বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

সুকান্ত পাল

 

সমকালীন ছোটগল্প



বোরোলীন

নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই মাঝে মাঝে চন্দ্রানীর কেন যে কাজে মন বসে না! সে বুঝে উঠতে পারে না। সারা পৃথিবীর যাবতীয় অনীহা তাকে তখন ঘিরে ধরে। সে ভালো করেই জানে যে এই অবস্থায় জোর করে অফিসের কাজ করলে অবধারিত ভুল হবেই। মনের এরকম অবস্থা হলে সেদিন সে হাফ সি. এল. নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। আজও সে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে।

এই অফিস পাড়ায় ফুটপাতের খাবারের দোকানগুলোতে তখন ভীষণ ভিড় জমে যায় অফিস কর্মীদের। ফুটপাতের দোকান হলেও এই দোকানগুলোর খাবার খুব পরিষ্কার এবং টাটকা। এরকমই একটি নির্দিষ্ট দোকানে সে প্রতিদিন টিফিন আওয়ারে লাঞ্চ করে। এক বিধবা মহিলা দোকানটা নিজের হাতে সামলায়। একটা সাত আট বছরের ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে মহিলার সাহায্যকারী। চন্দ্রানীকে দোকানের মালকিন এবং বাচ্চা ছেলেটি চিনে গেছে। কেমন যেন এক অচ্ছেদ্য সম্পর্কে তারা তিনজনে জড়িয়ে পড়েছে। চন্দ্রানী এলেই বাচ্চাটি মহাকরণের দেওয়াল ঘেঁসে পাতা লম্বা বেঞ্চের একটা নির্দিষ্ট জায়গা ন্যাকড়া দিয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে বলে,

-- ম্যাডাম বসেন।

কোনো কথা না বলে ঠোঁটের কোণায় আন্তরিক ও মার্জিত হাসির রেখা এঁকে চন্দ্রানী বসে পড়ে। সে জানে তার পছন্দের খাবার এদের জানা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পড়েই রেডি করে বাচ্চা ছেলেটি তার সামনে এনে বলবে,

-- গরম গরম খেয়ে নেন।

যেন একজন আপনজন তার এক পরম আত্মীয়কে খাবার পরিবেশন করছে!

সেদিন দোকানে ভিড় কম ছিল। ধীরে ধীরে খাওয়া শেষ করে, হাত ধুয়ে আবার সেই জায়গাতেই এসে চন্দ্রানী বসে এবং প্রতিদিনের মতো তার ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো ধোঁয়া ছাড়ে। প্রতিদিনের মতোই বাচ্চা ছেলেটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রথম দিন থেকে রোজই এক চিত্র। রোজই এই দোকানে চন্দ্রানী তার লাঞ্চ করে অথচ বাচ্চা ছেলেটির  নাম জানা হয়ে ওঠেনি। আজ দোকান ফাঁকা। খদ্দেরদের ভিড় নেই। চন্দ্রানী ইশারায় ছেলেটিকে কাছে ডাকল। খুব ভয়ে ভয়ে সে কাছে এসে দাঁড়াতেই চন্দ্রানী জিজ্ঞেস করল,

-- তোর নাম কি?

-- বাচ্চা।

-- ধূর, বাচ্চা আবার কারুর নাম হয় নাকি?

-- সবাই তাই বলে ডাকে।

-- তোর বাবা মায়ের দেওয়া নাম কি?

-- জানি না তো!

-- কেন? তোর বাবা মা কোথায়?

-- জানি না।

-- সে কি? তোর বাড়ি কোথায়?  কোথায় থাকিস?

-- বাড়ি নেই। এখানেই থাকি।

বলেই সে ফুটপাতের এক কোণায় জড়িয়ে রাখা একটা নোংরা বোঁচকার দিকে আঙুল তুলে দেখায়। চন্দ্রানী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-- তুই রাতে এখানেই একা একা থাকিস?

মুখে শিউলি ফুলের মতো এক রাশ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ।

-- তোর ভয় করে না?

-- নাহ্।

-- ঝড়বৃষ্টি হলে কি করিস?

বাচ্চাটি হাত তুলে রাস্তার উল্টো দিকের একটা শেড দেখিয়ে বলল,      

-- উইখানে।

চন্দ্রানী কেমন যেন আনমনা হয়ে ওঠে। তার দুই চোখ এক অনির্দিষ্ট দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে ঝুলন্ত সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে ছাই হতে থাকে। সে এক গভীর চিন্তার সাগরে যেন এক অসহায় গাছের গুঁড়ির মতো ভেসে যাচ্ছে! 

এতো করে বলার পরও সৌমেন কিছুতেই নিজেকে টেস্ট করালো না। অথচ যত রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে সব করিয়েও চন্দ্রানীর সন্তান নেওয়ার কোনো অসুবিধা নেই বলে ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন। সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে সৌমেন চলে গেল। ও মুক্তি চেয়েছিল, চন্দ্রানী বিনা প্রতিবাদে সৌমেনকে মুক্তি দিয়েছে। চন্দ্রানী একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনে এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে শেষ প্রান্তে এসে আঙুলের চামড়া ছুঁতেই চন্দ্রানীর সম্বিত ফিরে আসে। তার চোখের তারায় ঘন ও গভীর দৃষ্টি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

-- তোর একা একা থাকতে ভালো লাগে?

-- জানি না তো!

-- আচ্ছা শোন্, বাচ্চা কারুর নাম হয় না। তোকে আমি বাচ্চু নাম দিলাম। আজ থেকে তোর নাম হলো বাচ্চু। কেমন রে নামটা? পছন্দ হয়েছে তোর?

-- খুব ভালো নাম। পছন্দ হয়েছে। একটা কথা বলব ম্যাডাম?

-- কি রে?

-- তোমার কাছে বোরোলিন আছে?

-- কেন? কী করবি বোরোলিন দিয়ে? কোথায়ও কেটে গেছে?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বাচ্চু মাথা নিচু করে তার দুই পায়ের বুড়ো আঙুল বেঁকিয়ে দিয়ে ফুটপাতের শানের মধ্যে ঘষতে থাকে। তাকে নিরুত্তর দেখে চন্দ্রানী বলল,

-- কি হলো বল্!

অনেক কষ্টে মুখ তুলতেই চন্দ্রানী দেখল বাচ্চুর দুই চোখে জল টলটল করছে। তার চোখে জল দেখে বলল,

-- আমাকে তুই আজ থেকে সব বলতে পারিস।

এই কথা শুনে বাচ্চুর মনে হলো এক গভীর অভয়বাণী এবং স্নেহের পবিত্র হাত যেন মাথার উপর আছে। সে ধীরে ধীরে প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল,

-- বলতে লজ্জা করে।

-- আমার কাছে আজ থেকে তোর কোনো লজ্জা নেই। বল্ আমাকে।

-- পরশু রাতে....

এই পর্যন্ত বলে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে ওঠে। সে আর বলতে পারে না।

-- পরশু রাতে কী হয়েছে বল্।

-- একজন পুলিশ…

-- পুলিশ! পুলিশ কেন?

-- অনেক রাতে আমার সঙ্গে অসভ্য কাজ করেছে। খুব ব্যথা, ফুলে গেছে।

কোনোরকমে কথাগুলো বলতে পেরে যেন স্বস্তি পেল বাচ্চু। তার কথা শুনে থ হয়ে বসে থাকে চন্দ্রানী। রাতের কলকাতার এই চিত্র তার কাছে অজানা ছিল। তার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। অথচ কাঁদতে পারছে না। ফলে বুকের ভিতর একটা চাপ অনুভব করছে সে। এ চাপ যেন হাজার মন পাথরের চাপের থেকেও ভারি। অনেকক্ষণ এক অসহনীয় স্তব্ধতা। এতো যানবাহনের হর্ন ও মানুষের কোলাহল যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে।

স্তব্ধতা ভেঙে চন্দ্রানী বলল,

-- বাচ্চু,

-- কি?

-- তোর আমাকে পছন্দ হয়?

এই প্রশ্ন শুনে বাচ্চু চোখ তুলে, মুখে হাসি ছড়িয়ে বলে,

-- তুমি ভীষণ ভালো।

বাচ্চুর মুখে 'তুমি' শুনে চন্দ্রানীর বুকের ভিতর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ঘাই মারতে থাকে। সে বলল,

-- তুই আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে থাকবি? আমরা দুজনে মিলে থাকব!

এই কথা শুনে বাচ্চু আকাশ থেকে পড়ল। মনে মনে ভাবল, ধ্যুৎ এ আবার হয় নাকি! ম্যাডামের বাড়িতে সে থাকবে!

অনেকক্ষণ পর বলল,

-- তোমার বাড়ির লোকেরা কিছু বলবে না?

-- না, কেউ কিছু বলবে না। শুধু তুই আর আমি।

-- তোমার বাড়িতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা যায়?

-- যাবে না কেন! জানালা খুলে দিলেই আকাশ দেখতে পাবি।

-- ধুর, সেই আকাশ তো খাঁচার মধ্যে থাকে। জানো, আমি এখানে শুয়ে শুয়ে আকাশ আর কতো তারা দেখি। দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি।

-- তাই নাকি? তাহলে আমরা ছাদেই শোবো। তুই আর আমি আকাশ দেখব, তারা দেখব। যেদিন চাঁদ উঠবে সেদিন জোৎস্না মাখামাখি করে শুয়ে থাকব।

-- হি হি, তুমি কি গো? জোৎস্না আবার মাখে কেমন করে?

--- আমি তোকে দেখিয়ে দেব।

-- তুমি আমাকে বোরোলিন দেবে তো?

-- নিশ্চয়ই দেব। তোর সব অসুখ আমি সারিয়ে দেব দেখিস।

সে তার ম্যাডামকে একা পাবে এই কথা ভেবেই বাচ্চুর মনটা নেচে ওঠে আনন্দে। কিন্তু পরক্ষণেই তার দোকানের মালকিনের দিকে চেয়ে থাকে। তার দৃষ্টির অর্থ বোঝে চন্দ্রানী। সে বলল,

-- তুই চিন্তা করিস না। আমি কথা বলছি। আচ্ছা তুই আমাকে কী বলে ডাকবি বল তো?

-- কেন 'ম্যাডাম' বলে ডাকব।

-- উঁহু, তা হবে না।

-- তবে 'মাসিমা' বলব।

-- কেন রে! 'মাসি'টা বাদ দিতে পারবি না?

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন