সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

রোমেনা আফরোজ

 

আমি কে?




যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কে কিংবা কী আপনার পরিচয়, তখন যে-উত্তর পাওয়া যাবে, সেগুলো হলো সামাজিক স্তর বা সোসাইট্যাল লেভেল (Societal Level), যা সমাজ কর্তৃক প্রতিটি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য প্রদান করা হয়। এই সামাজিক স্তর, যা মানুষের চিন্তাভাবনাকে অতীত এবং ভবিষ্যত নামক মায়াজালের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তা থেকে বের হয়ে বর্তমানে ফোকাস করতে পারলেই অভ্যন্তরীণ আত্মকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অতীত এবং ভবিষ্যত হলো একপ্রকার মায়া। এর মধ্যে ব্যস্ত থাকলে 'আমিকে' খুঁজে পাওয়া যায় না।

বর্তমান রাষ্ট্রগুলো পুঁজিবাদী হওয়ার দরুণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আধ্যাত্মিকতার সকল উপাদান বাদ দিয়েছে। এদিকে বেশিরভাগ মানুষ অবহিত নয় যে, সুখ একপ্রকার মানসিক স্থিতি। তাই তারা ভাবছে বস্তু দিয়ে পরিতৃপ্ত হওয়া যায়। এই ভ্রান্ত ধারণাবশত তারা সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে ফিরছে বস্তুজগতে। ফলে কোম্পানিগুলো খুব সহজে ব্যক্তিকে পরিণত করতে পেরেছে ভোক্তায় (Consumer)। বস্তুকেন্দ্রিক জীবন-যাপনের একটা মারাত্মক সমস্যা হলো, বস্তু মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তুলে বস্তুবাদী (Materialistic) জীবন-যাপনের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

সুফিদের মতে, প্রতিটি বস্তুর জাহেরি এবং বাতেনি দু’টো দিক আছে। জাহেরি অর্থ প্রকাশ্য এবং বাতেনি অর্থ অপ্রকাশ্য। আমরা জানি, সাধারণ চোখে বস্তু একরকম, আবার কোয়ান্টাম লেভেলে বস্তুর গঠন প্রণালী ভিন্নরকম। এ সূত্র ধরে বলা যায়, বাহ্যিক আত্ম হলো জাহেরি দিক আর অভ্যন্তরীণ আত্ম হলো বাতেনি দিক। সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র জাহেরি বা দৃশ্যমান অংশ দেখতে পায়। তারা দৃশ্যমান জগতকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নেয়। কেবল সুফি, সাধক এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরা দেখতে পায় বাতেনি দিক। যেহেতু জাহেরি এবং বাতেনি মিলে বস্তুর গঠন, তাই বাতেনি দিক উপেক্ষিত হওয়ার ফলে এই ভোগবাদী যুগে (Consumerism) মানুষের মানসিক সমস্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি এবং প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত (Voabangla-১৩ই ডিসেম্ভর, ২০২১)।

(১)

আত্ম নিয়ে কিছু বলার পূর্বে ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন। ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা সহাবস্থান করতে পারে। তবে তারা এক বিষয় নয়। কেউ ধার্মিক না হয়েও আধ্যাত্মিক হতে পারেন, আবার ধার্মিক হয়েও আধ্যাত্মিক হওয়া যায়। আমার ধারণা, ধর্মের জন্য আধ্যাত্মিকতা একান্ত জরুরি। কারণ আচার-অনুষ্ঠানের সাথে আধ্যাত্মিকতা যুক্ত  হলে স্রষ্টার নৈকট্য গভীর হয়। ইংরেজিতে আধ্যাত্মিকতাকে বলা হয় স্পিরিচুয়ালিটি (Spirituality)।

ধর্ম হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে নৈকট্য স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এর সাথে মন এবং আত্মা সম্পর্কিত নাও হতে পারে। অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা হলো দেহ, মন ও আত্মা সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে স্রষ্টা বা নিজেকে পাওয়ার সাধনা। বস্তুত আধ্যাত্মিকতা হলো পার্থিব জগত বা বস্তুজগতের বিপরীত অবস্থা।

যদিও আত্ম এবং আধ্যাত্মিকতা একই জগতের বিষয়বস্তু, তবুও দু’টো এক নয়। আত্ম হলো স্বয়ং অর্থাৎ অবচেতন মনের ভেতর সচেতন দৃষ্টিপাত আর আধ্যাত্মিকতা হলো ভ্রমণ বা জার্নি। পার্থিব জগতকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুধাবন করা গেলেও আত্মজগত হলো অনুভবের জগত। আধ্যাত্মিকতার পথে যাত্রা করার প্রথম শর্ত হলো আত্মকে চেনা। দ্বিতীয় ধাপে নিজের মধ্যে বিচরণ করা। তবে পরিভাষা বা টার্মিনোলজি (Terminology) না জেনেও আধ্যাত্মিকতার পথে পরিভ্রমণ করা যায়। এ কথা বলার কারণ, আমি দীর্ঘদিন ধরে আধ্যাত্মিকতার জগতে বিচরণ করছি। এতদিন আত্ম’র বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত থাকলেও 'আত্ম' শব্দটি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম, মানে পরিভাষা না জেনেই আধ্যাত্মিকতার জগতে বিচরণ করেছি। 'আত্ম' শব্দটি জানার পরে বিষয়টার ভাষাগত রূপ দেওয়া সহজ হয়েছে।

এখন আমরা জেনে নেই, আত্ম কী এবং এর স্বরূপই বা কেমন? আত্ম হলো ব্যক্তিগত পরিচয়। দৃশ্যমান জগতের বাইরে এর অবস্থান অর্থাৎ স্নায়ুর ভেতর। ব্যক্তি ভিন্ন অন্য কেউ এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে না। চিন্তা, স্মৃতি, আবেগ এবং মনের অন্যান্য দিকগুলোর অবচেতন ভাণ্ডার হলো অভ্যন্তরীণ আত্ম। এর বিষয়বস্তু হলো অনুভূতি, অন্তর্দৃষ্টি, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব, চিন্তাভাবনা,আবেগ, কল্পনা, ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্য ইত্যাদি। প্রতিটি মানুষের মধ্যে কম বেশি কল্পনাশক্তি কাজ করলেও বলা যায় না যে, সবাই নিজের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত। বস্তুজগতের মতো অশরীরী জগতও (Spiritual) বিশাল। যে যত বেশি নিজ আত্মকে চিনতে পারে তার জগত তত বিশাল হয়।

নিজেকে উপস্থাপন বা অন্যদের অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য একজন মানুষকে নিজস্ব রুচি অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ জগত থেকে আবেগ-অনুভূতি বাছাই করতে হয়, সেই অনুযায়ী মানুষের আচার-আচরণ, কথাবার্তা নির্ধারিত হয়। যেমন প্রতিটি মানুষ শপিং করতে গেলে তার নিজস্ব রুচি এবং পছন্দ অনুযায়ী জিনিসপত্র কেনাকাটা করে। ‘অভ্যন্তরীণ আত্ম’ সমৃদ্ধ হলে বাহ্যিক আত্ম সংযত এবং সুন্দর হয়ে উঠে।

(২)

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ইনারসেল্ফ (Inner self) বা আত্মজগতে কীভাবে বিচরণ করা যায়? আত্মজগত বা স্ব-জগত বা ইনারসেলফের মধ্যে প্রবেশ করতে হলে বস্তুজগত(Material World) থেকে সচেতনতাকে পৃথক করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন গেজেট (Gadget) ( যা ভার্চুয়ালি মানুষকে অন্য মানুষের সাথে যুক্ত করে) এবং চারপাশের মানুষজনের সাথে বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন। প্রথমদিকে বিচ্ছিন্ন হলে 'আত্মজগত' নির্মাণ করা সহজ হয়। এই বিচ্ছিন্নতা থেকে আত্মজগতের আরম্ভ। প্রথমদিকে এই জগতে মনোনিবেশ করা খুব কঠিন। এ সময় মানুষকে  বিভিন্ন জাগতিক চিন্তা-ভাবনা আঁকড়ে ধরে। অবচেতন মন (Subconscious mind) আত্মজগতে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। (অবচেতন মন হলো দীর্ঘকালীন অভ্যাসের ফলে রপ্ত করা প্রোগ্রাম) তাই বিভিন্ন বৈষয়িক চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে বর্তমানের আত্মকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন সাধনা করতে হয়। আমার ধারণা, প্রকৃতির কাছাকাছি কোনো নির্জন স্থানে চোখ বন্ধ করে অভ্যন্তরীণ আত্মকে বেশি অনুভব করা যায়।

(৩)

সাধারণ মানুষজন বর্তমানে দৃশ্যমান জগতে বেশি বিচরণ করে থাকে। ল্যাপটপ এবং মোবাইলের মতো যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য তারা একদিকে কল্পনাশক্তি হারাচ্ছে, অন্যদিকে কমছে চিন্তাশক্তি। এই দুই জগতের মধ্যে সমানভাবে বিচরণ না করার ফলে অ্যাঙজাইটি, ডিপ্রেশনও বেড়ে চলছে। তাই যারা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন, তাদের অভ্যন্তরীণ আত্মের মূল্যবোধ, প্রত্যাশা এবং উপলব্ধির সাথে বাহ্যিক আচার-আচরণ সারিবদ্ধ আছে কিনা তা মিলিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতা (Conscious) জরুরি। সচেতনতা ছাড়া বস্তু এবং অবস্তু জগতের (Spiritual World) আত্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ আত্ম সম্পর্কে সচেতনতা এবং বাহ্যিক আত্মের সাথে মিথস্ক্রিয়ার উপর শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে। অভ্যন্তরীণ আত্ম শক্তিশালী হলে তা আবেগ, আত্মসচেতনতা, স্বচ্ছতা এবং মূল্যবোধ বজায় রাখতে এবং জীবনের উদ্দেশ্য তৈরি করতে সাহায্য করে; প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাহায্য করে শান্ত থাকতে। যখন বস্তুজগত এবং আধ্যাত্মিক জগতে একই সাথে বিচরণ করা যায়, তখন জীবনের বেশিরভাগ সমস্যা দূর হয়ে যায়।

বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বায়নের (Globalization) ফলে শুধু বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন হয়নি বরং সমাজের সর্বত্র এর প্রভাব পড়েছে। এর ফলে বেড়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য। নৈতিকতার ক্ষেত্রে বিরাজ করছে নমনীয় ভাব। মানুষজন এখন হালাল-হারাম নিয়ে আগ্রহী নয়। মিথ্যা, সুদগ্রহণ, অপবাদ, গীবতের মতো পাপ কাজগুলো সমাজে এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু নৈতিকতার ক্ষেত্রে একবিন্দু ছাড় দিলে অবচেতন মন সেই অবস্থাকে শক্তভাবে চিহ্নিত করে রাখে। সেক্ষেত্রে ছোট একটা ভুল থেকে বড় ধরনের অঘটন ঘটার সম্ভবনা বেড়ে যায়।

ইসলাম ধর্মে  বলা হয়েছে, নফসে লাওয়ামাহ এবং নফসে মুতমাইন্না মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথ চলতে সাহায্য করে। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, সিরাতুল মুস্তাকিম বা নীতি-নৈতিকতার পথে দুই নফস মিলেও সরল পথ ধরে রাখা কষ্টকর হয়। অন্যদিকে নফসে আম্মারাহ একাই সিরাতুল দল্লিন বা পথভ্রষ্টের পথে কাজ করে যায়। এর কারণ মানুষ খুব দ্রুত নেতিবাচক কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই মানুষকে নীতি-নৈতিকতার পথে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়।

 

 


২টি মন্তব্য:

  1. খুব সুন্দর লিখেছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লেখা।

    উত্তরমুছুন