ধারাবাহিক উপন্যাস
দ্য ক্লাউড
(চতুর্থ পর্ব)
আনন্দ বলতে থাকলো, সেদিন কী হলো, আকাশের ভাঁড়ার উপুর করে বৃষ্টি এলো। তখন ফুটপাতে আমার ছোটোখাটো দোকানটা গোটানোর পালা। হঠাৎ করে সরকারের মনে হয়েছে যে, শহরের সৌন্দর্য্যায়নের জন্য ফুটপাত কেবলমাত্র নাগরিকদের হাঁটাচলার জন্য ব্যবহৃত হবে। আচ্ছা বলুন তো, ফুটপাতের দোকানদাররাও তো নাগরিক! সরকার ও তার প্রেরিত দূতদেরকে পাঠিয়ে মাসোয়ারা নেয়। এ ছাড়াও পুনর্বাসন বলে একটা কথা আছে!
যেটা এতদিন ধরে স্থায়ী ছিল, সেটাই একটা মাত্র ভাষণে অস্থায়ী হয়ে গেলো। কতো জিনিসপত্র! বৃষ্টির মধ্যে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে ঢেকে একপাশে রাখছি। পথচারী দুটো কুকুর, যারা প্রতিদিন দোকান খোলার পরে ধূপ দেখিয়ে আমার নিজের হাতে টাইগার বিস্কুটের প্যাকেটকে এক নিমেষে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায়, তারাও আর আগামীকাল থেকে আমাকে দেখতে পাবে না। তারাও আগামীকাল থেকে বেওয়ারিশ ও ভিটেছাড়া হয়ে যাবে।
ভাবছিলাম, আচ্ছা, মানুষের জীবনেরই কি সত্যি সত্যিই কোনো ওয়ারিশ আছে? এ-সব ভেবে খুব হাসি পাচ্ছিলো। আপন মনেই তাই, দন্ত বিকশিত করে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম। হঠাৎই পেছন থেকে শুনতে পেলাম, আরে, এই হাসিটাই তো আমরা চাইছিলাম! দেখো দেখো, কতো খুঁজেছি। কোথায় না কোথায় প্রফেশনালদেরকে খুঁজে বেড়িয়েছি। কোত্থাও মনমতো কিছুই পাইনি।
আমার কাছে এসে লোকগুলো বললো, এই যে দাদা, শুনছেন! বললাম, আমাকে বলছেন? বললেন, হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি। কী নাম আপনার? বললাম, আনন্দ। ওনাদের মধ্যে একজন আমার খুব কাছে এসে বললেন, আপনি যা ভেবে এমন প্রাণখোলা হাসি হাসছিলেন আনন্দবাবু, ঠিক, তাই ভেবেই আর একবার হাসুন তো!
বললাম, কেন? ভদ্রলোক বললেন, আসলে আমরা বিজ্ঞাপন তৈরি করি। আপনার একদম ওই হাসিটাই আমাদের দরকার। কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেললাম, দেখুন, ফুটপাতে সাফাই অভিযান শুরু হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে সব ফাঁকা করে দিতে হবে। তাই...
এ এক নাছোড়বান্দা অবস্থায় পড়লাম। অবশেষে ওনাদের কথামতো আমাকে ওনাদের জন্য খানিকটা সময় দিতেই হলো। কী যে মনে হলো, বললাম, তাহলে বোঝাপড়াটা সেরে নিই! ওদেরই মধ্যে একজন বললেন, বলুন, এক থেকে দু' সেকেন্ডের জন্য হাসতে আপনি কতো চান? বললাম, দেখুন, ঘন্টা মিনিটের হিসেবে সেটা হয়তো খুবই সামান্য সময়ের ব্যাপার। তবে আপনারা তো আমার হাসিটাকে ব্যাবহার করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করবেন? কী? করবেন তো? তার মানে ফায়দা হবে আপনাদের? উনি বললেন, আরে মশাই, সেইজন্যই তো আমাদের এতো খোঁজাখুঁজি!
একথা সেকথার মাঝে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আমার এই হাসির ছবিটি আপনারা কোথায় ব্যবহার করবেন? ভদ্রলোক বললেন, এই শহরেরই প্রান্তিক জায়গায় একটি বৃদ্ধাবাস নির্মিত হচ্ছে। যে সমস্ত মানুষ টাকাপয়সা ও স্বজন পুত্র কন্যা থাকতেও অত্যন্ত অশ্রদ্ধার সাথে বেঁচে আছেন, আমাদের হাসিখুশি বাতাস তাদেরকে পুনর্বাসন দেবে। যেহেতু হোমের নাম হাসিখুশি, তাই একটা অনাবিল হাসির দরকার আমাদের। সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে বললাম, এটুকু বলতে পারি যে, আমার এই একলা হাসিটুকু কিন্তু আমি ছোটোবেলা থেকেই রপ্ত করেছি। সাথে এ-ও বললাম, তবে তো লং-টার্ম উপযোগিতা নিয়ে আপনাদের প্রোজেক্ট চলতে শুরু করছে?
হাতের কাজ গোটাচ্ছি আর ভাবছি, রাস্তার নেড়ি দুটো, যারা কাল থেকে আমার হাত থেকে আর বিস্কুট পাবে না, তাদের পুনর্বাসন। এই আমি, যে কাল সকালবেলা ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে, তার পুনর্বাসন। যে মানুষগুলো সব থাকতেও বাস্তুহারা, তাদের পুনর্বাসন। পৃথিবীতে এমন একটা পুনর্বাসন নামক চমৎকার শব্দকে কাজে লাগাতে তাই আমি মনে মনে মরিয়া হয়ে আগামী পাঁচবছরের জন্য পরিবারের তিনজনের খরচ বাদ দিয়ে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের একটা মোটামুটি হিসেব কষে দুম করে বলে দিলাম, দশ লাখ লাগবে। দেখুন, সম্ভব হলে বলুন। না হলে এখন আমার বহু কাজ। এই বলে আমি আমার নিজস্ব কাজে উঠেপড়ে লেগে গেলাম।
লোকগুলো নিজেদেরকে আমার থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলো। বুঝলাম, ওনারা নিজেদের মধ্যে কিছু আলাপচারিতা সেরে নিতে চান এই বিষয়ে।
এনাদের দলপতি এইবার আমার কাছে এসে বললেন, একটু কমান! বললাম,দেখুন এই যে পুনর্বাসন নামক চমৎকার একটা কথা, এটা সর্বত্রই চলছে। প্রতিমুহূর্তে, প্রতিটি জনপিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা চলছে। এই তো কয়েকদিন আগে, রাস্তার ওপরে থাকা একটি বৃহৎ বটগাছকে সড়ক উন্নয়নের জন্য পরিবেশবিদেরা অসম্ভব দক্ষতার সাথে উৎপাটন করে অন্যত্র প্রতিস্থাপন করে। এরপর সংবাদপত্রের শিরোনাম - প্রতিস্থাপিত করা গাছটি ক্রমশই সবুজ পাতায় সেজে উঠছে। আমারও আজকে উৎপাটিত হওয়া এক বিচিত্র অবস্থা। এর থেকে বেরিয়ে আপনাদের হাসিখুশি বৃদ্ধাবাসে আমার হাসিমুখ দেখানো, এও তো বটগাছের মতো একটি পুনর্বাসনের উদাহরণ!
আমার এমন পুনর্বাসন নামক চমৎকার উদাহরণে একেবারে কুপোকাৎ হয়ে গেলো বিজ্ঞাপন কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন