রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০৩ স্বপন রায়

রেলা-১
স্বপন রায়


জিগর থেকে বেরোয় তাই জিগরী দোস্ত! রেল, রেললাইন এই জিগরে জড়ানো এক সমান্তরাল দোস্তানা আমার, যা ফুরোয় না, চাক্কা জ্যাম হলেও চলতে থাকে! জামশেদপুর মামাবাড়ি, ছোট্ট আমার অবধারিত গন্তব্য... তবে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বাবা, মা ছাড়া প্রথম সেই ভারী মজার শহরে যাওয়া, মা আমায় যাতায়াতের ভাড়া আর দশ টাকা দিয়ে বললেন, আর এই দুটো টাকা রাখ, খিদে পেলে কিছু খেয়ে নিবি... আমার হাফ টিকিটের বয়স পেরিয়ে গেছে, তাতে কী? আমি হাফটিকিট কেটেই উঠে বসলাম আমার প্রথম একাকী রেল ভ্রমণের থার্ড ক্লাসে। অজান্তেই রেলবাহিত আমার সেই যাত্রা শুরু হলো ক্লাসলেস আত্মজীবনের দিকে!

এরপর পুরো রাউরকেলা থেকে জামশেদপুর এক অন্তর্গত ধ্বনিপ্রবাহ আমায় রক-এন-রোলে টিউনড করে তুললো! টি.টি দেখলেই ধ্বক ধ্বক আর না দেখলে সনাতনী রেল-রেওয়াজ : ঝিক ঝিক... মা’র দেওয়া দশ টাকা আর হাফটিকিট কেটে বাঁচানো ছ’ টাকা এই ষোলো টাকার মধ্যে পনেরো টাকা আমি হাফ-প্যান্টের গোপন পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম, ৫০ পয়সার চিনেবাদামের চর্ব্য চোষ্য পার করে বাকি ৫০ পয়সা আমার প্যাণ্টের সাইড পকেটে ঢুকে গেলো।

আমার হাফপ্যান্ট এবং নিরীহ চাউনি টি.টিদের নিয়ে এলো না, সন্দেহ করার ন্যূনতম যোগ্যতা আমার না থাকায় এই সুযোগ আমি পেয়ে গেলাম, আমার পাশের লোকটি আমায় ওই একই কারণে স্নেহচোবানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো : “কোথায় জায়গা?”

বাঙালি হিন্দি বলছে, আমায় কি বাঙালি মনে হয় না? অনেকদিন পরে একটি কবিতাসভায় এক ওড়িয়া মহিলাকবি আমায় পাঞ্জাবি ভেবেছিলো। সিকিমে তো আমায় দাজু বলেই ডাকে... এই মুখ-সমস্যা আমার শুরু থেকেই, সেই অনতিমুখর রেলযাত্রাতেও আমায় বাঙালি ভদ্রলোকের হিন্দি সহ্য করতে হচ্ছিল!

-ও টাটা যায়গা? ওখান মে অনেক গুন্ডা হ্যায় না?

-পতা নহি

-একলা একলা যাতা হ্যায় কিঁউ খোকা?

মনে মনে বললাম, তাতে আপনার কি?

মুখে কিছু না!

-তমকো একা একা বাবা মা ছোড় দিয়া? টাটা শুনা হ্যায় খুবই ইয়ে হ্যায়... মানে সাঙ্ঘাতিক হ্যায়... তুম ছোট হ্যায়, বিপদ মে পড়েগা তো ক্যা করেগা?

আমি চুপ করে থাকি। আমার একমাত্র বিপদ টি.টি। যদি ধরেগা তো ক্যা করেগা জানতা নহি!

ট্রেনের যে স্বভাবী বিট রয়েছে, তাতে অনেক কিছুই খাপ খেয়ে যায়। যেমন আমার সদ্য জেগে ওঠা কবিতাপ্রেম! ‘রেল চলে/মন টলে/রেল দোলে/মন বলে/আয় দেখি/ঝিকঝিকি/বাঁক নেয়া/ছাপ দেয়া/এই ট্রেনে/কে জানে/হয় কেনো/ধুকপুকই/আয় খুকি/আয় খুকি... এই জায়গায় থেমে গেলাম, শালার খুকি কোত্থেকে এলো... হেমন্ত আর শ্রাবন্তীর গানটা ঢুকে গেলো নাকি? ওই যে, “আয় খুকু আয়...” দুত্তোর! আমি বাদামে ফিরে আসি...

বাইরে সারান্ডা ছুঁয়ে ট্রেন চলেছে, জলের বিমনে রাখা জঙ্গল, জঙ্গলের সম্মোহনে রাখা অম্বরছাপ নীলাসক্তি, যেখানে কাশব্রাশের ডগায় আঁকা অক্টোবরী মেঘ, আর আমি জানালা দিয়ে এই সব ভাবী কবিতার বিচরণ দেখছি, ট্রেন চললে দৃশ্য সচল হয়ে ওঠে, একজন কিশোর তাতে পদ্য মেশায়, পদ্যে লা জবাব সামোসার গন্ধ ঢুকে যায়, ফেরিওয়ালা চেঁচায়, তার শিরার ফেটানো রঙে মিশে যায় ট্রেনের হর্ন, গতি কমে ট্রেনের, স্টেশন আসছে, চক্রধরপুর! আমার পাশের লোকটি কেন কে জানে তার বং-হিন্দিতে হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করে, -খোকা তোমারা বাপকা নাম কি?

-দেবানন্দ!

-ও... হে হে ফিলিম আর্টিস্ট কা নাম... বাঃ বাঃ... আউর তোমারা নাম?

-বিবেকানন্দ!

লোকটি আমায় দেখে কিছু একটা ভেবে নেয়, মুখ দিয়ে হুম টাইপের আওয়াজ বের করে চা-অলাকে ডাকতে থাকে...

চক্রধরপুরের পকৌড়া আর আলুর দম এক টাকায়, আমার গোপন সঞ্চয় এক টাকা কমে যায় স্বখাত স্বাদুলায়, তবে ওই রেলবিরল দমের ঝাঁ ঝাঁ আর কোথায় পাবো? খেতে খেতে পাশের লোকটিকে দেখতে থাকি। পুরো চুপ, বোলতি বন্ধ একেবারে! ট্রেন আবার দুলে ওঠে, আমি ভাবতে থাকি জামশেদপুর, আস্কারা টাস্কারা মামাবাড়ির, আর জুবিলি পার্ক যাওয়ার সেই রাস্তাটা যেখানে নির্জনতা দেরি করে আসা আলস্যের ছায়ায় শুয়ে থাকে, কাউকে দূর থেকে দেখে মনে হয় হাসছে আর হাসিতে জড়িয়ে যাচ্ছে দুধারা বিনুনী!

তো এসে যায় জামশেদপুর, টাটা! আমি সম্ভবত জুলিয়াস সিজারের হাসি দিয়ে(হাসিটা কেমন?) নেমে আসি আমার প্রথম স্বাধীন রেলযাত্রা শেষ করে। প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক তাকাই, গোঁফের মিহি রেখায় হাত বুলিয়ে শিস দিতে থাকি, ‘এ দিল না হোতা বেচারা...’

হাফপ্যান্ট, বুশসার্ট, কিটস-ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম প্রায়, টি.টি হাত চেপে ধরলো!

-ইয়ে টিকিট তুমহারা

-জী

-হাফটিকিট কিঁউ?

-মেরা ওমর গিয়ারাহ সাল

-আচ্ছা, তো বার্থ সারটিফিকেট দিখা

-ক্যা স্যার... ও তো ঘর মে হ্যায়

আমি বলছি আর ঘামছি, তীরে এসে তরী ডুবতে চলেছে!

-কাঁহা হ্যায় বে তেরা ঘর?

-রাউরকেলা

-তু তো পক্কা খিলাড়ি লগতা হ্যায়... হাফটিকিট... উল্লু বনা রহা হ্যায় হমলোগোঁকো?

-স্যার মেরা ওমর গিয়ারাহই হ্যায়

-প্রুফ ক্যা হ্যায় তেরা পাস? ফাইন লেকে পঁচ্চিশ রপায়া... নিকাল ওউর রাস্তা নাপ

-মেরা পাস কুছ নহি হ্যায় আঙ্কল

-আঙ্কল? মস্কা মত্‌ মার... তু সফর কর রহা হ্যায়... তেরা ঘরবালা কুছ নহি দিয়া তেরে কো?

আমার গোপন পকেটে রাখা পনেরো, থুড়ি চোদ্দ টাকা শিউরে ওঠে... অনেক কষ্টে চোখে জল এনে বলি, ‘আঙ্কল হমলোগ বহুত গরীব হ্যায়... কিসি তরহ টিকিট কা পয়সা জুগাড় হুয়া... মেরা মামাকা ঘর হ্যায় ইঁহা... মেরা পঢ়াই বন্ধ হো গিয়া থা... মামালোগ মা কো বোলা মুঝে ভেজনে কে লিয়ে পঢ়াই কে বাস্তে... বহুত গরীব হ্যায় হম আঙ্কলজী...

আমার চোখে এত জল ছিলো?

টি.টি আমার কান্না দেখে গলার স্বর নরম করে বললো, ঠিক হ্যায়, রোনা বন্ধ কর, পকেট মে কিতনা হ্যায় নিকাল...

আমি কাঁদতে কাঁদতে দুটো পকেট উল্টে দিই... সেই একাকী পঞ্চাশ পয়সা তার আট আনার শরীর নিয়ে খটাং করে পড়ে যায় টি.টি.র জুতোর ডগায়...

টি.টি ওই আটআনা কুড়িয়ে নিয়ে বলে, তু তো সচমুচ গরীব হ্যায়... ঠিক হ্যায় ইসিমে কাম চলা লেতে হ্যাঁয়... অব ফুট ইহাঁ সে...

আমি প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে স্তালিনের হাসিটা দিয়ে গাইতে থাকি, ‘জাগো জাগো সর্বহারা, অনশন বন্দী ক্রীতদাস...’। জামশেদপুরের সন্ধ্যায় আমার পা পড়ে, আমার সেয়ানা হওয়ার ভার নিয়ে...

৬টি মন্তব্য: