সমকালীন ছোটগল্প |
সাতখুন মাপ
বাঁকাচোরা বা ত্যাড়াবাঁকা হতেই হবে। নিখুঁত হওয়া চলবে না। বাঁকাচোরা হলে সাতখুন মাপ। দুমড়ানো, মোচড়ানো হলে সাত দুগুণে চোদ্দখুন মাপ। এমনকী আঠাশ খুনেও বুক ফুলিয়ে হাঁটা যাবে।
আঠাশটা খুন করে অবশ্য হা্ঁটতে হয় না। তার জন্য
গাড়ির ব্যবস্থা — নিদেনপক্ষে একটা, আঠাশ দুগুণেছাপ্পান্ন খুনের মালিকের তিন, চারটে
গাড়ি।
কখন কোথায় যাবে আলাদা করে জানাতেও হয় না, জানা
থাকে। গাড়ির দরজা খুলে দেবার লোক আছে। সেও ট্যারাবাঁকা, একটা হাত নেই। হতে পারে একটা
পাও নেই। এক হাত, এক পা — ল্যাকপ্যাক করতে করতে সে দরজা খুলে দেয়।
অনেক সময় এমনও হয় যে দরজা খোলার চাকরি যার, তার
দুটো হাতই নেই। পা অবশ্য যথাযথ। সেই পায়ে ভর দিয়ে দরজার সামনে, কিন্ত সে তো দরজা খুলতে
পারে না, যদিও সেটাই তার কাজ, তখন তাকে সাহায্য করার জন্য আরেকজন, তার পা না-ও থাকতে
পারে, হাত থাকবেই। সেই হাতে গাড়ির দরজা খুলে যাবে।
আঠাশ খুনের মালিক এবার গাড়ির ভেতর ঢুকবে। তার হাত
পা সব ঠিকঠাক, শুধু হৃদয় নেই। গাড়ি যে চালাবে তার চোখ নেই। চোখ আছে এমন একজন, হয়তো
পা নেই, বা কান নেই, সে ড্রাইভারকে চোখ ধার দেবে। ধার করা চোখ নিয়ে ড্রাইভার গাড়ি চালাবে।
আঠাশ দু-গুণে ছাপ্পান্ন খুন যার, তার ড্রাইভারের
অনেক সময় চোখ কান দুটোই থাকে না। তাকে দুটোই ধার করতে হয়। ছাপ্পান্ন দু-গুণে একশো বারো
খুন মাপ হয়েছে যার, এমন লোকের যে ড্রাইভার — তার চোখ, কান, হাত-পা কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে
সবকিছু ধার করতে হয়। এসব ড্রাইভারদের কদর বেশি, এরা অনেক মাইনে পায়।
এরকম একজন গন্তব্যে পৌঁছে, যার থেকে যা যা ধার
করেছিল সব ফেরত দিয়ে দীঘায় বেড়াতে গেল। এর সবটুকু রাহুলের দেখা গত একমাসের স্বপ্ন।
গতরাতে সে ছিল ড্রাইভার। আঠাশ দুগুণে ছাপ্পান্ন
খুনেও যার মাপ এমন একজনকে সে কোথাও একটা পৌ্ঁছে দিয়েছিল। সেখান থেকে দীঘা। স্বপ্নে
তার একটা হাত ছিল না। কান ছিল, কিন্তু চোখ ছিল না।
এই স্বপ্নগুলো গত একমাসে প্রতি রাতে, আর সব সময়
রাতুল একটা চরিত্রে। এক বা একাধিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছাড়াই সে তার ভূমিকায়। হার্ট বা কিডনি
নেই — হাত-পা-চোখ-কান ছাড়া সে গাড়ি চালিয়েছে, আর এই চালাতে চালাতেই তার ঘুম ভেঙেছে। স্বপ্নে সে
আশি থেকে একশোয়, খেয়াল হয়েছিল চোখ নেওয়া হয়নি, অথচ চোখ ধার দেবার লোকটি তারই পাশে,
গাড়িতে বসে অঘোর ঘুমে। তার থেকে দৃষ্টি নেবার আগেই গতি একশো পঞ্চাশে পৌঁছলে গাড়ি গভীর
খাদে। সে নেমে যাচ্ছিল। সূর্যের আলো থেকে অন্ধকারে,
তারপর ঘন জমাট ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেখান থেকে তল নেই এরকম একটা খাদে সে নেমে যাচ্ছিল।
এসির ঠান্ডার মধ্যেও ঘামে জবজবে শরীর আর দমচাপা
ভয় নিয়ে রাতুলের যখন ঘুম ভেঙেছিল, সকাল পেরিয়ে গেছে। দীঘায় এসে এই ক্লান্তিকর স্বপ্ন
থেকে রেহাই পাবে ভেবেছিল। হোটেলের বিছানায় নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বপ্ন আর সত্যির
তফাতটা গুলিয়ে যায় রাতুলের। দাদা রাতুলকে দীঘায় পাঠিয়েছে, নাড়িবাবুর বডিগার্ড হিসেবে।
এই হোটেল ছাড়া দীঘাতেই দাদার তিনটে হোটেল, তারপরেও একটা চারতারা, তারই কনস্ট্রাকশনের
কাজ চলছে। বড়ো বড়ো পেমেন্ট, দুটো সুটকেস ভর্তি টাকা নাড়ুবাবুর হেপাজতে। তার কাজ নাড়ুবাবুর
টাকা ভর্তি সুটকেস পাহারা দেওয়া। দাদা এখন রিয়েল এস্টেটে। সব দাদাই একটা সময় এখানে
শান্টিং হয়। তার আগে প্রমোটিং, তারপর একটা মল। কলকাতায় দাদার উনচল্লিশ তলার টাওয়ারের
কাজ চলছে। তার সঙ্গে দীঘার এই চারতারা হোটেল।
পুরীতে তিনটে, বেনারসে একটা - চাঁদিপুর, ডুয়ার্স, বেলপাহাড়ি, গড়পঞ্চকোট… আরও… আরও…
যেদিন সরকার দীঘাকে গোয়া তৈরি করতে চেয়েছিল, দাদার
নজর সেদিন থেকে দীঘার উপর।
কথাটা নাড়ুবাবুর। বলছিল, এই নতুন চারতারা হোটেলের
ব্যাপার স্যাপার আলাদা। এলাহি ব্যবস্থা। এর কনস্ট্রাকশন থেকে ইন্টেরিয়র ডিজাইন, সবেতেই
ফরেন এক্সপার্ট। মাল্লু খসালে কাস্টমার যা চাইবে তাই পাবে। এনজয় কাকে বলে বুঝবি। মস্তিতে
বডি এমন কেলিয়ে যাবে… নাড়ুবাবু বলছিল, সঙ্গে খিকখিক হাসি। ওর ট্রেডমার্ক।
সন্ধেবেলা একটা পাঁইট নিয়ে রাতুল, তার পাশে নাড়ুবাবু।
নাড়ুবাবু কিন্ত মদে নেই। সুটকেস ভর্তি ক্যাশ, সেই সুটকেস আলমারিতে, তার পাহারার জন্য
রাতুল।
সকালবেলা ঘামে ভিজে জবজবে রাহুলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে
দু-একটা মামুলি প্রশ্ন করে নাড়ুবাবু আর এগোয়নি। নজর ছিল রাতুলের শরীরের দিকে, সেখানে
কোন ঝামেলা নেই বুঝে ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাঁটায়নি।
রাতুল স্বপ্নের কথা বলেছিল। সকালের ওই সময়টুকুর
মধ্যে যতটা বলা যায়, অন্যসময় হলে তালাচাবি দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিত, কিন্তু তখনও স্বপ্নের
ঘোর থাকায় ভরভর করে বলে ফেলেছিল। জল আর সোডা দিয়ে পেগ সাজিয়ে নাড়ুবাবু সকালের স্বপ্নের
প্রসঙ্গে ঢুকতে চাইলে রাতুল মদের কোয়ালিটিতে ঢুকে যায়। বলে, মালটা হেভি। তোমার চয়েস
আছে।
দাদার শুরু মদ দিয়ে। আবগারি লাইসেন্স ছিল। মদের
দোকান এখনও আছে, কিন্তু সাইডে, কারণ দাদা ছড়িয়েছে, এক থেকে অনেক — মদ থেকে হোটেল পর্যন্ত
তার ডালপালা, আরো নতুন নতুন ডাল গজাবে দু-এক বছরের মধ্যে — এসব, রাতুলকে কথায় কথায়
নাড়ুবাবুই বলেছিল। কথায় কথায় রাতুলও দীঘার জন্য দাদার দোকান থেকে ভালো ব্র্যান্ড তুলতে
বলেছিল।
নাড়ুবাবু ফের রাতুলের স্বপ্নের ঠিকুজিকোষ্ঠী নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
কবে থেকে?
রাতুল স্মৃতি হাতরায়। মনে করতে চেষ্টা করে। তার
মাথা ঝিমঝিম করে। ডান হাতের কব্জির গাঁট ঝনঝন করে ওঠে কবে থেকে শুরু ভাবতে গেলে পিছনে
তাকাতে হয়, আর তাতেই ঝামেলা। জট পাকিয়ে যায়।
লাস্ট অ্যাকশন থেকে?
রাতুল দেখল, নাড়ুবাবুর চোখ দুটো মরে হেজে, ঠান্ডা
মরা মানুষের চোখের মণি হয়ে গেছে। তাকাবে না ঠিক করে রাতুল এক ঝলকে সিলিং ফ্যানের স্পিড
লক্ষ্য করল। তারপর এসির রিমোট টিপে ছাব্বিশ থেকে কুড়িতে নিয়ে এল। আড়চোখে টের পেল নাড়ুবাবুর
মরা চোখ দুটো তার দিকে টিপ করে চেয়ে আছে।
কী হল? গান্ডুর মতো ঘামছিস কেন?
স্বপ্নটা কী লাস্ট এনকাউন্টারের পরে, নাকি তারও
আগে থেকে?
নাড়ুবাবু দুয়ে দুয়ে চার করতে চাইছে, ওর সময় হাঁটকানোর
এটাই কারণ — রাতুল সেটা জানে বলেই ওই এরিয়াতে ঢুকতে চাইছে না। তাছাড়া কবে শুরু জেনে
এর হাত থেকে রেহাই পাবার কোন চান্স নেই ধরে নিয়ে নাড়ুবাবুর এই আতা-খচরামিতে সাড়া দেবে
না ঠিক করে রাতুল।
এমনিতেই হরকে যাওয়া লাস্ট অ্যাকশনে তার অনেক ব্যথা,
দাদার কাছে বহুত ঝাড় খেয়েছে, আর এ শালা খালি খোঁচাচ্ছে। ঢ্যামনা নাড়ু হুল ফুটিয়ে বিষ
ঢালছে!
কপাল টার্গেটে থাকলেও রাতুলের গুলি জগদীশের কান ঘেঁষে পিছনে দাঁড়ানো হালুয়ার কপাল ফুটো করে দিয়েছিল। ভারে, ওজনে দাদার সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা জগদীশের, চার চারটে বডিগার্ড, তাকে ফাঁকায় এনে দিল যে হালুয়া, জগদীশের ডানহাত, পাবলিক যাকে বলত জগদীশের চোখ আর কান, যে হালুয়া দাদার চোখ-কান হবে বলে সেটিং পাক্কা, তার কপালে গুলি লাগলে রাতুল কীভাবে বে্ঁচে থাকে সেকথা রাতুলও বোঝেনি প্রথম প্রথম। সেদিন পাশ থেকে নাড়ুবাবু জগদীশের কপাল ফুটো না করলে রাতুলের খবর ছিল জগদীশের হাতে।
হালুয়ার সঙ্গে সেটিং দাদার প্ল্যান, প্রথম থেকেই দাদা নিজের হাতে ডিল করেছে। এর আগে যত সেটিং, সবেতেই নাড়ুবাবু। এই কেস তাকে না জানিয়ে দাদা করেছিল।
এসবে নাড়ুবাবুর মাথা সাফ, কিন্তু ওই ব্রেন দাদার
আর দরকার নেই। লাশ ফেলা, খেঁচড়া মাল হলে গুমখুন, সুপারি কিলিং — নাড়ুবাবু এই ফিল্ডে
এক নম্বরে। থানা পুলিশের নড়াচড়া যাতে না হয় তার বিলি বন্দোবস্ত — তার জন্য নাড়ুবাবুই
দাদার সবকিছু। দাদা যখন ভাই ছিল, সেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের দিন থেকে নাড়ুবাবু। লোকে
বলে নাড়ুবাবু না থাকলে ভাই কোনদিন দাদা হতে পারত না।
এই বলাবলি দাদা আজকাল নিতে চাইছেছে না। তাছাড়া
দাদার এখন আর এসব দরকার নেই। আড়াল, আবডাল, ঘুপেঘাপে বডি ফেলার দিন থেকে দাদা সরে আসতে
চাইছে। এখন দাদা চাইছে সব ওপেন হোক। পাবলিক দেখুক, তার মনে ভয়ের হাওয়া ঢুকলেই ট্যাঁ
ফোঁ করার সাহস হবে না। তার জন্যই হালুয়া। হালুয়ার কষ বেশি। ভালো ড্রিবলিং জানে। একসঙ্গে
ছ’সাতটা কেস নিয়ে কাটিয়ে গোল করে আসে। যাদের কাটাল তারা কিছু বোঝার আগেই গোল। বল তখন
হালুয়ার হাতে।
প্রথমে হালুয়া, তারপর জগদীশ, দুটো বডি পটাপট লটকে
পড়তেই, নাড়ুবাবু রাতুলকে বলেছিল — তোকে বাঁচাতে জগদীশকে আমি, কিন্তু তুই কেন হালুয়াকে,
বোঝাতে পারবি না। তোর কপালে তোর দাদার স্পেশাল গুলি নাচছে। কেসটা ম্যানেজ করে দেব,
তেরি বেরি বন্ধ করে আমার পেছনে থাকবি।
তারপর নাড়ুবাবুর নামতা — তোর সাতখুন মাপ। আমার
চোদ্দটা। এরপর আঠাশখুন মাপ -
স্বপ্নটা কেন কবে থেকে সব মনে পড়ে যায় রাতুলের। নাড়ুবাবুর সাজানো পেগ এক চুমুকে শেষ করে সেকথা বলতে গিয়ে রাতুল দেখল, নাড়ুবাবু উপুর হয়ে পড়ে আছে। ঘাড় এলানো আর কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে বিছানার চাদরে।
রাতুল মনে করতে পারে না, কীভাবে নাড়ুবাবুর চাইনিজ
নাইন এম এম তার হাতে এল। গুলির শব্দ সে শুনতে পায়নি। টিভি ফুল ভলিউমে প্রথম থেকেই।
লুঙ্গি ড্যান্সের সিডি রাতুল চালিয়েছিল। গাঁকগাঁক করে বাজছিল। নাড়ুবাবু রিভলবারটা পাশে,
বিছানায় রেখে কানে আঙুল দিয়ে খেঁকিয়ে উঠেছিল — আ বে হারামি, আওয়াজটা কমাবি?
এই হোটেলটাও দাদার। হোটেলের পার্কিং-এ ড্রাইভার
রাতুলের অপেক্ষায়। ড্রাইভারের হাত নেই, পা নেই, চোখ-কান কিছুই নেই। যারা সেই সব সাপ্লাই
দেবে, অশরীরি হয়ে তারা রাতুলের ঘরে ঢোকে।
শেষ মদটুকু জল না মিশিয়ে রাতুল গলায় ঢালে। উঠতে
গিয়ে টলে পড়ে যাবার আগেই অনেক অশরীরি তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়।
গাড়ি চলতে শুরু করলে কলকাতা থেকে দাদার ফিসফিসানি।
রাতুলের কানে কানে ফিসফিস... ফিসফিস... নাড়ুবাবুর
কাজগুলো এখন থেকে তুই…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন