বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

অচিন্ত্য দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩০


সময়

একে শীতের দেশ তার ওপর শীতকাল। উঠতে দেরি হয়ে গেছে, তা কী আর হবে। ঘরে তো একাই থাকি। কফি আর ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেলাম। জানালা দিয়ে দেখছিলাম কাল রাত্তিরে বেশ বরফ পড়েছে। পারা এখনও শূন্যের নিচেই আছে। এখানকার টিভি আর স্থানীয় রেডিওতে বারবার বলছে যে যাদের বয়স সত্তর পেরিয়েছে তারা যেন কটা দিন বাড়ির বাইরে না বেরোয়।

ধুত্তোর নিকুচি করেছে! ঘরে বসে থাকতে থাকতে হাতে পায়ে খিল ধরে গেল! বাইরে একটু হেঁটে আসি। হাতের কাছে যা গরমজামা পেলাম সব পরে নিলাম। আলমারি থেকে দস্তানাটা নিয়ে বেরোতে যাব, এমন সময় আয়নার কাচে পলকে দেখলাম কে একটা যেন ঘরে ঢুকেছে। লোকটা আবার কে রে বাবা… ওহ না… ওটা তো আমিই। সোয়েটার, কোট, মাফলার. টুপিতে নিজেকে ‘হলদে-সবুজ ওরাংওটাং’ মনে হচ্ছে। চিনতে পারিনি।

পাহাড়ি এলাকার মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা বেশ। দুপাশে ছোট বড় অনেক অনেক গাছ। কিছুক্ষণ বরফ পড়েনি তাই কাঁকুড়ে রাস্তার ওপর বরফ নেই, গলে গেছে। আশপাশের পাথরে, ঘাসে, গাছের পাতায়, আগাছায় তুষারের সজ্জা। বনপথ জনমানবহীন। এই বিচ্ছিরি হাত-পা জমানো কনকনে হিমেল সকালে কে আর বাইরে আসবে!

সব ঋতুর আলাদা আলাদা রূপ থাকে। সব বয়সের আলাদা আলাদা মন থাকে। চলতে চলতে মনে হলো আজকে এই দুটো কেমন যেন মিলে গেছে। আমি নিজেই যেন এই অদ্ভুত তুষারাচ্ছন্ন প্রকৃতির অংশ।

কতদূর যাব ঠিক করিনি। তবে কিছুদিন আগে এই রাস্তায় একটা ঝরনা দেখেছিলাম। চঞ্চলা কিশোরীর মত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেচে নেচে লঘুপায়ে নেমে আসা ঝরনা। কলকল ছলছল জলের শব্দটা ভারি ভালো লেগেছিল সেবার। ভাবলাম তাকেই একবার দেখে আসি, আর মাইল খানেক গেলেই হবে।

হাঁটছি। হালকা জঙ্গল একটু একটু করে ঘন অরণ্যের রূপ নিচ্ছে। পাথরের টিলাগুলো রাস্তার পাশে এসে পড়েছে বলে উঁচু লাগছে। এদিকটা স্প্রুস, সেডার এই ধরনের গাছ বেশি। এরা দেবদারু গাছের বর্ধিত সংস্করণ। আকারে দৈত্যের মতো, দেড়শো-দুশো ফুট গাছ হামেশাই দেখা যায়।

এই তো ঝরনার কাছে এসে পড়েছি – কই, জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে না তো। ওহ, আমিও যেমন! ঝরনা সামনেই, তার ধারাগুলো সব জমে বরফ। চেনা এক নারী যেন নীরব পাষাণ হয়ে পড়ে আছে অহল্যার মতো।

কটা বাজল? একি হাত ঘড়িটা তো চলছে না, এই তো একটু আগে সময় দেখলাম। ব্যাটারি ফুরোলো নাকি? ফোনও তো আনিনি।

দিনমণি গেছেন ঘনমেঘের আড়ালে। কত বেলা হয়েছে জানি না। নির্জন হিমশীতল অরণ্যে আমি একা, আমার সামনে অহল্যা। আর এক পশলা তুষারপাত শুরু হবে এক্ষুণি।

মনে হলো, ঘড়ি ঠিকই আছে, শুধু কাঁটা ঘুরছে না। সাদা ছাইমাখা সন্ন্যাসীদের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছ আর তুষারিত নির্ঝরিণীর সামনে নিসঃঙ্গ এই মানুষটিকে দেখে সময় নিজেই থমকে দাঁড়িয়েছে।

 

 

 

 

 

 

 


৩টি মন্তব্য: