কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৫ |
সুমনার সন্ধ্যা
ছোটগল্পের মতো। তন্ময়কে যত দেখে, সুমনার এরকমই মনে হয়। অনির্দিষ্ট, মায়াময় আর ঝপ করে কখন থেমে যাবে, কিছুতেই বোঝা যাবে না। এই সাতবছরেও ওকে ঠিকঠাক জানা হয়ে উঠল না যেন। সব সময়েই, খেয়াল করেছে সুমনা, তন্ময়কে যখন প্রায় ধরে ফেলেছে, মনে হচ্ছে বেশ পড়া যাচ্ছে, ঠিক তখনই দাঁতে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে তন্ময় হয়ত প্রাণ খুলে গেয়ে উঠল, আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে। ব্যাস, সব লয় তান কেটে গিয়ে সুমনা জবুথবু, অসাড়। তার প্রায় সোয়া পাঁচ ফুটের ছিপছিপে অস্তিত্ব যেন নিছক একটা গাছ, যে কিনা কেবল ছায়া দেবে, তার আর চাওয়ার কিচ্ছু থাকবে না কক্ষনো। তখন আর এগোনো হয় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আর টিউশনির কথা মনে পড়ে যায় সুমনার।
-চলো। আর গাইতে হবে না।
-কেন! সূর্য তো সবে মুখ
লুকিয়েছে। আলোটুকু যে রয়ে গ্যাছে এখনো তার!
-থাক আলো। এবার দয়া করে ওঠো
রাজার রাজা আমার। আমার যে একটা টিউশনি রয়েছে আমার।
তন্ময়ের চোখদুটো দেখতে সুমনার
কি যে কষ্ট হয় তখন। ভাবে, আজ-ও তোমার গল্প আমার পড়া হয়ে উঠল না। কিন্তু তোমার গল্প যে আমাকে পড়তেই হবে!
ভাবতে ভাবতে শাড়ির কোঁচা
গুছিয়ে সুমনা উঠে পড়ে। হাত বাড়িয়ে দেয় তন্ময়ের দিকে।
তন্ময় আর কথা বলে না। যেন এই হাত সে চিরকাল
পাবেই, এমনভাবে সুমনার হাতটা জড়িয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায়। বছর ত্রিশের সুঠাম
তন্ময়কে তখন ধরে থাকতে অসুবিধেই হয়, কিন্তু ওকে যে ধরে থাকতেই হবে!
এ ভাবেই তন্ময়সুমনা, সুমনাতন্ময় নিজেরা
যেন প্রায় একটা উপন্যাস হয়ে ওঠে। এদের একেকটা চরিত্র জড়িয়ে অনেক বৃত্ত। আবার কেবল তাদের দু’জনকে জড়িয়ে অনেক
আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং শরীর। তারা দুজনেই বাড়িতে একই রকম। দুজনেরই বাবা নেই। তন্ময়ের দাদা রাজনৈতিক
খুনের এক পুরনো সংবাদ। সুমনা টিউশনি। তন্ময় পড়ে। অনেক কিছু। তার মধ্যে কমপিটিটিভ
পরীক্ষার পড়া আছে। আর সিনেমার পোকা। সে সব নিয়ে তন্ময়ের প্রচুর পড়াশোনা। আর প্রায় পাগলের
মত ছবি তোলে। ওর ক্যানন ডিএসএল আর দিয়ে। কেবল কীটপতঙ্গের। কি হয় সে সবে, কে জানে! তবে বেশ কিছু পুরস্কার
ইতিমধ্যেই তার ঝোলায়। দুবাই আর কানাডাতে ডেকেছিল। পয়সার অভাবে যেতে পারেনি। আর মাঝে মাঝে আধখানা
রবীন্দ্র সঙ্গীত। আবার হঠাৎ মৌনিবাবা।
রাত্রে শুয়ে তন্ময়কে ও যে
কত আদর করে! টিউশনির একঘেয়েমির ফাঁকে ফাঁকে সে সব মনে পড়ে যায় আর আধময়লা সুমনা প্রায় বেগুনি
হয়ে যায় করুণায়, নিজের জন্য, ্নময়ের জন্য।
ওরা হাঁটছে। দূরে বাদাম বিক্রেতার
লম্পের আলো। স্কয়্যার ফিল্ডের এদিকটা নির্জন, প্রায় অন্ধকার।
তন্ময়কে আজও জানা হল না সুমনার।
ভিজে যাওয়া চোখে সুমনা দেখল, তন্ময় গাইছে, আমার রাত পোহালো
শারদপ্রাতে…।
তন্ময়কে একটু আদর করার জন্য
সুমনা ঘুরে দাঁড়ালো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন