মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


গাজন

বিকেল চারটে বাজলেই বুকের ভিতর দুরুদুরু করতে থাকে রূপের। এই সময়ে তার মায়ের নিউজরিডিং সেশন থাকে চ্যানেলে। লালমোহনকাকু নিচের বেসমেন্টে দাঁড়িয়ে হর্ন দেয়। টিউশানের সময় হয়ে গেছে। রূপকে এখন বের হতে হবে। অথচ মায়ের নিউজডেস্কটা শুরু হয়ে গেছে। মা আজ গোলাপী রঙের সালোয়ার পরেছে। বেশ লাগছে দেখতে। তারকেশ্বরে গাজনমেলার কভারেজ করছে মার নিউজ টিম। ছবির ফাঁকে ফাঁকে মা কথা বলছে। পিঠে বড়শি লাগিয়ে নাগরদোলায় ঘুরছে লোকগুলো। রক্ত ঝরে পড়ছে। অথচ মুখে এতোটুকু কষ্টর দাগ নেই। 'কষ্টর দাগ' কাকে বলে, রূপ ক্লাস সেভেনে পড়লেও মনে মনে বুঝতে পারে। মাকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তার। কিন্তু তার উপায় নেই। টিভির স্ক্রিনের ওইপারে মায়ের সঙ্গে কথা বলবার উপায় রূপের আছে কি? তার ঘরে ফিরতে ফিরতে তো সেই গভীর রাত। রূপ তখন জেগে থাকতে চাইলেও ঘুমিয়ে পড়বে।

জোরে জোরে হর্ন দিচ্ছে লালমোহনকাকু। রূপ জানে টিউশানে পৌঁছোতে তার দেরি হয়ে যাবে। টিভিতে নোয়াপাড়ায় একটা বেসরকারি অফিসে যৌননির্যাতন-এর খবর কভার করছিল নিউজডেস্ক। কীভাবে অধনস্থ একটি মেয়ে কর্মচারীকে অফিসের বস নিয়মিত ডেকে এনে ধর্ষণ করত। সকলেই জানত কিন্তু কাজ হারাবার ভয়ে চুপ করে থাকত। 'ধর্ষণ' শব্দের অর্থ রূপ শিখে গেছে। পড়ার ঘরে বই আলমারিতে সংসদের বাংলা অভিধান মিলিয়ে সে একদিন দেখে নিয়েছে। একদিন সে লুকিয়ে শুনেছে,মা তার অফিসের বন্ধু সৌরভ আঙ্কেলকে বলছে। প্রতি মিনিটে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও কোনও পুরুষ একজন মেয়েকে ধর্ষণ করছে। মা বলছিল। পুরুষরা মেয়েদের ধর্ষণ করে। পুরুষ মানে বড় ছেলে রূপ সেটা জানে। সৌরভ আঙ্কেল একবার জানতে চেয়েছিল, উল্টোটা হয় না? মা মাথা নেড়ে বলেছিল, মেয়েদের পুরুষের ওপর যৌন নির্যাতনের কথা সে নিউজফাইল খুলে দেখবে। তবে সেটা আদৌ ঘটলেও সমীক্ষার ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও মাত্রা পাবে না।

প্রথমে 'যৌন নির্যাতন' শব্দটার মানে বুঝতে পারছিল না রূপ। পরে বুঝেছে। মাকে জিজ্ঞেস করতে তার ভয় লাগে। মা ভাবে এখনও সে শুধুই পোকেমন আর সিঞ্চান দেখে। রূপ বলব বলব করেও বলে উঠতে পারেনি। এখনও অনেক কিছুই রূপ তার মাকে বলতে গিয়েও বলতে পারল না। আরেকবার নীচে থেকে হর্ন বেজে উঠতেই রূপকে ব্যাগ নিয়ে নেমে যেতে হলো। রূপের বাবা নেই। নেই মানে মৃত নয়। আছে, অথচ নেই। রূপের শুধু মা আছে। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর বাবা আবার নতুন বিয়ে করেছে চৈতালী আন্টিকে। চৈতালী আন্টিকে খুব ছোটবেলা রূপ দেখেছিল তার জন্মদিনের পার্টিতে। কোর্টে চৈতালী আন্টিকে 'নতুন মা' বলতে ইচ্ছে করল না রূপের। মায়ের জায়গাটা সে অন্য কারোকে দিতে পারবে না। তাই উকিল জানতে চাইলে রূপ পাকাপাকি বলে দিয়েছিল। সে তার মায়ের কাছেই থাকবে। এরপর বাবা দু একবার দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। রূপ কথা বলেনি। ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এখন মাঝেমাঝে ভাবে সে। কথাগুলো বলবার তো একটা লোক চাই! বাবা কাছে থাকলে রূপ বলতে পারত। মাকে এসব কথা বলতে রূপের ভয় করে।

নবনীতা ম্যাডামের বাড়ি রূপের বাড়ি থেকে ছ'সাত কিলোমিটার দূরে। রূপ এখানে জীবনবিজ্ঞান পড়তে আসে। ম্যাডামের বাড়িটা কোন্নগরে। গঙ্গার ঘাট ঘেসে। যাবার পথে জিটিরোডের ধারে একটা শ্মশান পড়ে। রূপ 'শ্মশান' মানে জানে। মা তাকে বলেছে। মরবার পর দাদু আর দিদুনকে যেখানে পোড়ানো হলো, তার নাম 'শ্মশান'। প্রথম প্রথম ওই জায়গাটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার ভয়ে গা ছমছম করত। এখন আর করে না। ম্যাডামের বাড়ি এসে দোতলায় চলে যেতে হয় রোজ। দরজা খুলে দিল বেলাদিদি। ম্যাডামের বাড়ি কাজ করে। আজ ম্যাডাম মানুষের রেচনযন্ত্র পড়াবে। রূপ এসব পড়ে ফেলেছে আগেই। ম্যাডাম পড়া দিয়ে রেখেছিল আগের দিন। গিয়ে খাটের ওপর বোর্ড, পেন আর বই নিয়ে বসল রূপ। এই সময়ে রূপ একাই পড়তে আসে। ঘরে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নবনীতা ম্যাডাম একটা ফিনফিনে গোলাপী গাউন পরে ঘরে ঢুকল। আশ্চর্য! আজ মায়ের সালোয়ারের রঙ নবনীতা ম্যাডামের ফ্রিল দেওয়া গাউনের রঙের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। নবনীতা ম্যাডামের গায়ের রঙ অনেকটা চিজের মতো। ফ্যাকাসে হলুদ। হাসলে গালের কাছটা গর্ত হয়ে যায়। তখন তাকে দেখতে পুতুল পুতুল লাগে। রূপ অবশ্য পুতুল পছন্দ করে না। পুতুলকে তার ভয় করে!

-কী রূপ? আজ কী পড়া ছিল? করেছো?

রূপ উত্তর দেয় না। ঘাড় নেড়ে জানায় শুধু, সে হোমটাস্ক করেছে। নবনীতা ম্যাডাম এইবার ধীরেধীরে এগিয়ে আসে রূপের দিকে। নবনীতা ম্যাডাম এই বাড়িতে ওই বেলাদিদি বাদ দিয়ে একাই থাকে। দরজার ছিটকানি ভিতর থেকে তুলে দিল ম্যাডাম। তারপর আবার এগিয়ে আসে। রূপের ভয় করছিল। তার মনে হল কেউ যেন গাজনের মেলায় এইবার গরম লাল বড়শি ফুঁড়ে দেবে তার পিঠে।

-নাও। প্রতিদিনের মতো খুলে ফেল।

রূপ কলের পুতুলের মতো বিছানা থেকে নেমে তার পরনের জামা প্যান্ট খুলে ফেলল। নবনীতা ম্যাডাম খিলখিল করে হেসে উঠে নিজের পরনের কামিজটুকু ছেড়ে এইবার রূপের সঙ্গে নানান পুতুলখেলা করতে লাগল। রূপের ব্যথা করছিল। ম্যাডাম বারবার তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া করেই চলেছে। ম্যাডামের বিকট দুটো বুক, তার উপর আরো বিকট বাদামি কালো দুটো বড় বড় চাকতি। রূপ ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার এখন মাকে মনে পড়ছে খুব। বাবাকেও। সে একটু কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার উপায় নেই। ম্যাডাম ততক্ষণে ডাকিনীর মতোই রূপকে মেলার সেই সাধকের মতো নাগরদোলায় চড়িয়ে ঘুরিয়ে চলেছে। তার মাথা ঘুরছে। বমি পাচ্ছে। রূপ মন দিয়ে যেন শিবঠাকুরের নাম করছিল। যদিও সে জানে। বুড়ো শিব তখন রাস্তার বটতলায় বটগাছের নীচে কালো গোল পাথরের ভিতর গভীর ধ্যান করছে। মা, বাবা, শিবঠাকুর, সবাই ধ্যান করছে। আলাদা আলাদা রকমের ধ্যান। এদের ভাতর একটাই মিল। এরা কেউ রূপের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাবে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন