মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

কবিতার কালিমাটি ১৫০


আত্মজা ও অদৃশ্য স্তবগান

বিমানবন্দরে প্রবেশ করার সাথে সাথে জেইনাসের ইঙ্গিতে কাচের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আমার আত্মজা, অব্যক্ত কথার আভায় কাঁপে তার নির্জন সত্তা।

আমার চিকিৎসা অর্ধসমাপ্ত। সেতুর মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা নিরর্থক। সিসিফীয় নৈরাশ্যের ভেতর আমি আমার শহরের আহ্বান শুনতে পাই।

চারদিকে মধ্যদিনের মুখরতা - আত্মজা অভুক্ত। ক্ষুধার সমস্ত প্রতিধ্বনি উপেক্ষা করে হয়তো সে হোটেলে ফিরে যাবে। হয়তো ফুটপাথে কিছুক্ষণ হাঁটবে, আঙুলের ইশারায় আহ্বান জানাবে কোনো সুদীপ্ত রথকে।

আমার দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। বেদনার কুয়াশা দ্রুত ক্যাটারাক্ট সৃষ্টি করে। আমি তাকাই, পৃথিবী অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে একা দাঁড়িয়ে আছে - এ বোধ আমার চেতনায় অসুখের প্রদাহ বৃদ্ধি করে।

গৃহ ব্যতীত কোথাও সুস্থতা নেই।

হেসতিয়া জেনেছিল গৃহের সুরক্ষিত অগ্ন্যাধার নিশ্চিত করে সুস্বাস্থ্য।

আমার স্ত্রী গৃহে থেকেও অসুস্থ। অসুখ কোনো পরিসীমা বা পরিখা মানে না।

চিকিৎসার জন্য আজ রাতে তিনি এসে পৌঁছবেন। একঘণ্টা পরে অ্যান্টিগোনির বিশ্বস্ততা নিয়ে আত্মজা তাকে স্বাগত জানাবে। তার কোমল কাঁধে যত্নের ভার - সে অনমিত।

তবু ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে থাকে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মিনোটরে রূপান্তরিত হয়ে ডাক্তার অন্দরকক্ষে অবস্থান করেন; দ্বাররক্ষীরা নির্দয়ভাবে বাতিল করে দেয় অ্যাপস সম্পাদিত সাক্ষাৎসূচি।

ছিঁড়ে যাচ্ছে শৃঙ্খলার সূত্র। জীবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এলোমেলো বাতাস। ঋষিবাক্য কিংবা আবহাওয়াবিদের পর্যবেক্ষণ পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে পারে না।

হোটেল সি-ফরম পূরণে পরাঙ্মুখ। সামান্য তথ্যের অভাবে চিকিৎসা ব্যাহত হতে পারে, একটি শহর সমস্ত দরজায় অর্গল লাগাতে পারে, আগে ভাবিনি।

আমি ফিরে যাচ্ছি। ক্রোনাসের পলকা বালুঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করে ভিসার মেয়াদ। ঝরে পড়েছে সময়ের সমস্ত কণা।

ব্যর্থতার উপাখ্যান ঔজ্জ্বল্য হারায় না। আমাদের আকাঙ্ক্ষা অবসিডিয়ানের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিবর্ণ হয়ে পড়ে।

ব্যর্থতার অন্তরালে রয়েছে ছায়া। অদক্ষতা, অজ্ঞতা ও ভীতির মন্সটেরা ক্রমাগত ছায়া ছড়ায়।

আর থাকে প্রাচীর নির্মাণকারী কিছু হাত; হাতগুলোর স্নায়ুর ভেতর স্বার্থচিন্তার বীভৎস উদ্দীপনা।

ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও সমাজের বন্ধন দৃষ্টিকে সবুজ রাখে। আমাদের দৃষ্টির সবুজ প্রতিনিয়ত হচ্ছে অপচিত।

ব্যর্থতার ভেতর আত্মজার সক্রিয়তা ও স্ত্রীর উপলব্ধি যে সুধীর বৃত্ত রচনা করে তা থেকে ঝরে পড়ে অদৃশ্য স্তবগান।

 

জগন্নাথ হল

জগন্নাথ হলের মাঠ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আগে মাঠের মধ্যস্থলে যখন হাঁটতাম ভবনগুলোর দিকে এগিয়ে যেত ঘাসের গন্ধস্রোত। গ্রামের শীতলতা হঠাৎ আমার স্নায়ুকে কলাপাতার কম্পনসুর শোনাতে থাকত।

মাঠের একপ্রান্তে রতনলাল চক্রবর্তী ছোট ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। তাদের চিৎকার অসমাপ্ত স্তোত্রের পরিপূর্ণতার জন্য অগ্নিভ হয়ে উঠত।

ইতিহাসের অধ্যাপক তিনি, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লব নিয়ে তার একটি বক্তৃতা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। ছেলেদের কাছে তিনি অনমিত্র - অতীতের কোনো বিপ্লবের বিশ্লেষণ তার উদ্দেশ্য নয়, সারল্য ও শান্তির বীজ ছড়ানোই তার সংকল্প।

বল যখন ঘাসের ভেতর গতিশীল হতো ভেজা মাটিতে জেগে উঠত আর্ত প্রতিধ্বনি। মুহূর্তে স্বাধীনতাকামী মানুষের অশ্রুত হাহাকার আকাশে পুনর্মুদ্রিত হতে থাকত।

ছায়ার আশ্চর্য ঐশ্বর্য নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত এক মণিপুরী ছাত্র। সে কখনো মাঠে হাঁটেনি; তার নীরবতা নৃত্যমঞ্চের দিকে এগিয়ে যেত।

তার পায়ে জেগে উঠত প্লবগতি। বাতাসে নিক্ষিপ্ত হতে থাকত তার মনিপুরী মুদ্রা - অনাগত কোনো আগুনের জন্য সেগুলো সঞ্চিত থাকত।

ঘাসের ভেতর সুরক্ষিত থাকত তার পদক্ষেপ-বীজ। আসন্ন কোনো উৎসবে, এ বীজ থেকে জেগে উঠবে আলোর অধীরতা।

বীজের শুশ্রূষার জন্য বাতাস বাজাত অটোহার্প। সান্ধ্যভাষা ও শিল্পের আগে জন্মেছে নৃত্য।

উত্তর বাড়ির দক্ষিণের জানালায় লেগে থাকত পুকুরের পূর্ণতা ও স্থৈর্যের প্রতিভাস। জলের সাথে সখ্যের জন্য দৌত্য নিষ্প্রয়োজন।

পুকুরের দিকে তাকালেই একটি জলজন্ম কবিতার ভেতর অসংখ্য চিত্রকল্প বেপমান হয়ে উঠত। কবিতার নীরব বর্ণমালার ভেতর জেগে থাকত একটি সুবর্ণপদ্মের আত্মকথা।

মাঝে মাঝে পুকুরে কেউ স্নান করত, কেউ সাঁতার কাটত। আর আকাশ এসে মিশে থাকত পুকুরের জলে।

জল থেকে উঠে এলে শরীরে লেগে থাকত আকাশের গন্ধ। নীলের বিপুলতার সাথে স্নাতকের অদৃশ্য অনুবন্ধ রচিত হতো।

কবি মহাদেব সাহাকে একদিন পুকুরঘাটে বসে থাকতে দেখেছি। তার হাতে কলম বা কাগজ দেখিনি। মনে হলো, তিনি জলের ভেতর থেকে তুলে এনেছেন আকাশের সুগুপ্ত সৌরভ।

জগন্নাথ হল আর শামসুন্নাহার হলের মাঝে ছিল সংকীর্ণ পথ। এ পথ কলাভবন ও জুঁই-প্রান্তরের দিকে আমাকে নিয়ে যেত।

এ পথে কাশীনাথ রায় উদ্দালক-জ্যোতি ছড়াতে ছড়াতে ইংরেজি বিভাগে হেঁটে যেতেন; তার পাজামা-পাঞ্জাবিতে লেগে থাকতো আলোক-স্পন্দন। মাঝে মাঝে বিকেলবেলায় এ পথে তিনি ছোট্ট অপ্রতিমকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতেন; গাছের কোমল পাতায় প্রতিফলিত হতো শিশুর হাসি।

দিনের ক্ষয়িষ্ণু আলোয় দুটি শরীরকে একটি ছায়ায় বিন্যস্ত করবার কৌশল দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবতাম কাশীনাথের বাৎসল্য টরভাল্ড হেলমারের চরিত্র বিশ্লেষণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।

এ পথের পশ্চিম প্রান্তে কোনো প্রাচীর ছিল না।পশ্চিমমুখী হলেই আমরা পৌঁছে যেতাম ফুলার রোডে—ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির নিঃশব্দ স্বপ্নের ভেতর উড়তে থাকতাম।

লাইব্রেরির লনে বসে আমরা কবিতা পড়তাম। সবুজ ঘাস কবিতার উচ্চারিত শব্দে সাড়া দিত। ঘাসের তীক্ষ্ণ পাতায় ভেসে উঠত শাণিত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।

এক সময় বাতাস আলোকিত হয়ে উঠত, পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্যে ফুটে উঠত উষ্ণ রং।

রং ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। জলরঙে চিত্রিত লন বৃষ্টিজলে স্পষ্ট থাকে না। তবুও সংকীর্ণ মাঠ, মনিপুরী নৃত্যের মহড়া, উদারচিত্ত শিক্ষক, পুকুরঘাটের কবি, কাশীনাথের প্রজ্ঞা ও অপত্যস্নেহ নির্জনতম আকাশে জাগিয়ে তোলে আলোর কম্পন।

 

 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন