‘কালিমাটি’, সমীর রায়চৌধুরী…
সমীর রায়চৌধুরী ও অশোক তাঁতী |
প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ক্রমাগত ‘কালিমাটি’ প্রকাশ হচ্ছে নিয়ম করে,
আমি অবশ্য ‘কালিমাটি’তে বছর বারো
ধরে লিখেছি আজ অব্দি। কিন্তু ‘কালিমাটি
যাপন’ বলতে ঠিক যা বোঝায়, যেটুকু বোঝায়, তা আমার
এখনও হয়ে ওঠেনি বোধহয়। বোধহয় শব্দটা ব্যবহার করলাম কারণ ‘কালিমাটি’ আমার কাছে
শারীরিক উপস্থিতহীন সভা-সমিতির মত যেখানে কেন্দ্রে ‘কালিমাটি’ই
আর অন্য কিছু নেই, বাদবাকি
কেন্দ্রাতিগ কিংবা কেন্দ্রাভিমুখে এখানে লিখছি যারা, লেখালেখির পর নিজেদের মুখ দেখাদেখি
করা সহজ হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু তা হয়নি। এমন হয়েছে, লিখেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ‘কালিমাটি’তে না দিয়ে আর কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছি। কী হয়ত কাজলদার তাড়ায় লিখেছি একপাতা, তারপর নানান কারণে লেখা আর এগোয়নি। এইরকম অনেক কিছু। লেখা
স্বাভাবিক জিনিস ক্ষিধে তেষ্টার মত আর সেই তাগিদে নানান সাহিত্য-আড্ডায় ছুটে ছুটে কী করে সবার
আগে পৌঁছনো যায়, সেই চিন্তা। কত আড্ডা থেকে আবার
মুখ ঘুরিয়ে ফিরেও আসা। অগ্রজ কবি বলেই দিয়েছেন- ‘’এক দশকে সঙ্ঘ
ভেঙে যায়’, হ্যাঁ সঙ্ঘ হয়ত ভাঙে ঠিকই, কিন্তু লেখালেখি যাদের কাছে যীশুর মদ ও রুটির
মত, সেই সমতলক্ষেত্রটুকুকে শেষপর্যন্ত কেউ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারি না। কথা হচ্ছে, যতই সুন্দর মন নিয়ে আসি
না কেন, সংসারের ছাপ তাতে পড়বেই। কাজলদা, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, বারীন ঘোষাল, স্বদেশ সেন প্রমুখ উপদেষ্টা মন্ডলীর ঘেরাটোপে ‘কালিমাটি’র বীজ পুঁতেছিলেন
সেই ১৯৭৮এর এপ্রিলে। এবং প্রবাহ নিরবধি, সেহেতু ‘কালিমাটি’
বড় হল, ক্রমে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ঘেরাটোপের বাইরে, মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ থেকে অনলাইনের
কালিমাটি, ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১০তম সংখ্যা এবং ঐ একই সঙ্গে
‘কালিমাটি মুদ্রিত’ পত্রিকার ১০০তম সংখ্যা প্রকাশ, প্রবন্ধ–নিবন্ধ-অনুরঙ্গ আর বিশেষ বৈশিষ্ট ‘কালিমাটির
ঝুরোগল্প’ লেখা ও প্রকাশ, এইভাবেই তার অগ্রগতি
সবাই যেভাবে জানি।
ঝুরোগল্প লেখার জন্য কাজলদা একটা সময় নিয়ম করে আমাকে তাগিদ দিতেন। লিখেওছি অনেক ঝুরো, আবার লিখে পাঠাইনি তার চেয়েও বেশি, কারণ পুজোর ঘরে ধূপ প্রদীপ জ্বালিয়ে সিরিয়াস মুখে পুজো
না করে যদি হাল্কা গল্পগুজব করি তাতে ক্ষতি কি? আমি অন্তত এরকম ভেবেছি, শুধু ‘কালিমাটি’তে লিখতে গিয়েই, আর অন্য
কোথাও এটা হয়নি। আর লেখা সন্মন্ধে
আমার এককালে যে কাঁচা মোহ ছিল, তাও
ঘুচেছে এখানেই অর্থাৎ ‘কালিমাটি’তেই। ‘কালিমাটি’ই
করেছে এটা। (…শব্দগুলো এবং তত্ত্ব
আর বিশ্বাস
বাস করে মানুষের কল্পনায়, ধারণায়। তুমি আবার আমার কথা মানবে না, বিরোধিতা করবার জন্য উন্মুখ। কারণ you are a believer having a
closed mind, তোমার বিশ্বাস গণিত নিখুঁত ও কঠোর, কিন্তু আমি বলি
it is always flexible’’ – বারীন
ঘোষাল, কালিমাটি অনলাইন, কথনবিশ্ব, ডিসেম্বর
২০১৩) – এর থেকে এইটি
পরিষ্কার, নিজের লেখায় সমস্ত রকম নিজস্বতা থাকবে। আমার তোমার রাম শ্যামের হ্যাপি এন্ডিং যে যার মত,
সেজন্য অনেক ঝুরো লেখবার পরেও শুধু ঝুরোকেই সম্বল করে থেকে গিয়েছি আর ঝুরোগল্প লিখব না
বলেই। ‘কালিমাটি’ যাপন কি
এইটাই? যদি তাইই হয়,
কারণ অনলাইনের ‘কালিমাটি’তে সমীর রায়চৌধুরী
ঝুরোগল্পের প্রস্তাবনা অবতারণা ব্যাখ্যা বিন্যাস, কাকে
ঝুরোগল্প বলা হবে আর কাকে হবে
না, ইত্যাদি মুখে মুখে কথাচ্ছলে বা সিরিয়াসলি বলে দিয়েছিলেন
কারো কারো সামনে। কখনো বলেছিলেন ফোনে, নাতি-দীর্ঘ আলাপে কথায় ইম্পর্ট্যান্ট বক্তব্যেও (মোবাইল কনেকশন এখনকার মত অত ক্যাচাল
করেনি তখন, কী আশ্চর্য!), হয়ত সেটিও
‘কালিমাটি’ যাপন একঅক্ষরে। ২০১৩ সালের কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে মেলায় গেছি, ঘুরেও দেখলাম এ স্টল সে
স্টল, প্রচুর অখ্যাত ও খ্যাত কবি গল্প
লিখিয়ে সম্পাদক লেখকদের ভিড়। ক্রেতা তুলনায় কম, অন্তত আমি যেদিন গিয়েছি এইরকমটাই দেখেছি। পুঁচকে লিটিল ম্যগাজিনগুলোর জন্য এ-প্রান্ত
ও-প্রান্ত ম্যারাপ খাটানো, তাতে সারিবদ্ধ টেবিলে যে যার সম্ভার
সাজিয়ে বসেছেন। কী জানি এসবের
প্রতি কোনো দুর্দান্ত
টান অনুভূত হল না, উলটে
মনে হল ‘ধুর
ছাই’! বেরিয়ে পড়লাম মেলা থেকে, সটান বাঁশদ্রোণী যাব ঠিক করলাম, ওখানে ব্রহ্মপুরে সমীর রায়চৌধুরী থাকেন। আগে থাকতে ফোনে কোনো যোগাযোগ করিনি, কী জানি ওনার
সাক্ষাৎ পাব তো? শুনেছি সেরকম কেউ পরিচিত না হলে বেশি
সময়ও দেন
না, দেখাও করতে চান না। আশির ওপরে
বয়স, তাছাড়া দেখা করতে গেলে আগে থেকে ফোনে কথা বলে রাখতে হয়। আমি ওনার
নম্বার জানি না। বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনে নেমে একবাক্স ভাল মিষ্টি কেনা হল। একক ভাবে
আমি দুটি টাটকা লাল বড় গোলাপ নিলাম ডাঁটি পাতা কাঁটা
সমেত। অফবিট লেখকের জন্য উপহার। দলে অশোক তাঁতীই প্রধান, উনি এর আগে বার
দুই সমীর রায়চৌধুরীর কাছে
এসেছিলেন, দুর্গাপুরের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অশোক তাঁতী। নিমাই মাজি, খুশি, বৌদি সুছন্দাদি আর আমি, আমরা যত
না লিখি ভাবি বেশি, হাসাহাসি করি আরো বেশি, অন্তত সেই সময়ে যেমন ছিলাম, আজ
এতদূর থেকে ওটাই দেখাচ্ছে। রিকসা করে সমীর রায়চৌধুরীর একতলা বাড়ির গেটে নামলাম সবাই, সামান্য বাগান মত পার হয়ে
দু’ধাপ সিঁড়ি উঠে লাল বারান্দা। বারান্দায় তেসরা ফেব্রুয়ারির বিকেল
সাড়ে চারটের তেরছা রোদ। দরজা খুলে দিলেন বেলা রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরীর স্ত্রী। যথেষ্ট ফর্সা, বয়সের ভার, অথচ সুন্দর হাসি, যেন উনি জানতেন আমরা আজ আসবই! ঢুকেই
বসার ঘর, সাধারণ
সোফা ছোট টেবিল ইত্যাদি উপকরণের মাঝে আমিই বেলাদিকে পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করলাম। উনি মাথায় হাত রেখে বললেন, কলকাতা বইমেলা চলাকালীন রোজ কেউ না কেউ সমীর
রায়চৌধুরীর সাথে দেখা করতে আসেন। আজও কেউ আসবে, এটা উনি নিশ্চিত ছিলেন। আমাদের কথার
মাঝেই পাশের ঘর থেকে ধীরে
সুস্থে সমীর রায়চৌধুরী বেরিয়ে এলেন, বেশ লম্বা রোগাটে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অথচ মুখে ছেলেমানুষের হাসি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে গোলাপ দুটো একে একে দুজনে ধরিয়ে বললাম – আপনাদের জন্য এনেছি। সেই শুরু, তারপর দীর্ঘ আড্ডা সবাই মিলে। আমি একটা বড়গল্প ওনাদের শোনাব বলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আগাপাশতলা নিশ্চুপ শুনে সমীর রায়চৌধুরী প্রথম মন্তব্য করলেন – “তোমার গল্পটার মধ্যে আমি অনেকগুলো ঝুরোগল্প দেখতে পেলাম। ঝুরোগল্প লেখো। দাঁড়াও, ঝুরোগল্প নিয়ে একজন কাজ করেছেন, জামশেদপুরের কাজল সেন, নাম শুনেছ? জলধর সেনের নাতি। সাহিত্যে এখন বড় গল্পের ব্রেক এসে যাচ্ছে
নানান কারণে, অত ডিটেলস বলছি না … কিন্তু গল্প লেখা
তা বলে নিশ্চয়ই থেমে থাকবে না, বুঝতে পারছ তো? গল্প, গল্পই থাকবে কিন্তু মিসিং লিংকও থাকবে, সেই জায়গাটা থেকে গল্পটা যেদিক খুশি যাবে, তুমি তোমার ইচ্ছে মত লিখবে সেটা … আরে জীবন যেমন হয় … খেই থাকে না সব সময় …
কোনো নির্দিষ্ট পরিণতি পাবে না …
ধরতাইটা ‘কালিমাটি’, বুড়ি সমীর রায়চৌধুরী, ঐ খেলার মধ্যে ছুটে গিয়ে বুড়ি ছুঁয়ে আসতে হয়, না হলে আউট, সেরকম ঠিক। গুগল দেখাচ্ছে হাংরি কবি সমীর রায়চৌধুরী তাঁর ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’ লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন ও সাহিত্যে হাংরিয়ালিজম পুট করে গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনার মুন্ডে কুঠারাঘাত করেছিলেন, অন্তত তখনও অব্দি কল্লোল গোষ্ঠীর কবি-বৃন্দরা যেমন লিখতেন সেই ৫২/৫৩ সালে। সেই ৫৪/৫৫ সালে সমীর সুনীলকে শুধিয়েছিলেন – “কবিতাকে আপনি কোথায় খুঁজতে চান? কাব্য-আন্দোলনে না আত্মনিগ্রহে?” উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কী কী বলেছিলেন, তা অন্য কখনও বলা যাবে, যেহেতু সিটি কলেজে দুজনে সহপাঠী ছিলেন, আপাত প্রশ্নের যে কোনো ধরনের উত্তর দেবার, এমনকি উত্তর না দেওয়ারও অপশন ছিল তাঁদের, কিন্তু তৎকালীন বঙ্গসমাজ ও তার যাবতীয় এসব ব্যক্তিত্বদের অসহিষ্ণুভাবে নিজেকে প্রথার বাইরে নিয়ে যাওয়া, যাবতীয় নৈরাজ্য এবং হয়ত শেষপর্যন্ত কবিতা-ব্যধি (তাঁদের নিজেদের ভাষায়) অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল। গিয়মের (Guillaume Apollinaire, 1880-1918) লেখা পশুপাখি বিষয়ক ছোট ছোট কবিতাগুলো সমীর রায়চৌধুরীর খুব প্রিয় ছিল। সুররিয়ালিস্ট গিয়মের তুলনায় সমীর রায়চৌধুরীর কবিতা-ভাবনা কোথাও কি আলাদা ছিল? ছিল নিশ্চয়ই, কারণ একা সমীর রায়চৌধুরী কবিতাকে শেষপর্যন্ত বিমূর্ত প্রসঙ্গহীন বলেই মনে করতেন। যার ফলাফল – “যদি নিজস্ব কিছু নাইই দেব তো কবিতা লেখা কেন?’’ ( অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। খুল যা সিম সিম, সমীর রায়চৌধুরী)।
একই আকাশের নিচে গল্পের ঝুরো হয়ে ওঠা ও কোনো পরিণতি না পাওয়াকেই সমীর রায়চৌধুরী প্রথার বাইরে নিয়ে যাওয়া বলে বুঝতেন হয়ত। সেদিনের সেই আড্ডায় সন্ধের মুখে বেলাদি চা তৈরী করতে রান্নাঘরে গেলেন, সাথে আমিও গিয়ে হাতাপাতি করে কাপ ট্রে চা–পাতা কিছু নোনতা সাজানো ইত্যাদি আর ‘খুল যা সিম সিম’ বইয়ে যেমন লেখা - বেলাঃ তোমার চায়ের কী ভাল লাগে? আমার গরম গরম চা আর সাথে নানান খাবার পছন্দ।
সমীরঃ আমার ভাল লাগে
গরম চায়ের গলা দিয়ে ক্রমে নিচে নেমে যাওয়া…’’
এই বিমূর্ততা কি একান্তই
সমীর রায়চৌধুরীর নিজস্ব?
অনেক কথা হয়েছিল সেদিন সাহিত্যের বাইরেও, মৃদু হেসে উনি বলছিলেন – “তুমি এখানে আমাদের সাথে থেকে যাও ঝুমা!’’ বেলাদিও। ছোটবেলার কথা, পানিহাটিতে মামারবাড়িতে ওনার আদরের নাম ছিল বাসুদেব, সবাই ওই নামেই ডাকতেন - এসবের গল্পে, ভাই মলয় রায়চৌধুরীর নানান প্রসঙ্গে, উঠতি বয়সের স্যাঙ্গাত শক্তি সুনীল সন্দীপন শরৎদের টুকরো স্মৃতিতে … সমীর রায়চৌধুরী গতানুগতিক বাণিজ্যিক কাগজের নাম যশের প্রত্যাশা না করেই লিখে গিয়েছেন নিজের মত, তাতে যারা ওনার লেখা পড়েছে শুধু তারাই জানতে পেরেছে ওনাকে। আর কেউ না। হয়ত ‘কালিমাটি’ও না, কারণ ‘কালিমাটি’র সমস্ত প্রয়োগ সব অভিসন্ধি দৃষ্টান্ত যাবতীয় লেখককুল অক্ষরকর্মীরা এবং সম্পাদক শুদ্ধ কারিগর-ওস্তাগররা খুব কমই গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পেরেছেন।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন