সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


রোদ্দুর

 

তুষার চন্দ জানেন না ঠিক কতটা ক্ষণ তিনি চোখ বুঁজে আছেন। ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী এক দশায় দুলদুল করছে শরীর নামের যন্ত্রটি। তবু তিনি নিশ্চিত জানেন চোখ মেললেই বুঝি পেলব তুষারপাতের দৃশ্য ফুটে উঠবে তাঁর সামনে।

এই ঘরের ভেতর প্রায় শত বছরের পুরনো ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে তুষার চন্দের মনে হয় তিনি ক্রমশ জন্মতিথির মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছেন। অবিরাম বেজে চলা যন্ত্রসংগীতটি অচেনা লাগলেও এ মুহূর্তে যে স্বপ্নদৃশ্যে তাঁর যাত্রা এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় বোধ হয় জন্মাবধি।

দোতলার শেষ ঘরটার বাতি নেভেনি এখনো। ফুলেল পর্দার ফোকর দিয়ে আলো এসে দেয়ালে ইলিবিলি কাটছে। বালিশের ওয়ার, টেবিল ম্যাটের চারধার জুড়ে ফুলেল নকশা করেছিল বাড়ির মেয়ে-বউরা। কিংবা  হয়ত দীপার নিজের হাতের বুনন। তুষার চন্দের মাথায় উলের টুপিখানা, এখনো মাঘমাসের শীতে জোরালো ওম যার, আবছায়া স্মৃতিতে মনে পড়ে - ছোটো ছেলেটি তখন ওর গর্ভে, ছেলের জন্য দিনভর এটা ওটা বুনে যেতো দীপা। এই উলের টুপিটা সেসময়কার। দীপা যেদিন শ্মানে গেল, ওর পরনে ছিল গরদের শাড়ি, ব্লাউজের হাতেও ছিল ফুলতোলা নকশি কাজ, কপালে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ফোঁটা। আজকাল এসব  টুকরো টুকরো কথা, ‘মাইনর ডিটেইলস’ আচমকা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায়। এই তো বেশ অনেকগুলো বছর হয়ে গেল, এসব পুরনো কথাই বিরামহীন নিরেট অবসর যাপনের সর্বৈব রসদ হয়ে উঠেছে।

তুষার চন্দ পাশ ফেরেন। পড়ার ঘরে ম্যান্ডেলিন বাজছে। বোধ হয় ছেলে ল্যাপটপ খুলে বসেছে। ভিনদেশি মূর্চ্ছনা শুনতে শুনতে নির্ঘাত জটিল কোনো হাইপোথিসিসের তথ্য উপাত্তের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করছে। তুষার চন্দের শরীরটা এবার জেগে উঠতে চাইছে। একবার, দু'বার, তিনবার করে ঝাঁকুনি খাবার পর তিনি এবার চোখ মেললেন।

আজ পূর্ণচাঁদের রাত। জোছনার বাড়াবাড়ি। ঘরের মেঝে, আসবাবে, দেয়ালে হামলে পড়া আলো। তুষার চন্দের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে ধাতস্থ হতে। তার শরীরের সামনে ঝুঁকে থাকা ছোটোখাটো কিশোরের বিহ্বল মুখটি এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কিছু হয়েছে? এই অসময়ে ও এ ঘরে কেন? চোখের ইশারায় প্রশ্ন করেন তিনি। অশীতিপর লোলচর্মসার হাতের দিকে তাকিয়ে কিশোরটি এবার তীক্ষ্ণগলায় বলে ওঠে – সিই... ইয়্যু গট গুজবাম্পস!

তুষার চন্দ হেসে ওঠেন। বহুদিন হলো জীবন নিয়ে ভাবতে বসার মতো আদিখ্যেতা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আজকাল মনে মনে বিব্রত হন এই এতগুলি বছর পার করে এসেও নতুন গোছের এক দোলাচলের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে। এই একপলকা ছোট্ট শরীরের কচিমুখটির দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা এমন মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠছে যে ভাবতে গেলে নিজের কাছেই নিজেকে বিব্রত হতে হয় তাঁর। তবু দিনে দুবার তিনবার করে মনে হয় - কী বিস্ময়কর এই বেঁচে থাকা! এই যে ঘরের দেয়াল থেকে মেঝে অবধি জুড়ে থাকা তার প্রায় সমবয়সী গ্র‍্যান্ডফাদার ঘড়িটি অক্লেশ গতিতে জানান দিয়ে যাচ্ছে সময়ের হিসেব, নির্ঘুম মাঝরাতে যার রেডিয়াম আলোয় চোখ পড়লে প্রায় প্রতিদিন শেষরাতে বিভ্রান্তিতে হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়, বহুকাল আগে থেমে যেতে পারতো যেকোনো একটি যন্ত্রের গতি। অসময়ে জীবননাশের যে সংশয়ের কথা জ্ঞান হওয়া অবধি বাড়ির লোকেদের মুখে শুনে এসেছেন, তাতে এই সাড়ে সাতাশি বছরের জীবন তার জন্য অপ্রত্যাশিত বোনাসের চেয়ে বেশি কিছু। এই উপরি পাওনা জীবনের শেষ দিকের অধ্যায়ে এসে রোদ্দুর চন্দ নামের চরিত্রের আবির্ভাব কি তবে কোনো দৈবঘটনার সংকেত, নাকি সবই সংসারের অতি সাধারণ নিয়মের আবর্তন, এ নিয়ে ভাবতে গেলে তাঁকে রোজ গলদঘর্ম হতে হয়।

ডাক্তারিবিদ্যার লোকজন অবশ্য বলতে পারে এসবই গ্রে-ম্যাটারের ক্ষয়জনিত উপসর্গ মাত্র।

তুষার চন্দ নিজের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে আওড়ান - ভেতরটা ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে। ওসব গ্রে-ফের কিচ্ছু হয়নি!

এসব ভারী ভারী শব্দ তিনি নতুন করে শিখছেন। রজতের বন্ধুবান্ধব বাড়ি এলে ওর গবেষণার প্রসঙ্গ উঠবেই। রজত সাধ্যমতো চেষ্টা করে সহজ ভাষায় কিছুটা ব্যাখ্যা দেবার। শ্রোতাদের পক্ষে কতটা বোধগম্য হয় তা তারাই জানে, তুষার চন্দের কানে সবই খটোমটো শোনায়। তবুও মনে মনে তিনি নিজেকে বাহবা দেন কারণ এসব গভীর আলোচনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও শুধুমাত্র কান পেতে থেকে এ ক'দিনে শেখা নতুন শব্দের সংখ্যা নেহাত কম নয়!

ছেলে এবার দ্বিতীয়বার দেশে এলো। এর আগে এসেছিল প্রায় বছর সাতেক আগে। এবার এলো তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে, প্রথমবারের মতো। এই আসা অবধি চন্দবাড়ি দীর্ঘদিন পর বেশ খানিকটা সরগরম হয়ে উঠেছে। চন্দবাড়ির উঠোনে, ছাদে, এঘর থেকে ওঘরে মীন চোখের কিশোর রোদ্দুর দিনভর পায়চারি করে বেড়ায়। আধো বাংলায় নিরলস ভঙ্গিতে প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসে রোদ্দুর। পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত থেকে বেড়াতে এসে ওর রাতদিনের হিসেবটা ভীষণ তালগোল পেকে গেছে। অসময়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলে একা একাই সে ঘরময় পায়চারি করে বেড়ায়। পায়ে পায়ে তুষার চন্দের ঘর পর্যন্ত এসে উঁকি দেয়। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে রোদ্দুর, ফলে আলো আঁধারির মাঝে আচমকা ওর উপস্থিতি তুষার চন্দকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

সাদা চামড়ার দেশে কিশোর রোদ্দুরকে সবাই 'রডুর চান্ড' বলে জানে। নামের এই বেহাল অবস্থা শুনে তুষার চন্দ প্রাণ খুলে হাসেন। তিনি একে একে চন্দ বংশের ছেলেদের নাম স্মরণ করতে থাকেন। তারপর সেই পুরনো গল্পের ঝাঁপিও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে খুলে যায়।

দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী দীপার ঘরে যখন শেষ সন্তানটির জন্ম হয় তুষার চন্দের বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই।  প্রথম স্ত্রী ছিলেন মৃতবৎসা, তৃতীয়বারের সময় সন্তানের সাথে সাথে মায়েরও মৃত্যু হল। প্রথম স্ত্রীর সম্পর্কে বোন হবার ফলে দীপার সঙ্গে বিপত্নীক তুষার চন্দের বিয়ে সবাই একপ্রকার ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছিল। এ পক্ষের চারটি সন্তান, যাদের প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে বয়স পনেরো কি ষোলো পেরুবার আগেই, সেই ঘরের সবচেয়ে ছোটো সন্তানটি রজত চন্দ, রোদ্দুরের বাবা। সুস্থভাবে তরুণ বয়সে পৌঁছুনোর পর মায়ের ইচ্ছেতেই রজত চন্দ প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিল উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য। ওর মা, দীপার বরাবর মনে হতো ছেলে দূরদেশে চলে গেলে হয়ত অপঘাতে মৃত্যুর অভিশাপ থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকবে। মায়ের মনের এই সরল ভাবনাপ্রসূত ইচ্ছাতে তুষার চন্দও আর বাধ সাধেননি।

সত্যি বলতে তুষার চন্দ রজতের বিষয়ে শুরু থেকে ভীষণ নির্লিপ্ত থেকেছেন। শেকড় যত কম গভীর হয় তত সহজ বিচ্ছেদ ভুলে থাকা। খুব গোপনে তিনি আশংকার দিন গুনছিলেন, এই বুঝি সেই দুঃসংবাদটি এলো। তাকে একটু অবাক করে দিয়েই রজত চন্দ দূরদেশে একে একে নতুন শেকড় গড়ল। পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি পেল, নীলচোখের শ্বেতাঙ্গিনিকে বিয়ে করে জীবনে থিতু হল। সবচেয়ে বিস্ময়ের খবরটিও চলে এলো বছর ঘুরতেই। মীন চোখের বড় বড় পাঁপড়ি মেলা, আপেলের মতোন টুকটুকে গালফোলা শিশুটির ছবি প্রথমবার দেখে তুষারচন্দ সেদিন নতুন প্রজন্মের জন্মতিথি সম্পর্কে সম্যকভাবে জানার প্রবল আগ্রহে পঞ্জিকা খুলে বসেছিলেন।

সেই রোদ্দুরের দেখা মিলল এই এতকাল পর, যখন তার বয়স দশ ছুঁই ছুঁই। ওকে দেখে তুষার চন্দের কেবল একজনের কথা মনে পড়ে। গ্রে ম্যাটারের ক্ষয়ে যাওয়া যাকে এখনো বিস্মৃত করতে পারেনি, যার কথা তিনি কারুর কাছেই সেভাবে আলাপও করেননি কখনো। প্রায় ছ'ফুট গড়নের গেরুয়া পোশাকধারী মানুষটি, যিনি পথ দিয়ে হেঁটে গেলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে একবার ফিরে তাকাতে বাধ্য হতো, তিনি ছিলেন তুষার চন্দের সেই অতটুকু জীবনে এক আকস্মিক জ্যোতিষ্কের মতোন কেউ।

তুষার চন্দ তখন উনিশ-কুড়ি বছরের সদ্য তরুণ। পাড়ার মুখে মিশনের ব্রহ্মচারীদের আনাগোনা ক্রমশ বাড়ছিল। তুষার চন্দ দূর থেকে শুধু দেখতেন একজনকে, যিনি সুখানন্দ ব্রহ্মচারী নামে যেকোনো সমাগমের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। যেমন সুদর্শন তিনি, ঠিক তেমন চমৎকার ভরাট কণ্ঠ তার! জীবনবোধ আর ঈশ্বরচিন্তা নিয়ে তার গভীর আলোচনা তুষার চন্দের কাছে অমৃতের মতো মনে হতো। পাড়ার ছেলেরা যখন সুখানন্দের সঙ্গে নিয়মিত সন্ধ্যা আরতিতে বসতো, তুষার চন্দ সুযোগ পেলেই সে দিলে ভিড়তেন।

মাঝেমাঝে ভীনদেশী ভক্তেরা আসতেন মন্দিরে। সপ্তাহজুড়ে আলোচনা, কীর্তনগান চলতো। তুষার চন্দ বেশ লক্ষ্য করে দেখতেন তাদের মাঝে দুয়েকজনের আচরণ কিছুটা অন্যরকম। সেই রুপসী বিদেশিনীরা যেন সুখানন্দের প্রতি খানিকটা বেশি আকৃষ্ট। অমন বয়সে সেরকম না হওয়াটাই হয়ত অস্বাভাবিক হতো।

এসব সঙ্গই শেষমেশ অমন পরিণতির কারণ হয়েছিল। সুখানন্দ বিদেশবিভূঁইয়ে কনফারেন্সে গেলেন এবং এরপর আর ফিরে আসা হল না তাঁর। কিছুদিন পর লোকমুখে জানা গেল তিনি ব্রহ্মচর্য ছেড়ে ওখানেই  সংসারধর্ম শুরু করেছেন। তারপর আরো বছর খানেক গড়ালে কেউ কেউ বলতে শুরু করল মানুষটি কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে সংসার ছেড়ে গেছেন।

এসব লোকমুখে শোনা ঘটনা কতটা সত্য তা তুষার চন্দ জানেন না, তবু দুটো খবরই তাকে গভীরভাবে আলোড়িত আর বিষণ্ণ করেছিল। তার মনে হতো যেন খুব আপন কারোর সঙ্গে এমন অদ্ভুত কিছু ঘটে গেছে। এখনো পথে ঘাটে গেরুয়া পোশাকের যুবক দেখলে তার বুকের ভেতর একটা অজানিত শঙ্কাচিনচিন করে ওঠে।

রোদ্দুরকে দেখে বহুদিন পর আবার সুখানন্দের স্মৃতি ফিরে আসে তুষার চন্দের ভাবনায়। আর মনে হয় কত রকম বিচিত্রতায় ভরা মানুষের জীবন!

ম্যান্ডেলিনের শব্দটা থেমে গেছে। চোখ মেলে তুষার চন্দ দেখেন রোদ্দুর এখন জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর গায়ে পাতলা একটা পাজামা সেট। ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন তুষার চন্দ। সাড়া না পেয়ে নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু সে যেন এখন ঘোরে পাওয়া এক মানুষ।

-ঘুম আসে না, দাদুভাই?

এবার ওর শরীরটা একটু নড়ে ওঠে। রোদ্দুর মাথা নাড়ায় এদিক ওদিক।

বাইরে তাকিয়ে জোছনা দেখতে বিভোর সে।

-সাচ এ স্নো-হোয়াইট মুন!

তুষার চন্দ জিজ্ঞেস করেন - ও রোদ্দুর, তোমার কি মুনলাইট ভালো লাগে?

রোদ্দুর হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে ওঠে - আই ফিল লাইক লিভিং হোম টুনাইট…

তুষার চন্দের মনে হয় রোদ্দুর নয়, যেন অন্য কেউ কথা বলছে।



 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন