শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১৩৪ / ত্রয়োদশ বর্ষ : সপ্তম সংখ্যা   


 

আমাদের চারপাশে এখন শারদোৎসবের আবহ। সেই আবহে একদিকে যেমন চলেছে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি, তার অনুষঙ্গে নতুন পোশাকের কেনাকাটা, কাছে বা দূরে ভ্রমণে যাবার তোড়জোড়; অন্যদিকে তেমনি শারদ সংখ্যা পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ব্যস্ততা। মূলত বাংলা পত্র-পত্রিকা। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্রের বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের সুবৃহৎ শারদসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনের শারদসংখ্যাও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাংলা প্রকাশনসংস্থাগুলি এবং মুদ্রণসংস্থাগুলি অত্যন্ত তৎপর ও ব্যস্ত। এই দুই সংস্থার সব কর্মীরাই নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন যথাসময়ে পত্র-পত্রিকা সম্পাদকের হাতে তুলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে। বিশেষত পত্র-পত্রিকার ছাড়া এই সময় বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় লেখক-লেখিকাদের প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প ও কবিতার বই। মোটকথা শারদোৎসবের আবহ রীতিমতো  রঙিন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সাহিত্যের আবহের নিবিড় সান্নিধ্যে। আমরা যারা সাহিত্য ভালোবাসি,  যদিও নেহাতই যৎসামান্য সাহিত্যকর্মী, বলা বাহুল্য, আমরা এই সময় জীবনের এক স্বতন্ত্র স্বাদ খুঁজে পাই, জীবনের এক অন্য মাত্রায় উত্তোরিত হই।

অবশ্য একথা অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই নেই, শারদোৎসবের মতোই প্রতি বছর বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতেও আমরা নিমজ্জিত হই সেই একই উৎসবের আবহে। বিশেষত নববর্ষের এই দিনটি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সব বাঙালির একান্ত উৎসবের দিন। শারদোৎসবে বা ঈদের উৎসবে বা যিশু খৃষ্টের জন্মদিনের প্রেক্ষিতে বড়দিনের উৎসবে সেই আবহ সার্বজনীন, একথা কিন্তু বলা যায় না, যদিও তা কখনই অভিপ্রেত নয়। অত্যন্ত লজ্জা ও ক্ষোভের কথা, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে, সব সমাজে, সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে কায়েমী স্বার্থের কারণে বিভেদকামী যেসব মানুষ, গোষ্ঠী ও সংস্থা অত্যন্ত সক্রিয়, তারা কখনই মানুষকে  শুধুমাত্র মানুষের পরিচয়ে বেঁচে থাকতে দিতে রাজী নয়। আর তাই যেখানে বিশ্বের যাবতীয় বাঙালি নিজেদের অখন্ড জাতিসত্ত্বার মানসিকতায় কখনও মিলিত হতে পারে না, সেখানে অখন্ড মানবিকসত্ত্বায় মিলিত হবার ভাবনা অবান্তর বলে মনে হয়। বাংলাভাষার প্রণম্য কবি চন্ডীদাসের সেই অমোঘ উচ্চারণ, “সবার উপরে মানুষ সত্য / তাহার উপরে নাই” – আজ কেই বা মনে রেখেছেন!  

উৎসবের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ করতেই হয়, আমাদের বাংলা ও বাঙালির জীবনযাত্রা ও জীবনচর্যায় বিগত শতাব্দী থেকে যে সাহিত্য উৎসবের সূচনা হয়েছে, ভারতে পশ্চিমবঙ্গে ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা’ এবং বাংলাদেশে ঢাকায় ‘অমর একুশে বইমেলা’, তা সব বাঙালির শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বইমেলা প্রসঙ্গে আলোচনা এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে নয়, বরং বইমেলা চলাকালীন আবহে অন্য নিবন্ধে করা যেতে পারে।

সবাইকে জানাই আমাদের শারদ শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।      

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

সাজানো বাগান: নাটক থেকে চলচ্চিত্র

 


ভূমিকা

“পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে / স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে /

ড্রইংরুমে রাখা বোকাবাস্কতে বন্দি / ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে /

যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে / ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি’’

শুধু শিক্ষাক্ষেত্র নয়, আজকের আধুনিক বিশ্ব মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত। মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্ব আজ সর্বসাধারণের বাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত বিশ্বের যে-কোনো  জায়গায় ঘটে যাওয়া খবর ও চিত্র আজ আমাদের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রাচীনকালে গণজাগরণকারী মাধ্যম হিসেবে কীর্তন, কবিগান, মঙ্গলগান, ছড়া, লোকগাথা, কথকতা, পুতুলনাচ ইত্যাদির প্রচলন ছিল। ক্রমে বিজ্ঞানের উন্নতিতে সংবাদপত্র, বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন, ইন্টারনেট ইত্যাদি  মাধ্যমের প্রচলন হয়, যার মাধ্যমে যে-কোনো বিষয় সম্বন্ধে গণজাগরণ সম্ভবপর হয়েছে।

লোকশিক্ষা ও লোক-মনরঞ্জনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব অপরসীম। কাহিনিচিত্র, নিউজরিল, ডকুমেন্টারি চিত্র প্রভৃতি থেকে মানুষের জ্ঞান ও চেতনার প্রসার ঘটে। অবসর যাপনে, চরিত্র গঠনে, নীতিশিক্ষার প্রসারে, সাংস্কৃতিক বোধের প্রসারে চলচ্চিত্র আধুনিক জীবনের অন্যতম গণমাধ্যমসংগীতের বিমূর্ত শিল্পগুণ বা উপন্যাসের বিশ্লেষণ ক্ষমতা, নাটক কিংবা নৃত্যের ত্রিমাত্রিক রূপারূপ চলচ্চিত্রে উপস্থিত থাকে না তা সত্ত্বে চলচ্চিত্র হল সংগীতের সুর-তাল-ছন্দ-লয়, চিত্রকলার দৃশ্যতা, আলোকচিত্রের বাস্তবতা, স্থাপত্যের ভাস্কর্য, উপন্যাসের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, নাটকের অভিনয়, নৃত্যের গতির এক সূক্ষ জটিল নান্দনিক সমীকরণ।

আলোচ্য ক্ষেত্রে ‘গণমাধ্যমের নানা দিক ও বাংলা সাহিত্যকেন্দ্রিক গবেষণাপত্র প্রস্তুতি’র জন্য   ‘সাজানো বাগান’ (মনোজ মিত্র) নাটক এবং তার চলচ্চিত্রায়িত রূপ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’(তপন সিংহ পরিচালিত) নির্বাচন করা হল। উক্ত বিষয় অবলম্বনে উভয় মাধ্যমের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ  করা হল। আলোচনার সুবিধার্থে সমগ্র বিষয়টিকে কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হল।

প্রথম অধ্যায়ে, সাহিত্যে-নাটক-চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে, চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও বাংলায় তার প্রবর্তন এবং তার ক্রমানুসারী বিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়ে, বাংলা চলচ্চিত্রজগতে পরিচালক তপন সিংহের অবদান সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

চতুর্থ অধ্যায়ে, বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘সাজানো বাগান’ নাটক এবং ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার  অবস্থান ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে, ‘সাজানো বাগান’ এবং ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর মধ্যে একটি তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র

১। মহীনের ঘোড়াগুলি, ‘আবার বছর কুড়ি পরে’, কলকাতা, ১৯৯৫

১। ধীমান দাশগুপ্ত, ‘সিনেমার ভাষা’, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলির্শাস, ১৪১০, পৃ ৪৫

প্রথম অধ্যায়ঃ সাহিত্য-নাটক–চলচ্চিত্র

সাহিত্য মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত; কাব্যসাহিত্য ও গদ্যসাহিত্য। গদ্যসাহিত্যে প্রধানত বলতে গল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো কল্পনাত্মক রচনা সহ অন্যান্য বিবরণাত্মক রচনাকে বোঝায়। কাব্যসাহিত্য  বলতে কবিতাকে বোঝায়। ‘‘পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আদিম মানবীর যে দেহচ্ছায়া পড়েছিল রুক্ষ পাথরে সেই ছায়া বরাবর আদি মানব কাঠকয়লার দাগ টেনে দিতে পৃথিবীর প্রথম ছবিটি আঁকা হয়। তার সন্তানের মা হওয়ার জন্য স্ত্রী টিকটিকিকে পুরুষ টিকটিককে যে ডাক দেয় শব্দ আবিষ্কারের বহু আগে বন্য মানুষের ঠোঁটে উচ্চারিত অনুরূপ অস্ফুট ধ্বনিই ছিল মানুষের আদি সংগীত। আদিম প্রমিকার মনোরঞ্জন, উত্তেজনা ও উদ্দীপনার জন্য চালিত প্রেমিকের অঙ্গসঞ্চালনই হল যেমন আমাদের প্রথম নৃত্য।’’ এমন কোনো সময়ে বা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে চলচ্চিত্রের জন্ম না হলেও সে এই সকল মাধ্যমের সমন্বয়ে নিজেকে মূর্ত করে তোলে। বলা চলে, উপন্যাস যেমন অষ্টাদশ শতকের শিল্পরূপ চলচ্চিত্র তেমন বিংশ শতাব্দীর শিল্পমাধ্যম।

চলচ্চিত্রে মূলত একটি কল্পনাত্মক সৃষ্টি। যা বিষয়বস্তুর তারতম্য অনুসারে বাস্তবানুসারী বা মননপ্রধান হয়ে ওঠে। তাই সাহিত্যের সঙ্গে এই শিল্পকলার সংযোগ, বিনিময় ও মিথষ্ক্রিয়া অত্যাধিক। গল্পে বর্ণিত কাহিনির একমুখীনতা সিনেমার পক্ষে সহায়ক হওয়ায়; গল্পের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নানাধরনের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য, নতুন ধরনের ও কল্পনাসমৃদ্ধ ঘটনা বা সিচ্যুয়েশন, সংলাপরীতি ও সমৃদ্ধ সংলাপ এবং কাঠামো ও বিকাশ বিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক ধারণা গ্রহণ করে নেয় অন্যদিকে ‘‘কবিতার কাছ থেকে সিনেমা গ্রহণ করে প্রতিমা নির্মাণ বিষয়ে ধারণা, চেতনা ও অন্তদৃষ্টি, পরিমিতির সঙ্গে অমোঘতার মিলনপদ্ধতি এবং কাব্যময়তাকে’’ ফলে সাহিত্য চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হবার সময় সাহিত্যের ভাব ও  ভাষাগত ইমেজ চলচ্চিত্রে দৃশ্য ও শব্দগত ইমেজে পরিণত হয়। সিনেমায় সাহিত্যের ভাষা ত্রয়ী ভূমিকা পালন করে, যথা—সামান্যতার মাধ্যমে অর্থের ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা, ঘটনা ও চরিত্রের প্রকৃতি, অনুভূতি ও বিকাশ সৃষ্টি করা এবং বিমূর্তকে মূর্ত হিসেবে প্রতিভাত করা। উৎকৃষ্ট সিনেমা গল্পত্ব ও চিত্ররস থেকে প্রথমে আবেগময়তার দিকে ও পরে অনুভূতিমূলকতার দিকে অগ্রসর হয়।

সাহিত্যের ও চলচ্চিত্রের ভাবগত বিবর্তনের সঙ্গে নাটক ও চলচ্চিত্রের সাদৃশ্য থাকলেও রূপগত বিবর্তনের ধারায় বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। সেদিক থেকে “ভাব ও রূপ দুয়ে মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, চলচ্চিত্র গতি ও চিত্রকলার জ্যামিতিক উপাদানগুলির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য ও নাটকের অন্যান্য ও বিভিন্ন উপাদানের ওপর ভর দিয়ে বিমূর্ত থেকে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।’’  নাটকের কাছ থেকে চলচ্চিত্র প্রধানতম উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে অভিনয়, কিন্তু নাটকের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সার্বিক সম্পর্ক ও চলচ্চিত্রের ওপর নাটকের রূপগত ও শিল্পগত প্রভাব আরও অনেক ব্যাপক ও গভীরতর ‘‘সিনেমার পক্ষে যেমন লাভজনক গল্পের একমুখীনতা ও উপন্যাসের বহুমুখীনতা তেমনি লাভজনক ও ফলপ্রদ নাটকের সংঘাতময়তা’’নাটক ও সিনেমা উভয় মাধ্যমেই প্রত্যক্ষতা, সক্রিয়তা, নাটকীয়তা, তাৎক্ষণিকতা এবং আবেগগত অভিঘাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু উভয়রেই প্রধান লক্ষ্য ঘটমানতা তাই সাদৃশ্য ও সৌহার্দ্যের অনেক লক্ষণই ধরা পড়ে। সিনেমার ঘটমানতা নাটকের চেয়েও উন্নত মানের হয়। কারণ নাটকের ক্ষেত্রে ইমেজের চেয়েও সংলাপ অধিক গুরুত্বপূর্ণ; তাই ফিল্ম ইমেজের বৈচিত্র্য, প্রসার ও অবিরাম ধারাবাহিকতা সেই ক্ষেত্রে অসম্ভব। ফলে সিনেমা একাধারে দর্শনধারী বা নাটকীয়তার সীমানায় আবদ্ধ না থেকে লোকমনরঞ্জনকারী গণমাধ্যম হয়ে ওঠে।

তথ্যসূত্র

১। ধীমান দাশগুপ্ত, ‘সিনেমার ভাষা’, ১ম সং, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলির্শাস, ১৪১০, পৃ ৪৫

২। তদেব, পৃ ৪৬

৩। তদেব, পৃ ৪৭

৪। তদেব, পৃ ৫২

৫। তদেব, পৃ ৫৩

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ চলচ্চিত্রের উদ্ভব ও বাংলায় তার প্রচলন

সিনেমা বা চলচ্চিত্রের জন্ম পাশ্চাত্যে। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস ও জিন লুমিয়ের নামক ফরাসী ব্যক্তিদ্বয় চলচ্চিত্রের আবিষ্কর্তা। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর প্যারিসের গ্র্যান্ড ক্যাফেতে প্রায় কুড়িটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র প্রর্দশিত হয়। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে বিশ্ববাসী উপহার পায় “দ্য অ্যারাইভাল অব্‌ এ ট্রেন অ্যাট দ্য স্টেশন”(নির্বাক চলচ্চিত্র)। ফ্রান্সে প্রথম সিনেমা প্রর্দশনীর মাসছয়েক পর লুমিয়ের প্রতিনিধি মরিস সেসটিয়ারের পৌরহিত্যে ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই ওয়াটসন হোটেলে প্রর্দশিত সিনেমার মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষে নির্বাক চলচ্চিত্রের সূচনা হয়।

চলচ্চিত্রের এই জন্মলগ্নে বাঙালিরাও পিছিয়ে থাকেনি। ১৮৯৮ সালে হীরালাল সেন এবং তাঁর ভাই মতিলাল সেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি তৈরি করেন। ১৯০২ সালে কলকাতায় প্রথম মুভি ক্যামেরা আসে। যার দ্বারা ‘দিল্লি দরবার’ এবং ‘বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলন’ বিষয়ক দুটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয় হীরালাল সেনের পরিচালনায়। বাংলা সিনেমার প্রাতিষ্ঠানিক রূপকার জে এফ ম্যাডানের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের অগ্রগতি শুরু হয়। ১৯৩১ সালের ১১ এপ্রিল ম্যাডানের প্রযোজনায় প্রথম বাংলা সিনেমা ‘জামাইষষ্ঠী’(সবাক) মুক্তি পায়। তৎকালীন সময়ে চলচ্চিত্র ছিল বিনোদনের ও মনোরঞ্জনের উপকরণ। তাই রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার পরিবর্তে এইসময়ে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস-নাটক প্রভৃতির চলচ্চিত্রায়নের প্রবণতা দেখা গেল পরিচালকদের মধ্যে কিন্তু চারের দশক থেকে বাংলা সিনেমায় নিমাই ঘোষ, বিমল রায় প্রমুখের প্রচেষ্টায় জীবনের বাস্তব এবং নানা সামাজিক ঘটনা ছবির প্রতিফলন ধুরা পড়ল। অর্থাৎ পৌরাণিক, রোমাণ্টিক এবং মেলোড্রামাটিক পারিবারিকতার বৃত্ত ভেঙে হাঁটতে শুরু করলো বাংলা সিনেমা। পাঁচের দশকে সতজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের হাতে বাংলা সিনেমার নবজন্ম  ঘটলো; সিনেমা হয়ে উঠলো আন্তর্জাতিক। সুব্রত মিত্র–বংশীচন্দ্র গুপ্তের মতো প্রতিভাবান ক্যামেরাম্যান এবং দক্ষ শিল্পনির্দশকের সম্মিলিত প্রয়াস এই বাঁক বদলকে সার্থক করে তুললো। পরবর্তীকালে তপন সিন্‌হা, নির্মল দে, সরোজ দে, অজয় কর, অসিত সেন, বিভূতি লাহা, দীনেন গুপ্ত, রাজেন তরফদার, তরুণ মজুমদার প্রমুখ পরিচালকদের মাধ্যমে বাংলা সিনেমার নবোয়ন্ন ঘটে। সাহিত্যনির্ভর বৈচিত্র্যপূর্ণ চিত্রনাট্যের গুণে শিল্পসম্মত একাধিক ছবি তৈরি হলো, যা বাংলা সিনেমার দর্শককে হলমুখী করেছিল। সাতের দশকের শেষে বা আটের দশকের শুরুতে বাংলা  সিনেমায় এক সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হলেও নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন প্রমুখের মুন্সীয়ানায় সেই শূন্যতার অবসান হয়।

তথ্যসূত্র

১। পূর্ণেন্দু পত্রী, ‘সিনেমা সংক্রান্ত’, ২য় সং, দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬, পৃ ৫৯

২। তদেব পৃ ৬০

৩। তদেব পৃ ৬২

৪। তদেব পৃ ৬৩

তৃতীয় অধ্যায়ঃ পরিচালক তপন সিংহ ও বাংলা চলচ্চিত্র

১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর বীরভূম জেলার মুরারি থানার জাজিগ্রামের প্রসিদ্ধ সিংহ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পরিচালক তপন সিংহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতোকত্তর  পাশ করে, তিনি ১৯৪৬ সালে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে সহকারী শব্দগ্রহণকারী হিসাবে যোগ  দেন। নবতরঙ্গের চলচ্চিত্রকার হিসেবে তপন সিংহ পরিচিত না হওয়ায় একের পর এক শিল্পসম্মত  বাণিজ্য-সফল সিনেমা তৈরি করে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করা সত্ত্বেও; এদেশের চলচ্চিত্র-বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা চক্রে তাঁর নাম অনুচ্চারিত হয় অথবা ক্কচিৎ উচ্চারিত হয়। বাংলা  তথা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে স্বমহিমায় প্রতিভাত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা বাংলা সিনেমায় যে ভিন্নমাত্রার শিল্পগুণ, রুচি ও দক্ষ পরিচালনার প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁদের সমসাময়িক তপন সিংহ সেই ধারাকেই দর্শক মনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আরও ব্যাপকতা দিয়েছিলেন।

১৯৫৪ সালের ১৯ মার্চ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অঙ্কুশ’ সিনেমাটির মাধ্যমে আলোর পথযাত্রী হিসেবে তপন সিংহের যাত্রা শুরু হয় দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ব্যাপী বিচিত্র বর্ণের বিচিত্র রসের একের পর এক সুষমামণ্ডিত কাহিনি চিত্র উপহার দিয়েছেন দর্শকমন্ডলীকে নির্বিচারে তাঁর প্রতিটি ছবি স্বতন্ত্র  বৈশিষ্ট্য সন্ধান পাওয়া সম্ভবপর নয় মৌলিক সৃজনের পাশাপাশি তিনি বাংলা সাহিত্যের  বেশ কিছু  গল্প-উপন্যাস-নাটক নিয়ে একের পর এক জনপ্রিয় বাণিজ্য সফল সিনেমা বানিয়েছিলেন—‘ক্ষুধিত পাষাণ’(১৯৬০), ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’(১৯৬২), ‘জতুগৃহ’(১৯৬৪), ‘হাটে বাজারে’(১৯৬৮), ‘আপনজন’(১৯৬৯), ‘সাগিনা মাহাতো’(১৯৭৩), ‘হারমোনিয়াম’(১৯৭৫), ‘বাঞ্ছারামের বাগান’(১৯৮০)। ‘অঙ্কুশ’ থেকে ‘গল্প হলেও সত্যি’(১৩.১০.১৯৬৬) পর্যন্ত তপন সিংহের কোনো  সিনেমায় রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কিংবা সমাজপতিদের ষড়যন্ত্র বা রক্তচক্ষু দেখা না গেলেও; ‘হাটে বাজারে’ থেকে শ্রী সিংহ পরিচালিত সিনেমায় রূপান্তরীভবন হিসেবে মানুষের লোভ-লালসা-চক্রান্ত দেখা গেল এই ছবি থেকে  অদ্যাবধি নির্মিত কয়েকটি ছবি বাদ দিলে প্রায় প্রতিটিতে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কারণে সামাজিক অবক্ষয়কে দেখান তপন সিংহ।

বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে শ্রী সিংহের সমস্ত সিনেমা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাপেক্ষে ব্যক্তি মানুষের নানান দিকগুলোকে জনমানসে উন্মোচিত করে তোলে সত্যজিৎ রায়  যেমন  বাঙালি চরিত্রের খাবার-দাবার বেশভূষা, আলস্য রীতিনীতি, আদব-কায়দা, কবিতা ও গানের প্রতি অনুরাগকে এক অনন্য সমগ্রতা মাধ্যমে সিনেমায় তুলে ধরেছিলেন, ঠিক তেমনিই তপন সিংহ বাঙালি সমাজজীবনের খুঁটিনাটি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও চাওয়া-পাওয়াকে তাঁর চলচ্চিত্রের উপাদান করে তুলেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি রূপে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৫ জানুয়ারি ২০০৯ সালে জনপ্রিয় চিত্রপরিচালক তপন সিংহ  পরলোকগমন করেন

তথ্যসূত্র

১। সুগত ঘোষ, ‘তপন সিংহের চলচ্চিত্রে বিষয় বৈচিত্র্য’, ‘প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র এবং’ (জানুয়ারী ২০১৮) : ১৮০

২। তদেব, পৃ ১৮১

৩। তদেব, পৃ ১৮২

৪। তদেব, পৃ ১৮৩

বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘সাজানো বাগান’

উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা অনুসৃত যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তার প্রতিফলন ধরা  পড়েছিল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক নানা ধারার কর্মকান্ডের মধ্যে। উনিশ শতকের পূর্ববর্তী যাবতীয় সাহিত্য-সৃষ্টি পদ্য ভাষা মাধ্যমে রচিত হলেও; এই শতাব্দীর সূচনা পর্ব থেকে বাংলা গদ্যের বা নাটকের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্য সাহিত্য সংরূপের অনুসরণে বাংলা সাহিত্যে ধীরে ধীরে  জন্মলাভ করে বিভিন্ন প্রকার সাহিত্য সংরূপ; নাট্যসাহিত্য তার মধ্যে অন্যতম সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য ড্রামার অনুসরণে বাংলা সাহিত্যে নাটকের সূচনা হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য পর্বে তারাচরণ শিকদারের কলমে(ভদ্রার্জুন,১৮২৬খ্রিস্টাব্দে)। ধীরে ধীরে রামনারায়ণ তর্করত্ন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মোসারফ হোসেন প্রমুখের কলমে পরিপুষ্টতা লাভ করে বাংলা সাহিত্যের এই সংরূপটিপরবর্তীকালে বিভিন্ন স্বনাম-ধন্য নাট্যকারের কলমে জন্মলাভ করেছে নানা কালজয়ী নাটক; সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা নাট্যসাহিত্যের জগৎ

ঊনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীতে যুগগত পরিবর্তনের ফলে যেমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবনশৈলী, ঠিক তেমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে বাংলা নাট্যসাহিত্যের পটভূমিওতৎকালীন বাংলা নাট্যসাহিত্যের পরিসরে জনজীবনের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সামজিক পরিবর্তনের শোষণচিত্র প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার মনোজ মিত্র প্রণীত অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ সামাজিক নাটক ‘সাজানো বাগান’। নাটকটির মূল কেন্দ্র আবর্তিত হয় বৃদ্ধ অশীতপর চাষি  বাঞ্ছারাম ও তার প্রাণপ্রিয় বাগানকে ভর করে। পঁচাত্তরটি বসন্ত কেটে গেলেও সে নিজের বাগান আগলে রেখেছে স্বার্থান্বেষী জমিদার নকড়ি-ছকড়ি দত্তের শ্যেনদৃষ্টি থেকে। বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত বাঞ্ছার সম্পত্তি  করতলগত করার জন্যে বাক্‌চাতুরীর মাধ্যমে তার সঙ্গে মাসোহারার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হলেও; অশীতপর এই বৃদ্ধের প্রাণবায়ু যেন ভগবান প্রদত্ত তার সর্বাঙ্গ বার্ধক্য রোগে  জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদপিণ্ড অবিরাম ছন্দে স্পন্দিত হয়ে চলে। ঘটনাক্রমে দেখা যায় বারংবার মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও বাঞ্ছা তার ‘সাজানো বাগান’ রক্ষার্থে সমর্থ হয়

‘সাজানো বাগান’ নাটকে নাট্যকার বিশ্বপ্রকৃতির পটে মুখোমুখি দুটি শ্রেণীর ভূমিকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত, সেক্ষেত্রে কৃষিজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বৃদ্ধ চাষি বাঞ্ছারাম তথাকথিত শিক্ষায়    শিক্ষিত না হলেও জমি-শোষকদের তথা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত শ্রেণির নিম্নবর্গীয় শ্রেণির সম্বল কেড়ে নেওয়ার প্রবণতাকে সে উদাত্ত ভাবে জানিয়েছে। চিরকাল নিপীড়িত নিম্নবর্গীয় শ্রেণিকে মনোজ মিত্র বাঞ্ছার মৃত্যুহীনতার মাধ্যমে বিজয়ী করেছেন। একটি শ্রেণিসংগ্রামভিত্তিক তত্ত্বকতা দুটি পরিবারের বিরোধের মধ্য দিয়ে কালজয়ী নাটকে রূপান্তরিত হয়; যার মধ্যে নিহিত থেকে যায় ‘সাজানো বাগানে’র তাৎপর্য।

বাংলা নাট্যসাহিত্যে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’

১৯৮৯ সালের জুলাই বা অগাস্ট মাসে বাংলা আকাদেমিতে অভিনীত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি  দেখে অভিভূত হন পরিচালক তপন সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী দেবী। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি রূপে তিনি ‘সাজানো বাগানে’র চলচ্চিত্রায়ণে (বাঞ্ছারামের বাগান) অগ্রসর হন১৯৮৯  সালের  দুর্গাপুজোর সময় প্রযোজক ধীরেশ চক্রবর্তী আশি হাজার টাকা মূল্যে মনোজ মিত্রের থেকে ‘সাজানো বাগানে’র চিত্রস্বত্ত্ব ক্রয় করেন।

যেহেতু নাটক ও সিনেমার প্রধান লক্ষ্য ঘটমানতা তাই সাদৃশ্য ও সৌহার্দ্যের লক্ষণ হিসেবে  উভয়ের সন্ধিস্থলে বিষয়বস্তুর প্রত্যক্ষতা, চরিত্রের সক্রিয়তা, সংলাপের নাটকীয়তা, তাৎক্ষণিকতা এবং আবেগগত অভিঘাতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সিনেমার ঘটমানতা নাটকের চেয়েও উন্নত মানের হওয়ার দরুন ‘সাজানো বাগানে’র তুলনায় ‘বাঞ্চারামের বাগানে’ সংলাপ ইমেজের  থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণতা লাভ করে। সমগ্র নাটকের বিষয়বস্তুকে অভিন্ন রেখেও পরিচালক তপন সিংহ সিনেমায় তাঁর স্বতন্ত্রতার স্বাক্ষর প্রোথিত করেন কাহিনির কাল্পনিক বিস্তারের মাধ্যমে আসলে বিষয়গত ভাবে সাদৃশ্যযুক্ত যে-কোনো শিল্প মাধ্যমগত কারণে আলাদা হয়ে যায়। আর তাই নাটকের বৃদ্ধ বাঞ্ছার জরাকবলিত অবস্থার পরিবর্তে যৌবনোত্তর বাঞ্ছার কর্মক্ষম অবস্থা থেকে কাহিনির সূচনা করেন পরিচালক। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে বিমল মূখোপাধ্যায়ের ভূমিকাও অসামান্য। শ্রী সিংহের কাহিনি অনুসারে, দরিদ্র চাষী বাঞ্ছারাম কাপালীর পিতা গ্রামীণ জমিদার পাঁচকড়ি দত্তের থেকে পুরস্কার স্বরূপ একটি অনুর্বর জমি লাভ করে। বংশানুক্রমে সেই জমি বাঞ্ছার হস্তগত হলে, সে ওই অনুর্বর জমিকে ‘সাজানো বাগান’-এ পরিণত করে। গ্রামের বর্তমান জমিদার ছকড়ি দত্ত বাঞ্ছার বাগান দখলের জন্য বাহুবল প্রয়োগ করলেও ঘটনাক্রমে সাহেব শাসকের মধ্যস্থতায় বাঞ্ছা তার বাগান রক্ষায় সক্ষম হয়। এই ঘটনার প্রতিঘাতে হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান জমিদারবাবু মৃত্যুর পর তার অতৃপ্ত আত্মা বাঞ্ছার বাগানের অধিবাসী হয়অপর  দিকে বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত বাঞ্ছার জরাকবলিত দশার সুযোগ নিয়ে বাগ্মীতার মাধ্যমে বাগান অধিগ্রহণের ফন্দি আঁটে পরিকল্পনামাফিক মোক্তারের সহায়তায় জমিদার মাসোহারার ভিত্তিতে প্রজা বাঞ্ছার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধ চাষি তার প্রতিটি বিদায়ঘন্টাকেই বিদায় জানিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ‘সাজানো বাগান’-এ কাগজকলমে বাগানের মালিক বাঞ্ছা সিনেমায় প্রকৃতপক্ষে যথার্থ  বাগান পেল, যা একাধারে ইন্দ্রিয়গাহ্য ও অনুভূতিগ্রাহ্য। নাটকে যেমন আছে মায়া আর কল্পনায় বাস্তবকে গড়ার প্রবল প্রচেষ্টা ঠিক তেমনিই সিনেমায় আছে বাস্তবকে অনুপুঙ্খভাবে ধারণ করার অসীম স্পর্ধা। যার মধ্যে নিহিত থেকে যায় ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার তাৎপর্য। মঞ্চ ও চলচ্চিত্র এই দুই ভিন্ন মাধ্যমের স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ শক্তির টানে পরিপূর্ণ হয় উঠছে বাংলা সাহিত্য।

‘সাজানো বাগান’ থেকে ‘বাঞ্ছারামের বাগান: তুল্যমূল্য আলোচনা

প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার মনোজ মিত্র রচিত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি ১৯৭৭ সালের ৭ নভেম্বর সুন্দরম্‌ নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় ‘মুক্ত অঙ্গনে’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের খসড়ার নামকরণ করেছিলেন ‘তিন পুরুষ’, মনোজ মিত্র তাঁর ‘সাজানো বাগান’ শীর্ষক নাটকেও তিন পুরুষেরই গল্প বলেছেন। মঞ্চে যার পরিচিতি ‘সাজানো বাগান’ নামে, চলচ্চিত্রে তা ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ হিসেবে পরিচিত। তপন সিংহ পরিচালিত, ধীরেশ চক্রব্রর্তী প্রযোজিত এই সিনেমাটি ১৯৮০ সালে মুক্তি পায়। উভয় ক্ষেত্রেই মূল চরিত্র পঁচানব্বই বছরের থুথুড়ে চাষী বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম কাপালি তথা মনোজ মিত্র অভিনয় করেন।

চিত্রনাট্যের সংযোজন-বিয়োজন

সাজানো বাগান নাটকের সূচনা হয় অথর্ব বৃদ্ধ বাঞ্ছারামের রোগগ্রস্ত পর্যায় দিয়ে। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার সূচনা হয় কর্মক্ষম বাঞ্ছারামকে নিয়ে। নাটকের সূচনায় দেখা যায় গ্রামীণ জমিদার ছকড়ি দও পরলোকগত হয়ে প্রেতাত্মা স্বরূপ বাগানবাসী। কিন্তু সিনেমায় জমিদারের জীবিতাবস্থা থেকে তার ভূতত্বপ্রাপ্তি সমগ্র ঘটনাই দেখানো হয়েছে। সমগ্র নাটকের কাহিনির সঙ্গে সাদৃশ্যতা রেখে পরিচালক তপন সিংহ তার সিনেমার চিত্রনাট্যে বেশকিছু সংযোজন ও পরিবর্ধন করেছেন।

‘সাজানো বাগানে’ দেখা যায় বার্ধক্যভারাক্রান্ত বাঞ্ছা তখন রোগজ্বালায় জর্জরিত হয়ে ঘরের দাওয়ায়  শয্যাসীন। পরলোকগত গ্রামের জমিদার ছকড়ি দত্তের প্রেতাত্মা বাগান করতলগত করার জন্য মৃত্যুর পর সেখানে আশ্রয় নেয়। গ্রামের বর্তমান জমিদার ছকড়ির পুত্র নকড়ি দত্তেরও নজর পড়ে বাঞ্ছার বাগানের দিকে। অপরদিকে বাঞ্ছার নাতি গুপি চায় বাগান হস্তগত করে ভাটিখানার ব্যবসা করতে। নিজ উদ্দেশ্য সাধনে জমিদারবাবু বাঞ্ছার সঙ্গে মাসিক দুশো টাকার ভিত্তিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী বাঞ্ছার জীবিতাবস্থায় বাগানের রক্ষণাবেক্ষনের দায়ভার নকড়ির এবং তার মৃত্যুর পর বাগান জমিদারের হস্তগত হবে। কিন্তু দেখা যায় যে, আশি উক্তীর্ণ বৃদ্ধের শারীরিক অক্ষমতা  থাকা সত্ত্বেও তার হৃদ্‌যন্ত্র সতেজ এবং সচল। ফলত জমিদারের আশায় ছাই দিয়ে গঙ্গাপ্রাপ্তির পরিবর্তে ‘বাঁচবো...আমি বাচবো’ এই ধারাবাহিক জীবনতৃষ্ণা বাঞ্ছা জীবিত রাখে।

‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার সূচনা হয় বাঞ্ছারামের যৌবনোত্তর দশা থেকে। এখানে সে   নাতি গুপিকে নিয়ে বাগান পরিচর্যায় নিমগ্ন। অপর দিকে গ্রামীণ জমিদার গ্রাম পরিভ্রমণকালে বাঞ্ছার বাগানে উপস্থিত হয়ে, বাগান দখলের ইচ্ছাপ্রকাশ করে। কিন্তু এক সাহেব শাসকের  তৎপড়তায় বাঞ্ছা তার বাগান ফিরে পায়। অপমানে জমিদার ছকড়ি দত্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে  মারা যান বাঞ্ছার বাগান করতলগত করার প্রবল তৃষ্ণার দরুন জমিদারের অতৃপ্ত আত্মা আজ  বাঞ্ছার বাগানের অধিবাসী। বর্তমান জমিদার নকড়ি দত্ত সুকৌশলে বাঞ্ছাকে চুক্তিবদ্ধ করলেও তার উদ্দেশ্য সফল হয় না। ‘পুইমাঁচা’ গল্পের পুঁই গাছের মতন ধীরে ধীরে বাঞ্ছা নবযৌবন লাভ করে। ছকড়ি ও নকড়ি—পিতা-পুত্রের দ্বৈতভূমিকা সিনেমায় দেখা যায়। ছকড়ি আবার দুই রূপে উপস্থিত--জীবিত জমিদার ছকড়ি এবং প্রেতাত্মা ছকড়ি। বর্তমান জমিদারও দুই রূপে বিদ্যমান—যুবক এবং প্রৌঢ় তাই বলা যায় মূল নাটকের কাহিনি সিনেমায় অক্ষুণ্ণ থাকলেও বিষয়ের উপস্থাপনায় পরিচালকের স্বাক্ষর লক্ষ্য করা যায়।

চরিত্র সংযোজন-বিয়োজন

দুটি দৃশ্যে বিভক্ত ‘সাজানো বাগান’ নাটকটির ঘটনাক্রম মূল চরিত্রের জীবনের নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে শুরু হয়ে তার জীবনসংগ্রামের বৃত্তে এসে সমাপ্ত হওয়ায়; নাটকে চরিত্র সংখ্যাও সীমাবদ্ধ। যদিও এক্ষেত্রে সময়সীমার পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কিন্তু ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমায় নাটকের কাহিনি অক্ষুণ্ণভাবে পরিবেশিত হলেও সময়সীমার ব্যাপ্তি এবং মাধ্যমের রূপান্তরভবনের জন্য চিত্রনাট্যের সংযোজন ও পরিবর্ধন লক্ষ্য করা যায়। নাটকের চরিত্রলিপি প্রেতাত্মা ছকড়ি দত্ত, নকড়ি দও, বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম কাপালি, গুপি, মোক্তার, গোবিন্দ ডাক্তার, হোঁৎকা-কোৎকা, চোর, গণৎকার, পুরোহিত, জনৈক গোবিন্দ, শববাহক যুবকেরা, পদ্ম, নকড়ি-গিন্নি প্রমুখের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সিনেমায় পরিবর্ধিত কাহিনির পরিপূরক হিসেবে বেশ কিছু নতুন চরিত্রের সমাবেশ ঘটছে। গুপির স্ত্রী পদ্ম এখানে চুমকি নামে পরিচিতসিনেমায় চুমকির পিতা সহ গুপির পিতার বর্তমান পরিবারের ঘটনাক্রম উপস্থাপিত হওয়ায় সেই সকল চরিত্রেরও পাশাপাশি বাইজী, জমিদার-নায়েব ইত্যাদি চরিত্র সংযোজিত হয়েছে।

সংলাপের সংযোজন ও বিয়োজন

মূল নাটকের সঙ্গে সিনেমার চরিত্রসংখ্যার পার্থক্যের জন্য, ‘বাঞ্ছারামের বাগানে’ চরিত্রমাফিক সংলাপের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বাঞ্ছার শারীরিক পর্যবেক্ষণকালে (ডাক্তার গোবিন্দ ও নকড়ি দত্তের কথপোকথন অংশে) মূল নাটকের থেকে সিনেমায় ব্যবহৃত সংলাপ ভিন্নভাবে পরিবেশিত হয়;

“ডাক্তার।। (বাঞ্ছার নাড়ী পরিক্ষাকালে) ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ

নকড়ি দত্ত।। কবে হবে বিলীন!

ডাক্তার।। নাই বেশি দিন...’’

এছাড়া নাটকে চরিত্রদের কথপোকথনে বেশ কিছু স্ল্যাঙের উল্লেখ ঘটলেও সিনেমার চিত্রনাট্যে সম্ভবত নান্দনিকতার কারণে পরিচালক এর ব্যবহার করেননি

উপসংহার

বিষয়গত ভাবে সাদৃশ্যগত দুটি শিল্পমাধ্যম তাদের পদ্ধতি ও মাধ্যমের কারণে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাই ‘সাজানো বাগান’ ও ‘বাঞ্ছারামের বাগানে’র মূলগত পার্থক্য থেকেই যায়।  যার ভিত্তিতে মূল নাটক অপেক্ষা সিনেমাটি জনমানসে সর্বগ্রাহ্য হলেও, ‘সাজানো বাগানে’র গুরুত্ব অপরিসীম। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন নাটকের মাধ্যমে লোকশিক্ষা হয়। মনোজ মিত্রের লেখনীতে   মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত-কৃষক-শ্রমিক প্রতিটি চরিত্রই মূর্ত হয়ে ওঠে। তাই কোনোরকম রাজনৈতিক আনুগত্য ছাড়াই শ্রেণিসংগ্রাম-চরিত রচনায় বহমান তাঁর কলম। ‘সাজানো বাগান’এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ধনী-গরীব চিরায়িত শ্রেণি সংগ্রাম থেকে শুরু করে সামতান্ত্রিক ধারার প্রভাবও ও চোখে পড়ে। থিয়েটারে বাঞ্ছারাম কাগজে কলমে একটি বাগানের মালিক হলেও তার পায়ের নীচে মাটির পরিবর্তে মঞ্চের কাঠের পাটাতন ছিলসিনেমায় সে একটি যথার্থ বাগান পেল,যা কেবলমাত্র অনুভূতিগ্রাহ্য বা শ্রুতিগ্রাহ্য নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। গাছপালা, পাখি, আকাশ, সূর্য, তারা----এই সব কিছুই নাটকে মঞ্চের নেপথ্যে অভিনেতা ও দর্শকের কল্পনায় উপস্থিত না থাকলেও শিল্পীর শিল্পত্বে তা বাস্তবিক জগতে সামিল হয়তাই সমগ্র আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমার পরিবর্তে অধিক সমাদৃত। প্রখ্যাত সমালোচক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেন, “... দেশকালের সীমান্ত উত্তীর্ণ এই নাটক যে কোন স্বাজাত্য অভিমানীকে গর্বিত করে তুলবে...লোভ, বেঁচে থাকার ইচ্ছে, স্বার্থ ভালোবাসা—সব নিয়ে রামায়ণ-মহাভারত-টলস্টয়ের স্টাইলে এমন লুডো খেলা আর দেখিনি।’’ ( দ্র. অমৃতবাজার পত্রিকা, এপ্রিল ৭ ’৭৮)।

গ্রন্থপঞ্জিঃ বাংলাগ্রন্থ

১। মনোজ মিত্র‘সাজানো বাগান’ ৩য় সংকলকাতা, কলাভৃৎ, ২০১৫।

২। মনোজ মিত্র। ‘বাঞ্ছারাম : থিয়েটারে সিনেমায়’ কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ, ২০০০।

৩। আশুতোষ ভট্টাচার্য্য। ‘বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস’ ২য় সং ২য় খণ্ড। কলকাতা, এ মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং, ১৯৬০

৪। পূর্ণেন্দু পত্রী। ‘সিনেমা সংক্রান্ত’। ২য় সং। কলকাতা, দে’জ, ২০১৬।

৫। ধীমান দাশগুপ্ত। ‘সিনেমার ভাষা’। ১ম সং। কলকাতা, দে’জ, ১৯৯১।

৬। কুন্তল চট্টোপাধ্যায়। ‘সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। ৫ম পরিমার্জিত ও ২য় পরিবর্ধিত সং। কলকাতা, রত্নাবলী, ২০১৫।

সহায়ক ওয়েবসাইট

১। http://en.m.wikipedia.org/wiki/Monoj_Mitra.

২। http://indiancine.ma/UNQ/info

৩। http://en.m.wikipedia.org/wiki/Tapan_Sinha

সহায়ক সংবাদপত্র

১।‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২৭ এপ্রিল, ২০১৩, রবিবাসরীয় সং, পৃ ২

২। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ১১ অক্টোবর, ২০১৫, রবিবাসরীয় সং, পৃ ৪

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছবি : ৯ম পর্ব

(এবার আর বছর ধরে নয়; আলোচনা করব ছবির বিষয়বস্তু ধরে। সম্পর্কের ছবি।) 

 


সঞ্জু

২০১৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে সফলতম ছবি রাজকুমার হিরাণী পরিচালিত স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী যুগল সুনীল দত্ত-নার্গিসের (রূপায়নে পরেশ রাওয়াল-মনীষা কৈরালা) অভিনেতা-পুত্র সঞ্জয় দত্তের (রূপায়নে রণবীর কাপুর) জীবন নিয়ে ছবি সঞ্জু । সম্ভবত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার অপরাধেই এই ছবিটির ওপর প্রবলভাবে কুপিত হন দুটি গোষ্ঠীঃ প্রধানত যারা নিজেদের ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ আখ্যা দিয়ে চরম আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, সেই সাংবাদিককুল; এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রের একটি স্বীকারোক্তির পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদী সমাজ। এক এক করে দুই গোষ্ঠীর ছবিটির ওপর আক্রমণ নিয়ে কথা হোক।

সাংবাদিকতাকে গণতন্ত্রের পক্ষে অপরিহার্য মনে করা হয় মূলত তিনটি কাজের জন্যঃ

১। ক্ষমতাসীনদের নিজেদের ক্রিয়াকর্মের জন্য জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা।

২। জনসাধারণের কাছে সঠিক তথ্য পরিবেশন করে তাদের বিষয় ও ব্যক্তিসমূহের সম্বন্ধে ন্যায্য মতামত গঠনে সহায়তা করা।

৩। এইভাবে সঠিক জনমত গঠনে সাহায্য করা।

সঞ্জয় দত্তের ক্ষেত্রে ২ এবং ৩ – এই দুই ক্ষেত্রেই সাংবাদিককুল নির্লজ্জ দ্বিচারিতার পরিচয় দেয়। এই দ্বিচারিতার অস্ত্র একটি জিজ্ঞাসা চিহ্নঃ ‘সঞ্জয় দত্ত টেররিস্ট?’; ‘সঞ্জয় দত্তের বাড়ির বাইরে আর-ডী-এক্স ঠাসা লরি?’ যাতে সঞ্জয় বা তার বাবা আদালতে গেলে সংবাদপত্রের মালিক অম্লানবদনে বলতে পারে, “কই, আমরা তো কোন মিথ্যা বলিনি! আমরা শুধু প্রশ্ন রেখেছি, সন্দেহ ব্যক্ত করেছি মাত্র!” এমনকি, আদালত যখন দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে, “সঞ্জয় দত্ত, আদালত মনে করে না তুমি আতঙ্কবাদী,” সে খবর পরদিন কোন খবরের কাগজ ছাপে না। বরং ফলাও করে প্রচার করে, “টাডা (TADA) ধারায় সঞ্জয় দত্তের ছ’’বছর কারাবাসের নির্দেশ,” বেআইনিভাবে বাড়িতে এ-কে ৪৭ বন্দুক রাখার জন্য। এই অস্ত্রটি সঞ্জয় নির্বোধের মতো জোগাড় করেছিল যখন ফোনে তাকে শাসানি দেওয়া হয় যে ১৯৯২-এর দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের, যাদের অনেকেই মুসলমান, তার বাবা সাহায্য করেছেন, অতএব তাঁর মুসলমান-প্রীতির শাস্তিরূপে তাঁকে হত্যা করা হবে! এরপর সুনীল দত্তের ওপর দুবার হামলা হয়, এবং বাবার জন্য পুলিশী রক্ষার আবেদন করেও সঞ্জয় বিফল হয়।

‘সঞ্জয় দত্তের বাড়ির বাইরে আর-ডী-এক্স ঠাসা লরি?’ আদতে এটি ছিল ১৯৯২-এ দাঙ্গায় আক্রান্তদের জন্য  ত্রাণসামগ্রী ঠাসা সুনীল দত্তের লরি, যে খবর ছাপার ফলে সঞ্জয়ের প্রাণের বন্ধু কমলেশ (অভিনয়ে ভিকি  কৌশল) অবধি সঞ্জয়কে আতঙ্কবাদী ঠাওরে বসে! প্রথম জীবনে সঞ্জয় গুরুতরভাবে মাদকাসক্ত ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেবন করা যে কোন মাদককে টেক্কা দিতে পারে রোজ সকালে আমাদের সদর দরজার তলা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসা মানসিক মাদক – দৈনিক সংবাদপত্র!

সঠিক তথ্য পরিবেশন এবং যথার্থ জনমত গঠনের চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের অনেক বেশী পছন্দ ‘রসালো’ খবর তৈরি করে জনমন বিনোদন এবং মাঝে মঝেই জনমানসে ‘পবিত্র ক্রোধ’ উদ্রেক করা। আর নারীবাদীরা ‘সঞ্জয়ের বহুগামিতার আস্ফালন’ বলে যে দৃশ্য নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করেছে, তাতে মহিলা সাংবাদিকের (অভিনয়ে অনুষ্কা শর্মা) প্রশ্নের – “তুমি ক’জন মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছ? বৌয়ের (মান্যতা দত্ত, অভিনয়ে দিয়া মির্জা) দিকে নয়, আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি বলো!” উত্তরে সঞ্জয় প্রথমে জানতে চায়, সংখ্যাটি থেকে দেহোপজীবনীদের সে বাদ দেবে কিনা! তারপর একটু ভেবে বলে, “হিসেবে  ৩০৮ আসছে, সে যাক গে, ধরুন ৩৫০!” কোন আস্ফালন নয়, স্পষ্ট প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর।

এক মর্মস্পর্শী ছবি, যাতে চিত্রিত হয়েছে বাবা-ছেলে (সুনীল ও সঞ্জয় দত্ত) এবং দুই বন্ধুর (সঞ্জয় এবং কমলেশ) পারস্পরিক ভালবাসার অনবদ্য কাহিনি। অতএব ছবিটি নারীবাদী শিবির থেকে ‘পুরুষকেন্দ্রিকতা-দোষে দুষ্ট’!

 


বাধাই হো

আরেকটি হৃদয়গ্রাহী ছবি বাণিজ্যের হিসেবে এই বছরের নবম সফলতম অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মা পরিচালিত বাধাই হো । মধ্যবয়স্ক রেলকর্মী জীতেন্দ্র কৌশিক (অভিনয়ে গজরাজ রাও) এবং তাঁর গৃহবধু স্ত্রী প্রিয়ম্বদা  (অভিনয়ে নীনা গুপ্তা) দুই পুত্রসন্তান নকুল (অভিনয়ে আয়ুষ্মান খুরানা) আর গুল্লার (শার্দূল রানা) এবং জীতেন্দ্রের বৃদ্ধা মা দুর্গা (সুরেখা সিকরী) কে নিয়ে সংসার করেন। এক বর্ষার রাতে, রাতের আহারের সময় শাশুড়ির হাতে স্ত্রীকে যথারীতি হেনস্থা হতে দেখার পর নিজেদের শোবার ঘরে নিজের সদ্য-প্রকাশিত  কবিতা পড়ে শোনাতে-শোনাতে ‘জিতু’ এবং ‘বাবলি’ ঘনিষ্ঠ হয়। ১৯ হপ্তা পরে বাবলি-প্রিয়ম্বদা জানতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা। ফলে ছেলেদের এবং শাশুড়ির কাছ থেকে স্বামী-স্ত্রীর জোটে তিরস্কার আর আত্মীয়  মহলে কদর্য ব্যঙ্গ। এমনকি নকুল বাবা-মার এই ‘কীর্তি’-র ফলে নিজের বান্ধবী রেনের (সানিয়া মালহোত্রা) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে ব্যর্থ হয়। রেনে কিন্তু নকুলের এই মনোভাব সমর্থন করে না। ইস্কুলে এক সহপাঠী বাবা-মাকে ব্যঙ্গ করলে গুল্লার তার প্রতিবাদ করে প্রহৃত হয়। ইতিমধ্যে রেনের মা সঙ্গীতাও (শীবা চাড্ডা) নকুলের পরিবার সম্বন্ধে বক্রোক্তি করলে নকুল তার সমুচিত জবাব দেয়। এক জ্ঞাতির বিবাহ-অনুষ্ঠানে বাবলির বড় জা এবং তার বোন বাবলিকে কুৎসিত ভাবে অপমান করলে অপ্রত্যাশিতভাবে কর্তব্যপরায়ণা পুত্রবধূর পক্ষালম্বন করে সবাইকে ঝেড়ে কাপড় পরান শাশুড়ি দুর্গা!

বাড়ি ফিরে নকুল ভাই গুল্লারের সঙ্গে তার ইস্কুলে যায়, যেখানে গুল্লার যে তার গায়ে হাত তুলেছিল তাকে তিনটি চপেটাঘাত করে। নকুল ঠিক যেমন ভাবে বান্ধবীর মাকে জবাব দিয়েছিল, সেইভাবে নিজের ব্যঙ্গকারী বন্ধুদেরও চুপ করিয়ে দেয়।

মধুরেণ সমাপয়েত হয় বাবলির কথায় নকুল রেনের সঙ্গে সম্পর্কের জোড়া লাগাতে এবং, সর্বোপরি বাবলি যখন এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়।

সবদিক দিয়ে প্রশংসনীয় ছবি, প্রত্যেকের অভিনয় নিখুঁত, বিশেষ করে অন্যান্য ছবিতে মূলত পার্শ্বচরিত্রে থাকা গজরাজ রাওয়ের। আয়ুষ্মান খুরানা প্রায়শই ব্যতিক্রমী এবং বিতর্কিত চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন, যদিও সাধারণত তাঁর অভিনীত চরিত্রের মতবাদ ও আচরণের পক্ষেই নির্মাতারা দর্শককে থাকতে বলেন। এখানে প্রথম দিকে তাঁর নকুল কিন্তু সমর্থনযোগ্য নয়, যে কথা বান্ধবী রেনেও বলছে। পরে সে নিজেকে শোধরায়।

 


সোনু কে টিটু কী সুইটি

কিছু ছবি মূলত তাদের শীর্ষবিন্দুর গুণে মনে স্থান করে নেয়। ২০১৮-তে সফলতার হিসেবে ঊনবিংশতম (১০০ কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করা) এবং লাভ রঞ্জন পরিচালিত এই ছবিটি এক উদাহরণ। সোনু (কার্ত্তিক আরিয়ান) আর টিটু (সানি সিং) বাল্যকাল থেকে প্রাণের বন্ধু। টিটু স্বভাবে একটি প্রকৃষ্ট simp যে একের পর এক বিষাক্ত মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নির্যাতিত হয়। প্রত্যেকবার তাকে সেই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে আনে সোনু। ছবির শুরুতেই টিটু ‘পিহু’-নাম্নী এক রমণীর (ঈশিতা রাজ) কাছে ঝাঁটা খেয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে বসেছে। নিজের দোকানের চাবি অবধি টিটু পিহুকে দিয়ে রেখেছে, কিন্তু পিহুর ফোনে যে ‘টিন্ডার’ অ্যাকাউন্ট আছে, টিটু তা দেখে ফেলার অপরাধের জন্য পিহু টিটুর মাথা হাতে কাটছে। সোনু এবার চরম প্রস্তাব দেয় টিটুকেঃ “বেছে নে – হয় আমি নয় পিহু।” নিজের ভালো আপাতত বুঝতে পেরে টিটু পিহুকে জবাব দেয়।

এরপর টিটু নিজে এবং তার পরিবার ইচ্ছাপ্রকাশ করে তাকে পাত্রীস্থ করতে। ক্ষেপে গিয়ে সোনু টিটুকে বলে, “কাপড় ধোবার জন্য মেশিন আছে, রান্নার মাসী আছে, বাকি শুধু একটি জিনিস!” টিটু হাঁউমাঁউ করে বলে যে সে ‘সেক্স’-এর জন্য বিয়ে চাইছে না! তবে বিয়ে করা কেন, প্রশ্ন করে সোনু। টিটু বলে সে চায় কেউ তার পাশে থাকুক, তার যত্ন করুক। সোনু অতীতের ঘটনা ধরে ধরে প্রমাণ করে যে বারবার এই কাজ টিটুর জন্য করেছে!

যাইহোক, ‘সুইটি’ নামে এক আপাত-নিখুঁত মেয়ের (নুসরত ভারুচা) সঙ্গে টিটুর সম্বন্ধ পাকা হয়। সন্দিগ্ধ সোনুকে আশীর্বাদের দিন সুইটি একান্তে জানায়, “তুমি ঠিক ধরেছ! আমি নায়িকা নই, খলনায়িকা! টিটুর জীবন থেকে তোমাকে দূর করবই!”

শুরু হয় সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। সুইটি নারীসুলভ চাল খেলে টিটুকে প্রাক-বিবাহ যৌন সম্পর্কে টানে, এবং তজ্জনিত টিটুর অপরাধবোধ উদারত্বের ভড়ং করে ‘ক্ষমা’ করে। সোনু পিহুকে উপস্থিত করে টিটু-সুইটির সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে চায়, কিন্তু সুইটি টিটুর সামনে পিহুকে স্বপক্ষে টেনে এনে তা ব্যর্থ করে। এরপর সুইটি সোনুকে বলে, “বন্ধু আর মেয়ের প্রতিযোগিতা হলে ‘হামেশা’ মেয়েরই জিৎ হয়!”

মালাবদলের মুহূর্তে সোনু সেই পিহুর সময়ে যা বলেছিল, তাইই টিটুকে বলেঃ “আমাদের মধ্যে কে ঠিক, কে ভুল ভুলে যা। এখন একজনকে বেছে নেঃ ওকে নয় আমাকে!” সোনুর চোখে জল দর্শক এই প্রথম দেখে, আর সে বিয়ের মণ্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ স্থানুর মতো চুপ থেকে টিটু সুইটিকে বলে, “১৩ বছর বয়সে সোনু নিজের মা’কে হারায়। তারপর তিনদিন আমি তাকে কাছছাড়া করিনি, কারণ সে কাঁদছিল না। অবশেষে যখন তার চোখ থেকে জল পড়ে, আমি তাকে জড়িয়ে ধরে দরজা বন্ধ করে দিই, যাতে আর কেউ না এসে পড়ে। সেদিনের পর আজ অবধি সোনুর চোখে আমি জল দেখিনি।” সুইটির পরানো মালা গলা থেকে খুলে ফেলে টিটু বন্ধুর অনুসরণ করে।

বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরক সোনুর সঙ্গে তুলনা টেনেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ রচিত মায়ামৃদঙ্গ উপন্যাসের চরিত্র সুবর্ণের। সুধার ছলনায় সনাতন যখন সাময়িকভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে সুবর্ণকে ত্যাগ করার উপক্রম করে, তখন সুবর্ণের যন্ত্রণার সঙ্গে সোনুর চোখের জল কি এক নয়?

ছবির শেষে আমরা দেখি সোনু, টিটু, টিটুর ধনবান ঠাকুরদা ঘসিটারাম (অলোকনাথ) আর তাঁর অনুগত লালুকাকা (বীরেন্দ্র সাক্সেনা) হাঁটু অবধি কাপড় তুলে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে সোনুর সম্ভাব্য বিয়ের কথা নিয়ে হাসাহাসি করছে।

ত্রিকোণ প্রেমের ছবি, যার কেন্দ্রে সোনু আর টিটু, আর তাদের মধ্যে এসে পড়ছে কোন নারী – পিহু বা সুইটি। তাদের কাছ থেকে ভালোবাসার জনকে ছাড়িয়ে আনছে সোনু।

বিষমতা প্রবল শক্তিসম্পন্ন হতে পারে, কিন্তু ‘হামেশা’ তার জিৎ হয় না। এর পরের পর্বে এলজিবিটি বিষয়ক ছবিসমূহ নিয়ে আলোচনার পূর্বসূরি এই সনু কে টিটু কী সুইটি

 


ছিছোরে

শিরোনামের অন্যতম অর্থ হতে পারে ‘ছেঁদো’। ২০১৯-এর এই অসাধারণ ছবির কাহিনি আবর্তিত হচ্ছে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘরে। বিবাহবিচ্ছিন্ন মধ্যবয়স্ক অনি (অনিরুদ্ধ পাঠক, অভিনয়ে অকালপ্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুত) থাকে তার কিশোর ছেলে রাঘবকে (অভিনয়ে মহম্মদ সামাদ) নিয়ে। রাঘব দিনরাত এক করে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য পড়েছে, তার অনুক্ষণের চিন্তা, তাকে সফল হতেই হবে, নইলে কপালে জুটবে loser বা ‘ছেঁদো’ অভিধা, যা সে কিছুতেই মেনে নিতে রাজী নয়। বন্ধুর বহুতলের ফ্ল্যাটে সে যখন জানতে পারে যে সে তার অক্লান্ত পরিশ্রম সত্বেও অকৃতকার্য হয়েছে, সে বহুতলের বারান্দা থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার শুরুতে তার বিবাহবিচ্ছিন্না মা মায়া (শ্রদ্ধা কাপুর) দায় পুরোপুরি ঠেলে দেয় নিজের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ স্বামীর দিকে। অনিকে ছেলের অভিভাকত্বের অধিকার দেওয়াই নাকি মায়ার ভুল হয়েছিল! (প্রশ্ন জাগে কেন মায়া ছেলের দায়িত্ব নেয়নি, যেখানে নাবালিকা তো বটেই, নাবলক হলেও আদালত অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর অভিভাবকত্ব মাকেই দিয়ে থাকে?) হতভাগ্য বাবাকে ডাক্তার (শিশির শর্মা) জানান যে অনেকে এইরকম মারাত্মক জখমের পরও বেঁচে ফেরে শুধু তাদের অন্তরে বেঁচে থাকার যে প্রবল ইচ্ছে, তার তাগিদে। কিন্তু রাঘব বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলেছে।

অনি তখন আপাত-সংজ্ঞাহীন ছেলের কানের কাছে অনির নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার কাহিনি বলা শুরু করে – যেখানে অনি এবং তার পাঁচ সহপাঠীকে সারা কলেজে loser আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, এবং কীভাবে সেই ছ’জন এই অপবাদ কাটিয়ে উঠেছিল। মায়া এই প্রচেষ্টার প্রতি অবজ্ঞা ও বৈরিতা ব্যক্ত করে।

আশ্চর্যভাবে ডাক্তার দেখেন যে রাঘবের জ্ঞান ফিরেছে এবং সে বাবা ও তার বন্ধুদের উত্তরণের আখ্যান শুনতে চাইছে!

বাবার ডাকে সুদূর বিদেশ থেকে হাসপাতালে এসে হাজির হয় এক বন্ধু গুরমিত (ডাকনাম ‘সেক্সা’, অভিনয়ে বরুণ শর্মা)), এবং তারপর বাকী চারজনও। সবাই রাঘবের বিছানার চারদিকে বসে তাকে বলে নিজেদের কলেজজীবনে কীভাবে তারা পরাজিতের তকমা সফলভাবে বর্জন করতে পেরেছিল।

মজার কথা যে তারা, কলেজের চার নম্বর হস্টেলের ‘হেরোর’ দল, প্রবল প্রতাপান্বিত তিন নম্বর হস্টেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে ‘জি সি’ বা ‘জেনারেল চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ প্রথম হওয়ার জন্য। ছলে-বলে-কৌশলে চার নম্বর এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছোয় যেখানে তিনটি খেলায় তাদের সোনা জিতলেই তারা ‘চ্যাম্পিয়ন’ আখ্যা পাবে। দাবা আর দৌড়ে তারা জিতলেও বাস্কেটবলে স্বয়ং অনি শেষ মুহূর্তে বলকে নেটে ফেলতে ব্যর্থ হয়। বিমূঢ় রাঘব ছ’জনকে প্রশ্ন করে, “এত চেষ্টার পরেও হেরে গেলেন? আপনাদের মরে যেতে ইচ্ছে হয়নি?” অনি, এবং তার পরে বাকী পাঁচজন হেসে উত্তর দেয়, “একেবারেই নয়।” কৃতিত্ব আছে সাফল্যে নয়, সাফল্যলাভের চেষ্টায়, যে চেষ্টায় রাঘবের বিন্দুমাত্র ত্রুটি ছিল না! এবার রাঘব মস্তিষ্কে শেষ অস্ত্রোপচারের সম্মুখীন হোক loser নয়, fighter-এর মতো। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে রাঘব অপারেশন থিয়েটারে ঢোকে, বেঁচে ফেরে, আর পরের বছর কলেজে ভর্তি হয়। ইতিমধ্যে সন্তানের দায়িত্ব-এড়ানো মায়া স্বামীর ‘চিকিৎসা’-র কার্যকারিতা দেখে অশ্রুসজল নেত্রে অনিকে ‘অসাধারণ পিতা’-র স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

আরেকটি মজার কথা। তিন নম্বর হস্টেলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করার পর এক সময় অনি সকলকে বলে যে তাদের প্রত্যেককে, সাফল্যলাভের জন্য কৃচ্ছসাধন হিসেবে, কিছুদিনের জন্য নিজেদের যা অপরিহার্য মনে হয়, এমন কোন এক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনি নিজে প্রেমিকা মায়ার সঙ্গে প্রেমালাপ তো দূরের কথা, কথা বলাই বন্ধ রাখবে। নবীন (অ্যাসিড, অভিনয়ে নবীন পোলিশেঠী) কথায় কথায় অশ্রাব্য গালিগালাজ দেবে না; সুন্দর (মম্যি, অভিনয়ে তুষার পাণ্ডে), যে রোজ মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা না বলে থাকতে পারে না, সে মার সঙ্গে ফোনাফোনি করবে না; ডেরেক (তাহির রাজ ভাসিন) সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবে; সাহিল (বেওড়া, অভিনয়ে সহর্ষ কুমার শুক্লা) মদ্যপান থেকে বিরত থাকবে; আর গুরমিত (সেক্সা) পর্নোগ্রাফিক পত্রিকার ছবি দেখে হস্তমৈথুন করা থেকে নিজেকে সংযত করবে। অর্থাৎ সমতুল্যতার নিরিখে গালাগালি দেওয়া, মদ্যপ হওয়া, ধূমপান করা এবং হস্তমৈথুন করা হলো মা বা প্রেমিকার সঙ্গে বাক্যালাপের সমান!

(ক্রমশ)


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি... সমাজের বাইরের অভিনেত্রী বিনোদ ও বিনোদিনীরা

 


প্রতি

থিয়েটারের দর্শক

সমাজ কী? কে বানায়? কারা সমাজ? সমাজের বাইরের কারা? সমাজের বাইরে থাকলে তাঁদের দিয়ে সমাজের  কোনও কাজ কি করানো যায়? যদি যায় তাহলে তাঁদের কাজকে কী বলা হবে, সমাজের কাজ নাকি বাইরের? এই প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল নটীদের সমাজ? বা, সেই সীমায় আবদ্ধ ছিল না নটী তথা অভিনেত্রীদের সমাজ তাহলে কেন? সেটাই বিস্ময়! আর সেটাই আলোচনারও।

বারো বছরের বিনোদিনী, মলিন ফ্রক পরা ছোট্ট মেয়েটির সামাজিক অবস্থান নিয়ে কক্ষনও প্রশ্নই উঠত না, যদি না মেয়েটি বিনোদিনী নামের এক অভিনেত্রী হয়ে উঠত। হ্যাঁ, বিনোদিনীর সেই সমাজে কারা ছিলেন, কাদের সঙ্গে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তাঁদের কোনও ছবি কোথাও পাওয়া যায়নি। কারণ! অনেক। সেদিন এক ছোট্ট মেয়ে বিনোদিনী গঙ্গামণি বাঈয়ের সূত্রে ভর্তি হয় গ্রেট ন্যাশনালে। মাইনে দশটাকা। ১৮৭৩ সালে দশটাকা মাইনে আজকের হিসেবে কত হতে পারে? অর্থাৎ, এও অনুমান করা যায় তখন নটীদের চাহিদা কিছু কম ছিল না। গঙ্গাবাঈ-এর নামও উঠে আসছে, সেই কারণও বিনোদিনীর হয়ে ওঠা। কেন, থিয়েটারে এসেছিলেন এই মেয়েটা, সেই কথা সবারই জানা।

বিনোদিনীর পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কথা এখন সকলেরই জানা। 'আমার কথা' বইতে বারবার লিখেছেন,  তিনি দারিদ্রের আন-কাট কথা সব লিখেছেন। লেখার মধ্যে দিয়েই যে ছবি ফুটে ওঠে, সেটাই আমাদের বিনোদিনীকে দেখার ছবি, যা আমরা, লিখিত আকারে তো পাই।

নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষমহাশয় অভিনেত্রীদের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, পূর্বোক্ত অভিনেত্রীদের প্রত্যেকের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাময়ী ছিলেন বিনোদিনী। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, অভিনয় কেমন করে করতে হয়, তা শিখতে হলে বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আর নেই।

'শ্রেষ্ঠ উদাহরণ' শব্দটাকে ধরলে প্রশ্ন ওঠে, কখনও সময়ের নিরিখে আবারও নতুন করে দেখা দেয় শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ 'হয়ে ওঠা' থেকে শুরু করে, সেই ধারা অব্যাহত রাখার কাজ। শ্রেষ্ঠ শব্দের অর্থ দিয়েই বিনোদিনীর কথা লেখা যায়। কারণ, এইসব কা জের কোনও প্রমাণ নেই, শুধু কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কথা ছাড়া। সেই বয়ানই ছবি, সেটাই তাঁর অভিনয়ের দলিলও বটে। আমাদের কাছে ছবি একটা বড় প্রমাণ। সেকালে ছবি তোলার চল আমাদের মুঠোফোনে সাঁটানো ক্যামেরার মতো ছিল না।

তাই, লেখাই ভরসা। সেই বিনোদিনীর শ্রেষ্ঠ শব্দের অর্থ এখানেই রাখা হল। এবারে সমাজের দিকে ফেরা যাক। কেননা, সমাজের জন্য থিয়েটার। থিয়েটারের তিনি অভিনেত্রী বিনোদ।

বিনোদিনীর প্রথম অভিনয় ১৮৭৪, ১২ ডিসেম্বর তারিখে। তাঁর লেখা আত্মজীবনী নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। সবচেয়ে পঠিত সম্পাদনী হল নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর। এক আলোচনায় নির্মাল্য আচার্য লিখেছেন যে, গিরিশচন্দ্র তাঁর পূর্বোল্লিখিত ভূমিকায় বিনোদিনীর 'চৈতন্যলীলা', 'বুদ্ধদেব', 'দক্ষযজ্ঞ', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ', 'বিবাহ বিভ্রাট' 'সধবার একাদশী', 'কপালকুণ্ডলা', 'হীরার ফুল', 'মৃণালিনী'তে দর্শকের মনকাড়া অভিনয় করেছেন। এসব আমাদের জানা। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দুর্গেশনন্দিনী', 'বিষবৃক্ষ' উপন্যাসে যথাক্রমে 'আয়েষা' ও 'তিলোত্তমা', 'কুন্দনন্দিনী' চরিত্রের অভিনয়েও মুগ্ধ হয়েছিলেন।

মনে রয়েছে বঙ্কিমের উক্তিও...  'মৃণালিনী' নাটকে মনোরমার চরিত্র দেখে। বলেছিলেন যে, "আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখনো যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই। আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল।"

সাল ১৮৭৭। অর্থাৎ, থিয়েটারে যোগ দেওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যে এই প্রশংসা পেয়েছিলেন। তবে, এখানেও কথাই, না এইসব অভিনয়ের কোনও ছবি নেই।

বিনোদিনী তখন বেঙ্গল থিয়েটারে। তখন তাঁর বয়স চোদ্দ-পনেরো বছর হবে। সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বঙ্কিমচন্দ্রের এহেন প্রশংসা-বাক্য কি সমাজের বাইরের, নাকি সমাজের? শুনেছি অভিনয়ের জোরেই বিনোদিনী এসেছিলেন বেঙ্গল থিয়েটার থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়-এর থিয়েটারে। এবং কত শংসাপত্র যে পাওয়ার ছিল বা ছবিতে ছবিতে ছাপিয়ে যাওয়ার ছিল বিনোদিনীর! কারণ, যে অভিনেত্রী একসঙ্গে 'মেঘনাদ বধ' নাটকে  সাতটি চরিত্র রূপায়ন করতে পারেন, তিনিই আগামীর বিনোদিনী। হ্যাঁ, তিনি চিত্রাঙ্গদা, প্রমীলা, বারুণী, রতি, মায়া, মহামায়া এবং সীতাও। তাঁর জন্যে কত না উপাধি! ‘ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ স্টেজ', 'প্রাইমা ডোনা অব দি বেঙ্গলি স্টেজ' বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছিল তাঁকে। আর বিনোদিনী যিনি এরপর স্টার থিয়েটারের ঘটনা, বির্তকে জড়িয়ে গেলেন! যা বিনোদিনীর কথায় "থিয়েটার ভালবাসিতাম, তাই কার্য করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম।"

নটী বিনোদিনী। মাত্র বারোবছর অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে তিনি স্টার বা নটী বিনোদিনী  বা এখনও পর্যন্ত তর্কে-বিতর্কের সবচেয়ে বেশি টিআরপি তোলা অভিনেত্রী। কিন্তু, কত সহজে যে তিনি তাঁর  কৃতিত্ব, সবচেয়ে ভালবাসার স্থান ছেড়ে চলে যেতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র এই সামাজিক ছলনার কারণে!

এখন প্রশ্ন ওঠে, যাঁদের সমাজের বাইরের বলা হচ্ছে, তাঁদের আবার কোন সমাজ? সমাজ মানে নটীদের হল অভিনয়ের সমাজ, যেখানে তাঁরা কাজ করেন। শুধু কি কাজ? সেখানে তাবৎ উৎসাহী, ভাবনায় এগিয়ে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ। অর্থাৎ, তাঁদের অভিভাবকত্বে নিজেদের গড়তে পারার সুযোগ। এবং সেখানে নট, অভিনেতার সঙ্গে নটীদের যোগ দেওয়া। কিন্তু এর কোনওটাই নতুন নয়। আমাদের দেশে সেই কবে থেকেই মেয়ে পুরুষে অ্যাক্ট করে। এর কোনওটাই 'মন্দ মেয়ে'-দের মঞ্চায়ন বলে নির্ণয় করা যায়? একদিকে সমাজের ঘরে থাকা চৌহদ্দিতে মেয়েরা, ভদ্র ঘরের মেয়েরা। অন্যদিকে, বিনোদিনীদের কোথায় ঘর ও অবস্থান? সমাজের বাইরে থেকে যাঁদের সমাজের কাজে লাগে, তাঁরাই তো নটী। এসব তথ্য তো বই থেকে পাই, চোখে দেখা নয়। কিন্তু চোখে পড়ে যায় আরেকটা বিষয়, যেখানে সমাজের ছবি দেখা যাচ্ছে এক প্রত্যক্ষদর্শীর।

উল্লেখের বিষয় যে, তখন থিয়েটার নিয়ে অনেক লেখা বের হত। তারই কিছু প্রতিবেদন দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা করার। আর সেজন্য ২০২৫ থেকে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে ১৫২ বছর আগে। সেইসময়  'সাধারণী' নামে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হত। তাতে উল্লিখিত তারিখ তথা ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১২৮৬ বঙ্গাব্দ-তে ছাপা প্রতিবেদনের অংশবিশেষ পড়ে চোখে সর্ষেফুল।

উক্তি বা প্রতিবেদন – “কী কুক্ষণে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বঙ্গের রঙ্গভূমিতে বারাঙ্গনা প্রবিষ্ট করিয়া গিয়াছেন অধঃপতিত বঙ্গসমাজে অতি সন্তপর্ণে ইজ্জত রাখিতে হয়... এই বিড়ম্বনায় গিরিশ, কেদার, অর্ধেন্দু, শত, নগেন্দ্র, যোগেন্দ্র মাটী হইয়া গেলেন।"

এখানে বিশেষ করে লক্ষ্য করার যে, কয়েকটি বিশিষ্ট নামী ব্যক্তি মাটি হয়ে গেলেন, লেখা রয়েছে। অর্থাৎ, এইভাবে কি ধরে নেব যে, মুষ্টিমেয় অনাম্নীদের ক্ষমতা এত বেশি? নিষ্ফলা তর্ক ছেড়ে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় কেউই যে মাটি হননি, মাটিতে মিশেও যাননি, তার পরিচয় বিলক্ষণ মেলে ইতিহাসের পাতায়।



এসব নাট্যালয়ের ইতিহাস পড়তে বসে মনে হচ্ছিল, নাট্যরঙ্গ বুঝি নাট্যেই শেষ হয় না, তার প্রবাহ নিরন্তর সমাজে। সেকালের নাট্য-ব্যক্তিত্বরা কেউই মাটি হননি বলেই আজও বিনোদিনীর কথা লেখা হচ্ছে। সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আলোচনা সভা হচ্ছে। আর এইসব কাজ হচ্ছে কোথায়? সমাজে। কোন সমাজে? সমাজ অনেকটা হাওয়ার মতো। যেখানে সবই রয়েছে, অনুভব করা গেলেও, চোখে দেখা যায় না। হ্যাঁ, কিছু বিস্তারিত তথ্য রয়েছে, যা একরকম ছবি, বা সামাজিক ছবি। আমাদের কাছে এক সমাজ রয়েছে। উদার উন্মুক্ত সেই সমাজের অন্তরাত্মা হলেন দর্শক। থিয়েটারের দর্শক। সমাজের দর্শক। আর লেখার ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যাবে পাঠক। সেই সমাজ কোনও ছোট জায়গায় নয়। সীমাবদ্ধ নয়। বিস্তার অপার সেই পাঠকের মতামত জানানোর স্থান বা স্পেস যতদূর পর্যন্ত যায়, ততদূরই আমাদের সমাজ।

ইতি

@একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী