সমকালীন ছোটগল্প |
স্বৈরিণী
না না, এমন একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে আদৌ ঘটতে পারে তা কেউই আঁচ করতে
পারেনি আগে থেকে। ঘটে যাবার পর মজা দেখতে এসেছিল যারা তারা সবাই সমস্বরে
বলেছে, ‘সিনেমা সিরিয়ালের ঘটনা যে বাস্তবেও সম্ভব সেটা আজ প্রমাণ হয়ে গেল’। কেউ একজন আরও এককাঠি এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তোমরাও যেমন! আরে
বাবা ঘটনা ঘটে বলেই না সিরিয়াল সিনেমায় দেখায়, তা না হলে তো সেটা
রূপকথার গল্প হয়ে যাবে’। আর একজন, যে পাড়ায়
কবি বলে পরিচিত, মোক্ষম কথাটি বললেন, ‘আমাদের
জীবনটাই তো রূপকথা, সেখানে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। হতে পারে সে সব ঘটনা আপনার আমার জানার বাইরে থেকে যায়, তা বলে
ঘটে না, সে কথা সত্য নয়’।
এত কথা যাকে নিয়ে তিনি এখন নিরুদ্দিষ্টের তালিকায়। তার স্বামী এইমাত্র থানায় ডাইরি করে ফিরলেন। স্কুল থেকে ফিরে মাকে কোথাও খূঁজে পায়নি ছেলেরা। বড় ছেলে আবিষ্কার করল ড্রেসিং টেবিলের উপর এক টুকরো কাগজে কিছু লেখা। পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিকে দেখাতেই সে বলল, ‘বাবাকে এক্ষুণি ঘরে আসতে বল, তোমার মা মিসিং’। খবর পাওয়ামাত্র ছুটে চলে এসেছেন তিনি অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলি টেবিলের উপর অরক্ষিত ফেলে
রেখে। দারুণ রকমের সাজানো একটি পরিবারের কর্তা তিনি। নামী কোম্পানির হাই প্রোফাইল অফিসার। আছে সুদৃশ্য একটি ফ্ল্যাট, আর আছে স্বর্গের অপ্সরীর মত সৌন্দর্যময়ী
একজন লাইফ পার্টনার। সে ঊর্বশী, যে ক্রমান্বয়ে
দুটি অতি মেধাবী পুত্রের জন্ম দিয়ে তাদের গর্বিতা জননীর আসনে প্রতিষ্ঠিতা এবং বর্তমানে নিরুদ্দিষ্টা। মিস্টার সৎপথী বয়সে উর্বশী থেকে
অন্তত দশ থেকে বারো বছর এগিয়ে। সুপুরুষ বলা যায় না তবে উজ্জ্বল চোখদুটি বলে দেয়, ছেলে এলেবেলে সাধারণ কেউ নয়। ওদিকে ঊর্বশীকে
কেবলমাত্র সুন্দরী বললে কিছুই বলা হল না। বিয়ের চোদ্দ বছর
পরও তার শারীরিক গঠন কোন সদ্যবিবাহিতাকে হার মানাতে পারে। সৎপথীর বন্ধুরা ওদের দুজনকে দেখলেই কৌতুক করে বলে, ‘বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা’।
কোন বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে সৎপথীর চোখে পড়ে যায় উর্বশী, তারপর প্রায় মাসখানেকের মধ্যেই মিসেস সৎপথীর পদে দেখা গেল তাকে। ম্যাট্রিক ফেল কন্যার ভাগ্যে একজন চার্টার্ড অ্যকাউন্টেন্ট। উর্বশীর মা বাবা চাঁদ সমেত পুরো আকাশটাই হাতে পেয়ে গেল যেন। ‘তোমরা কিন্তু একটা বুড়োর সঙ্গে আমার
বিয়ে দিচ্ছ বাবা’! অভিযোগ ধোপে টেকেনি। ছেলেদের আবার বয়সের হিসাব কি? বর দেখতে কেমন? তা
সে যেমনই হোক না কেন, সোনার আংটি সে বাঁকা না সোজা তাতে কিই বা
এসে যায়! বিদ্যে, চাকরি, গাড়ি, বাড়ি এসব দিয়েই না বিচার হয় ছেলেদের! তা সে মধ্যবিত্ত ঘরের উর্বশী এখন এক অতি বিত্তবানের ঘরণী। তোমার নামে অ্যকাউন্ট খোলা থাকল, যেমন মন চায় জীবনকে উপভোগ কর। সংসারের চাবি তোমার হাতে, চালাও না যেমন খুশী। না কোন প্রশ্ন, না কোন বাধা। সৎপথী স্ত্রী
গর্বে গর্বিত। পার্টিতে তার পাশে যখন ঝলমল করে সুসজ্জিতা উর্বশী তখন নিজেকে
বড় ভাগ্যবান বলে মনে হয় তার। মনে মনে বলে, আমার
কাছে যে ধন আছে, আছে তোদের কারো কাছে? উর্বশী
আড়চোখে দেখে, পার্টিতে উপস্থিত সকল পুরুষের চোখ তাকেই তাক করে
নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করে। কতজনের চোখে যে লোভ চিকচিক করে উঠতে দেখেছে ঊর্বশী! না,
লজ্জায় বা সংকোচে সে আড়াল করেনি নিজেকে ওই বেহায়া লোকগুলোর নজর থেকে,
বরঞ্চ ওদের চোখে লালসা প্রকট হতে দেখে এক ধরনের উৎকট তৃপ্তিবোধে আচ্ছন্ন
হয়েছে। তার অহংকার, ঈশ্বর তাকে উর্বশীর মতই নিখুঁত সুন্দর করে গড়েছেন। এত সম্পদ, এত ভালবাসা, তবু মনে যে কাঁটা বিঁধে আছে
তা প্রতি মুহূর্তে তাকে স্মরণ করায়, মিস্টার সৎপথী যতই বিদ্বান
আর পয়সাওয়ালা হোন না কেন তিনি কখনই তার পাশে দাঁড়াবার মত যোগ্য পুরুষ নন। সৎপথীকে তুমি বলে সম্বোধন করতেও যেন সহজ বোধ করে না উর্বশী। মা বাবাকে অনবরত দোষারোপ করে চলে সে তারুণ্যের উন্মেষকালে যে স্বপ্ন তার মনে শিহরণের সঞ্চার করত তাকে এমন নির্মমভাবে মুছে দেবার জন্য। কোন এক বলিষ্ঠকায় প্রায়
সমবয়সী প্রেমী যুবকের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হবার আকাঙ্ক্ষা সর্বক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে তাকে, এমনকি দুই সন্তানের জননী হবার পরেও সে গোপন বাসনায় ঘাটতি পড়েনি একরত্তিও।
উর্বশীর ছেলেদুটি? কে না বলবে, দুটি বাচ্চাসৎপথী!
আর মেধা? সেখানেও তারা ঠিক তাদের বাবারই অনুরূপ। প্রতি ক্লাসে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব কেউ আজ পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারেনি তাদের থেকে। পড়াশোনার অতকিছু বোঝে না উর্বশী তবে অহংকারে ফেটে পড়ে যখন রেজাল্ট বেরোনোর দিনে
ফ্লাটের সবাই এসে একে একে অভিনন্দন জানিয়ে যায় কেবলমাত্র ছেলেদের নয় তাদের মাকেও। কেউ কেউ যখন মন্তব্য করে, উর্বশী রত্নগর্ভা, তখন তার অহংকারের মাত্রা বেড়ে চতুর্গুণ। এত কিছুর পরেও কিন্তু নিজেকে সুখী ভাবতে পারে না ঊর্বশী। কেবলই মনে হয় এই সন্তান জন্মের ব্যাপারে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল না কোন। সৎপথীর সঙ্গে তার শারিরীক সম্পর্ক ছিল একতরফা। সৎপথী প্রেমিক নন। ঊর্বশীর মন বোঝার চেষ্টাও করেননি কখনো। মেধাবী হওয়ার কারণে বিদ্যার্জন থেকে শুরু করে চাকরী অর্থ সবই এসেছে অনায়াসে। ঊর্বশীর মত পত্নী, সেও অনায়াসলব্ধ। তিনি ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি পান এই ভেবে যে তারা দু’জনই পেয়েছে মায়ের মুখের আদলটি।
সৎপথী কাজপাগল। একের পর এক প্রোমোশন
তাকে পৌঁছে দিয়েছে এমন এক উচ্চতায় যেখানে স্ত্রী-পুত্র-ঘরসংসার সব তুচ্ছ হয়ে যায়। মন নয়, মস্তিষ্কের
কারবারী সৎপথীর কাছে ঘর এখন রেষ্টহাউজ ছাড়া আর কিছু নয়। ঊর্বশীর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র যেন নিজের হাতেই তৈরী করে দিলেন তিনি। স্বামীর ঘরে ফেরার সুনিশ্চিত সময় নেই কোন। অবশ্য কোনদিনই তার অপেক্ষায় অধীর হতে দেখা যায়নি ঊর্বশীকে। সে যেন এক অবাঞ্ছিত জন, যতক্ষণ দর্শন সীমায় না আসবে ততক্ষণই যেন পরম স্বস্তির আস্বাদ মনপ্রাণ জুড়ে। ওদিকে দুই সন্তানের জন্য রয়েছে আয়ার ব্যবস্থা, সেই জন্ম থেকেই। অফুরন্ত অবসরে যখন যাকে মন চায় আমন্ত্রণ জানাতে পারে ঊর্বশী। ঊর্বশীহেন এক নারীর আহবানে সাড়া দেবে না এমন পুরুষ ক’জন আছে সংসারে, অন্তত ঊর্বশীর এমনই ধারণা। সৎপথী্র বন্ধুদের মধ্যে একজন অকৃতদার। বয়সে সৎপথীর থেকে দু’চার বছরের ছোটই হবে, এমনইতো মনে হয় দেখে। সুপুরুষ উচ্ছল আপনভোলা এই মানুষটিকে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই টার্গেট করে রেখেছিল ঊর্বশী। কেবলমাত্র একটি জোরদার অজুহাতের অপেক্ষা। কথাবার্তাও যে
কখনো হয়নি এমনও নয় তবে তা নিছকই ‘কেমন আছেন, ভাল আছি’র পর্যায়েই রয়ে গেছে। আজ যখন ডানা মেলার
সু্যোগ হাতের মুঠোয় তখন উড়বে কি উড়বে না এসব দুমুখী ভাবনায় সময় বইয়ে দেবার মত মেয়ে
নয় সে। হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে সৎপথীকে ডিভোর্সের প্রস্তাব দিতেও ভাববে না দু’বার। এখন সর্বপ্রথম
কাজটি হবে আপনভোলা লোকটার মধ্যে লোভ জাগানো, তাকে বোঝানো, একজন
নারীর সান্নিধ্য কতখানি প্রয়োজন একজন পুরুষের জীবনে। পৌরুষে আঘাত দিয়ে বলতে হবে, নারীর সৌন্দর্যের প্রতি সর্বগ্রাসী দৃষ্টি
নিয়ে তাকাতে জানে না যে পুরুষ সে আসলে পুরুষই নয়। একটা খবর যা ঊর্বশীর ভাবনায় বাড়তি উত্তাপ জুগিয়েছে সে হল ঐ সুঠাম সুপুরুষ সত্যশিব রুদ্র’র চাকরি
থেকে স্বেচ্ছাবসর। কী কারণ থাকতে পারে তার স্বেচ্ছাবসরের? শুনেছে ঊর্বশী তার বন্ধুবর্গের আলোচনায়, একার জীবন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবার জন্য আছে সঞ্চয়ের
টাকা আর সরকারী পেনশন, অথচ সময় বড় কম, তাই
তার এই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। সময় বড় কম ঊর্বশীর
জীবনেও,
তাই আর কালক্ষেপ নয়। এমন একজন পুরুষের
প্রতীক্ষাতেই তো সে ছিল এতকাল, যে ভরিয়ে দিতে পারবে তার জীবন দৈহিক মানসিক সকল রকম
তৃপ্তির উপাচারে।
সৎপথীর মোবাইল ফোন থেকে সত্যশিবের নাম্বার আগে থেকেই সংগ্রহ করে রেখেছিল ঊর্বশী। সেই নাম্বারেই রিং করে অপেক্ষায় থাকল কল ব্যাকের। জলদগম্ভীর স্বরে ‘কে বলছেন’ প্রশ্নটি
সাহস জোগালো মনে। আননোন নাম্বার বলে কেটে দিতে পারত। তা করেনি যখন, কথা বলা যায় তবে। সত্যদা বলেই সম্বোধন করল ঊর্বশী। তারপর পরিচয় পর্ব। ‘ওঃ হো হো, মক্ষীরানি! কী সৌভাগ্য
আমার, বলুন আপনার কী কাজে লাগতে পারি মক্ষীরানি!’ বটেই তো। যে কোন গেদারিং-এ সকল
পুরুষ অতিথির আলোচনার কেন্দ্রে তো একমাত্র একটিই নাম –ঊর্বশী। আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের মুখে মক্ষীরানি সম্বোধনটা বড় মধুর শোনালো ঊর্বশীর কানে। এ সুযোগটা ছাড়া যাবে না কিছুতেই। ‘আপনিও
একা, আমিও একা, বড্ড বোর লাগছে চলে আসুন
না, কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটানো যাবে’! কুহকিনীর
ভঙ্গিতে কথাগুলো সত্যশিবের কানে ঢেলে দিলো ঊর্বশী। সত্যশিব নীরব। ঊর্বশীর কথাবলার
ধরন কিছু একটা ইঙ্গিত বহন করছে যেন! বিভিন্ন পার্টিতে দেখেছে সে ঊর্বশীকে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ঊর্বশীর রূপ। কিন্তু
সাধারণ সৌজন্য বিনিময় ছাড়া তেমন কথা হয়নি কখনো। কেবলমাত্র ওইটুকু পরিচয়ের উপর ভিত্তি
করে এমনতর আমন্ত্রণ কি করে সম্ভব? তবে কি ঊর্বশী একাকিত্বে ভুগছে নাকি ও পলিগ্যামাস?
ঊর্বশী কি তবে সে চরিত্রের নারী যে এক পুরুষে সন্তুষ্ট নয়! অবশ্য একা ঊর্বশী কেন, প্রাণীজগতে নারীপুরুষ নির্বিশেষে
সকলেই তো পলিগ্যামাস। এই তো সেদিন কোন
এক দৈনিকে স্বাস্থ্যের পাতায় লিখেছেন এক ডাক্তারবাবু, প্রাণীজগতে
একমাত্র ঘুঘুপাখিই মোনোগ্যামাস, একজন পার্টনার নিয়ে জীবন কাটিয়ে
দিতে পারে, আর বাকী সকল প্রাণী একজন সঙ্গী নিয়ে খুশি হতে পারে
না কখনো। তার প্রমাণ তো যত্রতত্র। মানুষও যে সে সকল প্রাণীদের অন্যতম। হ্যাঁ, সমাজ ব্যভিচারের আশঙ্কায় নীতিনিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে বলে,
তা না হলে তো আবার সেই জঙ্গলের রাজত্ব। এত করেও কি মানুষের আদিম প্রবৃত্তির ডানা ছেঁটে ফেলা সম্ভব হয়েছে? যদি তাই হত তবে খবর কাগজের পাতা ভরে উঠত না অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনার বর্ণনায়। এই সাতপাঁচ ভাবতে গিয়ে কেটে গেল কয়েক মিনিট। ওদিক থেকে আবার কল, ‘কি মশাই, ঘাবড়ে গেলেন?
পুরুষ্ মানুষ কোন নারীর আহ্বানে এমন উদাসীন থাকতে পারে, এই প্রথম দেখলাম’। কী বলবে এর জবাবে, ভেবে
পেল না সত্যশিব। নীরবতাই বুঝি শ্রেষ্ঠ উপায় এমন বিষম পরিস্থিতি সামাল দিতে। ভাবল সত্যশিব, বলতে হবে তো সৎপথীকে, কাজের নেশায় পড়ে
বৌকে যে ঠেলে দিচ্ছেন এক সর্বনাশা নেশার দিকে! আবার বেজে উঠলো
ফোন। এবার ঊর্বশীর ভাষা
ঘামে ভিজিয়ে দিল সত্যশিবের সারা শরীর। কী শুনছে সত্যশিব, ‘সত্য,
সে প্রথম দিনের দেখা থেকেই তুমি
আমার বাঞ্ছিত পুরুষদের তালিকায় এক নম্বরে, আচ্ছা, তোমার আর সকল বন্ধুরা যে দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে, তোমার
ইচ্ছে জাগে না তেমন করে তাকাতে? তোমার পৌরুষ সম্পর্কে কিন্তু
প্রশ্ন জাগছে আমার মনে। প্লিজ! আমার
স্বপ্নটাকে এমন করে ভেঙ্গে চুরমার করে দিও না সত্য। তোমাকে নিয়ে অনেক বড় একটা স্বপ্নের জগৎ গড়েছি আমি। তোমার উপেক্ষা কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের দিকে ঠেলে দেবে আমাকে, আর তার
জন্য পুরোটাই দায়ী থাকবে তুমি’।
যেন ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে ঘুরপাক খাচ্ছে সত্যশিব। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় থেকেই কত মেয়ে যে স্বেচ্ছায় বাহুবন্দী হতে চেয়েছে, তার
হিসেব রাখেনি সে। সহজাত ব্যতিক্রমী
প্রবৃত্তি আর পারিবারিক সংযমশিক্ষা ওকে শক্তি
জুগিয়েছে সে সব প্রলোভনকে জয় করতে। সত্যশিব যেন গৃহীসন্ন্যাসী
এক। এতটা কাল কাটিয়ে দিয়েছে সে নিরুপদ্রপে আত্মীয়বন্ধুদের সাথে
আত্মিকযোগে। দেহের চাহিদাকে পরাস্ত করেছে বন্ধনহীন এক মুক্ত জীবন উপভোগ
করবার তাগিদে। আজ প্রৌঢ়ত্বে এসে এ কেমন এক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হল তাকে! দিশাহারা
হয়ে যাচ্ছে সত্যশিব। ভেবে কূল পাচ্ছে
না কী উপায়ে নিরস্ত করা যাবে বিকৃত মানসিকতার শিকার ওই মহিলাকে। সব খুলে বলবে
কি সৎপথীকে? সৎপথী কি আদৌ বিশ্বাস করবে তার কথা? যদি
তাকেই নাটের গুরু ভেবে বিপত্তি ঘটায় কোন!
কী ভাবে সে উত্থাপন করবে কথাটা সৎপথীর কাছে, ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল দুটিদিন। ভাবল রবিবার ছুটির দিনেই নিজের ঘরে
ডেকে নেবে সৎপথীকে। কিন্তু নিরাশ হল জেনে, রবিবারেও পুরো দিনটা কাজে ব্যস্ত থাকবে সে। তবে উপায়? মন বড় অস্থির। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসতে পারছে না সত্যশিব। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চমকে উঠে দরজা
খুলতেই আশংকায় কেঁপে উঠলো সত্যশিব। দরজায় দাঁড়িয়ে
মূর্তিমতি আপদ ঊর্বশী। কী করবে এখন সে? প্রত্যাখ্যান
না গ্রহণ? না, এদু’টির কোনটিই সম্ভব নয় তো! ‘আমি কিন্তু চলে এলাম,
ফিরিয়ে দিলে আমার আত্মহত্যার
দায় তোমাকেই নিতে হবে সত্যশিব’! জীবনে কখনও এমন বিষম সঙ্কটের
মুখে পড়তে হয়নি সত্যশিবকে। সত্যশিবের মনে হল আত্মহত্যা যদি করতে হয় তবে সে ঊর্বশী নয়, সে অঘটনটা
ঘটাতে হবে তাকেই। ‘আপনি ভিতরে এসে বসুন তো আগে’,
অনুরোধ জানালো সত্যশিব। এককাপ করে কফি খেয়ে তারপর কথা বলা যাবে। কফিটা আমি খুব ভালই বানাই, খেয়ে দেখুন’। বাধা দিল ঊর্বশী, ‘কফি নয়, জরুরী কথা আছে তোমার সঙ্গে’। ‘হ্যাঁ , কথা তো হতেই হবে তবে কফি খেতে খেতে’। সত্যশিব সৎপথীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজে নিল এই অজুহাতে। কিচেনে কফির দুধ গরম করতে করতে সেরে ফেলল কথা।
তুমি কোথায় আছ সৎপথী?
‘ঘরেই আছি’।
‘কেন, এখন তো তোমার অফিসে থাকার কথা’।
‘ছিলাম তো । এদিকে একটা ভয়ংকর
ঘটনা ঘটে গেছে’।
‘তবে একমুহূর্ত দেরী না করে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে এসো আমার ঘরে। ছেলেদের বল, তাদের মা তার এক ভাইয়ের বাড়ি গেছে, মানে মামাবাড়ি, চল আমরাও
যাই সেখানে’।
‘অসম্ভব। আমাকে এক্ষুণি
অফিসে ফিরতে হবে। থানায় ডাইরি করেছি, যা করার
পুলিশই করবে’।
‘ওই কাজই তোমার কাল হল, এখন বৌকে ফিরে পেতে হলে যা বললাম
তাই করো’।
‘আমি তো বুঝতে পারছি না বৌ ফিরে পেতে হলে মামাবাড়ির গল্প ফাঁদতে হবে কেন’।
‘এই তোমার দোষ, সব কিছু মাথা দিয়ে বিচার করো। আরে বাবা, সুন্দরী বৌ সামলাতে হলে মন চাই। পরে সব কথা হবে, দেরী না করে চলে এসো’।
কথা শেষ করে বড় দু’টি কফি মাগে ফেনায়িত কফি নিয়ে হাজির হল সত্যশিব ঊর্বশীর
কাছে। একটা কফি ঊর্বশীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সাবধানে কথা শুরু
করল। ‘আজ তো সানডে, আপনার ছেলেদের তো ছুটি, ওদের নিয়ে এলেন না কেন’?
সত্যশিবের দিকে সোজা তাকাল ঊর্বশী। ‘কী বলতে
চাও তুমি সত্য, বুঝতে পারছ না, আমি সব কিছু ছেড়ে এসেছি কেবল মাত্র তোমার সঙ্গে জীবন কাটাবো বলে’!
সত্যশিব অধীর হয়ে উঠছে মনে মনে। বার বার
অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে সে। কতক্ষণ কথা দিয়ে
ভুলিয়ে রাখা যাবে এই অর্বাচীন অপ্রকৃতিস্থ মহিলাকে! নাঃ। মোক্ষম কথাটা বলেই ফেলা যাক। ঊর্বশীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিল অব্যর্থ লক্ষ্যে তীর নিক্ষেপের মত, ‘আচ্ছা ঊর্বশী, আপনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে একটি বারের জন্যও ভেবে দেখলেন না, যার সঙ্গে আপনি বাকী জীবন কাটাবেন বলে স্থির করেছেন, সে ব্যক্তি আদৌ আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজী আছে কিনা’? ঊর্বশী প্রস্তুত ছিল না এমন একটি প্রশ্নের জন্য। সে ঊর্বশী। পুরুষরা পাগল
তার সান্নিধ্য পেতে, অথচ যাকে সে সর্বস্ব দেবার জন্য ঘর সংসার ছেড়ে ছুটে এলো,
সেই কিনা এমন একটি নেতিবাচক প্রশ্ন করে বসলো! কী জবাব দেবে ঊর্বশী এ প্রশ্নের?
প্রতীক্ষার শেষ নেই যেন। কখন যে এসে পৌঁছবে সৎপথী! আর কতক্ষণ কীভাবে আটকে রাখবে সত্যশিব ঊর্বশীকে? ঊর্বশীকে বড় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। পুরুষের কাছে কোন নারীর প্রত্যাখ্যান বড়ই অপমানের, অথচ কীই বা করতে পারতো সত্যশিব? পরস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যেন ঊর্বশীকে সামলে রাখার দায়িত্ব তারই, অন্তত যতক্ষণ সৎপথী এসে না পৌঁছোচ্ছে। দুকূল হারানো ঊর্বশী। এ অবস্থায় হটকারী
কিছু করে ফেলা অসম্ভব নয় ঊর্বশীর পক্ষে। উৎকীর্ণ সত্যশিব মুহূর্ত গুনছে একটা গাড়ির আওয়াজের। সে থেকে এখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি ঊর্বশী। কী চলছে তার মনের ভীতর তার আন্দাজ করা সম্ভব কিন্তু তার সমাধান তো জানা নেই সত্যশিবের। সে দেখছে, ঊর্বশী উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে। দিশাহারা সত্যশিব। যদি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলে ঊর্বশী তবে কি তার দায় থেকে পুরোপুরি মুক্ত ভাবতে পারবে নিজেকে? দরজা খুললেই ছাদে যাবার সিঁড়ি। যদি ঊর্বশী ছাদে চলে যায়, যদি ছাদ থেকে…! ঊর্বশীর দরজা খোলা আর একটি গাড়ি থামার আওয়াজ, যুগপৎ ঘটে গেল ঘটনা দুটি। প্রায় একই সাথে সত্যশিবের আতঙ্কিত উচ্চারণ, ‘ঊর্বশী’! ছাদের সিঁড়িতে এক পা বাড়ানো
ঊর্বশী বিহ্বল দৃষ্টিতে ফিরে তাকালো সত্যশিবের দিকে। এর মধ্যে দুই ছেলেকে নিয়ে লিফটে উঠে এসেছে সৎপথী। বড়ছেলেটি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, ‘আমাদের রেখে তুমি মামাবাড়ি
চলে এলে মা? আমাদের বুঝি ইচ্ছে হয় না মামাবাড়ি আসতে’? ছোটটি কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, মায়ের আঁচলটি জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে কেবল। সৎপথী ঘন হয়ে দাঁড়ালো ঊর্বশীর সামনে। ঊর্বশীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আবেগঘন স্বরে বললো, ‘তোমার মন আমি কোনদিন বুঝতে চাইনি ঊর্বশী, ভেবেছি, ঘরসংসার নিয়ে তুমি সুখেই আছ, আর আমি আমার কাজ নিয়ে। যদি মনে করো, আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে তুমি সুখে থাকবে, তবে তাই হোক’। সৎপথী কি কিছু আন্দাজ করেছে তবে? সত্যশিব বলতে চাইলো কিছু। সৎপথী ইশারায় থামিয়ে দিল তাকে। সত্যশিব অনুমান করল, ঘটনার আকস্মিকতায় ভেঙে পড়েছে সৎপথীর মনের গোপন গুহায় সুপ্ত আবেগের বাঁধ। দুরন্ত নদীর মত স্রোত প্রবাহে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাকে। উত্তেজনায় কাঁপছে তার সর্বশরীর। নিজের হাতের
বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিল ঊর্বশীর হাত। ঊর্বশী আর
সত্যশিব স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে। সত্যশিব আড়চোখে
তাকালো একবার সৎপথীর দিকে। সৎপথীর দৃষ্টিতে যেন একটা সঙ্কল্প দানা বেঁধেছে। তার আর ঊর্বশীর মধ্যে গড়ে ওঠা দেয়ালটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। সত্যশিব সব জেনেবুঝেও অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছে সৎপথীর কথাগুলো। বলছে সৎপথী, ‘আমি চাকরীতে রিজাইন দিয়ে চলে যাব অন্য কোথাও। ছেলে দুটোকে যদি আমার সাথে থাকতে দাও তবে কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে আজীবন। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাববো তুমি আছ আমার সাথেই। সকলে বলে, ওদের দুজনের মুখ নাকি তোমার আদলে গড়া’। সত্যশিব দেখলো সৎপথীর কথা শেষ হতেই ঊর্বশী জড়িয়ে কাছে টেনে নিল ছেলেদের। একি ঊর্বশীর ছেলেদের উপর অধিকার বোধের প্রকাশ না কি সব হারানোর শঙ্কা, বুঝে উঠতে পারলো না সত্যশিব।
এক মুহূর্তের বিরতি, তারপরই এক অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইল সত্যশিব। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ঊর্বশী। সে হাত আবার
বাঁধা পড়েছে, নিষ্পেসিত হচ্ছে প্রেমিক সৎপথী’র বলিষ্ঠ
দুটি হাতের মাঝখানে। ঊর্বশীর গালগন্ডে
ছড়িয়ে পড়ছে গাঢ়তর রক্তিম আভা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন