কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩০ |
শীর্ষসুখ
ষোলবছর বয়সটা যে কী মারাত্মক, তা আমি টের পেয়েছিলাম আমার ষোল বছর বয়স হতেই। তার আগে থেকেই একটু একটু করে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম আমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো। অথচ স্বভাবে অন্তর্মুখিন হওয়ায় কারও সঙ্গে ব্যাপারটা আলোচনা বা শেয়ার করতে পারছিলাম না। বাড়াবাড়ি রকমের রক্ষণশীল পরিবার আমাদের। কো-এড স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হয়নি। পরিবারে মা ছাড়া আর কোনো মহিলা সদস্য নেই। খুব সঙ্গত কারণেই ঘটনাচক্রে কোনো মেয়ের মুখোমুখি হলে আমি খুব আড়ষ্টবোধ করতাম, গুছিয়ে আলাপ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতাম। অথচ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় নতুন গজিয়ে ওঠা শারীরিক চাহিদাগুলোকে যেমন এড়িয়ে যেতে পারতাম না, তেমনি তা পূরণের প্রায়োগিক বিভিন্ন আচরণকে কিছুটা অজ্ঞতায়, কিছুটা নিষিদ্ধ ভাবনায়, বাকিটা অপরাধবোধে ঠেকিয়ে রাখতাম। আর এই টানাপড়েনের দ্বন্দ্বে যখন আমি বিভ্রান্ত তখনই এক বিচিত্র চিত্রনাট্যে আমার জীবনে নায়িকার ভূমিকায় অনুপ্রবেশ ঘটেছিল মৌসুমীদির।
আমার থেকে বয়সে বছর দুয়েকের বড়, তাই দিদি, তাই মৌসুমীদি। আমার মায়ের পিসতুতো দিদির মেয়ে। সম্পর্ক যতই লতায়পাতায় হোক, সেই সম্পর্কের সূত্রেই ভালো চিকিৎসার জন্য মফঃস্বল শহর থেকে শহর কলকাতায় আনা হয়েছিল মৌসুমীদিকে। আর যেহেতু মৌসুমীদির বয়সের ধারেকাছে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না, তাই আমার সঙ্গে বন্ধুত্বটা জমাট বাঁধল। মৌসুমীদি আমাকে বলেছিল, জানো স্নিগ্ধদেব, আমার এখন বয়স মাত্র আঠেরো, আমি আরও অনেক বছর বাঁচতে চাই। কিন্তু জানি, তা হবে না, আমাকে মরে যেতে হবে।
মৌসুমীদির কথা শুনে আমি অবাক। কেন,
মরে যেতে হবে কেন? কী হয়েছে তোমার? মৌসুমীদি বলেছিল, আমার মাথার ভেতরে খুব অশান্তি
চলছে। সব সময় ব্যথা করে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, মাথাটা একবার কেটে খুলে দেখবেন।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বলি, সেকী! তা মাথা
খুলে কী করবেন?
-আমার মাথার ভেতরে একটা মাংসপিন্ড
গজিয়েছে, ওটাকে টিউমার বলে, কেটে বাদ দেবেন।
আমি খুশি হলাম।
-এ তো খুব ভালো কথা। তুমি তো তাহলে
সেরে যাবে!
-না স্নিগ্ধদেব, মরেও যেতে পারি।
আমার মনে হয়, মরেই যাব।
মৌসুমীদি একদিন বলল, জানো স্নিগ্ধদেব, আমার জীবনে আঠেরোটা বছর গড়িয়ে গেল, কিন্তু সেই তেরো-চোদ্দ বছর বয়স থেকে এই মাথাব্যথা শুরু হওয়ায় জীবনে আমার আর কিছুই হলো না। আমার কোনো ছেলেবন্ধু নেই, আমাকে কোনো ছেলে কখনও ভালোবাসেনি। সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে। শুধু সান্ত্বনা দিয়ে কষ্ট বাড়ায়।
মৌসুমীদির জীবনের এই শূন্যতার কথা
জেনে আমার কী উত্তর দেওয়া শোভন, তা বুঝতে পারিনি। বোকার মতো বলেছি, তুমি ভেবো না, আমি
তো আছি তোমার পাশে। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মৌসুমীদি করুণ হেসে বলেছে, তোমাকেও
আমার ভালো লাগে স্নিগ্ধদেব, যদিও বয়সে তুমি আমার থেকে ছোট। কিন্তু জীবন আমার ফুরিয়ে
আসছে। হাতে আর সময় নেই। তাই তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, আমার অপারেশনের আগে তুমি
একদিন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমুতে আদরে ভরিয়ে দিও। আর একবার, অন্তত একবার আমাকে
শরীরী শীর্ষসুখ দিও স্নিগ্ধদেব!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন