শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সুকান্ত দেবনাথ

 

ধারাবাহিক উপন্যাসিকা

অস্তাচল

 


(৩)

এখন যদি ধরে নেওয়া হয় যে পৃথিবীর সব ঘটনারই একটা অতীত এবং ভবিষ্যৎ থাকে। কোনও কিছুই বিনা কারণে হয় না। তখন স্মিতার ঘরে ফেলে আসা তার কাজের ফাইল, স্মিতার ভয়, সেই ঘরটার প্রশ্ন আর ঝুমুরের এখানে আসার কারণ কেমন যেন এক সুতোয় গেঁথে যায়। আহ্নিক ঝুমুরকে নিয়ে ফের দরজায় আঘাত করে।

দরজা খুলে যায়। যেন কোনও আকাঙ্ক্ষিত নারী তাকে ভিতরে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অথচ ভিতরে স্মিতা নেই। সে দরজা খোলা রেখেই কোথায় চলে গিয়েছে। আহ্নিক ডাকে স্মিতা, ঝুমুর ডাকে দিদি আর সেই ঘর প্রতিধ্বনি করে। স্মিতার কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। সে কি ভিতরের দিকে আছে। রান্নাঘর পেরিয়ে একটা দরজা পিছনের দিকে দেখা যাচ্ছে। কী রয়েছে সেই দরজার পিছনে? যারা দরজায় তারা দুজনেই নতুন। কেউই কিছু জানে না। তাও দুজনের মধ্যে আহ্নিক দ্বিতীয়বার এসেছে এবং তার আসার একটা কারণ রয়েছে। তাই সে ঝুমুরকে রেখে কিছুটা এগিয়ে যায়। ঝুমুর দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, ঘরের সবকটি দেয়াল বিভিন্ন সব নেতা মন্ত্রীর ছবির সাথে স্মিতা আর বিকাশদার ছবি দিয়ে ঢাকা। ঝুমুর দাঁড়িয়ে থাকে সেই সব ছবির দিকে তাকিয়ে যেন কত চেনা তার। অথচ সেই চেনা মানুষ তাকে ফিরে চিনতে পারছে না।

আহ্নিকও ফিরে এসে জানায়, স্মিতা ঘরে নেই। তাহলে স্মিতা গেল কোথায়? সে কি এরই মধ্যে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে! গেল তবে ঘর খোলা রেখে গেল কেন? নাকি কাছে কিনারেই কোথায় রয়েছে। তারা দুজনেই আবার ডাক দেয়। সাথে সাথে ফাঁকা ঘর যেন আবার প্রতিধ্বনি করে ওঠে, সে ঘরে নেই।

ঝুমুর আহ্নিকের দিকে তাকিয়ে বলে, দিদি কি এমনই নাকি, না বলে চলে যায়?

আহ্নিক বলে, গোটা জীবন এমনই।

এমনই এক বৃষ্টির রাত ছিল কোথাও, তার মধ্যে আবার কারেন্ট নেই। সামান্য ঝড় হয়ে ছিল দুপুরে, হয়তো কোথাও ট্রান্সফরমার জ্বলে গেছে। তাই অন্ধকার এত। আর এই অন্ধকারেই আহ্নিকদের দরজায় একজন লোক। তাকে ডাকছে। তার মা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কে?

-আহ্নিক আছে ঘরে?

-আছে, কিন্তু আপনি কে?

-আমার মেয়ে ওর সাথে পড়ে, একটু ডাকুন না ওকে!

আহ্নিকের মা চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের মুখের দিকে। যেন আন্দাজ করার চেষ্টা করছে, ছেলে কি ফের বাপের ধারাই পেল? আহ্নিক এগিয়ে আসে দরজায়। লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করে,

-তুমি কি স্মিতাকে আজ কলেজে দেখেছ?

আহ্নিক জানে সে মেয়ে আজ কোথায় কার সাথে রয়েছে। কিন্তু সে কথা বলে কি করে?

-না আসলে আমি আজকে কলেজ থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে গেছিলাম।

-বাবু যা জানিস বল। তার মা বলে।

-স্মিতা এখনও ঘরে ফেরেনি, তুমি যা জান বল।

স্মিতা ঘরে ফেরেনি? আঘাত লাগে তার। সত্যি বড় আঘাত লাগে। সে তো কিছুই চায়নি কারোর কাছে, শুধু কথা বলা। সামান্য কথা বলা। দেখা হলে একবার সৌজন্য বিনিময়। রিকগনাইজ করা, একজন অন্যজনকে চিনতে পেরেছে। অথচ যখন এই চিনতে পারাও একটা প্রহসন হয়ে দাঁড়ায় তখনই বড় আঘাত লাগে। কেন? এই তো সামান্য মেয়ে। তার আবার এত কিসের দেমাগ? সে কি শালা নিয়ে পালাবে? তার মা আবার বলে, বাবু কী জানিস বল।

যদিও তার বলার মতো তেমন কিছুই নেই তাও সে বলে, আমাকে কিছু বলার মতো সে মেয়ে নয় মা। তাও উনি যখন এসেছেন তখন একবার দেখি। লোকটাকে আহ্নিকের কেন জানি না মনে হয়, ভীরু অথচ লোভী। মেয়ের চিন্তা যতটা, তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা নিজের। মেয়ে যদি খালি হাতে ফিরে আসে তবে? তার না ফেরাটা বিফলে যাবে। আহ্নিক চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, চোখের ভাষা কেমন। লোকটি আশ্চর্যজনক ভাবে বলে,

-ভেবো না আমি নিজের জন্য এসেছি, আমি এসেছি মেয়ের ভালোর জন্যই।

-সে তো বটেই, আমরা সবাই আমাদের সন্তানের ভালই চাই। আপনি ঘরে আসুন। আহ্নিকের মা বলে।

আহ্নিক বাইরে বেরিয়ে যায়। অন্ধকার রাস্তা আর তার সাইকেল চলেছে এক অজানা যুদ্ধের আহ্বানে। কোথায় যাচ্ছে বলা যেন বারণ। তাই সে বেরনোর সময় মাকে পর্যন্ত বলতে পারেনি কোথায় যাচ্ছে। বলে দিলে গোপন কিছু সবাই জেনে যাবে। এমন গোপন যা সে নিজেও জানে না। এই অন্ধকার রাতের মতোই গোপন।

ফিরে আসে আহ্নিক, ফিরে এসে সে ঝুমুরকে বলে। তুই একটু দাঁড়া। আমি বাইরেটা দেখে আসি। হয়তো বাইরে কোথাও গিয়েছে। ঝুমুর দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো থেকে চোখ নামিয়ে ইশারায় বলে, যাও। তারপর আবার দেয়ালের দিকে ফিরে তাকায়। দেয়ালে কী রয়েছে এমন? একটা ছবিতে বিকাশ স্মিতা আর কিছু মানুষের সাথে আহ্নিকের বাবার ছবি। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের। তখনও লোকটা সুস্থ ছিল। তারপর ব্রেনস্ট্রোক হয়ে বিছানায় চারবছর থাকে।

আহ্নিক আবার স্মিতাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আবার তার হাত খালি। গোটা জীবন যেভাবে খালি থেকেছে। সে দেখেছে, সে সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, অথচ তার জিজ্ঞাসা চির তমসা ঢাকা। অবশ্য ঘর থেকে বেরনোর সময় স্মিতার ঘরটা সেই মায়ের মতোই প্রশ্ন করল, কোথায় যাচ্ছ?

না এবারেও খালি হাতে ফিরতে হল আহ্নিককে। কোথায় খুঁজবে? তার থেকে ঘরে অপেক্ষা করা ভাল। তবে সে চেষ্টা করেছে। যেখানে যেখানে সম্ভব ঘুরে দেখেছে কোথায় যেতে পারে স্মিতা। সময়ও চলে গেছে অনেক। ফিরে এসে আবার যখন স্মিতার দরজায়, দেখে দরজাটা একইঞ্চি মতো ফাঁক হয়ে রয়েছে। আর সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে স্মিতা কোমরে হাত রেখে শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে দেখছে, তার সামনে ঝুমুরের অচৈতন্য শরীর। ঝুমুর পড়ে আছে মেঝেতে।

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন