অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী গণেশ পাইন
নাসের হোসেন
পৃথিবীজোড়া নাম যে ছোট্টখাট্ট মানুষটির, তাঁর নাম গণেশ পাইন। স্বনামধন্য শিল্পী তো বটেই, কিন্তু বিশাল নামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো অহংকার তাঁর ছিল না। স্বভাবলাজুক তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে ছিলেন স্বভাব-মিতভাষী। তাই বলে কী কথা তিনি একেবারেই কম বলতেন! না, সেটাও ঠিক নয়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কত যে কথা তাঁর মুখে শোনা গেছে! কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে দীর্ঘদিন আড্ডা দিতে দেখেছি তাঁকে। আড্ডা দিতেন সমসাময়িক আর্টিস্ট ও অন্যান্য গ্রুপের শিল্পীদের সঙ্গেও। তবে মূলত তিনি ছিলেন তাঁর ছবির জগৎ নিয়ে একা, একক অণ্বেষক। তাঁর বেশির ভাগ কাজই ছোট ও মাঝারি মাপের। খুব বড় আকৃতির ছবির সংখ্যা অত্যন্ত কম। কাজের সাইজ ছোট হলে কী হবে, ছবিগুলোর প্রতিটি বিন্দুতে এমন কিছু সংবেদ যুক্ত করে দিতেন যে, সেগুলো কী বিশাল আবহ নিয়ে ঘিরে ফেলতে সক্ষম তার দর্শকদের, তার পাঠকদের। বই যেরকম এক ধরনের পাঠ, ছবি ও ভাস্কর্যও তেমনি পাঠ। অর্থাৎ ছবি ও ভাস্কর্য দেখাটাও এক ধরনের পাঠ। গণেশ পাইনের ছবির যে পাঠ, সে-পাঠে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবির বিভিন্ন পাঠ আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন পাঠ থাকলেও, একটা মূল সুর। গণেশ পাইনের ছবির মূল সুর কিন্তু ভিতর-আবহের মতো তাঁর সব ছবির মধ্যেই বিরাজমান। কালিকলম, টেম্পারা, জলরঙ সবেতেই সেই ভিতর-আবহ আমাদের স্পর্শ করে থাকে। টেম্পারার কাজই বেশি করেছেন। বেশ কিছু কাজ মিশ্র মাধ্যমে। এই যে আমাদের জীবন, এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের মৃত্যু। একে আমরা জীবনের আবহ যেমন বলতে পারি, তেমনি একে আমরা মৃত্যুর আবহও বলতে পারি। এবং তার যে দৃশ্যায়ন, সে যে কী সংবেদনশীল! তার যে রেখায়ন, সেও যে কী সংবেদনশীল! একটা পেইন্টিং-এর চারদিকে নির্দিষ্ট সীমা বিদ্যমান, কিন্তু ওই সীমার থেকেও বড় কথা চিত্রটির কম্পোজিশন, তার রঙ, তার রেখা, এবং সব মিলিয়ে অপূর্ব এক সংক্রমণ। গণেশ পাইনের ছবিতে এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত জায়গায় অবস্থান করছে বলে মনে হয়। তাঁর যোদ্ধা, তাঁর কৃষ্ণ, তাঁর মৃত্যুর নৌ্কা প্রভৃতি অসংখ্য পেন্টিং-এর নিহিত পর্যটন আমাদের মৃত্যুময় আধো-অন্ধকার পরিমন্ডলে জীবনের স্পন্দন শোনায়। জীবনের সাহস শোনায়। গণেশ পাইনের ছবিগুলোকে কখনো কখনো মনে হতে পারে অন্য ধরনের রূপকথা। সেখানে অন্ধকারে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কোটরগত চোখ জ্বলতে থাকে, কেউ পাঁজর থেকে মশাল বের করে সেটা উঁচু করে ধরে হাঁটতে থাকে, একলা চলো রে গান শোনা যেতে থাকে। সেখানে কোথাও হাড়ের পাহাড়, কোথাও মণিমাণিক্যের পাহাড়, কোনো সরু একটা নদী, আর সেই নদীর উপরে পুরনো দিনের নৌকা, নৌকার উপর যাত্রীরা –- সব সময়ের –- আঘাত-তাড়িত, একইসঙ্গে যেন-বা নিয়তি-তাড়িত। তাঁর ছবিতে কোথাও হয়তো বুদ্ধ-ভূতুম বা রাক্ষস-খোক্ষসের দ্বান্দ্বিক প্রতিভাস জায়গা করে নিতে থাকে। কিন্তু সরাসরি এইসব নামে হয়। কিছু কিছু বইয়ের, বিশেষত ছোটদের, প্রচ্ছদ ও ভিতরের অলঙ্করণ, সচিত্রকরণ করেছেন। সেগুলিও যে কী নিষ্ঠা সহকারে করেছেন, ভাবলেই অবাক লাগে। তবে ওইসব সচিত্রকরণের মধ্যেও গণেশ পাইনকে গণেশ পাইনের মতো করেই পাই। পাই তাঁর মকশো-ছবি বা ডুড্লগুলোতেও। বা, জটিংস। মকশো ছবির ব্যাপারে মনে পড়ছে, তিনি বড় সাইজের ডায়েরির রুলটানা পাতাগুলিকে কী চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কিছু প্রদর্শনী দেখেছি। ফলে বড় ওরিজিন্যাল কাজ দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে আমি গর্বিত। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে।
আশি দশকের শেষের দিকে আমাদের ‘রৌরব বারো বছর’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল গণেশ পাইনের প্রচ্ছদ সহ। সেই প্রচ্ছদের ছবি আমি আনতে গেছিলাম কবিরাজ রো-এর অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িতে। গণেশ পাইন নিজে তাঁর সেই ছবি তুলে দিয়েছিলেন আমার আবেগ-বিহ্বল হাতে। সেটা ১৯৮৭ সাল। কালি ও জলরঙ-এর এই কাজটির নামও রেখেছিলেন ‘রৌরব’। তাঁর একটি পেন্টিং-এর মধ্যে আমাদের টগবগে যৌবনের ‘রৌরব’ পত্রিকা বেঁচে রইলো চিরদিনের জন্য, এটা আমাদের কাছে কত যে গৌরবের, একই সঙ্গে আনন্দের, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের কাজ হয়ে গেলে ছবিটি তাঁর হাতে পুনরায় অর্পণ করা হয়েছিল। পরে বিশাল আয়তনের বই আকারে ‘রৌরব বারো বছর’ বের হলে তাঁকে দিয়ে এসেছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বহুবার দেখা হয়েছে। সে-সব গল্প অন্য সময় বলা যাবে।
পৃথিবীজোড়া নাম যে ছোট্টখাট্ট মানুষটির, তাঁর নাম গণেশ পাইন। স্বনামধন্য শিল্পী তো বটেই, কিন্তু বিশাল নামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনো অহংকার তাঁর ছিল না। স্বভাবলাজুক তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে ছিলেন স্বভাব-মিতভাষী। তাই বলে কী কথা তিনি একেবারেই কম বলতেন! না, সেটাও ঠিক নয়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কত যে কথা তাঁর মুখে শোনা গেছে! কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে দীর্ঘদিন আড্ডা দিতে দেখেছি তাঁকে। আড্ডা দিতেন সমসাময়িক আর্টিস্ট ও অন্যান্য গ্রুপের শিল্পীদের সঙ্গেও। তবে মূলত তিনি ছিলেন তাঁর ছবির জগৎ নিয়ে একা, একক অণ্বেষক। তাঁর বেশির ভাগ কাজই ছোট ও মাঝারি মাপের। খুব বড় আকৃতির ছবির সংখ্যা অত্যন্ত কম। কাজের সাইজ ছোট হলে কী হবে, ছবিগুলোর প্রতিটি বিন্দুতে এমন কিছু সংবেদ যুক্ত করে দিতেন যে, সেগুলো কী বিশাল আবহ নিয়ে ঘিরে ফেলতে সক্ষম তার দর্শকদের, তার পাঠকদের। বই যেরকম এক ধরনের পাঠ, ছবি ও ভাস্কর্যও তেমনি পাঠ। অর্থাৎ ছবি ও ভাস্কর্য দেখাটাও এক ধরনের পাঠ। গণেশ পাইনের ছবির যে পাঠ, সে-পাঠে তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবির বিভিন্ন পাঠ আমরা দেখতে পাই। বিভিন্ন পাঠ থাকলেও, একটা মূল সুর। গণেশ পাইনের ছবির মূল সুর কিন্তু ভিতর-আবহের মতো তাঁর সব ছবির মধ্যেই বিরাজমান। কালিকলম, টেম্পারা, জলরঙ সবেতেই সেই ভিতর-আবহ আমাদের স্পর্শ করে থাকে। টেম্পারার কাজই বেশি করেছেন। বেশ কিছু কাজ মিশ্র মাধ্যমে। এই যে আমাদের জীবন, এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের মৃত্যু। একে আমরা জীবনের আবহ যেমন বলতে পারি, তেমনি একে আমরা মৃত্যুর আবহও বলতে পারি। এবং তার যে দৃশ্যায়ন, সে যে কী সংবেদনশীল! তার যে রেখায়ন, সেও যে কী সংবেদনশীল! একটা পেইন্টিং-এর চারদিকে নির্দিষ্ট সীমা বিদ্যমান, কিন্তু ওই সীমার থেকেও বড় কথা চিত্রটির কম্পোজিশন, তার রঙ, তার রেখা, এবং সব মিলিয়ে অপূর্ব এক সংক্রমণ। গণেশ পাইনের ছবিতে এই ব্যাপারটা চূড়ান্ত জায়গায় অবস্থান করছে বলে মনে হয়। তাঁর যোদ্ধা, তাঁর কৃষ্ণ, তাঁর মৃত্যুর নৌ্কা প্রভৃতি অসংখ্য পেন্টিং-এর নিহিত পর্যটন আমাদের মৃত্যুময় আধো-অন্ধকার পরিমন্ডলে জীবনের স্পন্দন শোনায়। জীবনের সাহস শোনায়। গণেশ পাইনের ছবিগুলোকে কখনো কখনো মনে হতে পারে অন্য ধরনের রূপকথা। সেখানে অন্ধকারে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কোটরগত চোখ জ্বলতে থাকে, কেউ পাঁজর থেকে মশাল বের করে সেটা উঁচু করে ধরে হাঁটতে থাকে, একলা চলো রে গান শোনা যেতে থাকে। সেখানে কোথাও হাড়ের পাহাড়, কোথাও মণিমাণিক্যের পাহাড়, কোনো সরু একটা নদী, আর সেই নদীর উপরে পুরনো দিনের নৌকা, নৌকার উপর যাত্রীরা –- সব সময়ের –- আঘাত-তাড়িত, একইসঙ্গে যেন-বা নিয়তি-তাড়িত। তাঁর ছবিতে কোথাও হয়তো বুদ্ধ-ভূতুম বা রাক্ষস-খোক্ষসের দ্বান্দ্বিক প্রতিভাস জায়গা করে নিতে থাকে। কিন্তু সরাসরি এইসব নামে হয়। কিছু কিছু বইয়ের, বিশেষত ছোটদের, প্রচ্ছদ ও ভিতরের অলঙ্করণ, সচিত্রকরণ করেছেন। সেগুলিও যে কী নিষ্ঠা সহকারে করেছেন, ভাবলেই অবাক লাগে। তবে ওইসব সচিত্রকরণের মধ্যেও গণেশ পাইনকে গণেশ পাইনের মতো করেই পাই। পাই তাঁর মকশো-ছবি বা ডুড্লগুলোতেও। বা, জটিংস। মকশো ছবির ব্যাপারে মনে পড়ছে, তিনি বড় সাইজের ডায়েরির রুলটানা পাতাগুলিকে কী চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কিছু প্রদর্শনী দেখেছি। ফলে বড় ওরিজিন্যাল কাজ দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে আমি গর্বিত। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, কুশল বিনিময় হয়েছে।
আশি দশকের শেষের দিকে আমাদের ‘রৌরব বারো বছর’ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল গণেশ পাইনের প্রচ্ছদ সহ। সেই প্রচ্ছদের ছবি আমি আনতে গেছিলাম কবিরাজ রো-এর অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িতে। গণেশ পাইন নিজে তাঁর সেই ছবি তুলে দিয়েছিলেন আমার আবেগ-বিহ্বল হাতে। সেটা ১৯৮৭ সাল। কালি ও জলরঙ-এর এই কাজটির নামও রেখেছিলেন ‘রৌরব’। তাঁর একটি পেন্টিং-এর মধ্যে আমাদের টগবগে যৌবনের ‘রৌরব’ পত্রিকা বেঁচে রইলো চিরদিনের জন্য, এটা আমাদের কাছে কত যে গৌরবের, একই সঙ্গে আনন্দের, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের কাজ হয়ে গেলে ছবিটি তাঁর হাতে পুনরায় অর্পণ করা হয়েছিল। পরে বিশাল আয়তনের বই আকারে ‘রৌরব বারো বছর’ বের হলে তাঁকে দিয়ে এসেছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে বহুবার দেখা হয়েছে। সে-সব গল্প অন্য সময় বলা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন