রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়

সুখস্মৃতি বয়ে চলেছি
মৃদুল বন্দ্যোপাধ্যায়



১৯৫৫, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। প্রথম দু’বছর সব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী, একসঙ্গে ক্লাস। নতুন এক ছাত্র এলো। শুনলাম খুব ভালো ড্রইং করে বলে মাস্টারমশাইরা সরাসরি সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি করেছেন। পরিচয় হলো। --‘কোন্‌ ডিপার্টমেন্ট? আমার কমার্শিয়াল আর্ট, তোমার?’ –-‘আমি তো ফাইন আর্টসে’। ক’দিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা হলো।

মাস তিনেক পরেই একদিন ছুটির পর বলল –-‘চল একটু ঘুরে আসি’। নিউইয়র্ক সোডা ফাউন্টেনের গলি দিয়ে স্টেটস্‌ম্যান অফিস হয়ে ওদিকের ফুটে এগিয়ে চলেছি। পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবী কালোপাড় ধুতি কোঁচা হাতে ধীর পায়ে গণেশের নিজস্ব ভঙ্গিতে হাঁটা। ওই ফুটেই ওরিয়েন্ট লঙম্যানের অফিস। দোতলায় চিত্রপ্রদর্শনী। একটা ছবির সামনে এগিয়ে বলল, ‘দেখ কেমন লাগছে! বুদ্ধ ও সুজাতা। টেম্পারা মাধ্যম। অবনীন্দ্র ছাপ বসানো। ছবিটি পুরষ্কৃত হয়েছে’।

পুজোর ছুটি –- ঠিকানা বিনিময়। কবিরাজ রো-এর সঙ্গে বেলঘরিয়ার কে. পি. ঘোষাল রোড। ক’দিনের মধ্যেই তুমি থেকে তুই হয়েছি। পোস্টকার্ডে প্রথম দিকে যে কোনো একটা স্কেচ। নিচে ও অপরদিকে দু’চার কথা। এবং সেই আদি ও অমলিন স্বাক্ষর –- গণেশ পাইন। অফিসে বা সরকারী কাজ ছাড়া ইংরেজিতে সই করতে দেখিনি। দু’চারটে চিঠি দেওয়া নেওয়ার পর কী মনে হলো, দু’লাইন কবিতা লিখে ফেললাম। ব্যস, শুরু হলো গণেশ পাইনের কবিতায় উত্তর। সে কথায় পরে আসছি।

সৌভাগ্যবশত পাশ করেই ফুলিয়া পলিটেকনিকে শিক্ষকতা। সেখানেই থাকতে হয়, কোনো কোনো শনিবার বাড়ি আসি। সোডা ফাউন্টেন বা বসন্ত কেবিনের আড্ডায় যাবার আর অবসর হয় না। পাঁচ বছর পর নিজের কলেজেই শিক্ষকতার সুযোগ পেলাম। অধ্যক্ষ হিসাবে চিন্তামণি কর, সুশীল সেন ও শেষে সত্যেন ঘোষাল –- সকলেই আমার মাস্টারমশাই। বিশেষ করে টিচার্স কাউন্সিলের সম্পাদক ও কলেজের গভর্নিং বডির টি. আর ছিলাম বলে প্রয়োজনে ডাক পড়ত।

ইন্ডিয়ান পেন্টিং বিভাগের প্রধান ইন্দুভূষণ রক্ষিত অবসর নিলেন। মাস্টারমশাই সত্যেন ঘোষাল আমায় ডেকে বললেন –-‘গণেশ তো তোমার খুব বন্ধু, ওকে বলো না, ঐ বিভাগে জয়েন করতে!’ গণেশকে সব কথা বললাম। শুনে বলল -–‘ভেবে দেখি’। নিজেরই কলেজ, তায় বিভাগও ভারতীয় শিল্প ঘরানা। বেশ কিছুদিন পর মাস্টারমশাই আবার জানতে চাইলেন, কী হলো! গণেশকে বলায় ওর উত্তর -–‘শোন্‌ আমি কি পারব মাস্টারী করতে! ও আমার ধাতে সইবে না। আর একটা কথা, ছাত্র-ছাত্রীদের ছবির কথা ভাবলে, আমার ছবির কথা ভাববো কখন? ও আমার দ্বারা হবে না!’

আবার গণেশের চিঠির কথায় আসি। ফুলিয়া থাকাকালীন যে-সব চিঠি -– সঙ্গে অন্যান্য সহপাঠী বিশেষ করে প্রাণের বন্ধু লালুপ্রসাদ, ঈশা মহম্মদ, সুরজিত দাশ, দেবীপ্রসাদ, শুক্লা, অঞ্জনা, মাস্টারমশাই ধীরেন ব্রক্ষ্ম, রথীন মিত্র ও আরও অনেকের চিঠি ছিল। অনেক পুরনো কথা, কাঠের আলমারীর মাথায় পিচবোর্ডের বাক্সে –- সব উইয়ের দখলে। ভাবলেই বুকটা টনটন করে।

গণেশের কবিতার কথা! কবিরাজ রো-এর প্রায়ান্ধকার ঘরের এদিক ওদিক থেকে মায়াবী আলো এসে ঘরটাতে একটা অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করত। তার ছবির সম্পদ। King of the dark chamber-এ ওকে সম্মানিত করল। তার সব ছবি অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। রামায়ণ মহাভারত থেকে ভিন্নধর্মী অনেক কাজ সে করেছিল –- কিন্তু তার পরিচিতি যে সব ছবি এঁকে, তা ওই অন্ধকার ভেদ করে বিভিন্ন স্তরের আলোর আনন্দানুভূতির প্রকাশ।

একটা কবিতার শেষ লাইন, যতদূর মনে পড়ে, ওর বাড়ির উলটো দিকের ছাদে শুকোতে দেওয়া শাড়ির কোণায় একটুকরো রোদ পড়েছে, গণেশ লিখেছে –-“একফালি পড়ন্ত রোদের আনন্দে শাড়িটার আঁচল একবার এপিঠ একবার ওপিঠ দেখাচ্ছে”।

লালু, আমি গণেশ –- আমরা সমবয়সী। গণেশ চলে যাওয়ায়, স্মৃতিভারে পড়ে আছি না বলে বলব, সুখস্মৃতি বয়ে চলেছি, যা আমার জীবনের সম্পদ –- পাথেয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন