কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩৯ |
ভাগ করা বিস্কুট
মোহনের চায়ের দোকান সাড়ে ছটাতেই খুলে যায় – মোহনের বউ ঝাড়ু দেয়, টেবিল চেয়ারগুলোর ধুলো ঝাড়ে। তারপর গ্যাসচুলা জ্বালিয়ে এক ডেকচি জল চাপায়। ডেকচিতে চা ফুটবে সারাদিন। কাল আবার ডেকচি বসবে, নতুন দিনে নতুন চা।
চা-পাউরুটি খেয়ে দিনমজুর আর একশ দিনের কাজ-পাওয়ারা কাজে যায়। আটটা নাগাদ আসে তিনজন বয়স্ক লোক। ধরা যাক ক, খ আর গ। আড্ডা জমে যায়। দেশের অবস্থা। রাশিয়া, চীন, আমেরিকার কী হবে! বিশ-তিরিশ বছর আগে পুরীতে কী দারুণ চিংড়ি, রামেশ্বরমে সে কী বড় বড় ঢেউ! কাছেপিঠে কাদের পৈত্রিক বাড়ি প্রমোটার ভাঙছে, ছ-তলা উঠবে। নিজের বাড়ির কথা কেউই বলে না, বলার আছেটাই বা কী!
তিনজনে তিন-পাঁচে পনেরো টাকা দিয়ে তিনটে মাঝারি গেলাস চা আর চারটে খাস্তা বিস্কুট কেনে। চা শেষ হলে পড়ে থাকে চার নম্বরটা। ডিশের ওপর রেখে ভাগ করা হয়। একে খাস্তা তারপর চৌকো, ভাগ করা সোজা নয়। ক’বাবু হয়তো বলেন, “এ হে আজকে একটা ছোট হয়ে গেল। ওটা আমি নিচ্ছি…”
“না না তুমি কেন নেবে, আজ আমি নিই। কাল বড়
পেয়েছিলাম। হা হা”।
“আরে থাক, আমি বরং গুঁড়োটা নিচ্ছি।”
“আচ্ছা, কাল আমি ভাগ করবো, কাঁটায় কাঁটায় সমান হবে, হি হি”।
মোহনের ছেলে শুভম কী একটা পাশ দিয়েছে এবং একটি কাজের কাজ করেছে। প্রেম। মেয়েটি মানে খুশি লেখাপড়াও জানে, বাপের পয়সাও আছে। দেশে বেকারত্ব থাকলেও এরা দুজনেই চাকরি পেয়ে গেছে। তাই বিয়েও হলো পট করে।
খুশি কিছুতেই মানতে পারল না যে তার শ্বশুর আটপৌরে চা-এর দোকান চালায়, শাশুড়ি সাতসকালে দোকান ঝাঁট দেয়। শুভমকে বলল, এটা বন্ধ করো। কিন্তু বললেই কি করা যায়? ঈশ্বর অবশ্য একটা উপায় করে দিলেন।
এআই আসাতে শুভমের চাকরিটি গেল। কী করা যায়? বিস্তর আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো খুশির বাবা শুভমকে পুঁজির ব্যবস্থা করে দেবে। চায়ের দোকানের জায়গায় শুভম মোবাইলের দোকান খুলুক।
হলো দোকান। অ্যলুমিনিয়ামের পট্টি লাগানো কাচের তাক, প্লাইউডের হাল ফ্যাশনের টেবিল, মাইক হাতে টেলর সুইফ্ট-এর চকচকে বড় পোস্টার। ফোনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তবু এসব পোস্টার লোক টানে। শুভমই সারাদিন দোকানে বসে, সন্ধেবেলায় কাজ থেকে ফিরে খুশিও বসে। সূচনা মন্দ হলো না, লোক আসতে লাগলো।
মোহনের এদিকে বাধ্যতামূলক অবসর হয়ে গেল। হাটু অবধি ধূতি আর তেলচিটে ফতুয়া পরে মোবাইলের দোকানে বসা যায় না। আর সে মোবাইলের জানেই বা কী! বাড়িতে মন টেকে না, শরীরটাও কেমন যেন দরকচা মেরে গেল। ডাক্তার বলল, সুগার।
আর ক, খ, গ বাবুরা? সকালবেলার আড্ডাটা নেই। খালিখালি লাগে, সময় কাটে না। ক বাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, প্রেশার বেড়েছে। তিনজনের আর দেখাও হয় না। খুব মনে পড়ে সেই একসঙ্গে বসে চা খাওয়া। বিশেষ করে চার নম্বর বিস্কুটটা ডিশের ওপর রেখে তিন টুকরো করে ভাগ করে নেওয়ার মজাটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন