সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

পি. শাশ্বতী

 

আলাউদ্দিনের ভারতবিজয়



ভারতবর্ষের ইতিহাসে সারা ভারতে সুলতানী সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রেক্ষিতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে আলাউদ্দিন খিলজির নাম। দাক্ষিণাত্যের যাদব রাজ্যের রাজধানী দেবগিরি। ১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খিলজি দেবগিরি জয়ের লক্ষ্যে অভিযান করেন। কথিত যাদব রাজা রামচন্দ্র বিনাযুদ্ধে পলায়ন করেন ও পরে তিনি প্রচুর অর্থের প্রস্তাব দিয়ে শান্তি চুক্তিতে সম্মত হন। কিন্তু আলাউদ্দিন ফিরে গেলে তিনি সাথে সাথে বিদ্রোহ করেন। আলাউদ্দিন আবারও ফিরে আসেন এবং রামচন্দ্রকে পুনরায় পরাজিত করেন। এবার শান্তিচুক্তির প্রস্তাবে আলাউদ্দিন অচলপুর প্রদেশ নিজ দখলে নেন।

বিস্তারিত ভাবে বলা যায়, ১২৯৬ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি আলাউদ্দিন ৮,০০০ ক্যাভালরি সৈন্য নিয়ে রাজধানী কারা ত্যাগ করেন। তিনি চান্দেরির দিকে অগ্রসর হন এবং তারপর গোপনে ভিলসায় চলে যান। এরপর তিনি বিন্ধ্যঅঞ্চল পেরিয়ে অচলপুরে পৌঁছান। আলাউদ্দিন এত দ্রুত এ সকল এলাকা অতিক্রম করেন যে, কোনো স্থানীয় শাসক তাঁকে প্রতিহত করার জন্য  অগ্রসর হতে সুযোগ পাননি। অচলপুরে তিনি সেনাবাহিনী নিয়ে দুইদিন বিশ্রাম করেন।

অচলপুর থেকে আলাউদ্দিন ঘটি লাজউরা নামে একটি গিরিখাত হয়ে দেবগিরির দিকে যাত্রা করেন। এই গিরিপথে আলাউদ্দিন যাদব রাজা রামচন্দ্রের এক সামন্ত কানহানের প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। কানহানের প্রতিরোধ আলাউদ্দিনকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় হামলায় কানহানের বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। অতঃপর আলাউদ্দিন যখন দেবগিরিতে পৌঁছান, দেখেন  শহরটি অত্যন্ত নিরাপদ ও সুরক্ষিত।



কিন্তু যাদব রাজাদের আত্মতুষ্টির কারণে দেবগিরির দুর্গগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। কেননা, শহরটি চতুর্দিকে অসংখ্য দুর্গের দুর্ভেদ্য নিরাপত্তার কারণে কখনোই আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। ফলে রাজাগণ শক্তিবৃদ্ধিতে মনোযোগ দেননি। আর, ঐ সময় তাদের বাহিনীর একটি অংশ রাজপুত্র সিংহনার সাথে শিকার অভিযানে দূরে গিয়েছিল। শত্রুর আকস্মিক হামলার মুখে রাজা রামচন্দ্র পাহাড়ের চূড়ায় একটি দুর্গে চলে যান। খুব সহজেই আলাউদ্দিন শহর দখল করে নেন।

রাজকীয় আস্তাবল থেকে ৩০-৪০টি হাতি ও প্রায় ১,০০০টি ঘোড়া পাওয়া যায়। কিন্তু তার সাথে মাত্র ৮ হাজারের কম সৈন্য ছিল। ফলে, রামচন্দ্র মনে করেন যে, এটা কোনো বিশাল বাহিনীর অগ্রগামী সেনাদল এবং মূল বাহিনী শীঘ্রই উপনীত হবে। তিনি আলাউদ্দিনের কাছে বার্তাবাহক পাঠিয়ে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব করেন। আলাউদ্দিন প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং শহর ছেড়ে রওয়ানা হন।

ইতিমধ্যে রাজপুত্র সিংহনা শিকার শেষে দেবগিরিতে ফিরে আসেন। রামচন্দ্র তাঁকে শান্তি চুক্তির কথা অবহিত  করেন। রাজপুত্র বার্তাবাহক পাঠিয়ে আলাউদ্দিনকে সমস্ত  উপঢৌকন ফেরত দিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। এতে আলাউদ্দিন অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন। তিনি সেনাপ্রধান নুসরাত খানের অধীনে ১,০০০ সৈনিক রেখে অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে অগ্রসর হন।




যাদব সেনাবাহিনী আলাউদ্দিনের বাহিনীর চেয়ে অনেক বড় ছিল। যুদ্ধের শুরুতে তারা আলাউদ্দিনের বাহিনীকে পরাস্ত করে ফেলে। নুসরাত খান এই খবর পেয়ে আলাউদ্দিনের আদেশের অপেক্ষা না করেই তাঁর বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যান। তখন রামচন্দ্র আতঙ্কিত হন। তিনি বোঝেন যে, আলাউদ্দিনের মূল বাহিনী এসে পড়েছে।

এরপর আলাউদ্দিন চললেন দুর্গ অবরোধ করতে। তিনি রামচন্দ্রের অনেক নিকটাত্মীয় ও অভিজাতকে দুর্গের সামনে অপমানজনকভাবে প্রদক্ষিণ করান। আতঙ্কিত রামচন্দ্র প্রতিবেশী হিন্দু রাজাদের নিকট সাহায্য চাইতেও সাহস করেননি। দেখা গেল যে, দুর্গে পর্যাপ্ত খাবার নেই। অভিযানের শুরুতে যাদবরা দুর্গে প্রায় ৩,০০০ ব্যাগ খাবার নিয়ে যায়, কিন্তু খুলে দেখা যায় যে, এতে কেবল লবণ রয়েছে।

চরম হতাশ রামচন্দ্র আলাউদ্দিনের কাছে পুনরায় শান্তিচুক্তির অনুরোধ করেন। পুনরায় আলাউদ্দিন শান্তিচুক্তিতে সম্মত হন। এবার তিনি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০০মণ স্বর্ণ, ১,০০০ মণ রূপা, ৭ মণ মুক্তা,  ২ মণ মূল্যবান রত্ন (রুবি, নীলকান্ত, হীরা প্রভৃতি), ৪,০০০ পিস রেশমের কাপড় ও অন্যান্য বস্তু গ্রহণ করেন। এছাড়াও, তিনি অচলপুর প্রদেশের সম্পূর্ণ রাজস্ব অধিকার করেন। আলাউদ্দিন সকল বন্দীকে মুক্তিদান করেন।

এরপর রাজা ১৩০০  সালে বার্ষিক কর প্রদান বন্ধ করে দেন। এবার আলাউদ্দিন এক বিশাল বাহিনী পাঠান। দেবগিরিতে এই অভিযানে রামচন্দ্র আবারও পরাজিত হন এবং শান্তিপ্রস্তাব প্রেরণ করেন। আলাউদ্দিন আবার শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং রামচন্দ্রকে ভাসাল হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আলাউদ্দিন রামচন্দ্রের কন্যা জাত্যাপালিকে বিবাহ করেন। এই নারী আলাউদ্দিনের পুত্র ও উত্তরসূরী শিহাবুদ্দিন ওমর ও কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহের মা ছিলেন।

১৩০৮ সালের দিকে, দিল্লী সালতানাতের শাসক আলাউদ্দিন খিলজি তার সেনাপতি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে একটি বড় সেনাদল পাঠান যাদব রাজা রামচন্দ্রের রাজধানী দেবগিরিতে। কারণ রামচন্দ্র সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেন এবং বাঘেলা রাজা কর্ণকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, যাকে আলাউদ্দিন ১৩০৪ সালে গুজরাট থেকে বাস্তুচ্যুত করেছিলেন।




আল্প খানের নেতৃত্বে দিল্লির সেনাবাহিনীর একটি অংশ যাদব রাজ্যের কর্ণের রাজত্ব আক্রমণ করে এবং বাঘেলা রাজকুমারী দেবলাদেবীকে বন্দী করে, যিনি পরে আলাউদ্দিনের ছেলে খিজর খানকে বিয়ে করেছিলেন। মালিক কাফুরের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ দেবগিরি দখল করে। রামচন্দ্র আলাউদ্দিনের ভাসাল হতে রাজি হন এবং পরে দক্ষিণ রাজ্যগুলিতে সুলতানি আক্রমণে মালিক কাফুরকে সাহায্য করেন। আলাউদ্দিন খিলজির দেবগিরি বিজয় দাক্ষিণাত্যে তথা সমগ্র ভারতে সুলতানী শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। তবে এই সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ইতিহাস জানা যায় যে সব সূত্র থেকে, তার মধ্যে ঐতিহাসিকদের বিবরণ অন্যতম।

১) ইসামির বর্ণনা

ইসামির বর্ণনায় দেখা যায়, রামচন্দ্রদেব গোপনে আলাউদ্দিনের নিকট এক দূত পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন যে, কর না দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কত অসহায়। তাঁর এই অসহায় অবস্থার কারণ বিশ্লেষণে বলেছেন, “তাঁর পুত্র ভিল্লামা ও রাজ্যের অভিজাতরা সুলতানের প্রতি আনুগত্যে রাজি নয়।” অবশ্য রামচন্দ্রদেব পূর্বপ্রতিশ্রুতি পালনে পূর্ণ আশ্বাস দেন। এই বর্ণনা থেকে ঐতিহাসিক নিজামি ধারণা করেছেন যে, রামচন্দ্রদেব প্রকারান্তরে সুলতানের সেনাবাহিনীকে গোপনে আহ্বান করেছিলেন।

২) নিজামির মন্তব্য

ড. নিজামির মতে, দেবগিরি থেকে বাৎসরিক কর না পাওয়াই ছিল আলাউদ্দিনের এই অভিযানের কারণ।

অভিযানের দায়িত্বে মালিক কাফুর ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে দেবগিরি অভিযানের প্রধান দায়িত্ব দেন। তাঁর সহকারী নিয়োগ করা হয় খাজা হাজি নামে জনৈক সেনাধ্যক্ষকে এবং মালব ও গুজরাটের শাসনকর্তাকে এই অভিযানে কাফুরকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

৩) ডঃ সুকুমার রায়ের অভিমত

ড. সুকুমার রায় মনে করেন, মালিক কাফুরও তাঁর প্রভুর মতো দেবগিরি অভিযানের মধ্য দিয়েই একদিকে যেমন তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের অবসান ঘটান, অপরদিকে তেমনি এই সময় থেকেই দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি এই কথাও বলেছেন যে, দেবগিরি অভিযান থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত দিল্লি সুলতানি যুগের ইতিহাস বলতে মালিক কাফুরেরই ক্ষমতাকে বোঝায়।

কাফুরের দেবগিরি জয়

মালিক কাফুর মালব ও গুজরাটের মধ্য দিয়ে দেবগিরিতে অবতীর্ণ হন। আমির খসরুর বর্ণনা থেকে জানা যায়, দেবগিরি তেমন বাধা দেয়নি। অতি সহজেই দেবগিরি পরাজয় বরণ করে। কাফুর প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। এই সকল লুণ্ঠিত দ্রব্যসহ রামচন্দ্রদেব দিল্লিতে আনীত হন।

৪) ফিরিস্তার বর্ণনা

ফিরিস্তার বর্ণনায় দেখা যায়, রামচন্দ্রদেব বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। ফিরিস্তার বিবরণ যথার্থ বলে মনে হয়। কারণ, আলাউদ্দিনও তাঁর প্রতি দিল্লিতে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন এবং ছয়মাস আলাউদ্দিনের অতিথি হিসাবে রামচন্দ্রদেব দিল্লিতে অবস্থান করেন।

ভোজসভার আয়োজন

আলাউদ্দিন রামচন্দ্রদেবের সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেন। এই ভোজসভায় আলাউদ্দিন রামচন্দ্রদেবকে ‘রায়-রায়ান’ অর্থাৎ ‘রাজার রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং নভসরী নামে একটি স্থানকে রামচন্দ্রদেবের রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন

তাঁকে সসম্মানে নিজ রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। একলক্ষ টাকা উপহার দেওয়া হয়। রামচন্দ্রদেবও তাঁর কন্যার সঙ্গে আলাউদ্দিনের বিবাহ দেন। রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে আলাউদ্দিনের এই বৈবাহিক সম্পর্ক দাক্ষিণাত্য অভিযানে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।

আলাউদ্দিনের উদার ব্যবহার

রামচন্দ্রদেবের প্রতি আলাউদ্দিনের উদার ব্যবহারকে আধুনিক অনেক ঐতিহাসিকই ‘A master stroke of diplomacy’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এই উদার ব্যবহারই দাক্ষিণাত্য বিজয়ে আলাউদ্দিনের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

রামচন্দ্রদেবের সক্রিয় সাহায্য

রামচন্দ্রদেব আলাউদ্দিনের শুধুমাত্র অনুগতই ছিলেন না, তাঁর দাক্ষিণাত্য অভিযানে সহকারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। রামচন্দ্রদেবের সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য বিজয় এত সহজ হত না। প্রকৃতপক্ষে দাক্ষিণাত্য অভিযানের সময় কাফুর দেবগিরিকে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।

৫) দেবলাদেবীর উপাখ্যান



দেবগিরি অভিযানের সময় আর একটি ঘটনা খুবই উল্লেখযোগ্য, তা হল কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবীর উপাখ্যান। দেবলাদেবীর ঘটনা সম্পর্কে অনেক উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তবে এর পিছনে ঐতিহাসিক তথ্য কতখানি আছে, তা বলা খুবই শক্ত।

উপাখ্যানটি হল দেবগিরি অভিযানের সময় গুজরাটের রাজা কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবী ধৃত হন ও দিল্লিতে প্রেরিত হন। আলাউদ্দিন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খিজির খানের সঙ্গে দেবলাদেবীর বিবাহ দেন। এই ঘটনার পিছনে যদি ঐতিহাসিক তথ্য থাকে, তা হলে মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডলে আলাউদ্দিনের এই কার্যকলাপ প্রগতিশীল কার্যকলাপ বলেই অনেকে মনে করেন।

ড. সুকুমার রায় মনে করেন, এই বৈবাহিক নীতির মধ্য দিয়ে দাক্ষিণাত্যের শাসককুলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কোনো বাসনা ছিল কিনা, তা নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। সবশেষে বলা যায়, দাক্ষিণাত্যে একের পর এক রাজ্য জয় করলেও এটা যথার্থ যে, দাক্ষিণাত্যের শাসকগণের সঙ্গে আলাউদ্দিন খিলজি কোনো বৈরীনীতি গ্রহণ করেননি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন