বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


কাশ্মীরি ফানিমুন

বিশ্বজিতের  সাথে ঝগড়া করে রেগে মেগে মল্লিকা বাপের বাড়ি চলে এলো। মা বসুন্ধরা অবাক হয়ে বললেন।

- কি হয়েছে? কি করেছে বিশ্বজিৎ?

- ঠকিয়েছে আমাকে। বলেছিলো কাশ্মীর নিয়ে যাবে। এখন বলছে কাশ্মীরের পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই কাশ্মীরের বদলে নৈনিতাল যাবে। বলো মা এটা ঠকানো নয়? কাশ্মীর আর নৈনিতাল কি এক? শয়তানটা তার জবাবে কি বলেছে জানো? বলেছে আরে নৈনিতাল আলু দিয়েই তো জেনুইন কাশ্মীরি আলুর দম তৈরি হয়। সুতরাং যা কাশ্মীর তাই নৈনিতাল। দুটোই তো হিমালয়ে। আমি তাই ঝগড়া করে চলে এসেছি।

বসুন্ধরা দেবী শুনে হেসে দিলেন। তার পুরনো কথা মনে পড়ে গেছে। পুরনো কথাটা এরকম।

সে অনেকদিন আগের কথা। তখনকার দিনে রেওয়াজ ছিলো না, তবু মল্লিকার মা বসুন্ধরা দেবীর হনিমুনে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। মল্লিকার বাবা শৈলেন্দ্র এক লজেন্স কোম্পানিতে কাজ করতেন। বিয়ের পরে কাজে জয়েন করে উনি একটি সুখবর পেলেন। তাদের কোম্পানি ঠিক করেছে লজেন্সের ব্যাবসাটা কাশ্মীর উপত্যকায় ছড়িয়ে দিতে হবে। সে সব খোঁজ খবরের জন্য কোম্পানি একজনকে কাশ্মীরে পাঠাবে। বড়ো সাহেবের বিবেচনায় ইয়ং এন্ড এনারজেটিক শৈলেন্দ্রই সেই একজন। কিন্তু সদ্য বিবাহিত শৈলেন্দ্র একা একা কেনো যাবেন? তাও আবার ভূস্বর্গ কাশ্মীরে? তিনি বড়ো সাহেবকে বলেছিলেন-

- স্যার বউকেও যদি সাথে নিয়ে যাই?

- আরে! নিশ্চয় নিয়ে যাবে। এটা নয় অফিস কাম হনিমুন ট্রিপ হলো। তবে ওয়ান থিং। লজিং খরচটা কোম্পানির। বউ বাবদে বাকি সব খরচ কিন্তু আপনার।

তাই সই।

হনিমুন কি বস্তু বসুন্ধরা দেবী জানতেন না। তবে কাশ্মীর যে ভূস্বর্গ সেটা জানতেন। আর স্বামীর সাথে বেড়াতে যেতে কার না ভালো লাগে। তাই এই প্রস্তাব শুনে তিনি খুব আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে রসভঙ্গ করে তাদের যাত্রাটা শুধু দুজনের হয়নি। তৃতীয়জন হিসেবে তাতে শৈলেন্দ্রর মা অর্থাৎ বসুন্ধরার শ্বাশুড়ি অন্নপূর্ণা দেবীও জুড়ে গেছিলেন। এর জন্য দায়ী সেই সময়কার একটি বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা। শাম্মী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর অভিনীত "কাশ্মীর কি কলি"। ইংরেজি বানানে "Kashmir ki Kali". আর এতেই বিভ্রান্ত হয়ে কলি হয়ে  গেলো কালী। কাশ্মীরে যে বিখ্যাত কোনো কালীমাতা আছেন অন্নপূর্ণা দেবী জানতেন না। কারো কাছ থেকে সিনেমার খবরটা পেয়ে তাঁর মনে সেই কালীমায়ের দর্শনের জন্য দুর্নিবার সাধ জেগে উঠলো। তিনি শৈলেন্দ্রর কাছে দাবি রাখলেন।

- ও শৈলো। আমাকেও নিয়ে চল। মায়ের দর্শন করে আসি।

ফলে অফিসের ডিউটি কাম হনিমুন ট্রিপটার সাথে তীর্থযাত্রা ও যুক্ত হয়ে গেলো।

তখন কলকাতা থেকে সরাসরি কাশ্মীর যাওয়ার ট্রেন ছিলো না। যাত্রাটি করতে হতো কয়েক ধাপে। ট্রেনে হাওড়া থেকে দিল্লি। দিল্লি থেকে জম্মু, সেটাও ট্রেনে। জম্মু থেকে কাশ্মীরের শ্রীনগর। সেটা বাসে। এবং জনশ্রুতি অনুসারে, পাহাড়ি পথের সেই বাসযাত্রাটি মোটেই সুখের নয়। কিন্তু ধর্মের জন্য তীর্থযাত্রীরা সবরকম ক্লেশ সইতে রাজি থাকেন। অন্নপূর্ণা দেবীও রাজি ছিলেন। তাকে পথের কষ্টের কথা বলে নিরস্ত করা যায়নি।

নির্দিষ্ট দিনে শৈলেন্দ্র, বসুন্ধরা ও অন্নপূর্ণা দেবী সন্মিলিত অফিসিয়াল ট্যুর কাম হনিমুন কাম তীর্থযাত্রার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। এবং দীর্ঘ তিন দিনের যাত্রা শেষ করে শ্রীনগরে পৌঁছে গেছিলেন। হোটেলের কামরা কোম্পানি বুক করে দিয়েছে। ডবল বেড কামরা। শোবার জন্য একটাই ডবল বেড খাট। তখন চারটে অপসন নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর তর্কাতর্কির শুরু হলো।

অপসন এক‌ - ছেলে বউ খাটে অন্নপূর্ণা দেবী চাদর পেতে মাটিতে।

অপসন দুই - মা বউমা খাটে, শৈলেন্দ্র মাটিতে।

অপশন তিন - মা অন্নপূর্ণা খাটে, ছেলে বৌমা দুজনে মাটিতে।

এবং অপসন চার - শৈলেন্দ্র খাটে, শ্বাশুড়ি বৌমা দুজনে মাটিতে।

তর্ক চলতেই থাকলো। এ তর্কের মীমাংসা আর হয় না। এর মধ্যে আরো একটি দুঃসংবাদ। হোটেলের লোকজনেরা জানালো, কাশ্মীরের কোনো বিখ্যাত কালীমাতার মন্দিরের কথা তারা জানে না। শোনেনি কখনো। সেই শুনে অন্নপূর্ণা দেবী ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন। শৈলেন্দ্র মাকে ভরসা দিলেন। কালীমাতার দর্শন হবে না বলে মন খারাপ কোরো না মা। ভূস্বর্গ বলে কথা। এখানে দেখার মতো অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। বলে তিনি গড়গড় করে অনেক কটা জায়গার নাম অন্নপূর্ণা আর বসুন্ধরাকে শুনিয়ে দিলেন। একটু আগেই হোটেলের লোকজন নামগুলো তাকে শুনিয়েছে। অতো অতো নামগুলোর মধ্যে অন্নপূর্ণা দেবীর কানে বাজলো শুধু একটা নাম। "গুলমার্গ"। তিনি নামটা মনে মনে বিশ্লেষণ করে বুঝে নিলেন, তাকে গুল মারা হচ্ছে। কাশ্মীরে কালী নেই হতেই পারে না। সিনেমাওলারা কি মিছিমিছি সিনেমা বানিয়েছে? মাকালীর নামে মিথ্যে মিথ্যে প্রচার করবে? ওদের কি ভয় ডর নেই? এমন মিথ্যেচার করলে মা ছেড়ে দেবে? তবে তিনি মনের কথা মনেই রাখলেন।

শৈলেন্দ্র বলেছিলেন, আমাকে তো অফিসের কাজে বের হতে হবে। সেই সময়টুকু তোমাদের এই হোটেলেই থাকতে হবে। অফিস থেকে ফিরে এলে তারপর বেড়াতে বের হবো। আর পরে দুটো দিন অফ আছে। তখন হোল ডে ট্যুর হবে।

সে রাতে শোয়ার অপসন মানা হলো অপশন তিন। মা খাটে, শৈলেন্দ্র বসুন্ধরা চাদর পেতে নিচে। পরদিন শৈলেন্দ্র সকাল সকাল অফিসের কাজে বের হয়ে গেল। এবং মা এবং বৌ দুজনকেই নানা রকম হুঁসিয়ারি দিয়ে গেল। তারা সেসব মন দিয়ে শুনলেন। কিন্তু শৈলেন্দ্র বের হয়ে যাওয়ার পরেই সক্রিয় হয়ে উঠলেন অন্নপূর্ণা দেবী। মায়ের দর্শন ইচ্ছে কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। তিনি হোটেলের ছেলেটিকে ডেকে বিশুদ্ধ বাংলায় তার কাছে কাশ্মীরের কালীর ব্যাপারে তত্ত্ব তল্লাশ করতে শুরু করলেন। বাকি ভাষা না বুঝলেও সে ছোকরা কাশ্মীরের কালী শুনে, দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়ে বিখ্যাত সিনেমাটার কথা বলা হচ্ছে ধরে নিলো। এবং সোৎসাহে বলে উঠলো, এঁহা পর উসকা সব সুটিং হুয়া। দাল লেক, নিষাদ বাগ, গুলমার্গ।

আবার সেই গুলমার্গ! এ ছোকরাও কি গুল দিচ্ছে? 

অন্নপূর্ণা দেবী বলে উঠলেন, আমরা দেখতে যায়গা। এখনই যায়গা। কাশ্মীরের কালী দেখতে যায়গা।

ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলো ব্যবস্থা করতে। এবং টাঙ্গা সমেত ওসমান দারকে হাজির করে ফেললো। হোটেলের ছোকরার নির্দেশ মেনে টাঙ্গাওলা ওসমান দার খুব যত্ন করে দুই বাঙ্গালী ঔরতকে কাশ্মীর কি কলির যাবতীয় সুটিং স্থল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো। লেক, ফোয়ারা, ফুলের বাগান। ভারি সুন্দর। কিন্তু কালী কোথায়? অন্নপূর্ণার জিজ্ঞাসার কোনো জবাব নেই ওসমানের কাছে। সে যতোই বোঝাতে চেষ্টা করে সে প্রায় সব সুটিং স্পটই দেখিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই দুই বাঙ্গালী ঔরতকে বোঝাতেই পারে না। অগত্যা নয়ন  সার্থক করে শ্রীনগরের শোভা অবলোকন করলেও মনে অসম্পূর্ণ দেবী দর্শনেচ্ছা নিয়ে দুজনে হোটেলে ফিরে আসেন। অন্নপূর্ণা দেবীর নিজস্ব ধনভান্ডার থেকে ওসমানের ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া হয়। আর শ্বাশুড়ী বৌমা ঠিক করে, তাদের এই ব্যর্থ অভিযানের কথা শৈলেন্দ্রকে জানানো হবে না। তবে এই অভিযানটিকে পুরোপুরি ব্যর্থ অবশ্যি বলা যাবে না। কারণ শ্বাশুড়ি বৌমা যা দেখে নয়ন সার্থক করেছেন, বহু সময় ধরে নিজেদের  মধ্যে তা নিয়েই গল্প করতে থাকলেন। খুশির চোটে অন্নপূর্ণা দেবী বললেন, গতরাতে আমি খাটে শুয়েছি তোরা নিচে। আজ শৈল নিচে শোবে। আর খাটে আমার সাথে তুই।

সে রাতে সেই ব্যাবস্থাই হলো।

শনিবার শৈলেন্দ্র ছুটি পেলো না। রবিবার ওরা তিনজন আবার সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখতে বের হলো। আবার সেই ওসমান টাঙ্গাওলা। তবে সে অতি সজ্জন ব্যক্তি। গত অভিযানের কথা একবারের জন্যেও উল্লেখ করলো না। অফিসের কাজ আর ভূস্বর্গ কাশ্মীর শোভা দেখা সেরে সোমবার সকাল সকাল ওরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলো। যাত্রা শুরু কোরে তিনদিন পর কলকাতায় ফিরে এলো। কলকাতা ফিরেও অন্নপূর্ণা দেবী আর বসুন্ধরা দেবী সেই ব্যর্থ অভিযানের কথা কাউকেই ঘুণাক্ষরে কিছু জানালেন না। তবে বহু বছর পরে মল্লিকা  যখন সদ্য যুবতী এবং মায়ের প্রিয় সখী, তখন একদিন এই গপ্পোটা বসুন্ধরা দেবী তাকে শুনিয়ে বলেছিলেন,

- জানলি মল্লি। কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে আমরা এভাবে ঠকে গেছিলাম।

মল্লিকা বলেছিলো, আর তোমাদের শোয়ার ব্যবস্থা? ঘুরে ফিরে ঐ চার রকমই হয়েছিলো তো? বসুন্ধরা দেবী হেসে বলেছিলেন, তা নয় তো আবার কি রকম হবে?

মল্লিকা মুখ ঝামটে বলে উঠেছিলো, ঠাম্মা ঠকেনি মা। সে কাশ্মীর যাত্রায় ডাহা ঠকেছিলে তো তুমি। ওকে কি হনিমুন বলে? ও তো ফানিমুন। তবে সেটা নৈনিতাল আলু দিয়ে কাশ্মীরি আলুর দমের থেকে বেটার ছিলো কি না বলা যাবে না।

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন