সমকালীন ছোটগল্প |
প্রাচীন গাছে সবুজ পাতা
বছর দুই আগে পিকলু নামক এক খেটে খাওয়া আধা জোয়ানকে রাস্তার ধারে একগাদা মেয়ে নিয়ে কচুরি খেতে দেখেছিলাম ৷ আসলে সেসময় আমি নিয়ত দেখতে চাইতাম -- অল্প পয়সায় কী করে সুখে থাকে মানুষ! সুখটা মনের না শরীরের খিঁচমিচি, এ নিয়েও ধন্দ ছিল৷ ঠিক এই সময় পিকলু আমার জীবনে রেগুলার হল৷ পিকলুর সুখী চোখ থেকে আনন্দ নিতে লাগলাম৷ আর আমার আনন্দ নেয়া থেকে মজা চাখত আমার পিকলুমনা৷ মালিকের গাড়ি ধোয়া থেকে পাড়ার বৌদিদের ভেজাশাড়ি ছাদে মেলা -- প্রতি কাজেই পিকলুর খুশিমুখ চোখে হাসি৷
সেবার মে দিবস এল৷ ততদিনে পিকলু অবশ্য তিনচারটে বিয়ে ও বউ-বিচ্ছেদ করে ফেলেছে৷ বিচ্ছেদপ্রাপ্ত বউগুলোর যত্ন করে আবার বিয়েও দিয়েছে৷ আজ্ঞে হ্যাঁ -- এ ব্যাপারে পিকলুর উদারতা শিবনাথ শাস্ত্রীকেও হার মানায়৷ তো মে দিবসে পিকলু করল কী -- নিজের সবকটা একদা বউ ও তাদের বর্তমান বরগুলোকে নেমন্তন্ন করে ফেল৷ কোথায় করল? গলিতে - যেখানে গাড়ি ধোয় পিকলু৷ একদম জমে গেল ব্যাপারটা৷
আমি দেখি নর্দমার পাশে উবু হয়ে কী গল্প জুড়েছে পিকলুর পৃথিবীব্যাপী পরিবার! তিননম্বর বৌটা আবার পিকলুকে পিখলু বলে ডাকত৷ যেদিনই গলিতে মেয়ের গলায় ক-এর পাশে হাওয়া বেরোনোর শব্দ পেতাম, বুঝে যেতাম -- পিখলু বরের তিননম্বর এল৷ সেদিন দেখি সেও একইভাবে বসে৷ তিননম্বর হওয়ার সুবাদে একটু বেশি কচুরি আর দু ধরনের আলুর তরকারি নিয়ে পিকলুর মুখোমুখি বসে৷ আলুর দম আর আলুর তরকারি৷ বাকি বউ আর তাদের এখনকার বরদের হাতে দুটো কচুরি আর আলুর তরকারি৷
পিকলু অবশ্য কোনো বউকেই নিজের কাছে রাখে না -- পাছে বৌদের প্রতি তার টান ধ্বসে যায়৷ কিংবা বৌদের তার প্রতি৷ অন্যান্যদিন জলখাবার বৌগুলোই নিয়ে আসে -- ডেট অনুযায়ী মেনু ঠিক করে পিকলু৷ দিনে পঞ্চাশ একশো রোজগার করেও পিকলু চুলে তেল মাখে এবং প্রত্যেকদিন একটি করে পাটভাঙা গেঞ্জি পরে৷
প্রত্যেকটা বিয়ের আগে থমথমে মুখে ভদ্রলোকদের সামনে দিয়ে হাঁটাচলা বাড়ায় পিকলু ৷ বুঝি - এবার ফের বিয়ে লাগাবে পিকলু এবং প্রবল বুদ্ধি প্রয়োগ করে সেটা লুকিয়ে রাখবে৷ দেখিয়ে দেখিয়েই লুকোবে৷ মানে সে যে লুকোচ্ছে - এমন একটা ভাব বজায় রাখবে শরীরের প্রতিটা মোচড়ে৷ তারপর ভ্যাক ভ্যাক করে হেসে সব বলবে আমাদের৷ দুটোই তার ইচ্ছেকৃত৷ এক দীনমানুষের কহানি গড়ার ইচ্ছে৷ নিজেকে নিয়ে৷ আসলে কোনটা কতখানি করা দরকার তাই বোঝে না সে৷ ব্যর্থ হয়ে মুখে রামকৃষ্ণের হাসি৷ নির্বিকল্প শ্রমিক৷ সর্বদাই বহুত খুশ৷ তারপর দেখুন -- যাদের সে বিয়ে করেছে তাদেরও এনতার বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে৷ এও তার ইচ্ছে করে দেয়া অনুমতি৷ ফলে বউয়ের সঙ্গে তার নিজস্ব সম্ভোগের বাচ্চা - নিজের বউয়ের সাথে তার অন্য বরের বাচ্চা - সেই বরের সাথে আবার তার আগের বৌয়ের বাচ্চা -- কত বাচ্চার বাবা হয়ে গিয়েছিল পিকলু! অনেক বেলুন ফিতে কিনতে দেখি তাকে৷ স্বেচ্ছায়৷ ওড়ার জন্য নিজেকে বাড়িয়েই চলেছে পিকলু৷
বড় হয়ে যাচ্ছে -- বড় হয়ে যাচ্ছে৷ শ্রমিকের গল্প তো এত বড় করা যাবে না ভাই৷ মে মাসের সেই প্রথম দিনে পিকলুর তিননম্বর সারাদিন ধরে খুব মজায় কচুরি লাড্ডু খেয়ে গেল৷ কারণ সে-রাতে পিকলুর সঙ্গে থাকার অনুমতি পেয়েছিল৷ গ্যারেজে যত্ন করে নোংরা বিছানাটা পেতেছিল পিকলু৷ একটা বালিশে দুজন মাথা রেখেছিল৷ অনেক রাত অব্দি গ্যারেজ থেকে মেয়েগলায় দেহাতী গান শুনেছিল পাড়ার লোক৷ মাঝরাতে পেটে ছটফটানি নিয়ে রাস্তায় বমি করল৷ মালিক বউটার শাড়িভর্তি বমি দেখে গাড়ি বার করতে দেরী করছিলেন৷ পিকলু কাঁদছিল - বউয়ের বমিমাখা তুবড়ে যাওয়া শরীরটাকে জড়িয়ে ছিল৷ বউ অবশ্য বেশী ঝামেলা করেনি৷ পুরনো বরের সঙ্গে নতুন শোওয়ার চমক নিয়ে মরে গেল৷ ওখান থেকেই শ্মশান গেল সে৷ দুই তারিখ সকালবেলা আবার সেইসব মেয়েপুরুষকে দেখলাম - বউটাকে সিঁদুর মাখিয়ে খাটিয়ায় তুলছে৷ বিহারী বউ লাল সিঁদুর পরেছিল৷ মেটেরঙ মেলেনি৷ পিকলু অবশ্য রাস্তার গাছের অনেকগুলো গন্ধহীন ফুল বউটার খোঁপার পাশে রেখে দিয়েছিল৷ বউটার যাওয়ার তাড়া ছিল - পিকলুরও অন্য কাজে জলদি যাওয়ার দরকার ছিল৷ ফুল থেকে বেচারা পাতা ছেঁড়ার সময় পায়নি৷ ফলে ফুলগুলো ঝাড়ের মতো হয়ে খোঁপায় বসেছিল৷
খাটিয়ায় চড়া মরা বউ চলে গেছে অনেকদূর
-- পিকলুকে দেখলাম দৌড়োচ্ছে দুটো নতুন লেডিজ স্যান্ডেল নিয়ে৷ আমাকে দেখে বলল - কাল
বউ বলল চটি ছিঁড়েছে৷ কিনে আনলাম৷ যাই এ দুটোও খাটিয়ায় দিয়ে আসি৷ আমি বললাম - তুমি দাহ
করতে যাবে না? পিকলু হেসে বলল - দূর! ওর বর বাচ্ছা আছে না? --বলতে বলতে গ্যারেজে পাতা
দু মানুষের বিছানাটা গুটিয়ে ফেলেছিল দ্রুত৷
কদিন পরে গাড়ি ধোয়ার সময় পিকলুকে ফের শিস দিতে শুনেছি৷ সঙ্গে একটা নতুন শব্দ -- পিখলু -পিখলু৷ সেই ক-এর পাশে বেশি হাওয়া৷ খচখচ করে উঠেছিল আমি নামক 'সোবার বুদ্ধিবাদীর’ ধড়কন! তোরা ভালো থাক সর্বকালে৷ নিজের খ্যাপা জোরে৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন