সমকালীন ছোটগল্প |
তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়
কবির জীবনে হয় না। বাস্তবে - ভক্তের চেষ্টা থাকলে - হয়ে যায় কখনো সখোনো। বারাসাতের জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সিঙ্গুরের বনলতা সেনের বিয়েটাও সে রকমই একটি চমকে যাবার মত ঘটনা। এই জীবনানন্দের বাবা - শ্রী দুকড়ি দাশ - ছিলেন কবি জীবনানন্দের প্রবল ভক্ত - গুপ্ত কবি। একষট্টি বছর আগে ছেলে হবার সঙ্গে সঙ্গে 'জীবনানন্দ' নাম রাখতে তার এক তিল দেরি হয়নি। সঙ্গে পদবী দাশ তো ছিলই। তা ... সে পদবী বসু হলে নাম রাখতেন 'বুদ্ধদেব', মিত্র হলে প্রেমেন্দ্র , দত্ত হলে '______' কিম্বা '_____' , রায় হলে '______' আর ঠাকুর হলে? আজ্ঞে না। সব অনুমান স্বতঃসিদ্ধ হবে সেটা আপনাদের অতিরিক্ত আত্ম বিশ্বাস। সে ক্ষেত্রে নাম হত দ্বিজেন্দ্রনাথ। কারণ দুকড়ি বাবুর ধারনা দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্য নির্ঝর রবীন্দ্রনাথের থেকে ঢের বেশী স্রোতস্বিনী। শুধু প্রতিভার গৃহিণীপনার অভাবে তাঁর স্বপ্ন প্রয়াণ কাব্য - আদ্দির পাঞ্জাবীর পকেটে না থেকে - পণ্ডিতদের খাদির ঝোলায় রয়ে গেল।
নামে কি বা করে? করে অনেক কিছুই। শুধু মাত্র দুকড়ি নাম হবার জন্যেই তার সাহিত্য সাক্ষর বাংলা দেশে কলকে পেল না। সে দুঃখ জানে বিয়েতে পাওয়া গোলাপি ফুল ছাপের মাঝে 'সুখে থাকো' লেখা তার হলুদ ট্রাঙ্ক। সে এখন জীবনানন্দের তিন কামরার ফ্লাটে জয়পুরী চাদর আর গোল তাকিয়ার পাগড়ি পরে বসার জায়গা হয়েছে। সেখানেই 'যদি নির্বাসন দাও' বলে শীত ঘুমে আছে - প্রায় দশটি হাতি মার্কা খাতা। তাদের বৃংহণ যে সাহিত্য সমাজে শোনা গেল না - তার কারণ - লেখকের নাম শোনা মাত্র প্রত্যেক সম্পাদকের কিছু না কিছু জরুরী কাজ মনে পড়ে গেছে। কিছু মনে না পড়লে বাথরুমেই কাটিয়েছেন দুকড়িবাবু বেরোনো পর্যন্ত। কড়ি দিয়ে তো কিনলেনই না - দুকড়ি বাবু কড়ি ফেলতে চাইলেও - সম্পাদকদের জরুরী কাজ শেষ হল না।
তিনি চাকরি পাবার ঠিক আগে মরিয়া হয়ে একবার তার বাবা এককড়ি দাশের কাছে নাম পরিবর্তনের দরবার করেছিলেন। ফলাফল মিশ্র। এককড়ি বাবু ছেলের নাম পরিবর্তনের কথা ফুৎকারে ওড়ালেন। কিন্তু সাত তাড়াতাড়ি দুকড়ি বাবুর বিয়ে সাতগাছিয়ার ক্ষেত্র-মনি সাঁতরার সঙ্গে ঠিক করে ফেললেন। একেবারে ওঠ ছোঁড়া - হাতে কড়া। শারীর বিদ্যায় তেমন জ্ঞান না থাকায় ক্ষেত্র-মনি পরের বছরই জননী হয়ে গেলেন। বাধ্য হয়েই মেয়ের বাপ দুকড়ি বাবুকে - সংসারের দড়া দড়ি আর কড়া কড়ির হিসাব ঠিক ঠাক বুঝতে হল। কবিতার খাতা গড়িয়ে গেল ট্রাঙ্কে। সে চাকা আর ফিরল না। প্রথম নাতনির নাম এককড়ি বাবুই রেখে যান - 'নয়নমণি'। দুকড়িবাবুর ঠিক করা 'পুণ্যলতা' বাড়ির ভোটে গো হারা হারে।
এর প্রায় তিন বছর পর এককড়ি সাধন-চিত ধামে গেলেন। তার দুবছর পরে অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যাবধানে - বিজ্ঞান ও বিজ্ঞাপন সম্মত ভাবে - ছেলে হল দুকড়ি বাবুর। সে ছেলের নাড়ি খসার আগেই দুকড়িবাবু 'জীবনানন্দ দাশ ' লেখা জন্ম শংসা পত্র বানিয়ে আনলেন। একেবারে পাকা কাজ, সরকারী মোহর লাগানো। কোনো নাক যে কোঁচকায়নি এমন নয় - কিন্তু তারা নিজে নিজেই সোজা হয়ে গেল। তাছাড়া সেই সময় একান্নবর্তী পরিবারের পাকচক্র খুলে খুলে পড়ছে। হেঁসেলে থালা বাটি কম - বড় জোর তিনটি বা চারটি। লাঠি ঘোরানো বয়স্করা বিলীয়মান। বিজয়া কি বিবাহ ছাড়া কেউ কারু চৌকাঠ মাড়ায় না। কে আর অন্যের ঝাড়ে বাঁশ কাটে।
এই নবজাতক জীবনানন্দ অবশ্য বাঙ্গালী যেমন হয় - তেমনি হলেন। ইশকুলে থাকাকালীন ফুটবল, ডাঙগুলি খেললেন। 'মনে'র সঙ্গে 'সনে' মিলিয়ে দু একটি সনেট লেখার চেষ্টা করলেন। 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে' আবৃত্তি করে পুরস্কার পেলেন। মোটামুটি ভাল ফলাফল করে স্নাতক হলেন এবং ঠিক সময়ে - নিখরচায় - সরকারি কাজে যোগদান করে মা বাবার হাসি চওড়া করলেন।ইতিমধ্যে নয়নমণি বিয়ে করে দু তিন মনি গিন্নী হয়েছে। কাজেই সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের হিসেবে এবার জীবনানন্দকে পাত্রের হাটে গলদা চিংড়ি হয়ে দাঁড়াতে হয়। মা দর রাখলেন পঁচিশ হাজার । অল্প কষাকষির ছাড়ও রাখলেন। জীবনানন্দ অবশ্য অর্থ নয়, কীর্তি নয়, লাবণ্যের খোঁজে আছেন।
এতদিন দুকড়িবাবু ছেলের পিছনে পিছনে ব্যায় করেছেন সাধ্যমত। স্ত্রীর প্রায় সব কথা শুনেছেন। কিন্তু এবার আর একটি মাস্টার স্ট্রোক খেললেন। বহু অনুসন্ধান করে - সিংহল নয় - সিঙ্গুর থেকে পাত্রী পছন্দ করলেন, নাম বনলতা সেন। পালটি ঘর। পাত্রীর বাবা কবি নন, মূলত কৃষিজীবী। প্রকৃতি প্রেম থেকেই মেয়ের নাম প্রথমে রেখেছিলেন 'কুমড়ো-লতা'। মেয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে বদলে করল বনলতা। ভূগোলে স্নাতকোত্তর, সুশ্রী, গড় পড়তা স্বাস্থ্যবতী। মায়ের সতর্ক তত্ত্বাবধানে গৃহকর্ম নিপুণাও বটে। রং চাপা। এই খানে দুকড়ি বাবুর ঈষৎ দ্বিধা এসেছিল।' থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন'। যাকে অন্ধকারে দেখা যায় তার রং ফর্সা হওয়াই বিধেয়। কিন্তু মেয়ের মেঘ বরন চুল - ঠিক যেন বিদিশার নিশা। ব্যাস, আর কি চাই। দরকার পড়লে ফর্সা হবার মলম মাখিয়ে চাপা রং কে চাঁপা করে দেওয়া যাবে। মুগ্ধ দুকড়িবাবু মেয়ে দেখতে গিয়ে অস্ফুটে বললেন ' এত দিন কোথায় ছিলেন'। তার পর অবাক মেয়ে ও তার হাঁ করা মা বাবা কে দেখে জিভ কেটে বললেন
- 'মোটামুটি পাকা কথাই দিয়ে গেলাম
বেয়াই মশাই। গিন্নী একবার আসবেন। তবে একটা কথা ছিল'।
হবু বেয়াই সাত তাড়াতাড়ি বললেন
-
- 'সে কথা বলতে হবেনা বেয়াই। সরকারি
চাকরির নিয়ম আমি জানি। তাছাড়া এক মাত্র মেয়ে। আমি ভরেই দেবো। ধরুন চল্লিশ ভরি ...
'।
- 'না না ও সব না। পণ প্রথার আমি
ঘোর বিরোধী। শুধু মাকে একটা অনুরোধ। এই চুল কিন্তু কাটতে পাবে না । এই কথাটি দিতেই
হবে'।
অনুরোধ কিছুটা অদ্ভুত হলেও রাখতে অসুবিধে নেই। শুধু দুকড়িবাবু চোখের আড়াল হলে সেন পরিবার পরস্পর গা টেপাটেপি করে হাসলেন। ধরেই নেওয়া হল দুকড়ি বাবু কিছুটা খামখেয়ালী এবং সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী। এমনটা হলে মেয়ের বাপের খুশি হওয়ার কথা। তিনি হলেন। শ্রীমতী ক্ষেত্র-মনিও ঘর দোর দেখে বুঝলেন এখানে দর দস্তুর না করলেই আখেরে লাভ। কাজেই তিনিও রা কাড়লেন না। যথাসময়ে ফুল সাজানো প্যাঁপো প্যাঁপ আম্বাসাডার পৌঁছল ভ্যাঁপো ভ্যাঁপ ব্যান্ড বাজা ঘরে। তার থেকে নেমে - হাজার বছর নয় - মাত্র কয়েকটি পা হেঁটে জীবনানন্দের সাক্ষাত হল বনলতা সেনের সঙ্গে। নিশীথের অন্ধকারে অবশ্য হল না। ডায়নামো গর্জনের সাথে সাথে আলোকোজ্জ্বল সভায় দাশ শর্মন্যর সঙ্গে সেন শর্মন্যার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হল। পরদিন ভোরে দুকড়িবাবু - নতুন পাম্পশুর ধুলো কোরা ধুতির কোঁচায় ঝেড়ে বেয়াইকে বললেন
- 'ভাবুন একবার। জীবনানন্দের সঙ্গে
বনলতার বিয়ে? । এরপরেও বাঙ্গালী আমাকে মনে রাখবে না'?
হা-ক্লান্ত বেয়াই মশাই ঘাড় নাড়লেন
কিছু না বুঝেই। তার তখন শিরে সংক্রান্তি। বাহান্ন জন বরযাত্রীর জন্যে মাত্র সতেরটি
গাড়ুর সংস্থান করা গেছে। পড়শিদের কাজ সারা হলে আরো কিছু পাওয়া যাবে। তাছাড়া রান্নার
ঠাকুর - কাল রাতে বরযাত্রীদের গোপনে চিকেন পকোড়া করে দেবার জন্যে - ভালো রকম প্রসাদ
পেয়েছিল। এখন ঘুম থেকে ওঠাতে গেলেই ইংরেজি গাল দিচ্ছে। মাছওয়ালি উঠোনে দশ কেজি মাছ
ছড়িয়ে বসে। ডেকোরেটরের লোক বলছে তিনটে পাস বালিশের যা অবস্থা তাতে আর ফেরত নেওয়া যাবে
না - পয়সা চাই। তিনি যে কোন দিক দেখেন । তার
ওপর দুকড়ি বাবুর আবোল তাবোল 'তোমারে কি শান্তি দেবে'। যাহোক কোনো রকমে দুপুর নাগাদ
মেয়ে জামাই এর আম্বাসাডার - বাসে সাদা চোখ,
লাল চোখ - বরযাত্রী আর একটি বাড়তি ট্রাকে
'এই টুকটাক কিছু মিছু ' নিয়ে রওনা হল দাশ বাড়ির দিকে।
ধান ভানতে শিবের গীত হল অনেক। এসব প্রায় তিরিশ বছর আগেকার কথা ।কিছু সময় পর পর দু জোড়া বেয়াই বেয়ান চন্দন ছাপ ছবি হয়েছেন। দাশ দম্পতী সিঙ্গুরের বাপের বাড়ি / শ্বশুরবাড়ি কে 'টা টা' করেছেন। শতাব্দী পেরিয়ে কাগজে, দূরদর্শনে সিঙ্গুর বহু পালাবদলের কেন্দ্রে থেকেছে । কিন্তু জীবনানন্দ এবং বনলতার বিবাহ কোন শিরোনাম পায়নি।কালের নিয়মে নবীন দম্পতি প্রবীণ হয়েছেন। যথা সময়ে তাদের ছেলে হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে । তারপর যথার্থ বাঙ্গালীর মত বাঙ্গালোরে থিতু হয়েছে। প্রথমে প্রতিদিন, তারপর শনিবার শনিবার ফোন আসে। বাকি সপ্তাহে তিনদিন গতানুগতিক ঝগড়া, দুদিন টিভি তে সিনেমা আর একদিন রাম কৃষ্ণ মিশনে সন্ধ্যারতি। 'জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার'।
কিন্তু একদিন ভোররাতে হটাৎ বৃষ্টির ঠেলা সামলাতে জানলা বন্ধ করতে উঠলেন জীবনানন্দ। ঘুম আর জোড়া লাগলো না। জানলার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে আস্তে আস্তে ভোরের চাপা আলো ফুটে উঠল। জীবনানন্দ বসেই রইলেন। তারপর বর্ষার আমেজে বসন্ত অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে এলেন দুকড়ি। কপাল চাপড়ে বললেন -
- ' কি ভেবে তোদের বিয়ে দিলাম আর
তোরা কি হলি'?
= ' কেন বাবা'?
- ' ওরে কবিতা লিখবি না ... লিখিস
না। তাই বলে তোদের জীবনে কোন প্রেম প্রীতি থাকবে না'?
= ' ইয়ে কেন বাবা। আছে তো। এই তো বনু কে গয়না গড়িয়ে
দিলাম। তাছাড়া গত মাসে বোমকাই'।
- ' এই খানেই মুচ্ছা যাই। ওরে পুরো
নামটা বলা প্র্যাকটিস কর। তুই কি বনুর ভাই ' ?
= ' আচ্ছা, আচ্ছা বোনু আর বলব না।
বনলতাই বলব। কিন্তু তোমার আসল কথাটা কি বলত'?
- ' তোদের ত্রিংশটিতম ... থাক আবার
বুঝবি কি না ... ত্রিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকী আসছে । কি ভাবে পালন করবি কিছু ভেবেছিস'?
= ' ও। এই। সে তো প্রতি বছরই আসে।
এক রকম পালনও হয়'।
- ' হ্যাঁ। হয় তো। আমাদের ফোটোয়
মালা চড়ে। ছেলে ফোন করে আর তোদের জন্যে অন লাইনে খাবার পাঠায়। এই তো'?
= ' হ্যাঁ। তো আর কি হবে'?
- ' আমার ঠাকুর্দা একটা কথা যখন
তখন বলতেন। আজ তোকে বলতে ইচ্ছে করছে। গর্ভস্রাব একটা। ওরে একটা মানুষ প্রেম খুঁজতে
খুঁজতে ট্রামে চাপা পড়ে গেল, তার নামে তোর নাম। একটু অন্য কিছু ভাবতে পারিস না? বনের
ধারে ক্যাম্প করলি এরকম কিছু? এ রকম বেঁকে
টেরে শুয়ে আছ - ঘাড়ে লাগবে যে'।
= ' অ্যাঁ ... কি'?
- ' বলছি চেয়ারে বসে ঘুমচ্ছ কেন।
খাটে গিয়ে শোও'।
জীবনানন্দ চোখ খুলে ভ্যাবলার মত সদ্যস্নাতা বনলতা কে দেখলেন। শেষ কথাগুলো তার বলা। স্বপ্নে ওভারল্যাপ করে গিয়েছিল। এক বার মাথাটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে আবার দেখলেন স্ত্রীকে। এবং খেয়াল করলেন যে বহুদিন স্ত্রীকে তিনি খেয়াল করে দেখেন নি। অনেক বর্ষীয়সী চিত্র তারকার মত বনলতাও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আরো শ্রীময়ী হয়েছেন। চুল বরাবরি কুন্তলীনের বিজ্ঞাপন। সেই চাপা রং বেশ মাজা ঘষা হয়েছে। বাবা ঠিক বলেছিলেন। বোনু নয় বনলতা। বনলতা গামছা দিয়ে ভেজা চুল ঝাড় ছিলেন । থামিয়ে ঘোর বিস্ময়ে বললেন -
- 'বাবা বলছিলেন? কার বাবা? কাকে
বলছিলেন'?
আবার জিভ কাটার পালা জীবনানন্দের।
এবার স্বপ্নের ডায়ালগ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বনলতা আর প্রশ্ন করার আগেই বাথরুমে সেঁধোলেন।
ব্রাশ করতে করতে মনে পড়ল পেঁচোর কথা। ইশকুল জীবনের যে সব হাতে গোনা বন্ধু এখনো যোগাযোগে
আছে, তার একজন । সিরিয়াল পাড়ায় (বি)চিত্র নাট্যকার।
ওকে বললে কিছু একটা প্লট করেই দেবে। তারপর ... এবারের বিবাহ বার্ষিকীতে ' দু এক মুহূর্ত
শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি ...'। বনের ধারে অবশ্য হবে না। এ পোড়া দেশে
বনে বাথরুম থাকে না।
সে দিনটা ছিল ঝগড়ার জন্যে তফসিল-ভুক্ত।
একাই বকে গেলেন বনলতা। জীবনানন্দ শুধু মুচকি মুচকি হাসলেন।
দিন দুয়েক পরে পেঁচো ওরফে পাঞ্চজন্য রুদ্রপালের ড্রইং রুমে পা ছড়িয়ে বসে জীবনানন্দ। সামনে অর্ধ নিমীলিত চোখে তৃতীয় কাপ দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিচ্ছেন পাঞ্চজন্য। তলানি টুকুও সাবড়ে বললেন -
- ' মেগা নামাবি যে সাপ্লাই কত'?
= ' মানে'?
- ' মাল্লু কত ছাড়বি? একটা স্বপ্ন
দৃশ্য কি মল দ্বীপে নামাবো'?
= ' না ভাই ওটা বেশী হয়ে যাবে ।
তাছাড়া মল দ্বীপ যাওয়া বোধ হয় এখন দেশদ্রোহিতা '।
- ' হু। তাও বটে। ঠিক আছে । ত্রিশ
বছরে 'তিনচুলে'তেই যা'।
= ' চুলোয়'?
= ' এই জন্যেই কাকু তোকে স্বপ্নে
গালমন্দ করেছেন। ওরে চুলো নয় তিনচুলে। উত্তরবঙ্গের একটা দাগী পর্যটক মানে টুরিস্ট স্পট।
কপালে থাকলে কম্বলের তলায় শুয়ে শুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সঙ্গে তাজা পাহাড়ি চা। ব্যাক গ্রাউন্ড
স্কোর পাখীর কিচি মিচি। তাছাড়া কাছেই দার্জিলিং। ভঞ্জন-বাবুর সিনেমা ও কি দেখিস না'?
- ' দেখেছি । কিন্তু ওতে তো প্রেম
কম খুন বেশী থাকে'।
= ' তোকে খুন করার ইচ্ছেই হচ্ছে
আমার। সিরিয়াল দেখিস না। সিনেমা দেখিস আদ্ধেক ঘুমিয়ে । সংস্কৃতির শ্রেণী শত্রু একটা।
যাই হোক তুই বললে আমাদের প্রডাকশন ম্যানেজারকে বলে তোর গাড়ি আর রুম বুক করে দেবো'।
- মাত্র দশ দিন বাকি। হবে'?
= ' আমাকে কি এখনও পাঁচু ভাবিস?
আমি এখন পাঞ্চজন্য। একবার বেজে উঠলেই কুরুক্ষেত্র ...'।
- ' রাগিস না ভাই। একটা রুম বুক
করেই দে'।
= ' এখানেই একটা টুইস্ট আছে। একটা
না দুটো গাড়ি, দুটো রুম'।
- ' কেন কেন? আরেক টা রুমে কে থাকবে?
তুই যাবি? তাহলে তো কথাই নেই। বৌদিকে বলি তাহলে'?
= ' ওরে না না । ওই হোম স্টের তিন
তলাতে শুধু দুটোই রুম আছে। কমন বারান্দা। গত সুটে আমাদের হিরো হিরোইন ছিল। সে এক কেলো।
পর দিন দুজনেই প্রায় উঠতে পারে না। সুটিং বন্ধ হবার জোগাড়'।
- ' কেন '?
= ' তিরিশ বছরে বুঝলি না এবার যদি
বুঝিস। যা হোক। একটায় তুই থাকবি আর একটায় বউদি মানে তোর বৌ'।
- ' কেন রে বাবা। ডবল খরচ'?
= ' তুই কি ইংরেজির অধ্যাপক? বার
বার চাকরি গেছে? তোর থাকার ফ্লাটে কি সাব লেট করেছিস? তা হলে কার্পণ্য কিসের? তাছাড়া
এই এপিসোডের আমি প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক - সব কিছু।এক পয়সা
চেয়েছি কি? আসি যাই করে অনেক কামিয়েছিস। এবার
অন্তত নিজের জন্যে খরচ কর। শোন আমার আইডিয়াটা। জলপাইগুড়ি অব্দি এক সঙ্গেই যেতে পারিস।
তারপর দুটো আলাদা গাড়ি করে পৌঁছবি তিনচুলে। পথে কয়েকটা দেখার জায়গা আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে
মোমো খেতে পারিস । আড়চোখে দেখবি বৌদিকে কিন্তু সেখানে কোনো কথা নয়। যেন অচেনা কেউ।
তিনচুলে পৌঁছে দুটো পাশাপাশি কিন্তু আলাদা ঘরে চলে যাবি দুজনে। সেদিনের ডিনার ঘরে আনিয়ে
নিবি। তোদের আবার দেখা হবে পরদিন ভোর বেলা,
বারান্দায়, কাঞ্চন জঙ্ঘার মুখোমুখি, দার্জিলিঙের চায়ের উষ্ণতায়। বলবি - এত দিন কোথায়
ছিলেন -ওফ ... শুনছো আরেক কাপ চা দাও, মোলায়েম করে'।
= ' বলিস কি? গায়ে কাঁটা দিচ্ছে'।
- ' তবে? এমনি এমনি মেগা সিরিয়াল
লিখি না ভাই। একটা তুবড়ি ডায়ালগ লিখতে সারা রাত কেটে যায়। সুড়সুড়ি দিতে পারলেই সুড়সুড়িয়ে
টাকা। তারপর শোন।এখন থেকে একটাই গাড়ি।একসঙ্গে দুদিনে কাছাকাছির সব দেখার জায়গা, খাবার
জায়গা, নিজস্বই। এসে পড়ল বিবাহ বার্ষিকী। ভোর হতেই আমাদের প্রোডাকশন ম্যানেজার নিয়ে
আসবে দুটো মালা, কেক। সন্ধ্যায় ছোট্ট একটা পার্টি - মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে' ।
= 'বনু ... ই ... ইয়ে বনলতা কে
বলব গাইতে। তবে খুব উঁচু ... পারবে কি না ...'।
- 'এটাও ভাল । আগে তো প্লে ব্যাক
হত না। নিজেদেরই গাইতে হত। দেখিস বলে। এখানে ঘর সাজানোর জন্যে যে বুক সেলফ রেখেছিস
তাতে নিশ্চিত জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা থাকবে। পারলে একবার উল্টে পালটে নিস।কটা
চাক্কু ডায়ালগ আমিও লিখে দেব। এত দিনের বিবাহিত জীবনে একটা ব্রান্ড নিউ ফ্লেভার। এরপর
একটা রুম ছেড়ে দিতেও পারিস। আর এখন খানিক ক্ষণ চোখ বুজে বসে ব্যাপারটা হজম কর। আমি
আর এক কাপ চা খাই'।
জীবনানন্দ হুকুম তামিল করলেন। আইডিয়া
যেন কপিল-দেব। জবাব নেই। বনলতা কে একটু বোঝাতে হবে। তবে বেড়াতে যাওয়া তো ... মেনে যাবে।
খরচ হলে হোক। ছেলের বিয়ে ছাড়া ... যদি বিয়ে করে আদৌ ... আর কোন বিরাট খরচা নেই। সত্যি
বলতে কি নিজেদের কথা তো ভাবাই হয়নি এতদিন।
পাঞ্চজন্যর সঙ্গে বিলি ব্যবস্থা করে ফেললেন সব। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ... মাত্র
দুটো ফোন ... তাতেই টিকিট থেকে থাকার ব্যবস্থা সব সুচারু ভাবে হয়ে গেল।
দিন দশ কেটে গেল যেমন যায়। না ঠিক তেমনি নয়। একেবারেই অন্যরকম। বনলতাকে রাজি করাতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। এমন কি জীবনানন্দের মানসিক সুস্থতা সম্বন্ধেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ দমেননি। 'আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে' বনলতাকে বিবাহ বার্ষিকীর তিনদিন আগে তিনচুলের পথে নিয়ে এসেছেন। নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ রেখেছেন পাঞ্চজন্যর সঙ্গে। সমস্তই হয়েছে প্ল্যান মাফিক। আজ ভোরেই ক্লাইম্যাক্স। ইতিমধ্যে পুরো ঘটনা প্রায় ছত্রিশ এপিসোডের খোলে ভরে ফেলেছেন পাঞ্চজন্য।স্ক্রিপ্ট পড়ার দিন প্রযোজকের মুখটা অন্ধ্রের কাতলা মাছের মত হলে - সেট পড়বে তিনচুলেতে আর ডিম ভরা কই হলে - সোজা সুইজারল্যান্ড। একটি করে কুচক্রী ননদ, দুস্থ কবি বন্ধু, হৃদয়ে চোট পাওয়া মাতাল, কমেডিয়ান হোটেল মালিক সব বসানো হয়ে গেছে খাঁজ খোঁজ মোতাবেক। এখন শুধু একটু বাস্তবে কি ঘটেছে তার মৌতাতটুকু চাই। পাঞ্চজন্যর মোবাইল বাজল সকাল সাড়ে আটটায়। উদগ্রীব পাঞ্চজন্য বললেন -
- ' কি এত দেরিতে উঠলি? সূর্য তো
মাথায় উঠে গেল। ক্যামেরায় সোলার ফিল্টার লাগাতে হবে এবার। যাগ গে । তাহলে আজ আবার মালা
বদল হল? কেক তো বিকেলে পার্টিতে কাটা হবে। আমার লোক সব ঠিক ঠাক করেছে তো'?
= ' হ্যাঁ ভাই । সব ঠিক ঠাক। তোর
ব্যবস্থাপনার জবাব নেই। আর ভোরে উঠতে হয় নি'।
- ' মানে? ভোরবেলা ঘুমালি ষাঁড়ের
মত? আর আমার এত ডায়ালগ - কিছু বললি না'?
= ' রাগ করিস না ভাই। ভোরে উঠিনি
মানে ঘুমাই নি। জেগেই ছিলাম। আসলে দু দিন এখানে ওখানে খেয়ে দেয়ে ... বুঝলি কি না
... কাল রাতে অম্বলের ব্যথায় প্রাণ যায় যায়। রাত বারোটা নাগাদ বনলতাকে ডাকতেই হল। তাড়াহুড়োয়
শুধু প্রেশারের ওষুধ নিয়েই বেরিয়ে এসেছিলাম। বাকি সব ওই গুছিয়ে নিয়ে এসেছিল। যা হোক
এক ডাকাতেই বাক্স নিয়ে হাজির। ওরও না কি ঘুম আসছিল না। ওষুধ খেয়ে ঘণ্টা দুয়েক পরে একটু
স্বাভাবিক হলাম। তো ... অত রাতে আর কোথায় পাঠাবো ... রইল আমার ঘরেই। তারপর বুঝলি না
... এদিকে তো ... দুজনেরই রাতের ঘুম চটকে গেছে। কি করি ? টুক টাক গল্প করতে করতে
... আশ্চর্য! এত কথা বাকি ছিল আমাদের। কখন
সূর্য উঠে গেল।
- ' গল্প করতে করতে সূর্য উঠে গেল?
আর কাঞ্চনজঙ্ঘা'?
= ' সেও হল । কাল অল্প বৃষ্টি হয়েছিল
বলে আজ সকালে পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা । আস্তে আস্তে সোনালি রং গড়িয়ে পড়তে লাগলো পাহাড়ের
গা বেয়ে ... সে যে কি দৃশ্য । আমি ভাই তোর মত জাত লেখক নই । ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
মালা তো রাখাই ছিল, বদলে নিলাম। কি জানি। জীবনটাও বোধহয় - ডায়ালগ ছাড়াই - একটু বদলে
গেল। তুই বদলালি। তোকে ...'।
= ' থাক । ধন্যবাদ দিবি তো? দিতে হবে না। জাত লেখক বললি... তোকেই ধন্যবাদ।
আমাদের কেউ লেখক বলে না রে। ধরে নে আমরা মিথ্যে কথার শপিং মল। আচ্ছা একটা ডায়ালগ ও
কাজে এলো না তা হলে'?
- ' এলো তো । -শাশ্বত রাত্রির বুকে
সকলই অনন্ত সূর্যোদয় - । আমি মুখস্থ করে রেখেছিলাম। অবশ্য তোর নয় ... স্বয়ং জীবনানন্দের। দুঃখ পেলি'?
= ' না। দুঃখ কিসের? এত চোখ খুলে
যাওয়া। বানানো ডায়ালগ বললে গভীরতাই নষ্ট হয়ে যেত। তার কবিতার কথা ভাব। কত পুরনো কিন্তু
কতটা টাটকা। তোরা বরং আর কটা দিন বাড়িয়ে নে।
থেকে আয় আবিষ্কারের আনন্দে। আমি বলে দিচ্ছি।বাই দ্য ওয়ে অনেক অভিনন্দন তোদের পুনরুজ্জীবনের।
রাখি এখন'।
মোবাইলটা ছেড়ে পাঞ্চজন্য বসলেন একটু চুপচাপ। কত ডায়ালগ লিখেছেন জীবনে। রাতের পর রাত কেটে গেছে। এক এপিসোডে বিচ্ছেদ ঘটানো, মানসিক যাতনা, বেহালায় জৌনপুরী । পরেরটায় মিল মিশ, সেতার সরোদে সিন্ধু ভৈরবী। টেলি-কাস্ট হলে আবার টেনশন । জনতা নিল কি না। অথচ এদের দেখো। কোন পরিকল্পনা নেই । যাতনা বলতে শুধু অম্বল - ব্যাস। ঢাক ঢোল বাজলো না, তিনদিক থেকে ক্যামেরা ফোকাস করলো না, তবু মিলে গেল সব কিছু। কলকাতা তিলোত্তমা হয়ে ঝলমল করে উঠল। ওই কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই।
পাঞ্চজন্য একটি লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে পড়লেন। তাকালেন হাতে ধরা এক তাড়া কাগজের দিকে। একবার ভাবলেন ছিঁড়ে ফেলেন ।যত সব মিথ্যের বেসাতি। কিন্তু না। কবি তো বলেইছেন - 'সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে। কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে - সহজ লোকের মতো;'। মাটি পৃথিবীতে যা হল - তাতে তো হর্ষ বিষাদ কিছুই নেই। রং মাখানো দুনিয়ায় তা অচল। জাত লেখকরা মাথায় থাকুন। তার ভাব নয় - ভাত চাই। এবার বেরোতে হবে। প্রযোজকের সময় নেওয়া আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন