মজলিশী অতুলপ্রসাদ : বাংলাগানে ঠুংরী, গজলের প্রবর্তক
সংগীত গবেষক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অগ্রন্থিত একটি প্রবন্ধে অতুলপ্রসাদ সেন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন,
"অমন রসিক সুজন দুর্লভ রস তাঁকে সংহীত করেছিল। রসকে মর্যাদা দিতে তিনি জানতেন।
পর্ণকুটিরে ভৈরবী ঠুংরি শুনতে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে। বৃদ্ধ ওস্তাদ কেঁপেই অস্থির, সেন
সাহেবকে কোথায় বসাবে?”
সেই ছেঁড়া-ভাঙা খাটের উপর বসে
ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনলেন। সঙ্গীত গবেষক ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অতুলপ্রসাদ
সম্পর্কে এই কথাগুলো শুনলেই বোঝা যায়, তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের কতটা অনুরাগী ছিলেন।
কতটা সংগীতপিপাসু ছিলেন। বলা যায়, যতটা না গায়ক, তার থেকেও বেশী শক্তিশালী শ্রোতা।
সংগীতের রস, অন্তনিহিত ভাব, ব্যঞ্জনা তাঁকে একপ্রকার তুরীয় অবস্থায় নিয়ে যেত। পঞ্চকবির
এক কবি অতুলপ্রসাদ সেন। নির্মাণ করেছিলেন তাঁর
নিজস্ব ঘরানা। সেই ঘরের নাম অতুলপ্রসাদ সেনের গান। তাঁকে বলা হয় বিরহের কবি, মরমী
কবি। একাকীত্বের আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেদনার অলিন্দে এসে যেন সংগীতের উদাসী আকাশে
উড়িয়েছেন বিষণ্ণতার কারুকাজ ভরা গানের জয়ধ্বজা। গানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনেছেন
"একা মোর গানের তরী"। কিন্তু ভেবে
দেখুন, মানুষটা বিষণ্ণতার কথাই কি বলেছেন সারাজীবন? অতুলপ্রসাদের অতুলনীয় সম্পদের মধ্যে পড়ে উত্তরভারতীয় শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের বহুমুখী ধারা তিনি দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করেছেন তাঁর ভাবের ঘরে। অতুলপ্রসাদের
এক অচেনা অতলের সন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি সত্যান্বেষী হয়ে। সত্যিই তিনি এক রসিক সুজন
ছিলেন। রসের মর্যাদা দিয়েছেন রাগ রাগিণীকে। তাঁর আর এক নাম দেওয়া যায় মজলিশী অতুলপ্রসাদ, যিনি বাংলা গানের প্রথম
ঠুংরির প্রবর্তক। সংগীতের প্রকৃত সমাঝদার মানুষ। ৬৫ বছরের জীবনে ২০৭খানা গান মাত্র।
অসম এই সংখ্যাতত্ত্ব আমাদের টেনে আনে এক জটিল জীবনের স্রোতাগর্তে। প্রশ্ন ওঠে অনেক
রকম। গান কি তাঁর আত্মবিম্ব না আত্ম প্রতারণা? তিনি লিখছেন, "ওগো দুঃখ সুখের সাথী
সঙ্গী দিনও রাতে সঙ্গীত মোর"... তাঁর গানে যতই বিরহ থাক না কেন, তাঁর জীবন নিয়ে
যত রকম প্রশ্নই থাকুক না কেন, মানুষটা ছিলেন মজলিশি। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তিনি
যতটা না গাইতেন, তার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন।
এই কথাই বারবার বলেছেন সংগীত গবেষক
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। "গান শুনে মুগ্ধ হলে, অতুলপ্রসাদের মুখ থেকে নানান
রকম উর্দু জবানের খই ফুটতে থাকে। শেষে বেসামাল হয়ে পড়েন। শিল্পীর দশ গজ দূরে থেকে
তিনি শুরু করতেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আরম্ভ হতো তাঁর ওয়া ওয়া, আরো পাঁচ মিনিটের মধ্যে
আরও ঘেঁষে আসতেন, শিল্পীর সঙ্গে টেনে আনতেন গুটানো সতরঞ্চিটিকে, আর তার সঙ্গে আমাকেও"...
১৯০২ থেকে ১৯৩৪ তাঁর জীবনের বত্রিশটা বছর কেটে
গেছে উত্তর ভারতীয় গানের সঙ্গে। তাই গানের মধ্যে যতই বিরহের আত্মকথা থাকুক না কেন, এই মজলিশী মানুষটাই
গজল আর ঠুংরির আত্মাকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। ধূর্জটিপ্রসাদের বহু বর্ণনা থেকে বোঝা
যায়, তিনি কতটা শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। এক জায়গায় গান শোনার দুটি
বর্ণনা দিয়েছেন। "দুটি নিখিল ভারত সংগীত সম্মেলনে অতুলপ্রসাদ উপস্থিত ছিলেন।
দিনে রাতে একবারও আদালতমুখো হননি। এই তিন দিনে তাঁর হাজার দুই তিন টাকার ক্ষতি হলো।
আমি সত্যই তাঁকে দেখেছি তার বাড়িতে যে কোন গান শোনার জন্য মক্কেলদের কাছ থেকে দৌড়ে
পালাতেন তিনি চোখ বুজে একেবারে মত্ত হয়ে যেতেন"…
লখনৌতে থাকাকালীন তাঁর বাংলোয়
আসতেন নবাব আলী সাহেব, আহমেদ খালিফ খাঁ, মুন্নিরেখা বরকত আলি খাঁ, আবিদ হোসেন। কখনোও
আসতেন আব্দুল করিম খাঁ সাহেব, ভাতখন্ডে ও শ্রীকৃষ্ণ রতান ঝংকার যিনি ছোট মুন্নে খা
ওয়াজিদ আলি শার দরবারের শেষ গায়ক ছিলেন, এসে জুটে ছিলেন অতুলদার বৈঠকখানায়। অতএব
প্রসাদ সেনের নিজস্ব বৈঠকখানায় তাঁর আসা যাওয়া ছিল। 'তালিব হুসেন' লখনৌ- এর শেষ বিখ্যাত
সানাইয়া। কৈসরবাগে থাকতে ভোরবেলা ভৈরো আর টোরী বাজাতেন দূর থেকে। অতুল সেন ঘুম থেকে
সুর শুনতে শুনতে উঠতেন। বলতেন, ইউসুফের সেতারে বড় মিঠা হাত। তাঁকেই রাখলেন। বরকতের
ছড়ির টান ভালো, নিয়ে এসো তাকে। কদরদান বলতে লখনৌয়ের লোক কি বোঝে জানি না, তবে ধূর্জটিপ্রসাদ
বলছেন, অতুলপ্রসাদকেই বুঝতাম। বাংলাদেশ নবাব ওয়াজিদ আলি শার মারফত লখনউর কাছে তিনি চিরঋণী। লখনৌ তাঁকে মজলিশী অতুলপ্রসাদ
বানিয়েছে ধীরে ধীরে।
অতএব লখনৌ থাকাকালীন বসত গানের
আসর। সেখানে সেই সময়ের তাবড় তাবড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের উপস্থিতি উজ্জ্বল
করত বৈঠকি আড্ডা। ভারতীয় সংগীতের পীঠস্থান লখনৌ। সেখানে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে বাইজিদের
গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। আর সেই সময় অসামান্য সংগীত সৃষ্টির স্বর্ণায়ন
ঘটে তাঁর। একাধিক গানের মধ্যে ঠুংরির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অতিরিক্ত মাত্রায় পাওয়া
যায় তাঁর বেশ কিছু গানে। পাশাপাশি উত্তর ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারার সঙ্গে তার
পরিচয় ঘটে। যেমন দাদরা, কাজরী, গজল প্রভৃতি।
সংখ্যাতত্বে পিছিয়ে থাকলেও, ২০৬টি
গানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মণি মানিক্য, কথা ও সুরের বিচিত্র মর্মস্পর্শী ঐশ্বর্য। প্রচারবিমুখ
অতুলপ্রসাদ রবি ঠাকুরের নির্দেশে ১৯২৫ সালে প্রকাশ করেন প্রথম গ্রন্থনা। পরবর্তীকালে
১৯৩১ সালে আসে গীতিকুঞ্জ এবং স্বরলিপিবদ্ধ কাকলী রচনা যুগল থেকে বেহাগ রাগে নির্মাণ
করলেন একটি অসাধারণ পরিবেশনা। "তুমি গাও তুমি গাও" যেখানে রয়েছে গজলাঙ্গের
ছোঁয়া। "কে গো তুমি বিরহিনী আমায় সম্ভাষিলে"- গজলের সুমধুর সুমিষ্ট রস
এই গানের মধ্যে একেবারে ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
বাঙালি কখনো এই রস আগে পায়নি। কবি এখানে যে বিরহিনীর কথা বলেছেন, কবির ভাষায় যাকে
সমস্ত ঋতুতেই দেখা যায়। যে অধরা হয়ে ধরা দেয় বিরহিনীর বেশে, যেন সে রাধার মত কিছু
বলতে চায়।
উত্তর ভারতীয় সংগীতের আর একটি
ধারা হচ্ছে লগ্নি। যাকে বিরহের সংগীত বলেই অভিহিত করা হয়, যে সুর শুনলে যে কোন কঠোর
হৃদয় বিগলিত হয়ে যেতে পারে, সেরকম একটি গান হল "ভাঙ্গা দেউল মোর কে তুমি ঘুম
ভাঙ্গালে"…
আরেকটি শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারা
‘কাজরি’ দুলনিচালে রচিত এক অপূর্ব ছন্দে নিবদ্ধ গান। শোনা যায় এই গানটি ছোটবেলায় রাস্তায় ভিস্তীদের জল ছেটানোর সময়
যখন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ উৎসারিত হত, তার যে একটা ছন্দ ছিল, সেই ছন্দকে আশ্রিত করে যেন রচিত
এই গানটি।
"জল বলে চল মোর সাথে চল"…
গান শুনতে তিনি এতটাই পছন্দ করতেন যে প্রতি সন্ধ্যায় নেশার মতো ছিল তার গান শোনা বা
গানের আসরে নিজেকে এবং নিজের হৃদয়কে মেলে ধরা।
বাংলাসাহিত্যে প্রথম ছুরির চাল
সংযোজন করেন তিনি, এছাড়া রাগ-প্রধান রঙে বাংলাগান রচনা সেখান থেকেই শুরু হয় বলে মনে
করা হয়। অতুলপ্রসাদের বৈশিষ্ট্য তিনি বাংলা গানের সুর তালের বিশেষত্বকে অক্ষুণ্ণ রেখেই হিন্দুস্থানী রীতির প্রয়োগ করতে
পেরেছিলেন। জীবনের অনেকটা সময় প্রায় অর্ধেকটা সময় উত্তর ভারতেই কাটিয়েছিলেন, সেখানকার
সাংগীতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়েছিলেন। তাই হিন্দুস্থানী ঢঙের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন বাংলা গানে।
তাঁর এই প্রয়াস একদিকে যেরকম বাংলা গানের ক্ষেত্রে এক নতুনত্বের জন্ম দিয়েছে, অন্যদিকে
বাংলাগানের জগতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ উন্মুক্ত করে শৈল্পিক আবহ তৈরি করেছে। তাঁর ঠুংরি
দাদরা ভঙ্গির গানগুলি শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। যেমন "কি আর চাহিব বল", রাগ ভৈরবী, টপ খেয়াল অঙ্গের গান। "ওগো
নিঠুর দরদি", মিশ্র আশাবরী রাগে গঠিত দাদরা অঙ্গের গান।
খুবই প্রচলিত আরো একটি ঠু্ংরি অঙ্গের
গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, "যাবো না যাবো না যাবো না রে"। কাজী নজরুল ইসলামের গানেও রাগপ্রধান অঙ্গ পাঠঙ্গি
গজলের প্রবল আধিক্য পাওয়া যায়। তবে অতুলপ্রসাদ সেন খানিকটা রবীন্দ্রনাথের মতোই রাগের
আধিক্যকে ততটা গুরুত্ব না দিয়ে ভাবকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে শাস্ত্রীয়
সংগীতের মূল রসটাকেই ধরে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। তবে নজরুলের অনেক আগেই তিনি বাংলাগানে
ঠুংরির প্রবর্তন করেন। উত্তর ভারতীয় সংগীতের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও পাণ্ডিত্য
ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন