ধারাবাহিক উপন্যাসিকা
অস্তাচল
(৪)
নাও প্যারাডক্স তোমার উত্তর নিয়ে এসেছি। ঘর, ঝুমুর, স্মিতা আর আহ্নিক, সবাই এক জায়গায়। স্মিতা আর আহ্নিক দু’জনেই দু’জনের ভিক্টিম আর একিউজড, তাহলে ঘর আর ঝুমুর? একজন বিচারক আর অন্যজন পাপ হারক। যখনই স্মিতা আর আহ্নিক এ ঘরে উলঙ্গ সত্য খুঁজতে বসেছিল, তখনই ঘর প্রশ্ন করে? তোমরা কী চাও? দুজনেই বলেছিল, মৃত্যু। কিন্তু কেউ সত্যি কথা বললে তাকে মৃত্যুদণ্ড সে দিতে পারে না। তাহলে মৃত্যুদণ্ডটা কার? ঝুমুরের, মৃত্যুদণ্ড এখানে ঝুমুরেরই হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
- ঝুমুর এখানে কি করে পড়ে আছে?
- জানি না।
- জানি না মানে?
- ঝুমুর, কেন এসেছিল?
- ঝুমুর বিকাশকে খুঁজতে এসেছিল।
- তাহলে আমাকে বলছিল কেন, আমি সব বুঝি?
- কী জিনিস বোঝার কথা বলে ছিল?
- জানি না।
- ঝুমুর, ঝুমুর!
কিছু কিছু উন্মোচন সময়ের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে দেখা গেল আহ্নিক ঝুমুরকে বুকে জড়িয়ে জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে ডাকছে। ঝুমুর, ঝুমুর চোখ খোল। কিন্তু সে তো অচৈতন্য। সে তার সব চিন্তা ভাবনা যেন তুলে দিয়েছে আহ্নিকের হাতে। আর আহ্নিক একবার তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে একবার স্মিতার মুখের দিকে। তারপর দেখা যাচ্ছে সে তাকে কোলে করে ছুটতে শুরু করেছে। দরজা, দরজার বাইরে পাঁচিল, পাঁচিলের বাইরে গলি, গলির বাইরে বড় রাস্তা। সেখান থেকে গাড়ি স্ট্যান্ড। সেখান থেকে পাশের হসপিটাল। কিন্তু ঝুমুরের ঘুম ভাঙেনি। ঝুমুরকে একটা কোণে পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখে যখন ডাক্তার বাইরে এসেছে, দেখেছে আহ্নিকের ক্লান্ত চোখের মাঝে থেকে জলের ধারা নেমে আসছে। যদিও গোটা জীবনে সম্ভবত দু’একবার মাত্র ঝুমুরের সাথে কথা বলেছে। ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে বলছে, মনে হয় মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল। দেখে মনে হচ্ছে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। তবে পোস্ট মর্টম করতে হবে।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। কোনও কিছুই বলার নেই। কে কাকে কী বলবে? ডাক্তার জিজ্ঞাসা করে,
- কে হয় আপনার?
- তেমন কেউ না। ওই বোন ধরা যেতে পারে।
- কী করে হল?
ততক্ষণে হসপিটালের ফাঁকা করিডোরে
স্মিতা এসে দাঁড়িয়েছে। যেন কিছুই জানে না। যেন কিছুই হয়নি। সে জানেই না কেন সে এখানে।
অন্য কোনও পেসেন্টকে দেখতে এসেছে। এদের দেখা হয়ে যাওয়া আকস্মিক ঘটনা। অবশ্য তার পাশে
দু’জন পার্টির মহিলা। দু’জন কর্মী যুবক। যেভাবে সেই বৃষ্টির রাত শেষে সে হঠাৎ ফিরে
এসেছিল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব ছিল তার মুখে। আহ্নিকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
- দাদা তুমি আমাদের ঘরে? তোমার ঘরে সবাই ভাল আছে তো?
আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল তার মা।
- এতটা নির্লিপ্ত মেয়ে? এ তো খুন করতে পারবে?
- খুন কি করেনি মনে করছ?
- এ মেয়ে কিন্তু অনেক দূর যাবে দেখে নিস।
- দেখা যাক।
এখন ফাঁকা করিডোর থেকে সে এগিয়ে
এসে জিজ্ঞাসা করছে কী হয়েছে?
- মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিতে পারতি। দু’চার থাপ্পড় লাগাতে পারতি। মারলি
কেন?
- মানে আমি মেরেছি কেউ দেখেছে?
- আমি দেখেছি।
- ডাক্তার তোমাকে দেখেছে তুমি তাকে এখানে নিয়ে এসেছ। আর কেউ দেখেনি
সে আমার ঘরে পড়েছিল।
- স্মিতা!
- আমি তোমার বউ নই, আমার উপর চেঁচাবে না।
জীবনের নাটকীয়তা এখানেই, সে সব কিছুকে এমন ভাবে দেখায় যেন মঞ্চে নাটক হচ্ছে। অথচ নাটক কোথাও কোথাও ভিতরে ভিতরে হয়ে যায়। যার রেস বাইরে থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।
এবার অবশ্যম্ভাবী সেই মঞ্চে পদার্পণ করবে বিকাশ। যদিও এখন তার পার্টি আলাদা তবুও তার একটা দায়িত্ব রয়েছে সমাজের প্রতি। তার মুখোমুখি স্মিতা আর আহ্নিক। আহ্নিক দেখছে ঝুমুরের প্রেগনেন্সির পিছনে বিকাশের হাত থাকার একশ ভাগ সম্ভাবনা থাকতে পারে। স্মিতা দেখছে বিকাশকে নয়, তাকে এবং পার্টিকে ধোঁকা দেওয়া একজন। আর বিকাশের চোখে প্রশ্ন, ঝুমুরের মার্ডার কে করল?
যে প্রশ্ন গোটা জীবন আহ্নিকের মা আহ্নিককে করে এসেছে। খুন করল কে? এবং কেন? আহ্নিক বলেছে, কে খুন হয়েছে? তার মা বলেছে, কেন আমি! আহ্নিক আর কোনও উত্তর করতে পারেনি। কেননা তার জানা আছে এখানে ভিক্টিম কে আর কেই বা অ্যাকিউজড। তাই তার কাছ থেকে এক নীরবতাই পেয়েছে তার মা। মা বলেছে কি রে বাবু তুই কথা বলতে পারিস না? বাবু তখন ঘর ছেড়ে চলে গেছে কোনও এক মাঠের কোণার দিকে। বেশির ভাগ সময়েই বাবু গিয়েছে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রাইমারী স্কুলের পিছনের দিকে। কেননা সেখানে সে ছোটবেলায় খেলতে যেত। ভাঙা পাঁচিলের পিছনে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে লুকোচুরি খেলত সে সময়ে। বাবু তাই মন খারাপ হলেই চলে গেছে সেই সব ঝোপ ঝাড়ের দিকে। ঝোপের ভিতর পাঁচিলের ভাঙা ইটের উপর বসে বসে প্রতীক্ষা করেছে। অবশ্য কীসের প্রতীক্ষা তা সে নিজেও জানে না। এখন তার মনে হচ্ছে হয়তো এই দিনটির প্রতীক্ষাই সে করে এসেছে।
ঝুমুর এবং ঝুমুরের মা কবে মারা যাবে। নিজের মায়ের জন্য অন্য কারোর মায়ের মৃত্যু কামনা, এ কেমন বাসনা? সে ঘুমের মধ্যে ভেবেছে অনেকবার। সাইকেল নিয়ে সেই ফাটা পাইপের পাশ দিয়ে ঘুরে এসেছে মাঝে মাঝে। ছোট্ট ডল পুতুলের মতো একটা মেয়ে, আর তার মা। দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলা, খাটো ব্লাউজ আর আটপৌরে শাড়ি পড়ে কাজ করছে। যার কাঁধ থেকে পিঠের আশি ভাগ উন্মুক্ত। যার সাথে মায়ের কোনও তুলনাই সে কোনও দিন করতে পারেনি। সে মেয়েকে স্নান করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, মেয়ের পিছে পিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মেয়ে তো নয় যেন প্রস্ফুটিত পদ্ম।
- আমাকে কেন আবার?
- বিকাশ কি তোকে ছেড়ে দিল?
- পলিটিক্সে কেউ কারোর বাবার সম্পত্তি নয়?
- কিন্তু ঝুমুর আজকে কেন এসেছিল তোদের ঘরে?
- হয়তো ভয় পেয়ে?
(পাঁচ)
পূর্ণিমা আর অমাবস্যার সাথে শরীরের বাতের ব্যথার এক যোগাযোগ আছে। সে তখনই দেখা দেয় যখন শরীর বেশি করে কিছু চায় তার কাছে। অনেকটা পড়তি জমিদার আর উঠতি ব্যবসায়ীর মতো। তাদের দেখা হয় কোনও এক নিলামের বাজারে। যে বাজার জমিদারের পূর্বপুরুষের নামে নামাঙ্কিত। জমিদার সেখানে বরাবর জিতে এসেছে। হারতে হয়নি কোনও দিন, তাই হার কাকে বলে জানাই হয়নি। এখন যখন মদে আর বেশ্যায় তার অবস্থা কিছু অস্তগামী। তখন বাজারে সেই নতুন ব্যবসায়ীর সাথে দেখা। সে নাম শুনেছে তবে দেখা হয়নি। আজ যখন নিলামে তারই ঠাকুরদার গদি, সে দেখতে পাচ্ছে, দ্বিগুণ দামে বোলি লাগিয়ে বসে আছে ব্যবসায়ী। তবে তার হার নিশ্চিত। অবশ্য এত টাকা পেলে ছেলের জন্য সামান্য কিছু রেখে যাওয়া যাবে। ছেলেও হয়েছে বাপের মতো। রাজ্য যাবে যাক, তার ভবঘুরেপনা যেন বজায় থাকে। যে বড়লোকের ছেলেকে এই নতুন ব্যবসায়ী সারা জীবন ঘৃণা করে এসেছে।
বিকাশ এগিয়ে এলো সামনে। সরাসরি তাকিয়ে জানাল,
- আমার ঘরে কী করতে গিয়েছিলে?
কী যে বলি, আমি তোমার না বিয়ে করা
বউয়ের সাথে একটু ইয়ে মানে, ওই আর কি, যে কাজ তুমি করে ছিল ঝুমুরের সাথে। তবে এখানে তফাৎ রয়েছে। আমি ম্যাচিউরিটির
আগেই উইদড্রল করে নিয়েছি। কিন্তু সে কি আর বলার ছিল। তাই ঘুরে তাকালাম তার দিকে। যেন
ঝুমুরের সাথে আমার গত জন্মের বাঁধন ছিল তাই এখানে বসে আছি। বিকাশ দেখছে আমি কোনও দ্বিধা
ছাড়াই তাকাচ্ছি তার দিকে।
তাহলে?
- এবং সেটা কী?
স্মিতা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছুটা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে দু’চার জন ছেলে। দু’জন স্মিতার সাথে ছিল, দু’জনকে বিকাশ নিয়ে এসেছে। আহ্নিক বুঝতে পারছে, এখানে অড ম্যান আউট খেলা খেলতে গেলে, তাকেই প্রথমে বেরিয়ে যেতে হবে। যদিও সে এখানে থাকতে চায়নি তবুও মনে হচ্ছে কিছু যেন ভেঙে যাচ্ছে তার বুকের ভিতর। সে কি ঝুমুরের মায়ের সাথে একবার দেখে করবে? দেখা করতে যাওয়ার আগে একবার শুধু একবার, জিজ্ঞাসা করার আছে স্মিতার কাছে। কেন?
হসপিটালের করিডোর, স্মিতা তাকিয়ে রয়েছে বাইরের দিকে। এখন আর সে ভিক্টিম নয়। এখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আহ্নিকের ফেলে আসা শৈশব। যখন সে মায়ের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে। বাবার প্রতি ঘৃণা তাকে নিয়ে যাচ্ছে বারবার সেই ফাটা পাইপের কাছে। অথচ বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা তার সাধ্যের বাইরে। যদিও সে আন্দাজ করেছে ঝুমুরের মা তার বাবাকে হয়তো ব্ল্যাকমেল করে। কেননা তার অনেক অনেক সম্পদ রয়েছে। যা তার নিজের মায়ের কাছে নেই। তার ইচ্ছে করে ঝুমুরের মাকে খুন করতে। অথচ তার মেয়েটি বড় সুন্দর। এমন একটা বোন যদি তার থাকত!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন