ধারাবাহিক
উপন্যাস
স্বর্গ এসেছে নেমে
(৫)
বৈশ্বানর স্কলারশিপের যৎসামান্য যে টাকাটা পায় সেটা তার মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর এ কাজটি অনঙ্গবাবু নিজেই করে থাকেন। এ ছাড়াও বৈশ্বানরের মায়ের জন্য তিনি একটি মাসহারার ব্যবস্থা করেছেন যাতে সে খেয়ে পরে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। তিনি কর্মে বিশ্বাসী। বিনাশ্রমে অর্থপ্রাপ্তি মানুষকে আয়েশী করে তোলে, তাই তাকে একটি দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করেছেন তিনি, আর সে হল তার বাড়িটির যথাযথ খেয়াল রাখা। শহুরে মানুষ তিনি কিন্তু গ্রামের সঙ্গে তার সম্পর্ক সেই আগের মতই। আর এই গ্রামটি তো তাঁর নিজের। এখানে এলেই তাঁর শৈশব কৈশোরের সকল স্মৃতি তাঁকে আচ্ছন্ন করে। তাই প্রতিমাসে গ্রামে আসাটা তাঁর কাছে একটা নেশার মত। কেবলমাত্র নিজের জন্য নয়, গ্রামে এসে তিনি সকলের খোঁজ খবর করেন। প্রয়োজনবোধে কোন কোন ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্যও করে থাকেন। তিনি গ্রামে এলেই তাই একটা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের হাওয়ায়। অনঙ্গ শুনেছেন বাবার কাছে, তার পূর্বপুরুষের আদিবাস ছিল অবিভক্ত ভারতের রংপুর জেলায়। ভারত বিভাগের পরেই তার ঠাকুর্দা চলে আসেন কুচবিহারের জামালদহ গ্রামে। শস্তায় প্রচুরপরিমাণ জমি কিনে বিশাল অট্টালিকার মত বাড়ি তৈরী করে গ্রামের মানুষের চোখে এক ক্ষমতাবান ব্যক্তি বলে সমীহ আদায় করে নেন। বাবা ছিলেন ঠাকুর্দার একই সন্তান। ঐ বিশাল সম্পত্তির মালিক তিনি কিন্তু তার মনটি ছিল উদার আকাশের মত। তিনি জমিহীন দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বেশকিছু জমি দান পাট্টা করে দেন, যাতে তারা মাথা গোঁজার জন্য নিজেদের আস্তানাটুকু তৈরী করে নিতে পারে। ওই কৃষকরাই তো তার জমিতে ফসল ফলানোর কারিগর। তারা একটু সুখে থাকলে কাজটাও করবে মন দিয়ে। তার তো এত জমি, দু পাঁচজনকে কিছুটা জমি দান করলে ঈশ্বরও খুশী হবেন। জমি পেয়ে ওই কৃষকদের সে কি আনন্দ! দাতার মনেও একই রকম পরিতৃপ্তির আবেশ। ঠাকুর্দা গত হলে হাল ধরলেন বাবা। সুখে সাচ্ছ্বল্যেই কাটছিল দিন। অনঙ্গ তখন খুবই কম বয়সের। তাকে তার বাবার জিম্মায় রেখে দু’দিনের জ্বরে অনঙ্গের মা পাড়ি দিলেন সে দেশে যেখান একবার গেলে আর ফেরা হয় না মানুষের। অনঙ্গর বাবা গ্রামের কোবরেজ বদ্যি থেকে শহরের ডাক্তার কিছু বাদ দেননি, কিন্তু তারা সকলেই তাদের অক্ষমতা জানিয়ে বিদায় নিল। মাকে হারিয়ে দিশাহারা অনঙ্গ। মৃত্যু যে জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম সে কথা বোঝার বয়স তখনও হয়নি অনঙ্গর। বাবা তখন মাতৃহারা অনঙ্গের সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। পরামর্শ দিয়েছে অনেকে, প্রস্তাবও এসেছে অনেক, কিন্তু ছেলের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বিয়েতে রাজী হননি অনঙ্গর বাবা। পড়াশুনোয় অনঙ্গ মেধার পরিচয় দিয়েছে সেই প্রাথমিক শ্রেণী থেকেই। তার বাবার মনে তখন ছেলেকে নিয়ে আশা জেগে উঠছে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের মত। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে প্রবেশ করল অনঙ্গ। প্রতি ক্লাসে প্রথম হয়ে সে তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র। বাবার পরিশ্রমের ভাগ নিতে চাইলেও, সম্ভব হত না। বাবা বলতেন, এখন তোমার একমাত্র কাজ হল পড়াশোনা করে সত্যিকারের মানুষ হওয়া। আমার পর তো তোমাকেই সবকিছুর হাল ধরতে হবে অনঙ্গ! একদিন সময় করে তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো। এই যে ভাগচাষী, যারা আমাদের জমিতে চাষ করে তাদের সম্বন্ধে জানতে হবে তোমাকে। অবশ্য শোনা যাচ্ছে ভাগচাষীদের জন্য নাকি কী এক আইন পাশ হবে যাতে জমির মালিকানা চলে যাবে চাষীদেরই হাতে। সে গেলে তো আর করার নেই কিছু! যেটুকু থাকবে তার তো হিসাব রাখতে হবে। ছুটির দিনে সব কিছু বুঝিয়ে দেব তোমায়।
না, সে সময় আর পাননি অনঙ্গর বাবা। ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সামান্য পরিশ্রমেই হাঁপ ধরে যেতো। একদিন জমি থেকে ফিরে হঠাৎ করেই বসে পড়লেন চেয়ারে। অনঙ্গ ছুটে এল। তিনি ইশারায় বললেন জল দিতে। অনঙ্গ জল নিয়ে ফিরেই দেখে বাবা এলিয়ে পড়ে আছেন। ছুটল সে গ্রামের কোবরেজের কাছে। তিনি এসে পরীক্ষা করে বুঝলেন অনঙ্গর বাবা বেঁচে নেই আর। অনঙ্গ দিশাহারা। কী বোঝে সে জমিজমার! ক্লাস নাইনের ছাত্র সে। এতদিনে রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট এক পরিবর্তন এসে গেছে। ভাগচাষীদের জমির দখল দিতে মরিয়া সরকার। অনুগত কৃষকেরা একযোগে এল অনঙ্গর কাছে। বলল, ছোটবাবু তুমিই বলে দাও আমরা কী করবো! অনঙ্গ, সেও বাবার মনটাই পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে। তার জবাব, সরকার যা ভাল বুঝবে করবে, সেখানে তার কিছু বলার থাকতে পারে না। পিতৃপুরুষের সম্পত্তি সকলের ভাগ্যে সয় না। পুরুষকার যার সঙ্গী সে নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে পারে। পড়াশোনার ওইখানেই ইতি ঘটলো অনঙ্গর। এক বিশ্বস্ত কৃষকের উপর ঘরবাড়ি দেখাশোনার ভার দিয়ে অনঙ্গ বেরিয়ে পড়ল ভাগ্যের অন্বেষণে। গ্রাম সে ছাড়লো বটে, গ্রামের সাথে তার যে নাড়ির টান, তা ছিন্ন হতে দিল না সে। ঐগ্রাম যে তার জন্মভূমি, মা। তাই মাসে অন্তত একবার হলেও গ্রামে ফেরা চাই। জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে তার কিন্তু গ্রামের সাথে সম্পর্কে ভাটা পড়েনি একটুও। বরঞ্চ বলা যায়, বেড়েছে অনেকগুণ।
বৈশ্বানর তারই গ্রামের
ছেলে, একথা ভাবলেই তাঁর বুক ফুলে ওঠে গর্বে। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল যেদিন সেদিন
তিনি কয়েক হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে হাজির গ্রামবাসীদের মিষ্টিমুখ করাবেন বলে। তখনই কথা হয়েছিল
মায়ের সাথে। অতি নিম্ন আয়ের পরিবার। জানলেন অনঙ্গবাবু লোকের বাড়ি বাসন মেজে কাপড় কেচে
দিন গুজরান হয় মা ছেলের। প্রতি বৎসর যেমন করে থাকেন তিনি, তেমন করেই বৈশ্বানরের দায়িত্ব
গ্রহণ করলেন সাগ্রহে। যে ছেলে তাঁর গ্রাম, গ্রামের স্কুলকে চিহ্নিত করেছে কেবলমাত্র
জেলায় নয় সারা রাজ্যে, সে তো তাঁর সন্তানের
মতই। আশ্বাস দিয়ে গেলেন তার মাকে, এই ছেলেই একদিন এমন একজন ব্যক্তিতে পরিণত হবে যে
তার নাম ঘুরে বেড়াবে লোকের মুখে মুখে। বৈশ্বানরের মা বুঝল না এত কিছু। সে কেবলমাত্র
এটুকুই বুঝল তার ছেলের লেখাপড়া থেকে শুরু করে
সমস্ত দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন তাদের দাদাবাবু। বৈশ্বানর যেন দেখতে পেলো তার অনিশ্চিত
ভবিষ্যতের পথে আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এসেছেন ঈশ্বর। বলছেন, ‘মা ভৈ, আমি আছি বৈশ্বানর,
ভয় কী?’
অনঙ্গ সান্যাল, যাঁকে
এর মধ্যেই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে মনে মনে পুজা করতে শুরু করেছে বৈশ্বানর অনুগামী ভক্তের
মত, ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ঈশ্বরকে এমন একটি অমূল্য সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্তির
জন্য। তিনি জানেন, এ নিয়ে কুন্তলা অশান্তির একশেষ করে ছাড়বে, বলবে, ‘খাল কেটে কুমীর
আনলে’, কিন্তু অনঙ্গ সান্যাল যে পিছু হটতে জানেন না!
এমনই ঘটেছিল সেদিন।
কোন হাভাতে ঘরের এক ছেলেকে নিয়ে এসেছেন তার দয়াময় স্বামী, তাও যদি বামুনের ছেলে হত!
অচ্ছুৎ, ম্লেচ্ছ দুই চোখের বিষ কুন্তলার। কী যে এমন দেখলেন তার স্বামীপ্রবরটি এই ছেলেটার
মধ্যে, তিনিই জানেন। কি না, পেত্থম হয়েছে জিলার মধ্যে কি একটা পরীক্ষায়। তার গাঁয়ের
ছেলে। আরে তাতে তোমার আমার কি এলো গেলো! স্কলারশিপ, ছাত্রবৃত্তি, জলপানি এমন কোনো শব্দই
শোনেনি কুন্তলা, বা শুনে থাকলেও সে নিয়ে অযথা মাথা ঘামায়নি কখনো। অনঙ্গ সান্যাল অনেক
করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু কুন্তলার ঐ এক গোঁ, থাকতো ছেলেটা গাঁয়ে ওর মা বাপের
কাছেই, কেন এই ছেলেটার বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে তাদের! সান্যালমশাই শেষমেশ আশ্বস্ত করলেন কুন্তলাকে এই কথা
বলে যে ছেলেটা আর দুজন ছেলের সাথে আউটহাউসেই থাকবে। সেইদিন থেকে আজতক প্রায় পাঁচবছর
কাটিয়ে দিল বৈশ্বানর নিরুদ্বেগে। কলেজে সদ্য ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ছাড়া এমন
কিছু ঘটেনি তার কলেজজীবনে যাতে বিড়ম্বিত হতে পারেন তার ঈশ্বরসদৃশ সান্যালকাকু। যে সব
বাধা এসেছে কখনো কখনো, নিজ বুদ্ধিতেই সে অতিক্রম করেছে অনায়াসে। কোন আঁচ লাগতে দেয়নি
তার আশ্রয়দাতা বা তার পরিবারের উপর।
আজই রিলিজ করবে বৈশ্বানরকে,
এমনি কথা হয়ে আছে ডাক্তারের সাথে। কলেজে দুটো পিরিয়ড অফ। এই ফাঁকে নার্সিংহোমে চলে
গেলে কেমন হয়। দুবার ভাবল না মনস্বিনী। পৌঁছে দেখে তার বাবা আর রণজয়স্যার কথা বলছেন
ডাক্তারদের সঙ্গে। মনস্বিনী কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কথা শেষ হলে ডাক্তারবাবু তাকালেন মনস্বিনীর
দিকে। অনঙ্গবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন তিনি, ‘আপনার মেয়েটিও হয়েছে ঠিক আপনার মতই।
প্রতিদিন এসে রোগীর সম্বন্ধে খোঁজ খবর করে গেছে, বলেছে, চিকিৎসার যেন ত্রুটি না হয়,
বলেছে, ছেলেটি নাকি খুব প্রিয় আপনার’। অনঙ্গবাবু গর্বিত বোধ করলেন মেয়ের প্রশংসায়।
হেসে বললেন, ‘ঠিক কথাই বলেছে আমার মেয়ে, তবে ছেলেটি কেবলমাত্র আমার প্রিয় নয়, কলেজে
শিক্ষক-ছাত্র মহলে ওর মত প্রিয়পাত্র আর কেউ নেই, বলেই তাকালেন রণজয় স্যরের দিকে। মাথা নেড়ে সমর্থন জানালেন অধ্যাপক রণজয়।
দুর্বল বৈশ্বানরকে অতি
সন্তর্পণে গাড়িতে তুলে আনলেন অনঙ্গ সান্যাল। মাঝে বৈশ্বানর, দুইপাশে পিতাপুত্রী। রণজয়
স্যার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলেন, সহজেই যাতে নেমে যাওয়া যায়। গাড়ি চলল মন্থর গতিতে।
রণজয় নেমে গেলেন তাঁর কোয়ার্টারের সামনে। যাবার
আগে বৈশ্বানরের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘এমন করেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে
বৈশ্বানর। মনে রাখবে রবিকবির সেই বিখ্যাত দুটি লাইন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...’
বাকীটা তো তুমি জান বৈশ্বানর, মনের জোর হারাবে না কখনও, সুস্থ হয়ে ওঠ, আর হ্যাঁ, ওই
গানটা আওড়াবে মনে মনে, ‘উই শ্যাল ওভারকাম...’। মৃদু হেসে মাথা নাড়ল বৈশ্বানর।
গাড়ি ক্রমাগত এগোচ্ছে বাড়ির দিকে। জানেন অনঙ্গবাবু, জানে মনস্বিনী, এইবার আরম্ভ হবে মহারণ। একই গাড়িতে ওই ছেলেটাকে মধ্যমণি করে নিয়ে আসা হচ্ছে মহা সমাদরে, খবরটা দারোয়ানের মুখে আগেই পৌঁছে গেছে কুন্তলার কানে। না, গাড়িটা বাড়ির দরজায় নয়, আউটহাউসের দরজাতেই থামল নির্দেশমত। ভিতর থেকে আশ্রিত আর দুটি ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে এল গাড়ির কাছে। তারা শুনেছে সমস্ত ঘটনা কিন্তু অনুমতি না থাকায় যেতে পারেনি নার্সিংহোমে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়া দুটি তরুণ। অনঙ্গবাবুর আনুকুল্যে বৈশ্বানর সহ তিনজনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। অনঙ্গবাবু ডেকে বললেন ওদের, ‘আয় তোদের বিশুদাকে নামিয়ে নে’। এরা দুজন বৈশ্বানরেরও প্রিয়পাত্র। সময় বাঁচিয়ে বৈশ্বানর ওদের গৃহশিক্ষকের এমনকি অভিভাবকের ভুমিকাটিও পালন করে থাকে। তাই বিশু ওদের কাছে কেবলমাত্র সিনিয়র দাদা নয়, বড়দাদার মত। অতি যত্নে ওরা নামিয়ে নিল বৈশ্বানরকে। ঘরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালো স্টাডি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটিতে। মনস্বিনীর তদারকিতে বিছানা ঝাড়পোঁছ করে শুইয়ে দেওয়া হল বৈশ্বানরকে। ওষুধের প্যাকেট, কিছু ফল ও হরলিকসের একটি পাউচ যা আগেই কেনা হয়ে গিয়েছিল, ছেলেদুটির জিম্মায় দিয়ে বলে গেলেন অনঙ্গবাবু, যেন সকাল বিকেল বৈশ্বানরকে ফল আর হরলিকস নিয়মিত দেওয়া হয়। ঘর থেকে বেরোনোর সময় মনস্বিনীর সতর্কবার্তা, কলেজ যাওয়ার সময় সে প্রতিদিন খোঁজ নিয়ে যাবে, পথ্য ঠিক মত নেওয়া হচ্ছে কিনা। কৃতজ্ঞতা ভাষা পেল বৈশ্বানরের চোখে।
এই হল মনস্বিনী। যা একবার ঠিক বলে মনে করে কারও সাধ্য নেই তার সংকল্প থেকে তাকে বিচ্যূত করে। নামটাই এমন, কেউ একজন নাম ধরে ডাকল কি ধারে কাছে দাঁড়ানো বা পথচলতি মানুষ একবার দেখবেই মাথা ঘুরিয়ে নামের অধিকারিণীকে। বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ, সারা মুখমন্ডল জুড়ে ব্যক্তিত্বের বিচ্ছুরণ প্রভাবিত করবেই তার পারিপার্শ্বিক সকলকে। এ কারণেই নেতার নির্দেশে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ছাত্র সংসদের সহ সম্পাদক হিসেবে। এ ছাড়াও প্রভাবশালী পিতার নামের ওজন তো একটা আছেই। বৈশ্বানরের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তার তীব্র পতিবাদ জানিয়েছে মনস্বিনী এবং স্বভাবতই বিরাগভাজন হয়েছে সংসদ নেতৃত্বের। বৈশ্বানরের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন নার্সিংহোমে তার সঙ্গী হওয়া ক্রমশ কলেজ পরিমন্ডলে একটি রসালো গল্পের জন্ম দিয়ে ছেড়েছে। মনস্বিনী অবশ্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে সব। কলেজ প্রিন্সিপ্যাল যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন খবরটা চেপে দিতে। বড় কাগজগুলোতে খবর ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ছোট কাগজগুলো প্রচারের সুবিধা নিতে ছাড়েনি, যদিও মনস্বিনীর ভূমিকা কৌশলে এড়িয়ে গেছে তারা।
ঘরে ফিরতেই কলেজ প্রিন্সিপালের
একটি চিঠি নজরে পড়ল অনঙ্গবাবুর। খামটি খুলে চিঠিটি পড়তে যাবেন তক্ষুনি ধেয়ে এল কুন্তলা।
বেশ একটু উতপ্ত কন্ঠেই সে মনের ঝাল মেটাতে চাইল। শাণিত বাক্য এক একটি। ‘বেগার খেটে
দিনের অদ্দেক কাটিয়ে ফিরলেন দুজন। আমি আর কে, দাসীবাঁদি ছাড়া কেউ তো নই। বলি শুনছ,
যত ঝামেলা যকন ঐ হতচ্ছাড়া ছেলেটাকে নিয়ে তকন বিদেয় করে দিলে হয় না! বললেই তো শুনবো,
ও হচ্চে গিয়ে জলপানি পাওয়া ছেলে, জেলার গব্ব। বলি, সে যকন আমাদের বিপদের কারণ হচ্চে
তখন কি পেয়োজন তাকে রাজপুত্তুরের মত সমাদর করা? একনো বোলচি, ওকে তাড়াও নয়তো দেখবে আমিই
কোনদিন ওকে তাড়িয়ে ছাড়বো’। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে হাঁপাতে রান্নাঘরের দিকে
পা বাড়ালো কুন্তলা।
মনে মনে হেসে উঠলো মনস্বিনী। কী করে কাটাবে মায়ের এই অমূলক ভয়! হ্যাঁ, একথা মনস্বিনী অস্বীকার করতে পারে না, কী করে অজ্ঞাতে যেন মনের কোথাও এক টুকরো জায়গা নিয়ে ফেলেছে বৈশ্বানর। তা সে কার্যকারণে কত কিছুই তো মনের দখল নিয়ে নেয়, তা বলে তাকে গুরুত্ব দিয়ে মহাকান্ড বাধিয়ে দিতে হবে? মনস্বিনীর এ প্রশ্ন কাকে উদ্দেশ্য করে? মনস্বিনী প্রশ্ন করে নিজেকে। বৈশ্বানরকে নিয়ে তার মনের এই ভাবনার প্রশ্রয় কি নিজে থেকেই দেয়নি সে? একি ভালবাসা? না না, এ ভাললাগা ছাড়া আর কিছু নয়। আচ্ছা, ভাললাগার মধ্যেই কি ভালবাসার অঙ্কুর লুকিয়ে থাকে না? এটা কি নিছক ইনফ্যাচুয়েশন! না, নায়কের মত চেহারা নয় মোটেই, তবে মেধা, সাহসিকতা আর মানবিকতা এই তিনটি গুণ বৈশ্বানরকে নায়কোচিত মর্যাদায় উন্নীত করেছে যে! মনে মনে হেসে কুটিকুটি মনস্বিনী, দোর্দন্ডপ্রতাপ অনঙ্গ সান্যালের মেয়ে কিনা তার জীবনের মহৎ লক্ষ্য ছেড়ে দুদিনের পরিচিত, বাবার আশ্রিত একটা মানুষের ভালমন্দের চিন্তায় সময়ের অপব্যবহার করছে! না, এসব ভাবনায় আর কালক্ষেপ নয়। তার জন্য রয়েছে বিশাল এক কর্মক্ষেত্র। মনস্বিনীদের জন্ম নিজের জন্য নয়, বৃহৎ এক জগৎ রয়েছে তার প্রতীক্ষায়। নিজেকে তৈরী করে নিতে হবে তার জন্য।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন