঠান, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় কিন্তু। আর হ্যাঁ, পানাসক্তি (pun + আসক্তি) যদিও বা মেনে নেওয়া যায়, বেশ্যাসক্তি (বেশি + আসক্তি) নৈব নৈব চ।

০১ সুজিৎ মুখোপাধ্যায়

অপরাহ্ন
সুজিৎ মুখোপাধ্যায়



( চরিত্র : অমলা -- বড়বোন, বয়স ৫৫, বিধবা। রমলা -- ছোটবোন, বয়স ৪৩, অধ্যাপিকা, অবিবাহিতা। সময় -- প্রায় সন্ধ্যা। অমলা ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে )

অমলা : রুমি, এই রুমি! তখন থেকে কী এত রান্নাঘরে ঘুটুর ঘুটুর করছিস? আর রাঁধতে হবে না। একটু এদিকে এসে বোস তো!

রমলা : কিছু না দিদি! রান্না হয়ে গেছে। এই চা-টা ছেঁকে এখুনি আসছি।

(একটু পরেই রমলার প্রবেশ)

অমলা : আয় আয়, বোস! রান্নাঘরে এতক্ষণ কী করছিলি? দুজনে বসে যে একটু কথা কইব, তার উপায় নেই। একটু ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ করলেই তো হয়!

রমলা : (হেসে) থাক থাক, আর বেশি কথা কইতে হবে না। এখন চা খাও তো! কত ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খানেওয়ালা, আমার জানা আছে। একদিন দায়সারা রান্না করলেই খাবার সময়...। নাও তো, এখন চা বিস্কুট খাও।

অমলা : আঃ চা-টার কী সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে রে! অনন্ত চা-টা খুব ভালো দেয়, কি বল? কিন্তু এই চায়ের সঙ্গে এই অখাদ্য মেরিগোল্ড না ফেরিগোল্ড না হয়ে যদি পাতলা মুচমুচে পাঁপড়ভাজা হতো না...!

রমলা : এ-এ-এই দেখ, দেখলে তো! সাত হাত নোলা আবার বড়বড় কথা। ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ! শোনো, রাত্তিরের জন্য পেঁয়াজ-পোস্ত করেছি, ইচ্ছে না হলে খেয়ো না। ভাতের সঙ্গে একটা আলুসেদ্ধ করে দেবখন... খেয়ো।

অমলা : তুই চিরকাল এই রকম। খালি ঝগড়া আর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। এই জন্যেই...

রমলা : বলো বলো, থামলে কেন! শেষ করো কথাটা!

অমলা : (রেগে) না, বলব না, যা!

রমলা : তাহলে আমিই বলছি, “এই জন্যই তোর কপালে বর জুটলো না”।

অমলা : (হেসে) না, আমি সে কথা মোটেও বলতে যাচ্ছিলাম না।

রমলা :
(হেসে) আহা বললেই বা, আমি তাতে একটুও রাগ করব না, দুঃখও পাব না। যাকগে, কী কথা বলবে বলছিলে, বলো।

অমলা : (একটু ইতঃস্তত করে) তোর কলেজে বেরিয়ে যাবার পরে পরেই নন্তুর ফোন এসেছিল।

রমলা : তা ফোন এসেছিল তো মেজাজ ভালো থাকার কথা। কি, ডিসেম্বর মাসে আসতে পারবে না বলেছে নাকি?

অমলা : হ্যাঁ, বলছিল কী সব ওদের ট্রেনিং ফ্রেনিং আছে। নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যেতে হতে পারে।

রমলা :
(হেসে) ঐ এক কথা! আচ্ছা দিদি, তুমি কী বলো তো! নতুন বিয়ে করেছে, এখন ওরা একটু এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবে, না এখানে এসে এই দুই বুড়ির সঙ্গে বসে আড্ডা মারবে?

অমলা :
কতদিন হয়ে গেল, তা প্রায় দু’বছর হতে চললো, ওর সঙ্গে চোখের দেখাও নেই। বিয়েটাও ওখানে হুট করে করে ফেললো, তাতেও থাকতে পারলাম না।

রমলা : তোমার না সব তাতেই বেশি বেশি! কোথায় ছেলে বিদেশে ভালো কাজ করছে বলে সেই আনন্দে দু’হাত তুলে নেত্য করবে, তা না, সকাল সন্ধ্যে খালি প্যানপ্যান আর প্যানপ্যান। আরে বাবা, আজকাল কোনো সমস্যা আছে নাকি! যত খুশি যখন খুশি প্রাণ খুলে ফোনে কথা বললেই হলো!

অমলা : তুই চুপ কর তো! আমি বলছি ওকে দুটো বছর চোখে দেখিনি, আর উনি বলছেন ফোনের কথা।

রমলা : (হেসে) আরে বাবা, “দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া ক’রে...”। একথা মেনেছো বলেই তো ছেলে মানুষ হয়েছে। নয়তো রাখতে আঁচলের তলায়, “রেখেছো বাঙালি ক’রে মানুষ করনি”।

অমলা : মেয়েটাকে নিয়েও হয়েছে জ্বালা! নিজে ভালোবেসে বিয়ে করলি, দু’বছর যেতে না যেতেই ডিভোর্স-টিভোর্স ক’রে সবশেষ। এখন ঐটুকুন একরত্তি মেয়েকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে নিজে চাকরি করছে।

রমলা : উঃ দিদি, আর কত চিন্তা করবে? আর যাকে নিয়ে তোমার এত দুঃশ্চিন্তা, সে কিন্তু দিব্যি আছে।

অমলা : থাম তো, দিব্যি আছে না কচু আছে! আমি মা, আমি বুঝি না, আর তুই বেশি বুঝছিস!

রমলা : (হেসে) দেখ দিদি, আমি যদি মা হতাম তাহলে হয়তো আমিও দুঃশ্চিন্তায় ছটফট করতাম। কিন্তু মা নই বলেই একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারছি, চিন্তা করতে পারছি। (একটু থেমে) দিদি, প্রত্যেকেরই নানা দুঃখ নানা যন্ত্রণা। সেই তত বেশি সুখী যে যত বেশি দুঃখ সহ্য করতে পারে, আর তার সঙ্গে লড়াই করতে পারে।

অমলা : ভাব তো রুমি, মেয়েটা একা একা সারাটা জীবন কী ক’রে কাটাবে! আর ঐ যে দুধের শিশু মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ সবকিছু হারিয়ে একটা বোর্ডিং স্কুলে অনাথ বাচ্চার মতো প’ড়ে আছে! আমি যে ভাবতেই পারি না – সারারাত ঘুমোতে পারি না।

রমলা : (সামান্য হেসে) দিদি, একটু স্থির হও। শান্ত হও। আবার বলছি, ওরা দুঃখে নেই। ওরা শুধু আর সকলের মতো বিভিন্ন অসুবিধের সঙ্গে লড়াই করছে মাত্র। আচ্ছা বলো তো, আজ তোমার কাছে কে আছে? কোথায় তোমার স্বামী! কোথায় বা তোমার ছেলেমেয়ে!

অমলা : আমার কথা বাদ দে! আমার নিজের কোনো অসুবিধা নেই। তুই আছিস কাছে – আমাকে তো কুটোটাও নাড়তে হয় না। একটু এদিক থেকে ওদিক হবার যো নেই – সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার।

রমলা :
কী যে বলো তুমি! আমি থাকা আর নিজের স্বামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকা কি এক হলো? আর ধরো, আমিই যদি না থাকতাম তোমার কাছে, তাহলে?

অমলা : তাহলে আবার কি? যা হবার তা হতো। আচ্ছা রুমি, তুই এত একগুঁয়ে জেদি কেন বল তো? গোঁয়ার্তুমি ক’রে কিছুতেই বিয়ে করলি না। আজ আমি আছি, কাল যখন থাকব না, তখন তোকে কে দেখবে?

রমলা : (হেসে) এই রে, আবার আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? এই তো বেশ আলোচনা চলছিল।

অমলা : হাসিস না তো! সবেতেই তোর হাসি দেখলে না আমার গা জ্বালা করে।

রমলা : কী মুশকিল! যার উত্তর আমার জানা নেই, তা আমি দেব কী ক’রে? তোমার না আসলে দিদি, দুঃশ্চিন্তা করাটা একটা বিলাসিতা হয়ে গেছে। দেখ দিদি, শেষ বয়সে কেউ দেখবে কিনা এই দুঃশ্চিন্তায় আমি যে কোনো একজন মানুষকে নিয়ে তো ঘর করতে পারি না!

অমলা : আহা, যে কোনো লোককে কেন বিয়ে করবি? যাকে তোর ভালো লাগবে তাকে বিয়ে করলেই হলো। কেন, সে লোক কি তোমার ছিল না নাকি – ন্যাকা!

রমলা : কাউকে ভালো লাগাটাও আর দশটা জিনিসের মতো একটা প্রাকৃতিক নিয়মে মনের মধ্যে ওঠে আবার মিলিয়েও যায়। চিরস্থায়ী তো হয়ই না, বোধহয় খুব একটা দীর্ঘস্থায়ীও হয় না।

অমলা : (হেসে উঠে) দেখ রুমি, মুশকিলটা কি জানিস – বেশি পড়াশোনা করলে অনেক সময় নিজের স্বাভাবিক চিন্তাটাও ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যায়। যেটা বোধহয় তোর হয়েছে। দেখ শুধু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে মানুষ পাগল হয়ে যাবে। সব কাজ তুচ্ছ, পন্ডশ্রম, নিরর্থক বলে মনে হবে। জেনে রাখ, প্রকৃতি যেমন আমাদের বুদ্ধি দিয়েছে, তেমনি হৃদয় মন বলেও কিছু দিয়েছে।

রমলা : দিদি শোনো, আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ শত চেষ্টা করেও জীবনের কোনো অর্থই খুঁজে পায়নি। তাই সব চিন্তাশীল মানুষ শেষ পর্যন্ত কনফিউসড থেকে যায়। (হেসে) তবে তুমি ঘুরিয়ে আমাকে হৃদয়হীন ব’লে বোধহয় আমার ওপর একটা অবিচার করলে।

অমলা :
দূর পাগলী! আমি তোকে হৃদয়হীন ভাবতে যাব কোন্‌ দুঃখে! হৃদয়হীন হলে কি আমার কথায় তোর অভিমান হতো, না আমার মতো এক বুড়িকে এতকাল ধরে সারাক্ষণ এভাবে আগলে রাখতিস? আসলে তোর যোগ্য তোর মনের মতো মানুষের মুখোমুখি তুই আজও...। হয়তো কোনো একদিন হবি, হয়তো বা হবি না, কিংবা হয়তো কোনোদিন হয়েছিলি, খেয়ালই করিসনি।

রমলা : একসেলেন্ট! একসেলেন্ট! এই না হলে আমার দিদি! ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথরের এমন অসাধারণ ব্যাখ্যা অকল্পনীয়!

অমলা : ঠাট্টা করছিস? কর। কিন্তু যতই পন্ডিত হোস না কেন, মনকে কিছুতেই বশে আনতে পারবি না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন কর, ঠিক উত্তর পাবি।

রমলা : দেখ দিদি, আমি একথা জোর দিয়ে বলতে পারি, প্রত্যেক মানুষেরই একটা সময় আসে যখন সে বুঝতে পারে, যতই স্বামী-পুত্র-কন্যা থাক না কেন, সে কিন্তু আসলে একেবারে নিঃসঙ্গ, সম্পূর্ণ একা। আর এই বিশ্ব সংসারে কারও কাছেই তার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এই উপলব্ধির আবার দুটি দিক আছে, একদিকে যেমন তার স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা লাগে, তেমনি অন্যদিকে ভারি নিশ্চিন্তে সে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে। মনে হয়, সমুখে শান্তি পারাবার।

অমলা : রুমি, তোর সব কথা হয়তো একেবারে ঠিক, কিন্তু এই পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় শব্দটা কি জানিস – ভালোবাসা। এর তল খুঁজতে গেলে অনেক হাবুডুবু খেতে হবে, কিন্তু কিছুতেই তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি এক অতি সাধারণ অশীতিপর রুগ্ন বৃদ্ধাকে বলতে শুনেছি – তাঁর অতিবৃদ্ধ স্বামীর মৃত্যু যেন তাঁর মৃত্যুর আগে হয়। তাঁর চিন্তা, তাঁর নিজের মৃত্যু আগে হলে, এই অসহায় বৃদ্ধকে কে দেখবে! এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর নিজের যে কী হবে, সে কথা একেবারেই ভাবছেন না। এটা দেখার পর মনে হয়েছে, ভালোবাসার অতিরিক্ত এই ব্রক্ষ্মান্ডে আর কিছুই নেই।

রমলা :
আঃ দিদি, একথা শুনলেও মনটা জুড়িয়ে যায়। আবার মনটা ভারী বিষণ্নও হয়ে যায়। মনে হয়, কাউকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, কারোর কাছে পরম নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পণ করতে পারলে বোধহয় দেহ মন জুড়িয়ে যেত! কিংবা যদি এর উল্টোটিও হতো, যদি আমার মনের মতো কেউ আমার কাছে আসতো – অসহায় – আশ্রয়ের খোঁজে – যেমন –

সব পাখি ঘরে আসে,
সব নদী। ফুরায় এ জীবনের
সব লেন দেন।
থাকে শুধু অন্ধকার
মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

অমলা :
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।

রমলা :
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারিধার।
দু’জনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,আকাশে জল ঝরে অনিবার
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
অমলা :
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি – অনুভব –
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।
(সামান্য নীরবতা)

রমলা : দিদি, রাত হলো। ওঠো, খাবে চলো।

অমলা : ওমা, সত্যিই তো! অনেক রাত হলো। চল চল, খাবি চল।

(দূর থেকে সুর ভেসে আসে)

অশ্রুনদীর সুদূর পারে
ঘাট দেখা যায়
তোমার দ্বারে
(ধীরে ধীরে শব্দ মিলিয়ে যায়)








০১ অনুপম মুখোপাধ্যায়


সে
অনুপম মুখোপাধ্যায়


দেশের শেষ >       ধুলোর শেষ >       অন্ধকারের শেষ >

এক রাস্তার শেষ

নেই

ধারে
অথবা
পাশে

তবু

সরকারি সরাই থাকছে না
ধুলো কিছুতেই
নেটিভ
হচ্ছে না

হবে না
সে

লাথ খাবে না

সে

চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে

অপূর্ব জামাখানা
সাফ থাকতে দিচ্ছে না

চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে

ধপধপে শাদা লোকটা
গলায় ঢালছে এক রাতের মদ
আটকে থাকা জল থেকে মুক্তি চাইছে

সারা গা থাবড়ে থাবড়ে
ধুলো ফেলছে
র্ণবিদ্বে ফেলছে


বঙ্গীয় কুটীরের মেঝেয়

অথবা

কুটীরের বঙ্গীয় মেঝেয়

শেষে

নদীয়ায় / কুমিল্যায়
অথবা
অন্য যে কোনো এক জেলায়
মহকুমায়

শেষে

শুধু

নিজের ভাষা একটা মুখ

একটা নীলরঙা দিন
পিরিত হচ্ছে না

নিজের ভাষা একটা মুখ

একটা নীল সপ্তাহ
স্নেহ হচ্ছে না

নিজের ভাষা একটা মুখ

একটা নীল মাস
মমতা হচ্ছে না

কেমন ঘুরে যাচ্ছে

আর

তার

মনে পড়ছে

কুঠির চারপাশে
এক রাতের বিষনীল মায়ায়

চাবুকহীন

দয়ানাম্নী

she

০১ মলয় রায়চৌধুরী

চিহ্ণের ধাপা
মলয় রায়চৌধুরী



ডটপেনে চিটে আঁস্তাকুড়ে
মরা-পচা চিহ্ণদের লাশ
হৃদয় নিঠুর প্রিয়তমা
বিধাতা নির্বাণ অবক্ষয়
কত যে ফসিল ছেঁদো ছাই
ফেলে-দেয়া বাতিল বাতেলা
কীট খুঁটে ভিআরেফ কবি
জমা করে নিচ্ছে কবিতায়

আজও কুঝিকঝিকে ফেঁসে
রিসাইক্লিঙ বোঝে না দাদু
রকেটের ইনোভেটিভতা
মানুষ কী করে গেল চাঁদে

হ্ণদের খোলস ছাড়িয়ে... 


০২ স্বপন রায়

রিয়া আবার-৫
স্বপন রায়



আর বাইকে নীহার পড়ে মাচার কন্ঠি টিয়া সেও পড়ে
ভোর উলটে যায়
পড়াকে সরাকে ধরাকে দেখা যায় মাঠে উক্ত ওড়ে ব্যাখ্যা ওড়ে
সার সার বাইক
মনে হলো উড়বে এক্ষুনি বিলম্বতামায় যে রোদ এখনি তো গীয়ারে লাঘব ষাট 


এখনি তো সবাঁক ভ্রুতল আসবে চেক চেকনাকায় ডুবজীন্স নীহার কা মতলব...

বাইক আছে গিডি গিডি বসন্তে কেনা আমারও

তাই মেঘ আসে ভাসা ভাষা মেঘের ওদিকে আমি যে কি ফেলে এসেছিলাম
সামান্য ভেজা


০৩ আশরাফুল কবীর

কুজ্ঝটিকায় জেগে ওঠা বসন্তআখ্যান...
আশরাফুল কবীর



শেষরাত্র্রিতে এখানেই শীত পালিয়েছিল বসন্তের খোঁজে
গুটিয়ে নিয়েছিল তার স্বল্পায়ু-আবাস,
পেছনে ফেলে রেখে গিয়েছিলো--
একদা জোৎস্না-প্লাবনে ভেসে যাওয়া
কিছু অপেক্ষমান খোলা-জানালা।

দ্রুতগামী উপকূল-এক্সপ্রেস ট্রেনের মতোই
স্ব-শব্দে গতিময় হয়েছিলো সে,
একে একে পেরিয়েছিল স্বপ্নালোকের টান টান পরিধি
ভিড়জমানো ছায়া-প্রচ্ছায়ার যুগলবন্দি।

আরো পেরিয়েছিলো--
গহীন রাতে থেকে থেকে কম্পিত হওয়া
কোনো এক চন্দ্রাহত ডাহুকীর অনালোকিত অন্দর
পোর্ট-অফ-স্পেন, ত্রিনিদাদ-ট্যোবাগো কিংবা
নাম না জানা, অচেনা কোনো বন্দর।

পড়ন্ত বিকেলে বেলাভূমিতে খুঁজে ফিরছিলো সে--
কাঁসর-ঘণ্টায় মুখরিত কোনো এক শুকতারার টান
দিনাবসানের ধূম্রজালে আটকে পড়া শেষ রোদটুকু,
তুলির আঁচড়ে ভর করা কোনো সকরুণ মুখের সন্ধান করছিলো
প্রতিকৃতি-বিহীন কোনো বিমূর্ত ক্যানভাসে,
হা-হুতাশ দীর্ঘশ্বাসে, আড়ালে আবডালে
যার ছিটেফোঁটা এখনো লজ্জাশীলা হয়ে ভাসে।

এখনো ঝড় বয়ে যায়,
শোঁ শোঁ শব্দে এখনো ঝরে পড়ে কিছু অব্যক্ত কথামালা
বসন্ত প্রতীক্ষায় এখনো উড়ে চলে কিছু সজল বুনোহাঁস
চন্দ্রবীণায় সাঁতরে চলে আরো কিছু দুরন্ত কাকতাড়ুয়া
খোলা-জানালা অভিমুখে--
বসন্ত-আখ্যানে এখনো প্রতীক্ষিতরা
যেখানে জ্বলে, পুড়ে, মরে ধুঁকে।

০৪ কচি রেজা

ডানার লালপিঁপড়ে
কচি রেজা


তোমাকে আবিষ্কার করতে পারি না জীবন
তাকিয়ে রয়েছি আলগোছে,
নোনতা করেছ, বাধা দিয়েছ উদগমে,
তবু তোমাকে পান করে বিদীর্ণ হয় মানুষের বুক

মার বুকও,
আমরা তাদের কথা জানি না, যারা আবিষ্কার
করেছিল লিপি,
কৃষিকাজে গাড়ি টানতো গাধা ও ঘোড়া, মূর্তি
তৈরিতেও দক্ষ,
একদিন মূর্তি দখল করে নিল তাদের,
আমরা এখনও মূর্তির অধীন

এখনও সময় আছে, কলম দিয়ে মাটিতে দাগ
টানি, এসো
আর দেবতার রোদে শুকিয়ে নিই,
গ্রাম ও শহরের হাজার হাজার বছরের মানুষ

কাত হতে হতে ভালোবেসে ফেলি শাশ্বত জীবন
ধীরে ধীরে ধূলোর পাহাড় জমুক,
কৌতূহলী কেউ খুঁজে নেবে চিহ্নগুলি 


০৫ সুবীর সরকার

মেগাসিরিয়াল
সুবীর সরকার



(১)

মাছ মাংস খাই না
পরিবর্তে কফি ও
             শপিংমল
সিরিয়াল থেকে মাঠে নামছে
                             চাষিভাই


(২)

পানের পিক ছুঁড়ে ছুঁড়ে নোংরা
একটা হিমনির্জন বাড়ি
শিকারিকে প্রচুর খেলায় স্বাদু
                             জলের মাছ
বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কাঁকড়াবিছে


(৩)

অনেক দূরে চলে যাবো, আর ফিরবো না
পুরনো দিনের চশমায় বেশ দেখাবে
লক্ষ্য করেছো অদ্ভূত মিল!
আওয়াজ ভরা সেপ্টেম্বর। বাইরে খেতে
                                              যাই।


(৪)

একেবারে উদাসীন ছিলে
চাঁদ, চাঁদের মতো
খোলসা করি ব্যাকুলতা
কেমন হিজিবিজি হয়ে আছো

০৬ প্রদীপ চক্রবর্তী

প্রবাসীর গাছ
প্রদীপ চক্রবর্তী


বেশ তো ভালোই ছিল গাছ। রঙ রোয়া হলো ভিড়ে

পাতায় দূরে
               সুরে ভাঙে
শীর্ণতম আলোর আঘাতে সন্তত পিপাসা
               প্রবাসীর বৃষ্টি যেন ঘরছবি আঁকে

তাকে ছুঁলাম। ছোট ছোট হাতে পাখি
না-ফোটা হেম, এক-একটি ফিরিওয়ালার দুপুর
গাছের নিবিড় গন্ধে পথ সাফাই হচ্ছে ও সমান

পল পলকের পিয়াশাল। ভরাডুবি গন্ডগ্রাম জাতীয় সড়ক।
আত্মতাহীন গাছটুকু ছাড়া সবই হিন্তাল।
পার হচ্ছে ধু ধু হাওয়া
                    প্রসন্ন মনে জলভারে সিঁধকাটা ঘর
একা একটা সদা প্রজাপতি উড়ছে কেবল ভবিতব্যে...

০৭ সোনালি বেগম

খড়কুটো
সোনালি বেগম


পরিশ্রমী যন্ত্রমানবী ঘুরে বেড়ায়। অগ্নিদগ্ধ
নদীগর্ভ রাজপথ অবলম্বন করে। কঠোর
নিয়ন্ত্রণে নৃপতিশাসন। লাগামহীন ঝড় ও
গর্জন। ভুলত্রুটির দুঃখপ্রকাশ কখনো কখনো
মঠজীবন আঁকড়ে ধরতে চায়। নিঃস্ব হাত।
পণহীন মিলন-অনুষ্ঠানে চালাক পাথর-হৃদয়
লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে। অর্থনৈতিক
স্বাধীনতার পাঁচালি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত পৃষ্ঠায়
আকাশ আঁকতে চায়।

লুঠের সামগ্রী ঘিরে প্রজ্বলিত প্রদীপ
হাঁসফাঁস দামি শিকার শিকারির জালে
আত্মগোপন করে। সপাং সপাং চাবুকের
শব্দ কিছুটা বেমানান ঢংয়ে স্থান করে
নিলে মমতার খড়কুটো মুখে কপোত
কপোতী উড়ে যায় ---