সমকালীন ছোটগল্প |
পাসওয়ার্ড
-আচ্ছা, তবে আজ আসি স্যার! ভাল
থাকবেন। কিছু প্রয়োজন হলে ফোনে জানিয়ে দেবেন। আমরা আছি তো! আপনার পাশেই আছি।
-উহুঁ, আর একটু বসতে হচ্ছে তোমাকে
আদিত্য!
আজ দিন কয়েক হলো ওদের অফিসের জেনারেল ম্যানেজার সমুজ্জ্বল বসু স্যার ছুটিতে আছেন। খুব একটা ছুটি নেন না উনি। সোজা সাপটা কথা আর স্বচ্ছ কাজের মানুষ। স্টাফদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। কারোকে কোনও কনফিউজানে রাখেন না। নিজের চেয়ারের অযথা সুবিধে নেন না। আজ তাঁর পঞ্চম দিনের ছুটিতে তাঁকে দেখতে তাঁর বাড়িতে এসেছে আদিত্য।
বসতে হচ্ছে শুনে আদিত্য ব্যস্ত
হয়ে বলে, নিশ্চয় স্যার। বলুন! কী করতে হবে! একটু ভেবে আবার বলে, না না স্যার, কাউকে
ব্যস্ত করবেন না। আমি বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। এখান থেকে সোজা অফিস যাবো।
- উহুঁ, আদিত্য, আমি খেয়ে আসা মানুষকে
ডবল খাওয়ানোর বাজে লৌকিকতায় বিশ্বাস করি না। একটু থমকে গেল আদিত্য গুঁই। এই মানুষটি
কে তো সে চেনে! তিনি সব কথা নিঃসঙ্কোচে বলেন। কোন স্টাফকে অযথা করুণা করে তাকে লজ্জা
দেন না, বা সেই সুবাদে তার কাছ থেকে সুবিধে আদায় করেন না। তাঁর কোনও স্টাফ অন্যের কৌশলী
চালাকির শিকার হয়ে ওপরওয়ালার কাছে মিথ্যে বদনাম পেলে, যথাযথ সমীক্ষা করে সেখান থেকে
বের করে আনার সততায় বিশ্বাসী এবং সে কাজ তিনি সবাইকে জানিয়েই করে থাকেন। কারোর অপ্রসন্নতাকে
থোড়াই কেয়ার করেন! কোম্পানিতে তিনি যে কাজের মানুষ একথা ওপর মহল যেমন জানে, তিনি নিজেও
তেমন জানেন।
তাঁর উত্তর শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল আদিত্য। আদিত্যকে বিস্মিত করে সমুজ্জ্বল বসু বললেন, বসো। একটা কথার উত্তর চাইছি তোমার কাছে। এই যে তুমি বললে না, ‘ভালো থাকবেন স্যার,’ এই কথাটা অনেকেই অনেককে বলে। আচ্ছা ভাই, আমাকে একটু জানাও তো, ভালো থাকার পাসওয়ার্ড কী! কিংবা কী হতে পারে!
স্যারের কাছ থেকে এরকম কথা বা অনুরোধ আসতে পারে ভাবতেই পারেনি আদিত্য। কোনদিন কারো কাছে কিছু না চাওয়া মানুষটার দিকে সে তাকিয়ে থাকলো একটুক্ষণ। তবে কি এই অসুখটা তাঁকে একটু নরম করে দিয়েছে? এই একটা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে তাঁকে একটু ভেঙেপড়া মানুষ মনে হচ্ছে যেন! এতক্ষণ কথা বললাম, বুঝতে পারিনি তো! আসলে তেমন ভাবে ভাবিনি বলেই বুঝতে পারিনি হয়তো! উত্তর দিতে গিয়ে ঘাবড়ে গেছে আদিত্য। একটু ইতঃস্তত করে বললো,
-পাসওয়ার্ড, মানে…
- হ্যাঁ এককথায় পাসওয়ার্ড! অথবা
পয়েন্টওয়াইজ বলো, ভালো থাকতে গেলে কেমন মানুষ হতে হয়? কী কী ভাবনা চিন্তা করতে হয় এবং
করতে নেই?
আদিত্য বুঝতে পারলো স্যারের অসুখটা
শারীরিক পর্যায়ে নেই!
- আচ্ছা, তোমাকে একটু ক্লু দিই আদিত্য! না হলে তোমার পক্ষে এটা টাফ হয়ে যাবে। আমি জানি তুমি বলবে ভালো থাকার পাসওয়ার্ড ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করে। আসলে ভালো থাকাটা যে যেমন ভাবে নেয় আর কি! তবুও, কিছু কিছু তো মিলবে!
খানিকক্ষণ দুজনেই নীরব থাকলো। আদিত্য ভাবছে, প্রত্যেকের মধ্যেই কি দুটো করে মানুষ বাস করে! সমুজ্জ্ব্বল বসু নামের সোজা-সাপ্টা মানুষটার ভেতরেও!
নীরবতা ভাঙলেন, সমুজ্জ্বল বসু।
- আমার ছেলে সৌম্য আমার কাছে থাকে না, জানো তো!
-হ্যাঁ, ও বাইরে চাকরি করে শুনেছি। আজকাল প্রায় বেশীরভাগ বাড়িতেই তো তাই স্যার!
-সৌম্য ম্যানেজমেন্ট পাশ করে এখানে কলকাতাতেই ভালো পোষ্টে চাকরি পেয়েছিল। চাকরির জন্য ওর বাইরে যাবার দরকার ছিল না! আসলে আমার সোজা-সাপ্টা কথাবার্তা, সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো- ওর ভালো লাগতো না। অন্যরকম আমাকে চাইতো ও। বলতো, তোমার এই ইমেজটা তোমার চাকরির ক্ষেত্রে ঠিক মানায় না। তর্ক তুলতো যখন তখন! বড় হবার সাথে সাথে নিজের যে মেকি পার্সোনালিটি নিয়ে সৌম্য থাকতে চাইতো, যেসব ব্যাপারগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকাকে ও নিজের যুক্তিতে সভ্য ও সম্ভ্রান্ত মনে করতো, আমি তাতে ইন্ধন দিতে পারিনি। সায় দিতে পারিনি। সৌম্য ওর বন্ধু-বান্ধবীদের বাবা-মায়ের সাথে আমার তুলনা করে, বাবাসুলভ স্নেহ- ভালোবাসা সে আমার কাছ থেকে কোনওদিন পায়নি বলে আঙুল তুলতো আমার দিকে। এগুলো না দিয়ে আমি ওকে বঞ্চিত করেছি। এমনকি ওর জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছি! এইসব কারণে ও অন্য শহরে নিজের বাসা বাঁধলো। আমার কাছ থেকে দূরে। পিতা হিসাবে ওর যেরকম সু্যোগ প্রাপ্য ছিল, আমি তাকে তার কিছুই দিই না, এরকম অনু্যোগ সৌম্যর মায়েরও! তিনিও আমার প্রতি বিরক্ত এই কারণেই!
আদিত্য বেশ বুঝতে পারছে স্ট্রেইটকার্ট মানুষ সমুজ্জ্বল বসুর অনিরুদ্ধ আবেগ তাঁকে আর থামাতে পারছে না। বুঝতে পারলো তিনি শারীরীক নয়, মানসিক ভাবে সুস্থ নেই।
অনেকক্ষণ বলার পর তিনি মাথা নিচু করে বসে থাকলেন। নিজের স্বভাবের বাইরে আচরণ করে যেন আদিত্যর দিকে মুখ তুলে তাকাতে সঙ্কোচ বোধ করছেন। শরীর কাঁপছে তাঁর। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে।
উনি থেমে থেমে বললেন উন্মাদ স্নেহ-ভালোবাসায় নিজের সন্তানকে আপত্য-স্নেহ দিয়ে পরোক্ষভাবে তাকে মন্দপথে ঠেলে দেবার রাস্তা দেখিয়ে দিলে কি আমি তার আদর্শ বাবা হতাম! আর সেটাই আমার ভালো থাকার পাসওয়ার্ড হতো আদিত্য!
আদিত্য গুঁই তাঁর শারীরীক অবস্থা দেখে তাকে থামাতে গেলো। ঊনি বললেন, -এতটাই যখন বললাম তোমাকে, তবে আর একটু শুনতে অনুরোধ করছি তোমায়।
-গলার স্বর নিচু হয়ে যাচ্ছে তাঁর। খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে বলছেন সমুজ্জ্বল। কিন্তু এ কী বলছেন তিনি!! বলছেন, ছেলে আমার ভালো র্যাঙ্ক পেয়ে ম্যানেজমেন্ট পাস করে ভালো ব্যাংকের উঁচু পোষ্টে কাজ পেয়েও ও সাইবার জালিয়াতি আর প্রতারণার দায়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে খবর পেলাম। বলোতো, আমার বাজে প্রশ্রয় পায় নি বলেই কি সৌম্য এইরকম একটা ঘৃন্য প্রতারক হয়ে উঠলো! এর জন্য কি আমি দায়ী! আত্মীয় স্বজন আমার দিকেই আঙুল তুলছে। ওরা যে কথা বলতে চাইছে সেই ভাবে চললেই কি আমি ওর আদর্শ বাবা হতাম! আর সেটাই কি আমার ভাল থাকার পাসওয়ার্ড হতো। আদিত্য আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলতে চাইলো না স্যার, কখনই না। কিন্তু বলতে পারলো না। আদিত্য সেই মূহুর্তে তার নিজের স্কুল আর কলেজজীবন ও এখনকার ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজজীবনের মাঝখানে একটা মস্ত গভীর অন্ধকার গুহার মতো ফাঁদ বসে থাকতে দেখলো। মনে পড়লো, আগামিকাল তার ছেলেটার মাধ্যমিক পরীক্ষা! স্যার তো তবু তার ছেলেকে চিনেছিলেন কিছুটা। আমি যে আমার ছেলে শুভদীপের মতি গতি সম্বন্ধে কিছুই জানিনা! ইনফ্যাক্ট ও কেমন ছেলে আমি কিছুই জানিনা! কোনওদিন মনোযোগ দিয়ে সেদিকটা ভাবিনি! আজ পরীক্ষার হলে ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে কি না আমি জানি না! ওর মা কি জানে! যদি ওর ছেলে পরীক্ষার হলে বসে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে কারোকে পাঠাবার চেষ্টা করে! যদি ধরা পড়ে যায়! যদি যদি যদি…
ভয়ে তির তির করে কাঁপতে শুরু করেছে আদিত্যর বুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন