মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


কুমারী সম্ভবম

আমাদের চেয়ে বয়সে বড়ো বিনায়ক আমাদের সাথেই পড়তো। মাঝারি মানের ছাত্র। পাশ করতো টেনেটুনে। প্রতিবারই একটা দুটো সাবজেক্টে ফেল করে করে। আর এখানেই ছিলো রহস্য। ঐ ফেল করা সাবজেক্ট সবসময় এক থাকতো না। মানে একবার অঙ্কে তো একবার ইংরেজিতে তার পরের বার সামাজিকে। এই সামজিক সাবজেক্টটা এখনকার কেউই চিনবে না। তখন আমাদের এই সাবজেক্টটা পড়তে হতো। আসল নাম সমাজবিজ্ঞান। ডাক নাম সামাজিক। শিক্ষক থেকে ছাত্র সবাই এই ডাক নামটাই বলতো‌। সেটা ছিলো নানা বিষয়ের মিশ্রণ। এই সাবজেক্টটাতে সাধারণত কেউই ফেল করতো না। আমরা একমাত্র বিনায়ককেই  সামাজিকে ফেল করতে দেখেছি।

আমাদের তৎকালীন টাটানগর রেলকলোনির ‘খান স্যার’ ছিলেন পরিমল স্যার। টপ প্রাইভেট টিউটর। ফেল করা ছাত্র পাশ করানোতে ওস্তাদ।

বিনায়ককে বিনায়কের মা ধরে পড়ে পরিমল স্যারের কাছে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিবার বিনায়কের রেজাল্ট দেখে পরিমল স্যারও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন। বলতেন-

- আই কান্ট ইমাজিন। হাও ইট ইজ পসিবল। আগের পরীক্ষায় ইংরেজিতে পঞ্চান্ন আর এবারে তের!?

এরকমই অসামঞ্জস্য একবার অঙ্কের ক্ষেত্রেও হয়েছিলো। সবচেয়ে অবাক কান্ড যেবার বিনায়ক সামাজিকে কুড়ি পেয়েছিলো, সেবার  ক্লাসের কেউই সামাজিকে পঁয়তাল্লিশের কম পায়নি।

পরিমল স্যারের মনে হয়েছিলো। এই কম নম্বর পাওয়াটা বিনায়কের কোনোরকম একটা পরিকল্পিত বদমায়সি। সোচি সমঝি কোই চাল। তিনি বিনায়ককে চেপে ধরতেন। বিনায়কদা শুধু বোকার মতো মাথা নাড়তো।

বিনায়কের মা এসে পরিমল স্যারের কাছে সব শুনে বিনায়কের উপর রাগ দেখাতেন। তারপর বিনায়ককে যেভাবে বকতেন ও কানের বদলে গাল মুলে দিতেন। তা দেখে আমাদেরও ফেল করতে সাধ জাগতো। আমাদের ভাগ্যেও যদি ওরকম চুরনের মতো টক মিষ্টি সাজা জোটে তবেই। তবে সেটা একরকম অসম্ভবই ছিলো। কারণ ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েও আমাকে বকাঝকা ও মারধোর খেতে হয়েছে। তখন সব  গার্জিয়ানরাই মনে করতেন ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার প্রতি নজর দেওয়া মানে বছরে দুই বার রেজাল্টের দিন বকাঝকা ও মারধর করা। আর সম্ভব হলে পরিমল স্যারের কাছে টিউশনি পড়তে পাঠানো। আর তারপর আর তারা খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন‌ বোধ করতেন না। মারধোরের কর্তব্যগুলো করতেন বাবারা। আর মায়েদের ছিলো শুধু বকাঝকা। কিন্তু মায়েরা আলাদা করে দুটো হুমকি দিতেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার হুমকি। আর ছেলেদের বিড়ি বাঁধার কাজে লাগিয়ে দেবার হুমকি। বিনায়কের মায়ের মতো মিঠা হুমকি আর ‘গাল মলা’ আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না।

বিনায়কের ব্যাপারটা হচ্ছে। ওর বাবা কুমারন সাউথ ইন্ডিয়ান। অন্ধ্রের মানুষ। মা কিন্তু বাঙালী। এবং বিনায়ক পড়তো আমাদের সঙ্গে বাঙ্গলা সেকশনে।

কুমারন গাড়ুর গাত্র বর্ণ ছিলো বেশ কালো। আর বিনায়কের মায়ের গায়ের রং ছিলো বেশ ফর্সা।

বর বউয়ের জাত আলাদা। এরকম জুটি তৎকালীন রেল কলোনিতে আরো কয়েকটা ছিলো।

সেরকম প্রত্যেক জুটির ব্যাপারেই অসমর্থিত গল্প কাহিনীও প্রচলিত ছিলো। যেগুলো শোনা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও আমরা সব্বাই সেগুলো জানতাম। তবে বিনায়কের মা বাবার গল্পটা আমার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগতো।

কি কারণে যেন বিনায়কের মা ট্রেনের লাইনে গলা দিতে গেছিলেন। আর ট্রেন আসতে দেখে দারুণ ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। ইন্জিন ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছেন। তবুও মহিলা লাইন ছেড়ে উঠে যাচ্ছে না দেখে অতিকষ্টে ট্রেন থামিয়ে ড্রাইভার রাও বাবু মহিলাকে লাইন থেকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দিয়ে তার দুই গালে ঠাস ঠাস করে চড় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। চড় খেয়ে মহিলার ফর্সা সাদা গাল লাল হয়ে গেছিলো। তাতেও কিন্তু মহিলার জ্ঞান ফেরেনি। তখন উনি ওর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উত্তেজনায় জলের বোতলের বদলে দেশি মদের বোতল থেকে মদ নিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে ছিলেন। ড্রাইভারদের জন্য মদ্যপান ঘোরোতর অপরাধ। ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে নৌকরি নট হয়ে যাবে। কিন্তু তথাপি সেটা তাদের মধ্যে বেশ প্রচলিত ছিলো। রাওবাবু এক আঁজলা মদ ছিটিয়ে দিয়েই ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মিরাকেল ডু হ্যাপেনস। ঐ উগ্রগন্ধী মদের এক ঝাপটাতেই মহিলার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো।

পরে তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিলো কেউ জানে না।

শুধু জানা যায় ড্রাইভার রাও মহিলাকে নিয়ে রাউরকেলার রানিং রুমে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে উপস্থিত কুমারন অর্থাৎ বিনায়কের বাবাকে বলেছিলেন।

- ইস বেচারিকো তুম শাদী করলো। তুম্হারা তো বিবি মর গই। সো নো প্রবলেম। মেরা তো বিবি বাচ্চা সব হ্যায়। দেখো লেডি কিতনি বিউটিফুল হ্যায়। তুম্হারা বিনায়ককে লিয়ে ভি জরুর এহ ডিউটিফুল হোগি।

এই ঘটনাটা রাউরকেলার কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় ঘটেছিলো। বিনায়কের বাবার পোস্টিং টাটানগর। রাউরকেলা রানিং রুমে পুরোহিত ডেকে ড্রাইভার রাও সাহেব বিনায়কের বাবার সাথে ঐ মহিলার বিধিবদ্ধ বিয়ে দিয়ে কর্তব্য সম্পন্ন করে ছিলেন। তার ফলে তিন বছরের বিনায়ক আচমকাই একজন মা পেয়ে গেছিলো।

যে মা তাকে এখন পরীক্ষায় ফেল করলে মিষ্টি করে গালাগাল দেয় আর শুধুমাত্র গাল মুলে দেয়।

আর সেই সাথে পরিমল স্যারকে হাত জোড় করে রিকোয়েস্ট করেন।

- প্লিজ। রাগ কোরবেন না। আমার বিনায়ক মা হারা ছেলে।

মা হারা?! বলে কি?

এরকম সৎমা যার তাকে কি মা হারা বলা যায়?

তা সে মাকে রেল লাইনের ধার থেকে কুড়িয়ে আনা হলেও।

ক্লাস এইট ছিলো আমাদের ছাত্র জীবনের ব্যাপক পরিবর্তনের ক্লাস। আমাদের রেলওয়ে স্কুলের পরিধি ছিলো ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। ক্লাস সেভেন পাশ করে গেলে আমাদের অন্য বাইরের স্কুলে ভর্তি হতে হতো। কেএমপিএম, আরডিটাটা, শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যাভবন এই সব ছিলো ছেলেদের জন্য হাতের কাছের স্কুল। তবে সেসব স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি হতে গেলে ভালো রেজাল্ট করতে হয়। আমাদের অবাক করে দিয়ে বিনায়ক তাই করেছিলো। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল রেজাল্টে সে সব সাবজেক্টেই পাশ। এবং তার গড় নম্বর শতকরা পঞ্চাশের বেশি। আরো কয়েকজনের সাথে আমি আর বিনায়ক ভর্তি হয়ে গেছিলাম শ্যামাপ্রসাদ বিদ্যাভবনে।

এই ক্লাস এইটেই ছেলেরা সিগারেট খাওয়া শিখতো। এবং আরো শিখতো-- না থাক। সেটা নয় পরেই বলবো।

বিনায়ক সিগারেট ধরলো। প্রথম সিগারেট খাওয়ার পর আমাকে বললো-

এখন আমাকে ইলাইচি খেতে হবে। না হলে মা মুখে সিগারেটের গন্ধ পাবে। আর পেলে খুব রেগে যাবে।

আমি হেসে বলেছিলাম। রাগবে তো কী হবে? দেবে তো গাল মলা। ও তো একরকম আদর করাই।

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে দামোদর বলেছিলো। এ ব্যাপারে সেটা হবে না।

- তবে? তবে কি হবে? মারবে তোকে?

- না আমাকে মারবে না। ঘটি দিয়ে মেরে মা নিজের কপালই ফাটিয়ে দেবে।

শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেছিলো।

- বলছিস কি?

- ওরকম ঘটি মেরে কপাল ফাটিয়ে ফাটিয়ে বাপুর দারু খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে মা। হয়তো পুরা বন্ধ হয় নি। কিন্তু  দারু খেয়ে বাপু আর ঘরে আসে না।

- তবে কি ইলাইচি খেয়ে আসে?

শুনে বিনায়ক আমাকে দমাস করে একটা ঘুষি মেরেছিলো।

এরপরের ঘটনাটা বেশ গুরুতর। বিনায়কের সাথে রেল কলোনিরই এক মেয়ের ভাব হয়েছিলো। অন্য রকম ভাব। যাকে আমরা লাভ বোলতাম। এটাও ক্লাস এইটে উঠে ছেলে মেয়েদের মধ্যে শুরু হয়ে যেতো। মেয়েরাও সেভেন পাশ করে অন্য ইস্কুলে ভর্তি হতো। তাদের জন্য সবচেয়ে কাছের স্কুল ছিলো সিস্টার নিবেদিতা। এ ছাড়া ডি এম ম্যাডাম (আসলে ম্যাডাম নয় মদন। কিন্তু ম্যাডামই বলা হতো)। আর ছিলো সারদামণী গার্লস।  বিনায়কের সাথে লভ হয়েছিলো সিস্টার নিবেদিতার মনীষার সাথে। প্রেমের শুরুটাও জটিল। ভালোবাসাটা প্রথমে জন্মেছিলো খুব সম্ভব বিনায়কের মনে। ও যেচে যেচে মনীষার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলো। দুজনের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছিলো। মনীষার কাছেই বিনায়ক ফাঁস করে দিয়েছিলো তার বছর বছর এক দুটো সাবজেক্টে ফেল করার রহস্যটা। ওটা ও কোরতো ওর বাবা যাতে ওকে হস্টেলে না পাঠিয়ে দেয় সে জন্যে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিলো ওকে ঝাড়গ্রামের এক নামকরা স্কুলের হোস্টেলে ভর্তি করানোর। এক সাবজেক্টেও ফেল করলে সেটা সম্ভব হবে না। মনীষা খবরটা আমাদেরকেও জানিয়ে দিয়েছিলো।

জেনে আমরাও বিনায়ককে চেপে ধরেছিলাম।

আচ্ছা এই তাহলে তোর কেরামতি। আর এসব তোর মা জানে?

বিনায়ক মাথা নেড়ে বুঝিয়ে ছিলো জানে।

তারপর ফিসফিস করে বলেছিলো আমাকে হস্টেলে পাঠানোর পেছনে বাপুর অন্য মতলব ছিলো। মতলব হলো মায়ের পুরো ভালোবাসাটাকেই নিজে কব্জা করার। মা যে আমাকে বহুত ভালোবাসে এ জন্য বাবার হিংসে হতো খুব।

আমার জন্যই মা বাপুকে বলেছিলো।

- এক বিনায়ক হি কাফি হ্যায়। মুঝে ঔর ঔলাদ নহি চাহিয়ে।

আর বাপু আমাকে কি বলেছিলো জানিস? বলেছিলো-

- এই বুরবক। তেরা এক গোরা গোরা ভাই হোগা তো কৈসা লগেগা?

মা শুনতে পেয়ে ছুটে এসে বাবাকে ধমকি দিয়েছিলো।

- একদম ফালতু কথা বলবে না। আর গোরা বেটাই হবে তার কি গ্যারান্টি? তুম্হারা মাফিক কালা কলুঠাও তো হতে পারে?

এরপর একদিন মহা হৈচৈ। মনীষার মা বাবা রেগে মেগে বিনায়কদের বাড়িতে এসে হাজির। সাথে মনীষাকেও নিয়ে এসেছেন। যদিও সব চেঁচামেচি হচ্ছিলো বন্ধ ঘরের ভেতরেই। তবু আমরা টের পাচ্ছিলাম। বিনায়ক গুরুতর কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছে।

সেটা পরে বিস্তারিত জানতে পেরেছিলাম বিনায়কের কাছ থেকে। ও ছুটে এসেছিলো আমাদের কাছে। এক্ষুনি গোপী আঙ্কেলকে ডেকে আনতে হবে। গোপী আঙ্কেল রেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডার। আমরা তাকে ডেকে এনেছিলাম। তিনি এসে বিনায়কের মায়ের ফাটা কপালে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ছিলেন।

উনি মৈ তো পৈর ফিসলকে গির গই, বললেও। আমরা বুঝে গেছিলাম কি ভাবে তার কপাল ফেটেছে । পেতলের ঘটিটাকেও আমরা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।

পরে বিনায়ক ঘটনাটা আমাদের পুরো বলেছিলো। সিগারেট খেয়েছিলো ও। আর মনীষাকে বলেছিলো। দেখো তো মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে কিনা?

মনীষা বিনায়কের হাঁ করা মুখের সামনে নাক এনে গন্ধ শুকতে শুকতে নাকি বলেছিলো। সিগারেটের গন্ধ ওর খুব ভালো লাগে। আর তাই বিনায়কের মুখের সামনে নাক রেখে বার বার গন্ধটা শুঁকছিলো ও। তখনই মাথা গোলমাল হয়ে গেছিলো বিনায়কের। ও মনীষাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো।

আর তাতেই মেয়েটা কেঁদে কেটে একসা হয়ে ছুটে বাড়ি চলে গেছিলো। আর বিনায়কের কুকির্তীটার কথা নিজের মা কে জানিয়ে দিয়েছিলো।

তার পরের ঘটনাগুলো তো আগেই জানিয়েছি আমি।

এরপর বিনায়কের ঝাড়গ্রাম হস্টেলে যাওয়া আর আটকানো সম্ভব হয়নি।

এবং বিনায়ক হস্টেলে চলে যাওয়ার পরের বছরেই ওর এক ফর্সা বোনের জন্ম হয়েছিলো। যার নামকরণ করা হয়েছিলো সরোজা। স্ত্রী বাঙালি কিন্ত স্বামী তো দক্ষিণ ভারতীয়। নামটা তো সেই অনুযায়ী হবে। আর সেই মতো এই কাহিনীর নাম হবে ‘কুমারী সম্ভবম’।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন