শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছবি : ৯ম পর্ব

(এবার আর বছর ধরে নয়; আলোচনা করব ছবির বিষয়বস্তু ধরে। সম্পর্কের ছবি।) 

 


সঞ্জু

২০১৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে সফলতম ছবি রাজকুমার হিরাণী পরিচালিত স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী যুগল সুনীল দত্ত-নার্গিসের (রূপায়নে পরেশ রাওয়াল-মনীষা কৈরালা) অভিনেতা-পুত্র সঞ্জয় দত্তের (রূপায়নে রণবীর কাপুর) জীবন নিয়ে ছবি সঞ্জু । সম্ভবত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার অপরাধেই এই ছবিটির ওপর প্রবলভাবে কুপিত হন দুটি গোষ্ঠীঃ প্রধানত যারা নিজেদের ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ আখ্যা দিয়ে চরম আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, সেই সাংবাদিককুল; এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটি স্বীকারোক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদী সমাজ। এক এক করে দুই গোষ্ঠীর ছবিটির ওপর আক্রমণ নিয়ে কথা হোক।

সাংবাদিকতাকে গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিহার্য মনে করা হয় মূলত তিনটি কাজের জন্যঃ

১। ক্ষমতাসীনদের নিজেদের ক্রিয়াকর্মের জন্য জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা।

২। জনসাধারণের কাছে সঠিক তথ্য পরিবেশন করে তাদের বিষয় ও ব্যক্তিসমূহের সম্বন্ধে ন্যায্য মতামত গঠনে সহায়তা করা।

৩। এইভাবে সঠিক জনমত গঠনে সাহায্য করা।

সঞ্জয় দত্তের ক্ষেত্রে ২ এবং ৩ – এই দুই ক্ষেত্রেই সাংবাদিককুল নির্লজ্জ দ্বিচারিতার পরিচয় দেয়। এই দ্বিচারিতার অস্ত্র একটি জিজ্ঞাসা চিহ্নঃ ‘সঞ্জয় দত্ত টেররিস্ট?’; ‘সঞ্জয় দত্তের বাড়ির বাইরে আর-ডী-এক্স ঠাসা লরি?’ যাতে সঞ্জয় বা তার বাবা আদালতে গেলে সংবাদপত্রের মালিক অম্লানবদনে বলতে পারে, “কই, আমরা তো কোন মিথ্যা বলিনি! আমরা শুধু প্রশ্ন রেখেছি, সন্দেহ ব্যক্ত করেছি মাত্র!” এমনকি, আদালত যখন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে, “সঞ্জয় দত্ত, আদালত মনে করে না তুমি আতঙ্কবাদী,” সে খবর পরদিন কোন খবরের কাগজ ছাপে না। বরং ফলাও করে প্রচার করে, “টাডা (TADA) ধারায় সঞ্জয় দত্তের ছ’’বছর কারাবাসের নির্দেশ,” বেআইনিভাবে বাড়িতে এ-কে ৪৭ বন্দুক রাখার জন্য। এই অস্ত্রটি সঞ্জয় নির্বোধের মতো জোগাড় করেছিল যখন ফোনে তাকে শাসানি দেওয়া হয় যে ১৯৯২-এর দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের, যাদের অনেকেই মুসলমান, তার বাবা সাহায্য করেছেন, অতএব তাঁর মুসলমান-প্রীতির শাস্তিরূপে তাঁকে হত্যা করা হবে! এরপর সুনীল দত্তের ওপর দুবার হামলা হয়, এবং বাবার জন্য পুলিশী রক্ষার আবেদন করেও সঞ্জয় বিফল হয়।

‘সঞ্জয় দত্তের বাড়ির বাইরে আর-ডী-এক্স ঠাসা লরি?’ আদতে এটি ছিল ১৯৯২-এ দাঙ্গায় আক্রান্তদের জন্য  ত্রাণসামগ্রী ঠাসা সুনীল দত্তের লরি, যে খবর ছাপার ফলে সঞ্জয়ের প্রাণের বন্ধু কমলেশ (অভিনয়ে ভিকি  কৌশল) অবধি সঞ্জয়কে আতঙ্কবাদী ঠাওরে বসে! প্রথম জীবনে সঞ্জয় গুরুতরভাবে মাদকাসক্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেবন করা যে কোন মাদককে টেক্কা দিতে পারে রোজ সকালে আমাদের সদর দরজার তলা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসা মানসিক মাদক – দৈনিক সংবাদপত্র!

সঠিক তথ্য পরিবেশন এবং যথার্থ জনমত গঠনের চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের অনেক বেশী পছন্দ ‘রসালো’ খবর তৈরি করে জনমন বিনোদন এবং মাঝে মঝেই জনমানসে ‘পবিত্র ক্রোধ’ উদ্রেক করা। আর নারীবাদীরা ‘সঞ্জয়ের বহুগামিতার আস্ফালন’ বলে যে দৃশ্য নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করেছে, তাতে মহিলা সাংবাদিকের (অভিনয়ে অনুষ্কা শর্মা) প্রশ্নের – “তুমি ক’জন মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছ? বৌয়ের (মান্যতা দত্ত, অভিনয়ে দিয়া মির্জা) দিকে নয়, আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি বলো!” উত্তরে সঞ্জয় প্রথমে জানতে চায়, সংখ্যাটি থেকে দেহোপজীবনীদের সে বাদ দেবে কিনা! তারপর একটু ভেবে বলে, “হিসেবে  ৩০৮ আসছে, সে যাক গে, ধরুন ৩৫০!” কোন আস্ফালন নয়, স্পষ্ট প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর।

এক মর্মস্পর্শী ছবি, যাতে চিত্রিত হয়েছে বাবা-ছেলে (সুনীল ও সঞ্জয় দত্ত) এবং দুই বন্ধুর (সঞ্জয় এবং কমলেশ) পারস্পরিক ভালবাসার অনবদ্য কাহিনি। অতএব ছবিটি নারীবাদী শিবির থেকে ‘পুরুষকেন্দ্রিকতা-দোষে দুষ্ট’!

 


বাধাই হো

আরেকটি হৃদয়গ্রাহী ছবি বাণিজ্যের হিসেবে এই বছরের নবম সফলতম অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মা পরিচালিত বাধাই হো । মধ্যবয়স্ক রেলকর্মী জীতেন্দ্র কৌশিক (অভিনয়ে গজরাজ রাও) এবং তাঁর গৃহবধু স্ত্রী প্রিয়ম্বদা  (অভিনয়ে নীনা গুপ্তা) দুই পুত্রসন্তান নকুল (অভিনয়ে আয়ুষ্মান খুরানা) আর গুল্লার (শার্দূল রানা) এবং জীতেন্দ্রের বৃদ্ধা মা দুর্গা (সুরেখা সিকরী) কে নিয়ে সংসার করেন। এক বর্ষার রাতে, রাতের আহারের সময় শাশুড়ির হাতে স্ত্রীকে যথারীতি হেনস্থা হতে দেখার পর নিজেদের শোবার ঘরে নিজের সদ্য-প্রকাশিত  কবিতা পড়ে শোনাতে-শোনাতে ‘জিতু’ এবং ‘বাবলি’ ঘনিষ্ঠ হয়। ১৯ হপ্তা পরে বাবলি-প্রিয়ম্বদা জানতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা। ফলে ছেলেদের এবং শাশুড়ির কাছ থেকে স্বামী-স্ত্রীর জোটে তিরস্কার আর আত্মীয়  মহলে কদর্য ব্যঙ্গ। এমনকি নকুল বাবা-মার এই ‘কীর্তি’-র ফলে নিজের বান্ধবী রেনের (সানিয়া মালহোত্রা) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে ব্যর্থ হয়। রেনে কিন্তু নকুলের এই মনোভাব সমর্থন করে না। ইস্কুলে এক সহপাঠী বাবা-মাকে ব্যঙ্গ করলে গুল্লার তার প্রতিবাদ করে প্রহৃত হয়। ইতিমধ্যে রেনের মা সঙ্গীতাও (শীবা চাড্ডা) নকুলের পরিবার সম্বন্ধে বক্রোক্তি করলে নকুল তার সমুচিত জবাব দেয়। এক জ্ঞাতির বিবাহ-অনুষ্ঠানে বাবলির বড় জা এবং তার বোন বাবলিকে কুৎসিত ভাবে অপমান করলে অপ্রত্যাশিতভাবে কর্তব্যপরায়ণা পুত্রবধূর পক্ষালম্বন করে সবাইকে ঝেড়ে কাপড় পরান শাশুড়ি দুর্গা!

বাড়ি ফিরে নকুল ভাই গুল্লারের সঙ্গে তার ইস্কুলে যায়, যেখানে গুল্লার যে তার গায়ে হাত তুলেছিল তাকে তিনটি চপেটাঘাত করে। নকুল ঠিক যেমন ভাবে বান্ধবীর মাকে জবাব দিয়েছিল, সেইভাবে নিজের ব্যঙ্গকারী বন্ধুদেরও চুপ করিয়ে দেয়।

মধুরেণ সমাপয়েত হয় বাবলির কথায় নকুল রেনের সঙ্গে সম্পর্কের জোড়া লাগাতে এবং, সর্বোপরি বাবলি যখন এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়।

সবদিক দিয়ে প্রশংসনীয় ছবি, প্রত্যেকের অভিনয় নিখুঁত, বিশেষ করে অন্যান্য ছবিতে মূলত পার্শ্বচরিত্রে থাকা গজরাজ রাওয়ের। আয়ুষ্মান খুরানা প্রায়শই ব্যতিক্রমী এবং বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, যদিও সাধারণত তাঁর অভিনীত চরিত্রের মতবাদ ও আচরণের পক্ষেই নির্মাতারা দর্শককে থাকতে বলেন। এখানে প্রথম দিকে তাঁর নকুল কিন্তু সমর্থনযোগ্য নয়, যে কথা বান্ধবী রেনেও বলছে। পরে সে নিজেকে শোধরায়।

 


সোনু কে টিটু কী সুইটি

কিছু ছবি মূলত তাদের শীর্ষবিন্দুর গুণে মনে স্থান করে নেয়। ২০১৮-তে সফলতার হিসেবে ঊনবিংশতম (১০০ কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করা) এবং লাভ রঞ্জন পরিচালিত এই ছবিটি এক উদাহরণ। সোনু (কার্ত্তিক আরিয়ান) আর টিটু (সানি সিং) বাল্যকাল থেকে প্রাণের বন্ধু। টিটু স্বভাবে একটি প্রকৃষ্ট simp যে একের পর এক বিষাক্ত মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নির্যাতিত হয়। প্রত্যেকবার তাকে সেই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে আনে সোনু। ছবির শুরুতেই টিটু ‘পিহু’-নাম্নী এক রমণীর (ঈশিতা রাজ) কাছে ঝাঁটা খেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে বসেছে। নিজের দোকানের চাবি অবধি টিটু পিহুকে দিয়ে রেখেছে, কিন্তু পিহুর ফোনে যে ‘টিন্ডার’ অ্যাকাউন্ট আছে, টিটু তা দেখে ফেলার অপরাধের জন্য পিহু টিটুর মাথা হাতে কাটছে। সোনু এবার চরম প্রস্তাব দেয় টিটুকেঃ “বেছে নে – হয় আমি নয় পিহু।” নিজের ভালো আপাতত বুঝতে পেরে টিটু পিহুকে জবাব দেয়।

এরপর টিটু নিজে এবং তার পরিবার ইচ্ছাপ্রকাশ করে তাকে পাত্রীস্থ করতে। ক্ষেপে গিয়ে সোনু টিটুকে বলে, “কাপড় ধোবার জন্য মেশিন আছে, রান্নার মাসী আছে, বাকি শুধু একটি জিনিস!” টিটু হাঁউমাঁউ করে বলে যে সে ‘সেক্স’-এর জন্য বিয়ে চাইছে না! তবে বিয়ে করা কেন, প্রশ্ন করে সোনু। টিটু বলে সে চায় কেউ তার পাশে থাকুক, তার যত্ন করুক। সোনু অতীতের ঘটনা ধরে ধরে প্রমাণ করে যে বারবার এই কাজ টিটুর জন্য করেছে!

যাইহোক, ‘সুইটি’ নামে এক আপাত-নিখুঁত মেয়ের (নুসরত ভারুচা) সঙ্গে টিটুর সম্বন্ধ পাকা হয়। সন্দিগ্ধ সোনুকে আশীর্বাদের দিন সুইটি একান্তে জানায়, “তুমি ঠিক ধরেছ! আমি নায়িকা নই, খলনায়িকা! টিটুর জীবন থেকে তোমাকে দূর করবই!”

শুরু হয় সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। সুইটি নারীসুলভ চাল খেলে টিটুকে প্রাক-বিবাহ যৌন সম্পর্কে টানে, এবং তজ্জনিত টিটুর অপরাধবোধ উদারত্বের ভড়ং করে ‘ক্ষমা’ করে। সোনু পিহুকে উপস্থিত করে টিটু-সুইটির সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে চায়, কিন্তু সুইটি টিটুর সামনে পিহুকে স্বপক্ষে টেনে এনে তা ব্যর্থ করে। এরপর সুইটি সোনুকে বলে, “বন্ধু আর মেয়ের প্রতিযোগিতা হলে ‘হামেশা’ মেয়েরই জিৎ হয়!”

মালাবদলের মুহূর্তে সোনু সেই পিহুর সময়ে যা বলেছিল, তাইই টিটুকে বলেঃ “আমাদের মধ্যে কে ঠিক, কে ভুল ভুলে যা। এখন একজনকে বেছে নেঃ ওকে নয় আমাকে!” সোনুর চোখে জল দর্শক এই প্রথম দেখে, আর সে বিয়ের মণ্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ স্থানুর মতো চুপ থেকে টিটু সুইটিকে বলে, “১৩ বছর বয়সে সোনু নিজের মা’কে হারায়। তারপর তিনদিন আমি তাকে কাছছাড়া করিনি, কারণ সে কাঁদছিল না। অবশেষে যখন তার চোখ থেকে জল পড়ে, আমি তাকে জড়িয়ে ধরে দরজা বন্ধ করে দিই, যাতে আর কেউ না এসে পড়ে। সেদিনের পর আজ অবধি সোনুর চোখে আমি জল দেখিনি।” সুইটির পরানো মালা গলা থেকে খুলে ফেলে টিটু বন্ধুর অনুসরণ করে।

বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরক সোনুর সঙ্গে তুলনা টেনেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচিত মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের চরিত্র সুবর্ণের। সুধার ছলনায় সনাতন যখন সাময়িকভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে সুবর্ণকে ত্যাগ করার উপক্রম করে, তখন সুবর্ণের যন্ত্রণার সঙ্গে সোনুর চোখের জল কি এক নয়?

ছবির শেষে আমরা দেখি সোনু, টিটু, টিটুর ধনবান ঠাকুরদা ঘসিটারাম (অলোকনাথ) আর তাঁর অনুগত লালুকাকা (বীরেন্দ্র সাক্সেনা) হাঁটু অবধি কাপড় তুলে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে সোনুর সম্ভাব্য বিয়ের কথা নিয়ে হাসাহাসি করছে।

ত্রিকোণ প্রেমের ছবি, যার কেন্দ্রে সোনু আর টিটু, আর তাদের মধ্যে এসে পড়ছে কোন নারী – পিহু বা সুইটি। তাদের কাছ থেকে ভালোবাসার জনকে ছাড়িয়ে আনছে সোনু।

বিষমতা প্রবল শক্তিসম্পন্ন হতে পারে, কিন্তু ‘হামেশা’ তার জিৎ হয় না। এর পরের পর্বে এলজিবিটি বিষয়ক ছবিসমূহ নিয়ে আলোচনার পূর্বসূরি এই সনু কে টিটু কী সুইটি

 


ছিছোরে

শিরোনামের অন্যতম অর্থ হতে পারে ‘ছেঁদো’। ২০১৯-এর এই অসাধারণ ছবির কাহিনি আবর্তিত হচ্ছে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘরে। বিবাহবিচ্ছিন্ন মধ্যবয়স্ক অনি (অনিরুদ্ধ পাঠক, অভিনয়ে অকালপ্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুত) থাকে তার কিশোর ছেলে রাঘবকে (অভিনয়ে মহম্মদ সামাদ) নিয়ে। রাঘব দিনরাত এক করে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য পড়েছে, তার অনুক্ষণের চিন্তা, তাকে সফল হতেই হবে, নইলে কপালে জুটবে loser বা ‘ছেঁদো’ অভিধা, যা সে কিছুতেই মেনে নিতে রাজী নয়। বন্ধুর বহুতলের ফ্ল্যাটে সে যখন জানতে পারে যে সে তার অক্লান্ত পরিশ্রম সত্বেও অকৃতকার্য হয়েছে, সে বহুতলের বারান্দা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার শুরুতে তার বিবাহবিচ্ছিন্না মা মায়া (শ্রদ্ধা কাপুর) দায় পুরোপুরি ঠেলে দেয় নিজের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ স্বামীর দিকে। অনিকে ছেলের অভিভাকত্বের অধিকার দেওয়াই নাকি মায়ার ভুল হয়েছিল! (প্রশ্ন জাগে কেন মায়া ছেলের দায়িত্ব নেয়নি, যেখানে নাবালিকা তো বটেই, নাবলক হলেও আদালত অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর অভিভাবকত্ব মাকেই দিয়ে থাকে?) হতভাগ্য বাবাকে ডাক্তার (শিশির শর্মা) জানান যে অনেকে এইরকম মারাত্মক জখমের পরও বেঁচে ফেরে শুধু তাদের অন্তরে বেঁচে থাকার যে প্রবল ইচ্ছে, তার তাগিদে। কিন্তু রাঘব বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলেছে।

অনি তখন আপাত-সংজ্ঞাহীন ছেলের কানের কাছে অনির নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার কাহিনি বলা শুরু করে – যেখানে অনি এবং তার পাঁচ সহপাঠীকে সারা কলেজে loser আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, এবং কীভাবে সেই ছ’জন এই অপবাদ কাটিয়ে উঠেছিল। মায়া এই প্রচেষ্টার প্রতি অবজ্ঞা ও বৈরিতা ব্যক্ত করে।

আশ্চর্যভাবে ডাক্তার দেখেন যে রাঘবের জ্ঞান ফিরেছে এবং সে বাবা ও তার বন্ধুদের উত্তরণের আখ্যান শুনতে চাইছে!

বাবার ডাকে সুদূর বিদেশ থেকে হাসপাতালে এসে হাজির হয় এক বন্ধু গুরমিত (ডাকনাম ‘সেক্সা’, অভিনয়ে বরুণ শর্মা)), এবং তারপর বাকী চারজনও। সবাই রাঘবের বিছানার চারদিকে বসে তাকে বলে নিজেদের কলেজজীবনে কীভাবে তারা পরাজিতের তকমা সফলভাবে বর্জন করতে পেরেছিল।

মজার কথা যে তারা, কলেজের চার নম্বর হস্টেলের ‘হেরোর’ দল, প্রবল প্রতাপান্বিত তিন নম্বর হস্টেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে ‘জি সি’ বা ‘জেনারেল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ প্রথম হওয়ার জন্য। ছলে-বলে-কৌশলে চার নম্বর এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছোয় যেখানে তিনটি খেলায় তাদের সোনা জিতলেই তারা ‘চ্যাম্পিয়ন’ আখ্যা পাবে। দাবা আর দৌড়ে তারা জিতলেও বাস্কেটবলে স্বয়ং অনি শেষ মুহূর্তে বলকে নেটে ফেলতে ব্যর্থ হয়। বিমূঢ় রাঘব ছ’জনকে প্রশ্ন করে, “এত চেষ্টার পরেও হেরে গেলেন? আপনাদের মরে যেতে ইচ্ছে হয়নি?” অনি, এবং তার পরে বাকী পাঁচজন হেসে উত্তর দেয়, “একেবারেই নয়।” কৃতিত্ব আছে সাফল্যে নয়, সাফল্যলাভের চেষ্টায়, যে চেষ্টায় রাঘবের বিন্দুমাত্র ত্রুটি ছিল না! এবার রাঘব মস্তিষ্কে শেষ অস্ত্রোপচারের সম্মুখীন হোক loser নয়, fighter-এর মতো। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে রাঘব অপারেশন থিয়েটারে ঢোকে, বেঁচে ফেরে, আর পরের বছর কলেজে ভর্তি হয়। ইতিমধ্যে সন্তানের দায়িত্ব-এড়ানো মায়া স্বামীর ‘চিকিৎসা’-র কার্যকারিতা দেখে অশ্রুসজল নেত্রে অনিকে ‘অসাধারণ পিতা’-র স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

আরেকটি মজার কথা। তিন নম্বর হস্টেলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার পর এক সময় অনি সকলকে বলে যে তাদের প্রত্যেককে, সাফল্যলাভের জন্য কৃচ্ছসাধন হিসেবে, কিছুদিনের জন্য নিজেদের যা অপরিহার্য মনে হয়, এমন কোন এক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনি নিজে প্রেমিকা মায়ার সঙ্গে প্রেমালাপ তো দূরের কথা, কথা বলাই বন্ধ রাখবে। নবীন (অ্যাসিড, অভিনয়ে নবীন পোলিশেঠী) কথায় কথায় অশ্রাব্য গালিগালাজ দেবে না; সুন্দর (মম্যি, অভিনয়ে তুষার পাণ্ডে), যে রোজ মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা না বলে থাকতে পারে না, সে মার সঙ্গে ফোনাফোনি করবে না; ডেরেক (তাহির রাজ ভাসিন) সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবে; সাহিল (বেওড়া, অভিনয়ে সহর্ষ কুমার শুক্লা) মদ্যপান থেকে বিরত থাকবে; আর গুরমিত (সেক্সা) পর্নোগ্রাফিক পত্রিকার ছবি দেখে হস্তমৈথুন করা থেকে নিজেকে সংযত করবে। অর্থাৎ সমতুল্যতার নিরিখে গালাগালি দেওয়া, মদ্যপ হওয়া, ধূমপান করা এবং হস্তমৈথুন করা হলো মা বা প্রেমিকার সঙ্গে বাক্যালাপের সমান!

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন