বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৪


প্রেম

 

মণিদীপাকে ভালোবাসা শাম্মলীর মতো দীর্ঘ ছিল। কেমন এক বিস্তারিত-আলো মণিদীপা। ওর নামের মতো। সব কিছুই তছনছ করে দেওয়ার ছেলে আমি। যা কিছু নান্দনিক, তা আমার  ভালো লাগে না। কেউ সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে রাখলেই আমার ভীষণ ইচ্ছা করে সব এলোমেলো করে দিতে। আজ এসেছি এক ঘরোয়া কবি-সম্মেলনে। বড়ো একটি বারান্দা লাগোয়া হলঘরে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা সাদা চাদরে মণিদীপা ওর ঘন সর্ষেরঙ নিয়ে গাঢ় লাল রঙেরশাড়িতে পা মুড়ে বসে। বড়ো বড়ো দুটো ফুলদানিতে অর্কিড আর গোলাপ রাখা। ঘরে রুম ফ্রেশনারের গন্ধ। সবাই পরিমিত হাসছে, নীচুস্বরে কথা বলছে। পরিপাটি পোশাক, ঝকঝকে মুখ। আমার ভেতর থেকে রাগ কেমন কুলকুল করে ঘাম হয়ে জামা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। এতো কৃত্রিমতা অসহ্য। ইচ্ছা করেই সিগারেট ধরালাম দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। গোল গোল ধোঁয়ার রিং ছুঁড়ে দিতে লাগলাম ঘরের বাতাসে। মণিদীপা গ্রীবা উঁচু করে, কপাল কুঁচকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল।  

কী মারাত্মক ভঙ্গিমা! আমার গলায় সিগারেটের ধোঁয়া আটকে দমবন্ধ হয়ে এলো। নিজের অজান্তেই ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলাম বারান্দায়। সকলে কবিতা পড়তে লাগল। সকলের মৃদু হাততালির গুঞ্জন। নিজের কবিতা পড়ার সময় চারলাইন পড়ে সামনে তাকিয়ে দেখলাম, মণিদীপার চোখের দৃষ্টি নীচে মেঝের দিকে। কী এক হয়ে গেল ভিতরে, পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই সোজা দরজা থেকে বের হয়ে বাইরে যাওয়ার গেটের কাছে। এটা কবি সুবিমল রায়ের বাড়ি। বেশ নামডাক।

আমাকে বেশ স্নেহ করেন। উনি আন্তরিকভাবে ডেকেছিলেন আমাকে। আমার এই হঠকারিতা তাঁকে নিশ্চিত ব্যথিত করবেই।

‘শুনুন’

মণিদীপা!

‘বলুন’

‘কবিরা এতো অসভ্য হয়, জানতাম না’

‘আমি কবি নই’

‘তাহলে কবিতা পাঠ করতে উঠেছিলেন কেন? কাকে অপমান করার জন্য? কবি সুবিমল রায়কে না কবিতাকে?’

‘সে কৈফিয়ত আপনাকে দেব কেন?’

‘আপনি খুব উদ্ধত, শুনেছিলাম। কিন্ত আপনি যে কাউকে মানুষ বলেই মনে করেন না, সেটা জানতাম না’

‘প্রথমে ভেবেছিলাম ভালো লাগবে পড়তে। পড়তে গিয়ে দেখলাম খুব বোকা-বোকা লাগছে’

‘আশ্চর্য!’

দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল মণিদীপা।

আমি হাঁটতে লাগলাম শহরের যানজটে। মণিদীপা, তু মি জানো না একটা নষ্টশৈশব, একটা বীভৎস যৌবনের জন্ম দিয়েছে। তুমি একটা শান্ত দিঘির মত মেয়ে আমার মূল ধরে টান দিচ্ছো!

আমি মুক্তি চাই প্রেম থেকে, মায়া থেকে, স্নেহ থেকে। এসবে বড়ো মাধূর্য। গৃহবাস আমার মত আজব, ছন্নছাড়া জানোয়ারের সইবে না।

তৃষ্ণার্ত গহ্বরের ঠেক থেকে বের হলাম যখন তখন পা টলমল, বুক জ্বালা, জ্বরের ঘোর।

হঠাৎ এক হলুদ রঙের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে।

দরজা খুলে বেরিয়ে আসে মণিদীপা।

‘কবিরা এরকম ছন্নছাড়া, অহঙ্কারী,স্বার্থপর হলে যে আমাদের পাঠকদের বড়ো যন্ত্রণা হয়! আসুন’

হাত ধরে টেনে আমাকে ট্যাক্সিতে তোলে মণিদীপা।

রাতের শহরে ছুটে চলি। দুজনের মুখ দুদিকে।

আমার তীব্র ইচ্ছা করে, এই মুহূর্তে মণিদীপাকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে এক লাইটহাউসে উঠতে। দু’ মিনিটের জন্য হলেও।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন