সাজানো বাগান: নাটক থেকে চলচ্চিত্র
ভূমিকা
“পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে / স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে /
ড্রইংরুমে
রাখা বোকাবাস্কতে বন্দি / ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে /
যোগাযোগ
আজ হাতের মুঠোতে / ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি।’’১
শুধু শিক্ষাক্ষেত্র নয়, আজকের আধুনিক বিশ্ব মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত। মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ব আজ সর্বসাধারণের বাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত বিশ্বের যে-কোনো জায়গায় ঘটে যাওয়া খবর ও চিত্র আজ আমাদের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রাচীনকালে গণজাগরণকারী মাধ্যম হিসেবে কীর্তন, কবিগান, মঙ্গলগান, ছড়া, লোকগাথা, কথকতা, পুতুলনাচ ইত্যাদির প্রচলন ছিল। ক্রমে বিজ্ঞানের উন্নতিতে সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মাধ্যমের প্রচলন হয়, যার মাধ্যমে যে-কোনো বিষয় সম্বন্ধে গণজাগরণ সম্ভবপর হয়েছে।
লোকশিক্ষা
ও লোক-মনরঞ্জনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অপরসীম। কাহিনিচিত্র,
নিউজরিল, ডকুমেন্টারি চিত্র প্রভৃতি থেকে মানুষের জ্ঞান ও চেতনার প্রসার ঘটে। অবসর
যাপনে, চরিত্র গঠনে, নীতিশিক্ষার প্রসারে, সাংস্কৃতিক বোধের প্রসারে চলচ্চিত্র আধুনিক
জীবনের অন্যতম গণমাধ্যম। সংগীতের বিমূর্ত শিল্পগুণ বা উপন্যাসের বিশ্লেষণ
ক্ষমতা, নাটক কিংবা নৃত্যের ত্রিমাত্রিক রূপারূপ চলচ্চিত্রে উপস্থিত থাকে না। তা সত্ত্বে চলচ্চিত্র হল সংগীতের সুর-তাল-ছন্দ-লয়,
চিত্রকলার দৃশ্যতা, আলোকচিত্রের বাস্তবতা, স্থাপত্যের ভাস্কর্য, উপন্যাসের অনুপুঙ্খ
বর্ণনা, নাটকের অভিনয়, নৃত্যের গতির এক সূক্ষ জটিল নান্দনিক সমীকরণ।২
আলোচ্য
ক্ষেত্রে ‘গণমাধ্যমের নানা দিক ও বাংলা সাহিত্যকেন্দ্রিক গবেষণাপত্র প্রস্তুতি’র জন্য ‘সাজানো বাগান’ (মনোজ মিত্র) নাটক এবং তার চলচ্চিত্রায়িত
রূপ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’(তপন সিংহ পরিচালিত) নির্বাচন করা হল। উক্ত বিষয় অবলম্বনে উভয়
মাধ্যমের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ
করা হল। আলোচনার সুবিধার্থে সমগ্র বিষয়টিকে কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা
হল।
প্রথম
অধ্যায়ে, সাহিত্যে-নাটক-চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয়
অধ্যায়ে, চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও বাংলায় তার প্রবর্তন এবং তার ক্রমানুসারী বিবর্তন সম্বন্ধে
আলোচনা করা হয়েছে।
তৃতীয়
অধ্যায়ে, বাংলা চলচ্চিত্রজগতে পরিচালক তপন সিংহের অবদান সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
চতুর্থ
অধ্যায়ে, বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘সাজানো বাগান’ নাটক এবং ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার অবস্থান ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
পঞ্চম
অধ্যায়ে, ‘সাজানো বাগান’ এবং ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর মধ্যে একটি তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ
করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
১। মহীনের ঘোড়াগুলি, ‘আবার
বছর কুড়ি পরে’, কলকাতা, ১৯৯৫
১। ধীমান দাশগুপ্ত, ‘সিনেমার ভাষা’, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলির্শাস, ১৪১০,
পৃ ৪৫
প্রথম অধ্যায়ঃ সাহিত্য-নাটক–চলচ্চিত্র
সাহিত্য মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত; কাব্যসাহিত্য ও গদ্যসাহিত্য। গদ্যসাহিত্যে প্রধানত বলতে গল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো কল্পনাত্মক রচনা সহ অন্যান্য বিবরণাত্মক রচনাকে বোঝায়। কাব্যসাহিত্য বলতে কবিতাকে বোঝায়। ‘‘পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আদিম মানবীর যে দেহচ্ছায়া পড়েছিল রুক্ষ পাথরে সেই ছায়া বরাবর আদি মানব কাঠকয়লার দাগ টেনে দিতে পৃথিবীর প্রথম ছবিটি আঁকা হয়। তার সন্তানের মা হওয়ার জন্য স্ত্রী টিকটিকিকে পুরুষ টিকটিককে যে ডাক দেয় শব্দ আবিষ্কারের বহু আগে বন্য মানুষের ঠোঁটে উচ্চারিত অনুরূপ অস্ফুট ধ্বনিই ছিল মানুষের আদি সংগীত। আদিম প্রমিকার মনোরঞ্জন, উত্তেজনা ও উদ্দীপনার জন্য চালিত প্রেমিকের অঙ্গসঞ্চালনই হল যেমন আমাদের প্রথম নৃত্য।’’১ এমন কোনো সময়ে বা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে চলচ্চিত্রের জন্ম না হলেও সে এই সকল মাধ্যমের সমন্বয়ে নিজেকে মূর্ত করে তোলে। বলা চলে, উপন্যাস যেমন অষ্টাদশ শতকের শিল্পরূপ চলচ্চিত্র তেমন বিংশ শতাব্দীর শিল্পমাধ্যম।
চলচ্চিত্রে
মূলত একটি কল্পনাত্মক সৃষ্টি। যা বিষয়বস্তুর তারতম্য অনুসারে বাস্তবানুসারী বা মননপ্রধান
হয়ে ওঠে। তাই সাহিত্যের সঙ্গে এই শিল্পকলার সংযোগ, বিনিময় ও মিথষ্ক্রিয়া অত্যাধিক।
গল্পে বর্ণিত কাহিনির একমুখীনতা সিনেমার পক্ষে সহায়ক হওয়ায়; গল্পের কাছ থেকে চলচ্চিত্র
নানাধরনের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য, নতুন ধরনের ও কল্পনাসমৃদ্ধ ঘটনা বা সিচ্যুয়েশন, সংলাপরীতি
ও সমৃদ্ধ সংলাপ এবং কাঠামো ও বিকাশ বিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক ধারণা গ্রহণ
করে নেয়। অন্যদিকে ‘‘কবিতার কাছ থেকে সিনেমা গ্রহণ করে প্রতিমা নির্মাণ বিষয়ে ধারণা,
চেতনা ও অন্তদৃষ্টি, পরিমিতির সঙ্গে অমোঘতার মিলনপদ্ধতি এবং কাব্যময়তাকে।’’২
ফলে সাহিত্য চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হবার সময় সাহিত্যের ভাব ও ভাষাগত ইমেজ চলচ্চিত্রে দৃশ্য ও শব্দগত ইমেজে পরিণত
হয়। সিনেমায় সাহিত্যের ভাষা ত্রয়ী ভূমিকা পালন করে, যথা—সামান্যতার মাধ্যমে অর্থের
ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা, ঘটনা ও চরিত্রের প্রকৃতি, অনুভূতি ও বিকাশ সৃষ্টি করা এবং বিমূর্তকে
মূর্ত হিসেবে প্রতিভাত করা।৩ উৎকৃষ্ট সিনেমা গল্পত্ব ও চিত্ররস থেকে প্রথমে
আবেগময়তার দিকে ও পরে অনুভূতিমূলকতার দিকে অগ্রসর হয়।
সাহিত্যের
ও চলচ্চিত্রের ভাবগত বিবর্তনের সঙ্গে নাটক ও চলচ্চিত্রের সাদৃশ্য থাকলেও রূপগত বিবর্তনের
ধারায় বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। সেদিক থেকে “ভাব ও রূপ দুয়ে মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যায়,
চলচ্চিত্র গতি ও চিত্রকলার জ্যামিতিক উপাদানগুলির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য ও নাটকের অন্যান্য
ও বিভিন্ন উপাদানের ওপর ভর দিয়ে বিমূর্ত থেকে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।’’৪ নাটকের কাছ থেকে চলচ্চিত্র প্রধানতম উপাদান হিসেবে
গ্রহণ করে অভিনয়, কিন্তু নাটকের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সার্বিক সম্পর্ক ও চলচ্চিত্রের ওপর
নাটকের রূপগত ও শিল্পগত প্রভাব আরও অনেক ব্যাপক ও গভীরতর।
‘‘সিনেমার পক্ষে যেমন লাভজনক গল্পের একমুখীনতা ও উপন্যাসের বহুমুখীনতা তেমনি লাভজনক
ও ফলপ্রদ নাটকের সংঘাতময়তা।’’৫ নাটক ও সিনেমা উভয় মাধ্যমেই প্রত্যক্ষতা,
সক্রিয়তা, নাটকীয়তা, তাৎক্ষণিকতা এবং আবেগগত অভিঘাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু
উভয়রেই প্রধান লক্ষ্য ঘটমানতা তাই সাদৃশ্য ও সৌহার্দ্যের অনেক লক্ষণই ধরা পড়ে। সিনেমার
ঘটমানতা নাটকের চেয়েও উন্নত মানের হয়। কারণ নাটকের ক্ষেত্রে ইমেজের চেয়েও সংলাপ অধিক
গুরুত্বপূর্ণ; তাই ফিল্ম ইমেজের বৈচিত্র্য, প্রসার ও অবিরাম ধারাবাহিকতা সেই ক্ষেত্রে
অসম্ভব। ফলে সিনেমা একাধারে দর্শনধারী বা নাটকীয়তার সীমানায় আবদ্ধ না থেকে লোকমনরঞ্জনকারী
গণমাধ্যম হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র
১। ধীমান দাশগুপ্ত, ‘সিনেমার ভাষা’, ১ম সং, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলির্শাস,
১৪১০, পৃ ৪৫
২। তদেব, পৃ ৪৬
৩। তদেব, পৃ ৪৭
৪। তদেব, পৃ ৫২
৫। তদেব, পৃ ৫৩
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও বাংলায় তার প্রচলন
সিনেমা বা চলচ্চিত্রের জন্ম পাশ্চাত্যে। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস ও জিন লুমিয়ের নামক ফরাসী ব্যক্তিদ্বয় চলচ্চিত্রের আবিষ্কর্তা। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে প্রায় কুড়িটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র প্রর্দশিত হয়। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে বিশ্ববাসী উপহার পায় “দ্য অ্যারাইভাল অব্ এ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন”(নির্বাক চলচ্চিত্র)।১ ফ্রান্সে প্রথম সিনেমা প্রর্দশনীর মাসছয়েক পর লুমিয়ের প্রতিনিধি মরিস সেসটিয়ারের পৌরহিত্যে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই ওয়াটসন হোটেলে প্রর্দশিত সিনেমার মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে নির্বাক চলচ্চিত্রের সূচনা হয়।২
চলচ্চিত্রের
এই জন্মলগ্নে বাঙালিরাও পিছিয়ে থাকেনি। ১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন এবং তাঁর ভাই মতিলাল
সেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরি করেন। ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথম মুভি ক্যামেরা আসে।
যার দ্বারা ‘দিল্লি দরবার’ এবং ‘বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলন’ বিষয়ক দুটি তথ্যচিত্র
নির্মিত হয় হীরালাল সেনের পরিচালনায়।৩ বাংলা সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার
জে এফ ম্যাডানের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রগতি শুরু হয়। ১৯৩১ সালের ১১ এপ্রিল
ম্যাডানের প্রযোজনায় প্রথম বাংলা সিনেমা ‘জামাইষষ্ঠী’(সবাক) মুক্তি পায়।৪
তৎকালীন সময়ে চলচ্চিত্র ছিল বিনোদনের ও মনোরঞ্জনের উপকরণ। তাই রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল
বাংলার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার পরিবর্তে এইসময়ে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস-নাটক
প্রভৃতির চলচ্চিত্রায়নের প্রবণতা দেখা গেল পরিচালকদের মধ্যে। কিন্তু
চারের দশক থেকে বাংলা সিনেমায় নিমাই ঘোষ, বিমল রায় প্রমুখের প্রচেষ্টায় জীবনের বাস্তব
এবং নানা সামাজিক ঘটনা ছবির প্রতিফলন ধুরা পড়ল। অর্থাৎ পৌরাণিক, রোমাণ্টিক এবং মেলোড্রামাটিক
পারিবারিকতার বৃত্ত ভেঙে হাঁটতে শুরু করলো বাংলা সিনেমা। পাঁচের দশকে সতজিৎ রায়, ঋত্বিক
ঘটকের হাতে বাংলা সিনেমার নবজন্ম ঘটলো; সিনেমা
হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক। সুব্রত মিত্র–বংশীচন্দ্র গুপ্তের মতো প্রতিভাবান ক্যামেরাম্যান
এবং দক্ষ শিল্পনির্দশকের সম্মিলিত প্রয়াস এই বাঁক বদলকে সার্থক করে তুললো। পরবর্তীকালে
তপন সিন্হা, নির্মল দে, সরোজ দে, অজয় কর, অসিত সেন, বিভূতি লাহা, দীনেন গুপ্ত, রাজেন
তরফদার, তরুণ মজুমদার প্রমুখ পরিচালকদের মাধ্যমে বাংলা সিনেমার নবোয়ন্ন ঘটে। সাহিত্যনির্ভর
বৈচিত্র্যপূর্ণ চিত্রনাট্যের গুণে শিল্পসম্মত একাধিক ছবি তৈরি হলো, যা বাংলা সিনেমার
দর্শককে হলমুখী করেছিল। সাতের দশকের শেষে বা আটের দশকের শুরুতে বাংলা সিনেমায় এক সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হলেও নবেন্দু
চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন প্রমুখের মুন্সীয়ানায় সেই শূন্যতার অবসান
হয়।
তথ্যসূত্র
১। পূর্ণেন্দু পত্রী, ‘সিনেমা সংক্রান্ত’, ২য় সং, দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬,
পৃ ৫৯
২। তদেব পৃ ৬০
৩। তদেব পৃ ৬২
৪। তদেব পৃ ৬৩
তৃতীয় অধ্যায়ঃ পরিচালক তপন সিংহ ও বাংলা চলচ্চিত্র
১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর বীরভূম জেলার মুরারি থানার জাজিগ্রামের প্রসিদ্ধ সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পরিচালক তপন সিংহ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতোকত্তর পাশ করে, তিনি ১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সহকারী শব্দগ্রহণকারী হিসাবে যোগ দেন।১ নবতরঙ্গের চলচ্চিত্রকার হিসেবে তপন সিংহ পরিচিত না হওয়ায় একের পর এক শিল্পসম্মত বাণিজ্য-সফল সিনেমা তৈরি করে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করা সত্ত্বেও; এদেশের চলচ্চিত্র-বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা চক্রে তাঁর নাম অনুচ্চারিত হয় অথবা ক্কচিৎ উচ্চারিত হয়। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে স্বমহিমায় প্রতিভাত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা বাংলা সিনেমায় যে ভিন্নমাত্রার শিল্পগুণ, রুচি ও দক্ষ পরিচালনার প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁদের সমসাময়িক তপন সিংহ সেই ধারাকেই দর্শক মনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আরও ব্যাপকতা দিয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অঙ্কুশ’ সিনেমাটির
মাধ্যমে আলোর পথযাত্রী হিসেবে তপন সিংহের যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ
পঞ্চাশ বছর ব্যাপী বিচিত্র বর্ণের বিচিত্র রসের একের পর এক সুষমামণ্ডিত কাহিনি চিত্র
উপহার দিয়েছেন দর্শকমন্ডলীকে। নির্বিচারে তাঁর প্রতিটি ছবি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সন্ধান পাওয়া সম্ভবপর নয়। মৌলিক
সৃজনের পাশাপাশি তিনি বাংলা সাহিত্যের বেশ
কিছু গল্প-উপন্যাস-নাটক নিয়ে একের পর এক জনপ্রিয়
বাণিজ্য সফল সিনেমা বানিয়েছিলেন—‘ক্ষুধিত পাষাণ’(১৯৬০), ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’(১৯৬২),
‘জতুগৃহ’(১৯৬৪), ‘হাটে বাজারে’(১৯৬৮), ‘আপনজন’(১৯৬৯), ‘সাগিনা মাহাতো’(১৯৭৩), ‘হারমোনিয়াম’(১৯৭৫),
‘বাঞ্ছারামের বাগান’(১৯৮০)। ‘অঙ্কুশ’ থেকে ‘গল্প হলেও সত্যি’(১৩.১০.১৯৬৬) পর্যন্ত তপন
সিংহের কোনো সিনেমায় রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানি
গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কিংবা সমাজপতিদের ষড়যন্ত্র বা রক্তচক্ষু দেখা না গেলেও; ‘হাটে বাজারে’
থেকে শ্রী সিংহ পরিচালিত সিনেমায় রূপান্তরীভবন হিসেবে মানুষের লোভ-লালসা-চক্রান্ত দেখা
গেল। এই ছবি থেকে অদ্যাবধি নির্মিত
কয়েকটি ছবি বাদ দিলে প্রায় প্রতিটিতে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কারণে সামাজিক অবক্ষয়কে
দেখান তপন সিংহ।
বিভিন্ন
বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে শ্রী সিংহের সমস্ত সিনেমা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের
সাপেক্ষে ব্যক্তি মানুষের নানান দিকগুলোকে জনমানসে উন্মোচিত করে তোলে। সত্যজিৎ রায় যেমন বাঙালি
চরিত্রের খাবার-দাবার বেশভূষা, আলস্য রীতিনীতি, আদব-কায়দা, কবিতা ও গানের প্রতি অনুরাগকে
এক অনন্য সমগ্রতা মাধ্যমে সিনেমায় তুলে ধরেছিলেন, ঠিক তেমনিই তপন সিংহ বাঙালি সমাজজীবনের
খুঁটিনাটি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও চাওয়া-পাওয়াকে তাঁর চলচ্চিত্রের উপাদান করে তুলেছিলেন।৪
বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি রূপে তিনি দাদাসাহেব
ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৫ জানুয়ারি ২০০৯ সালে জনপ্রিয় চিত্রপরিচালক
তপন সিংহ পরলোকগমন করেন।
তথ্যসূত্র
১। সুগত ঘোষ, ‘তপন সিংহের চলচ্চিত্রে বিষয় বৈচিত্র্য’, ‘প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র
এবং’ (জানুয়ারী ২০১৮) : ১৮০
২। তদেব, পৃ ১৮১
৩। তদেব, পৃ ১৮২
৪। তদেব, পৃ ১৮৩
বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘সাজানো বাগান’
উনিশ
শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুসৃত যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার প্রতিফলন ধরা পড়েছিল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক নানা ধারার কর্মকান্ডের
মধ্যে। উনিশ শতকের পূর্ববর্তী যাবতীয় সাহিত্য-সৃষ্টি পদ্য ভাষা মাধ্যমে রচিত হলেও;
এই শতাব্দীর সূচনা পর্ব থেকে বাংলা গদ্যের বা নাটকের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্য
সাহিত্য সংরূপের অনুসরণে বাংলা সাহিত্যে ধীরে ধীরে জন্মলাভ করে বিভিন্ন প্রকার সাহিত্য সংরূপ; নাট্যসাহিত্য
তার মধ্যে অন্যতম। সময়ের পালাবদলের
সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য ড্রামার অনুসরণে বাংলা সাহিত্যে নাটকের সূচনা হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর
মধ্য পর্বে তারাচরণ শিকদারের কলমে(ভদ্রার্জুন,১৮২৬খ্রিস্টাব্দে)। ধীরে ধীরে রামনারায়ণ
তর্করত্ন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মোসারফ
হোসেন প্রমুখের কলমে পরিপুষ্টতা লাভ করে বাংলা সাহিত্যের এই সংরূপটি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন স্বনাম-ধন্য
নাট্যকারের কলমে জন্মলাভ করেছে নানা কালজয়ী নাটক; সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা নাট্যসাহিত্যের
জগৎ।
ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে যুগগত পরিবর্তনের ফলে যেমনভাবে পরিবর্তিত
হয়েছে মানুষের জীবনশৈলী, ঠিক তেমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে বাংলা নাট্যসাহিত্যের পটভূমিও। তৎকালীন বাংলা নাট্যসাহিত্যের পরিসরে জনজীবনের
পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সামজিক পরিবর্তনের শোষণচিত্র। প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার মনোজ মিত্র প্রণীত অন্যতম
একটি শ্রেষ্ঠ সামাজিক নাটক ‘সাজানো বাগান’। নাটকটির মূল কেন্দ্র আবর্তিত হয় বৃদ্ধ অশীতপর
চাষি বাঞ্ছারাম ও তার প্রাণপ্রিয় বাগানকে ভর
করে। পঁচাত্তরটি বসন্ত কেটে গেলেও সে নিজের বাগান আগলে রেখেছে স্বার্থান্বেষী জমিদার
নকড়ি-ছকড়ি দত্তের শ্যেনদৃষ্টি থেকে। বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত বাঞ্ছার সম্পত্তি করতলগত করার জন্যে বাক্চাতুরীর মাধ্যমে তার সঙ্গে
মাসোহারার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হলেও; অশীতপর এই বৃদ্ধের প্রাণবায়ু যেন ভগবান প্রদত্ত। তার
সর্বাঙ্গ বার্ধক্য রোগে জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও
তার হৃদপিণ্ড অবিরাম ছন্দে স্পন্দিত হয়ে চলে। ঘটনাক্রমে দেখা যায় বারংবার মৃত্যুর সম্মুখীন
হওয়া সত্ত্বেও বাঞ্ছা তার ‘সাজানো বাগান’ রক্ষার্থে সমর্থ হয়।
‘সাজানো
বাগান’ নাটকে নাট্যকার বিশ্বপ্রকৃতির পটে মুখোমুখি দুটি শ্রেণীর ভূমিকে কেন্দ্র করে
যে সংঘাত, সেক্ষেত্রে কৃষিজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বৃদ্ধ চাষি বাঞ্ছারাম তথাকথিত
শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জমি-শোষকদের তথা
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত শ্রেণির নিম্নবর্গীয় শ্রেণির সম্বল কেড়ে নেওয়ার প্রবণতাকে সে উদাত্ত
ভাবে জানিয়েছে। চিরকাল নিপীড়িত নিম্নবর্গীয় শ্রেণিকে মনোজ মিত্র বাঞ্ছার মৃত্যুহীনতার
মাধ্যমে বিজয়ী করেছেন। একটি শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক তত্ত্বকতা দুটি পরিবারের বিরোধের
মধ্য দিয়ে কালজয়ী নাটকে রূপান্তরিত হয়; যার মধ্যে নিহিত থেকে যায় ‘সাজানো বাগানে’র
তাৎপর্য।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’
১৯৮৯ সালের জুলাই বা অগাস্ট মাসে বাংলা আকাদেমিতে অভিনীত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি দেখে অভিভূত হন পরিচালক তপন সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী দেবী। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি রূপে তিনি ‘সাজানো বাগানে’র চলচ্চিত্রায়ণে (বাঞ্ছারামের বাগান) অগ্রসর হন। ১৯৮৯ সালের দুর্গাপুজোর সময় প্রযোজক ধীরেশ চক্রবর্তী আশি হাজার টাকা মূল্যে মনোজ মিত্রের থেকে ‘সাজানো বাগানে’র চিত্রস্বত্ত্ব ক্রয় করেন।
যেহেতু নাটক ও সিনেমার প্রধান লক্ষ্য ঘটমানতা তাই সাদৃশ্য
ও সৌহার্দ্যের লক্ষণ হিসেবে উভয়ের সন্ধিস্থলে
বিষয়বস্তুর প্রত্যক্ষতা, চরিত্রের সক্রিয়তা, সংলাপের নাটকীয়তা, তাৎক্ষণিকতা এবং আবেগগত
অভিঘাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সিনেমার ঘটমানতা নাটকের চেয়েও উন্নত মানের
হওয়ার দরুন ‘সাজানো বাগানে’র তুলনায় ‘বাঞ্চারামের বাগানে’ সংলাপ ইমেজের থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণতা লাভ করে। সমগ্র নাটকের
বিষয়বস্তুকে অভিন্ন রেখেও পরিচালক তপন সিংহ সিনেমায় তাঁর স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর প্রোথিত
করেন কাহিনির কাল্পনিক বিস্তারের মাধ্যমে। আসলে বিষয়গত ভাবে সাদৃশ্যযুক্ত যে-কোনো শিল্প মাধ্যমগত
কারণে আলাদা হয়ে যায়। আর তাই নাটকের বৃদ্ধ বাঞ্ছার জরাকবলিত অবস্থার পরিবর্তে যৌবনোত্তর
বাঞ্ছার কর্মক্ষম অবস্থা থেকে কাহিনির সূচনা করেন পরিচালক। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে
বিমল মূখোপাধ্যায়ের ভূমিকাও অসামান্য। শ্রী সিংহের কাহিনি অনুসারে, দরিদ্র চাষী বাঞ্ছারাম
কাপালীর পিতা গ্রামীণ জমিদার পাঁচকড়ি দত্তের থেকে পুরস্কার স্বরূপ একটি অনুর্বর জমি
লাভ করে। বংশানুক্রমে সেই জমি বাঞ্ছার হস্তগত হলে, সে ওই অনুর্বর জমিকে ‘সাজানো বাগান’-এ
পরিণত করে। গ্রামের বর্তমান জমিদার ছকড়ি দত্ত বাঞ্ছার বাগান দখলের জন্য বাহুবল প্রয়োগ
করলেও ঘটনাক্রমে সাহেব শাসকের মধ্যস্থতায় বাঞ্ছা তার বাগান রক্ষায় সক্ষম হয়। এই ঘটনার
প্রতিঘাতে হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান জমিদারবাবু। মৃত্যুর
পর তার অতৃপ্ত আত্মা বাঞ্ছার বাগানের অধিবাসী হয়। অপর দিকে বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত বাঞ্ছার জরাকবলিত
দশার সুযোগ নিয়ে বাগ্মীতার মাধ্যমে বাগান অধিগ্রহণের ফন্দি আঁটে। পরিকল্পনামাফিক
মোক্তারের সহায়তায় জমিদার মাসোহারার ভিত্তিতে প্রজা বাঞ্ছার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু
অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধ চাষি তার প্রতিটি বিদায়ঘন্টাকেই বিদায় জানিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ
হয়ে ওঠে। ‘সাজানো বাগান’-এ কাগজকলমে বাগানের মালিক বাঞ্ছা সিনেমায় প্রকৃতপক্ষে যথার্থ বাগান পেল, যা একাধারে ইন্দ্রিয়গাহ্য ও অনুভূতিগ্রাহ্য।
নাটকে যেমন আছে মায়া আর কল্পনায় বাস্তবকে গড়ার প্রবল প্রচেষ্টা ঠিক তেমনিই সিনেমায়
আছে বাস্তবকে অনুপুঙ্খভাবে ধারণ করার অসীম স্পর্ধা। যার মধ্যে নিহিত থেকে যায় ‘বাঞ্ছারামের
বাগান’ সিনেমার তাৎপর্য। মঞ্চ ও চলচ্চিত্র এই দুই ভিন্ন মাধ্যমের স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ
শক্তির টানে পরিপূর্ণ হয় উঠছে বাংলা সাহিত্য।
‘সাজানো বাগান’ থেকে ‘বাঞ্ছারামের বাগান: তুল্যমূল্য আলোচনা
প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার মনোজ মিত্র রচিত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি ১৯৭৭ সালের ৭ নভেম্বর সুন্দরম্ নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় ‘মুক্ত অঙ্গনে’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের খসড়ার নামকরণ করেছিলেন ‘তিন পুরুষ’, মনোজ মিত্র তাঁর ‘সাজানো বাগান’ শীর্ষক নাটকেও তিন পুরুষেরই গল্প বলেছেন। মঞ্চে যার পরিচিতি ‘সাজানো বাগান’ নামে, চলচ্চিত্রে তা ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ হিসেবে পরিচিত। তপন সিংহ পরিচালিত, ধীরেশ চক্রব্রর্তী প্রযোজিত এই সিনেমাটি ১৯৮০ সালে মুক্তি পায়। উভয় ক্ষেত্রেই মূল চরিত্র পঁচানব্বই বছরের থুথুড়ে চাষী বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম কাপালি তথা মনোজ মিত্র অভিনয় করেন।
চিত্রনাট্যের সংযোজন-বিয়োজন
সাজানো বাগান নাটকের সূচনা হয় অথর্ব বৃদ্ধ বাঞ্ছারামের রোগগ্রস্ত পর্যায় দিয়ে। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার সূচনা হয় কর্মক্ষম বাঞ্ছারামকে নিয়ে। নাটকের সূচনায় দেখা যায় গ্রামীণ জমিদার ছকড়ি দও পরলোকগত হয়ে প্রেতাত্মা স্বরূপ বাগানবাসী। কিন্তু সিনেমায় জমিদারের জীবিতাবস্থা থেকে তার ভূতত্বপ্রাপ্তি সমগ্র ঘটনাই দেখানো হয়েছে। সমগ্র নাটকের কাহিনির সঙ্গে সাদৃশ্যতা রেখে পরিচালক তপন সিংহ তার সিনেমার চিত্রনাট্যে বেশকিছু সংযোজন ও পরিবর্ধন করেছেন।
‘সাজানো
বাগানে’ দেখা যায় বার্ধক্যভারাক্রান্ত বাঞ্ছা তখন রোগজ্বালায় জর্জরিত হয়ে ঘরের দাওয়ায় শয্যাসীন। পরলোকগত গ্রামের জমিদার ছকড়ি দত্তের প্রেতাত্মা
বাগান করতলগত করার জন্য মৃত্যুর পর সেখানে আশ্রয় নেয়। গ্রামের বর্তমান জমিদার ছকড়ির
পুত্র নকড়ি দত্তেরও নজর পড়ে বাঞ্ছার বাগানের দিকে। অপরদিকে বাঞ্ছার নাতি গুপি চায় বাগান
হস্তগত করে ভাটিখানার ব্যবসা করতে। নিজ উদ্দেশ্য সাধনে জমিদারবাবু বাঞ্ছার সঙ্গে মাসিক
দুশো টাকার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী বাঞ্ছার জীবিতাবস্থায় বাগানের
রক্ষণাবেক্ষনের দায়ভার নকড়ির এবং তার মৃত্যুর পর বাগান জমিদারের হস্তগত হবে। কিন্তু
দেখা যায় যে, আশি উক্তীর্ণ বৃদ্ধের শারীরিক অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার হৃদ্যন্ত্র সতেজ এবং সচল। ফলত
জমিদারের আশায় ছাই দিয়ে গঙ্গাপ্রাপ্তির পরিবর্তে ‘বাঁচবো...আমি বাচবো’ এই ধারাবাহিক
জীবনতৃষ্ণা বাঞ্ছা জীবিত রাখে।
‘বাঞ্ছারামের
বাগান’ সিনেমার সূচনা হয় বাঞ্ছারামের যৌবনোত্তর দশা থেকে। এখানে সে নাতি গুপিকে নিয়ে বাগান পরিচর্যায় নিমগ্ন। অপর
দিকে গ্রামীণ জমিদার গ্রাম পরিভ্রমণকালে বাঞ্ছার বাগানে উপস্থিত হয়ে, বাগান দখলের ইচ্ছাপ্রকাশ
করে। কিন্তু এক সাহেব শাসকের তৎপড়তায় বাঞ্ছা
তার বাগান ফিরে পায়। অপমানে জমিদার ছকড়ি দত্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাঞ্ছার বাগান
করতলগত করার প্রবল তৃষ্ণার দরুন জমিদারের অতৃপ্ত আত্মা আজ বাঞ্ছার বাগানের অধিবাসী। বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত
সুকৌশলে বাঞ্ছাকে চুক্তিবদ্ধ করলেও তার উদ্দেশ্য সফল হয় না। ‘পুইমাঁচা’ গল্পের পুঁই
গাছের মতন ধীরে ধীরে বাঞ্ছা নবযৌবন লাভ করে। ছকড়ি ও নকড়ি—পিতা-পুত্রের দ্বৈতভূমিকা
সিনেমায় দেখা যায়। ছকড়ি আবার দুই রূপে উপস্থিত--জীবিত জমিদার ছকড়ি এবং প্রেতাত্মা ছকড়ি।
বর্তমান জমিদারও দুই রূপে বিদ্যমান—যুবক এবং প্রৌঢ়। তাই
বলা যায় মূল নাটকের কাহিনি সিনেমায় অক্ষুণ্ণ থাকলেও বিষয়ের উপস্থাপনায় পরিচালকের স্বাক্ষর
লক্ষ্য করা যায়।
চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন
দুটি দৃশ্যে বিভক্ত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটির ঘটনাক্রম মূল চরিত্রের জীবনের নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে শুরু হয়ে তার জীবনসংগ্রামের বৃত্তে এসে সমাপ্ত হওয়ায়; নাটকে চরিত্র সংখ্যাও সীমাবদ্ধ। যদিও এক্ষেত্রে সময়সীমার পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কিন্তু ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমায় নাটকের কাহিনি অক্ষুণ্ণভাবে পরিবেশিত হলেও সময়সীমার ব্যাপ্তি এবং মাধ্যমের রূপান্তরভবনের জন্য চিত্রনাট্যের সংযোজন ও পরিবর্ধন লক্ষ্য করা যায়। নাটকের চরিত্রলিপি প্রেতাত্মা ছকড়ি দত্ত, নকড়ি দও, বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম কাপালি, গুপি, মোক্তার, গোবিন্দ ডাক্তার, হোঁৎকা-কোৎকা, চোর, গণৎকার, পুরোহিত, জনৈক গোবিন্দ, শববাহক যুবকেরা, পদ্ম, নকড়ি-গিন্নি প্রমুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সিনেমায় পরিবর্ধিত কাহিনির পরিপূরক হিসেবে বেশ কিছু নতুন চরিত্রের সমাবেশ ঘটছে। গুপির স্ত্রী পদ্ম এখানে চুমকি নামে পরিচিত। সিনেমায় চুমকির পিতা সহ গুপির পিতার বর্তমান পরিবারের ঘটনাক্রম উপস্থাপিত হওয়ায় সেই সকল চরিত্রেরও পাশাপাশি বাইজী, জমিদার-নায়েব ইত্যাদি চরিত্র সংযোজিত হয়েছে।
সংলাপের সংযোজন ও বিয়োজন
মূল নাটকের সঙ্গে সিনেমার চরিত্রসংখ্যার পার্থক্যের জন্য, ‘বাঞ্ছারামের বাগানে’ চরিত্রমাফিক সংলাপের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বাঞ্ছার শারীরিক পর্যবেক্ষণকালে (ডাক্তার গোবিন্দ ও নকড়ি দত্তের কথপোকথন অংশে) মূল নাটকের থেকে সিনেমায় ব্যবহৃত সংলাপ ভিন্নভাবে পরিবেশিত হয়;
“ডাক্তার।।
(বাঞ্ছার নাড়ী পরিক্ষাকালে) ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ
নকড়ি
দত্ত।। কবে হবে বিলীন!
ডাক্তার।।
নাই বেশি দিন।...’’
এছাড়া
নাটকে চরিত্রদের কথপোকথনে বেশ কিছু স্ল্যাঙের উল্লেখ ঘটলেও সিনেমার চিত্রনাট্যে সম্ভবত
নান্দনিকতার কারণে পরিচালক এর ব্যবহার করেননি।
উপসংহার
বিষয়গত ভাবে সাদৃশ্যগত দুটি শিল্পমাধ্যম তাদের পদ্ধতি ও মাধ্যমের কারণে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাই ‘সাজানো বাগান’ ও ‘বাঞ্ছারামের বাগানে’র মূলগত পার্থক্য থেকেই যায়। যার ভিত্তিতে মূল নাটক অপেক্ষা সিনেমাটি জনমানসে সর্বগ্রাহ্য হলেও, ‘সাজানো বাগানে’র গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন নাটকের মাধ্যমে লোকশিক্ষা হয়। মনোজ মিত্রের লেখনীতে মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত-কৃষক-শ্রমিক প্রতিটি চরিত্রই মূর্ত হয়ে ওঠে। তাই কোনোরকম রাজনৈতিক আনুগত্য ছাড়াই শ্রেণিসংগ্রাম-চরিত রচনায় বহমান তাঁর কলম। ‘সাজানো বাগান’এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ধনী-গরীব চিরায়িত শ্রেণি সংগ্রাম থেকে শুরু করে সামতান্ত্রিক ধারার প্রভাবও ও চোখে পড়ে। থিয়েটারে বাঞ্ছারাম কাগজে কলমে একটি বাগানের মালিক হলেও তার পায়ের নীচে মাটির পরিবর্তে মঞ্চের কাঠের পাটাতন ছিল। সিনেমায় সে একটি যথার্থ বাগান পেল,যা কেবলমাত্র অনুভূতিগ্রাহ্য বা শ্রুতিগ্রাহ্য নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। গাছপালা, পাখি, আকাশ, সূর্য, তারা----এই সব কিছুই নাটকে মঞ্চের নেপথ্যে অভিনেতা ও দর্শকের কল্পনায় উপস্থিত না থাকলেও শিল্পীর শিল্পত্বে তা বাস্তবিক জগতে সামিল হয়। তাই সমগ্র আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার পরিবর্তে অধিক সমাদৃত। প্রখ্যাত সমালোচক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন, “... দেশকালের সীমান্ত উত্তীর্ণ এই নাটক যে কোন স্বাজাত্য অভিমানীকে গর্বিত করে তুলবে...লোভ, বেঁচে থাকার ইচ্ছে, স্বার্থ ভালোবাসা—সব নিয়ে রামায়ণ-মহাভারত-টলস্টয়ের স্টাইলে এমন লুডো খেলা আর দেখিনি।’’ ( দ্র. অমৃতবাজার পত্রিকা, এপ্রিল ৭ ’৭৮)।
গ্রন্থপঞ্জিঃ বাংলাগ্রন্থ
১। মনোজ মিত্র। ‘সাজানো
বাগান’। ৩য় সং।
কলকাতা, কলাভৃৎ, ২০১৫।
২। মনোজ মিত্র। ‘বাঞ্ছারাম : থিয়েটারে সিনেমায়’। কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ, ২০০০।
৩। আশুতোষ ভট্টাচার্য্য। ‘বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস’। ২য় সং। ২য় খণ্ড। কলকাতা, এ মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং, ১৯৬০।
৪। পূর্ণেন্দু পত্রী। ‘সিনেমা সংক্রান্ত’। ২য় সং। কলকাতা, দে’জ, ২০১৬।
৫। ধীমান দাশগুপ্ত। ‘সিনেমার ভাষা’। ১ম সং। কলকাতা, দে’জ, ১৯৯১।
৬। কুন্তল চট্টোপাধ্যায়। ‘সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। ৫ম
পরিমার্জিত ও ২য় পরিবর্ধিত সং। কলকাতা, রত্নাবলী, ২০১৫।
সহায়ক ওয়েবসাইট
১।
http://en.m.wikipedia.org/wiki/Monoj_Mitra.
২। http://indiancine.ma/UNQ/info
৩।
http://en.m.wikipedia.org/wiki/Tapan_Sinha
সহায়ক সংবাদপত্র
১।‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩, রবিবাসরীয় সং, পৃ ২।
২। ‘আনন্দবাজার
পত্রিকা’, ১১ অক্টোবর, ২০১৫, রবিবাসরীয় সং, পৃ ৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন