বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

উপল মুখোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩০


বিটুদা

একসময়ে বিটুদা আর আমি দেওয়াল লিখতাম। দেওয়াল লিখতে লিখতে বিটুদা বলেছিল, “আগে রাতেই দেওয়াল লিখতাম।” আমি বললাম, “কেন দিনেরবেলায় সময় পেতে না?” এইসময় মানিকদা নাইট ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরতে গিয়ে সাইকেল থেকে নেমে এসে বলল, “কিস্যু হচ্ছে না। কিস্যু হচ্ছে না। দে দে আমাকে দে।” এই বলে মানিকদা দিনেরবেলা দেওয়াল লিখতে লাগল। বিটুদা আমাকে বুঝিয়েছিল মানিকদাও রাতেরবেলা দেওয়াল লিখত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এখন তো মানিকদা রাতে পাঁউরুটি কারখানায় কাজ করে?” বিটুদা পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেনি কেন রাতের বেলাটা একসময় দেওয়াল লেখার জন্য বেছে নেওয়া হতো। যাইহোক আমরা বরাবরই দিনেরবেলা দেওয়াল লিখে এসেছি। এই করতে করতে দিন গিয়ে রাতের বেলা আসে আর অনেক বছর পেরিয়ে আমরা বুড়ো হই। আমি আর বিটুদা। এখন রাতেরবেলা ঘুম এতো বেড়ে গেছে যে দিনের অনেকটা পরেও সারা গায়ে ব্যথা নিয়ে আমরা ঘুমতে থাকি। কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চায় না। বিটুদাকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি সকাল সকাল উঠতে পার?” ও বলল, “ধুস্ এই বুড়ো বয়েসে সকাল সকাল কে উঠবে!” আমি বলি, “গায়ে ব্যথা ব্যথা করে।” শুনে ও বলল, “আমারো।” আমি বললাম, “কী?” বিটুদা বলল, “ওই যে গায়ে ব্যথা।” দেখা যায় এরপর গায়ে ব্যথা নিয়েই আলোচনা হতে থাকে।

এইরকম অনেকদিন চলার পর যখন দিনেরবেলা দেওয়াল লেখা আর রাতেরবেলা দেওয়াল লেখার অতীত স্মৃতি প্রায় ভুলতে বসেছি। সেসময় একদিন বিটুদা এসে বলল, “চলে এসো।” আমি বললাম, “কোথায়?” বিটুদা বলল, “আজ সারারাত দেওয়াল লেখা হবে। মানিকদা থাকবে বলেছে।” আমি ভাবলাম ওর হলো কী! মানিকদা এই কিছুদিন আগে মারা গেল! তার স্মরণ সভা হলো! হ্যাঁ, সে তো বিটুদার বাড়িতেই! তাই আমি বললাম, “তোমার বাড়িতেই তো হলো।” বিটুদার যেন কিছুই মনে পড়ছে না। সে কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি আবার বললাম, “তোমার মনে পড়ছে না?” বিটুদা বলল, “স্মরণ সভার কথাই তো বলছিলে।” আমি বললাম, “একদমই তাই।” বিটুদা বলল, “তার সঙ্গে সারারাত দেওয়াল লেখার কী?” আমি মানিকদার মারা যাওয়ার কথা বলতে গিয়েও বলিনি। সব কিছুর কারণ খোঁজা ঠিক নয়। কারণ খুঁজেও পাওয়া যায় না।

সেদিন মানিকদা আর বিটুদার সঙ্গে আমিও ছিলাম রাতে। রাতে লিখে টিখে পরের দিন ঘুম থেকে উঠতে আরো দেরী হয়। সারা গা আরো ব্যথা করতে থাকে। বিছানায় পড়ে থেকে খালি ভাবতে থাকি। মৃত মানুষেরা যে দেওয়াল লিখতে পারে না, রাত জাগতে পারে না, একথা কে বলেছে? আর পারলে তাদের সারা গায়ে  ব্যথা ব্যথা হবে নাই বা কেন? নিজেদের গায়ের ব্যথা নিয়ে কথা না বলে, এটা নিয়ে বিকেলে বিটুদার সঙ্গে কথা বলেছিলাম।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন