সমকালীন ছোটগল্প |
ব্ল্যাক বিউটি
অফিস থেকে ফিরছি, হঠাৎ নজরে আটকে গেল। এই খনিশহরে লোকের আনাগোনার তো শেষ নেই! কর্মরত বঙ্গসন্তানদের সংখ্যাধিক্যের ফলে ভ্রমণপিয়াসী আত্মীয়বন্ধুদের গমনাগমন তো নিত্যদিনের ব্যাপার। এ ছাড়া চাকুরীসন্ধানরত যুবকযুবতী, সাধুসন্ত, ভবঘুরে, এমন আরো কত যে চুনাপাথরের পাহাড়ঘেরা এই শহরটির টানে ছুটে আসে তার হিসেব রাখতে বসে নেই কেউ। এই জনারণ্যে কোথায় কোন মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীন মহিলা দাঁড়িয়ে নিজের মনে কখনো হাসছে কখনো বা কে জানে কোন অজানা ভাষায় বিড়বিড় করে চলেছে তার খবর রাখার দায় পড়েনি কারো। আমারই বা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কি? আহা! পৃথিবীর সবকিছুই যেন প্রয়োজনের মাপকাঠি মেনে চলে! কেন জানি না, মধ্য তিরিশের ঐ মহিলা সব প্রয়োজন ভুলিয়ে আমায় স্থানুর মত দাঁড় করিয়ে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ। আমি তখন তুলনা খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওই নাক, ওই চোখ, ওই একঢাল কৃষ্ণকেশের অধিকারিণী আর কোন সুন্দরীকে কোথাও কখনো দেখেছি কিনা। না, মর্ত্যের মাটিতে নয়, হতে পারে কল্পরাজ্যের কোন ঊর্বশী বা মেনকার আদলে কেউ গড়ে দিয়েছে তাকে। তবে গাত্রবর্ণ বাদ সেধেছে বড়। সোনার বরণ বলতে পারতাম যদি! না হোক, ঐ শ্যামলা রঙটি আছে বলেই না সে ব্ল্যাক বিউটি! একটি চতুর্চক্রযান কখন থেকে যে হর্ণ বাজিয়ে চলেছে! চমক ভাঙল, যখন চালকমশাই নেমে এসে একগাল হাসি নিয়ে বলল, ‘কী বাবু, পাগলীর জন্য আপনি নিজের বিপদের কথাও ভুলে গেছেন? আমি সময় মত ব্রেক না দাবালে আপনাকে নিয়ে আমারই এখন হাসপাতালে যাবার কথা’। রতন, পরিচিত ড্রাইভার। হেসে বললাম, ‘স্যরি’। গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল রতন, ‘আপনার দোষ নয় স্যর, আমারও এই একই দশা হয়েছিল প্রথম যেদিন নজরে পড়েছিল পাগলী। অ্যাকসিডেন্ট করতে করতে বেঁচে গিয়েছিলাম’। ভাবলাম, এ মুগ্ধতা তবে আমার একার নয়! মনে মনে লজ্জাবোধেও আক্রান্ত হলাম যুগপৎ।
ঘরমুখো হয়েছি কি বেজে উঠলো ফোনটা। হুঁ, গৃহিণী । তিনি ছাড়া এমন মধুকন্ঠ আর কার হতে পারে! অভিযোগ, ‘কী গো, ফিরতে এত দেরী করছ যে, মনে নেই আজ সন্ধ্যায় দাসবাবুর কোয়ার্টারে ব্রহ্মচারীবাবা কৃষ্ণলীলা গাইবেন’? চলতে চলতেই বললাম, ‘হ্যাঁ গো, মনে থাকবে না! আজ তো আবার বস্ত্রহরণ পর্ব। ভেরী ইনটেরেস্টিং’। আবার অভিযোগ, ‘তোমরা পুরুষগুলো না! ঘরে এসো একবার, দেখাচ্ছি মজা’।
দাসবাবু বড় ধর্মানুগতপ্রাণ, সে কারণেই এ শহরে সাধুসজ্জনের ঠিকানা দাসবাবুর দু’শ চার নম্বর কোয়ার্টার। যদিও দাসমহাশয়ার এসবে রুচি নেই তেমন, তবু মেনে নিয়েছেন এই ভেবে যে, ক্লাবে গিয়ে তাসপেটানো আর এর ওর নামে কেচ্ছা গেয়ে বেড়ানোর চেয়ে ঠকুরদেবতার নামগান করা শতগুণ ভাল। এবার যিনি এসেছেন, কন্দর্পকান্তি চেহারার ব্রহ্মচারীবাবা। হ্যাঁ, বাবার এলেম আছে বটে! প্রতি সন্ধ্যায় অন্তত পঞ্চাশষাট জন মেয়ে পুরুষকে তো নাচিয়ে ছাড়ছেন
নামকীর্তনে! তা হয়ে গেল প্রায় সপ্তাখানেক। বিশ পঁচিশজন শিষ্যশিষ্যাও জুটিয়ে ফেলেছেন তিনি। প্রসঙ্গহীনভাবেই একদিন ওঠালেন তিনি সুন্দরী পাগলীর
কথা। সতর্ক করে দিলেন মহিলাদের, তারা যেন সজাগ থাকে তাদের স্বামীদের ব্যাপারে। পাগলী হোক, সুন্দরী তো!
কে না জানে সুন্দরের প্রতি
পুরুষমানুষের দুর্বলতার কথা!
পুরুষ শিষ্যদের কানেও এ কথাটা
ভাল করে পুরে দিলেন তিনি,
ওই সুন্দরীর চক্করে পড়ে যেন
তারা সংসারে বিপর্যয় টেনে না আনে।
বাবা আরও বললেন, কে বলতে পারে, মহিলা আদৌ পাগল কি্না! হতেও তো
পারে, কোন ভ্রষ্টচরিত্রের নারী ছদ্মবেশ ধারণ
করে আছে স্বাধীনভাবে কাম চরিতার্থ করার জন্য! বাবার প্রতি ভক্তির আতিশয্যে প্রতিবাদ জোগালো না কারো মুখে, বরঞ্চ ধন্য ধন্য করে উঠলো বাবার নামে।
এমন একটি আস্তানা, তার উপর গৃহকর্তার গদগদভাব, বাবা নিশ্চিন্ত অন্তত মাস খানেকের জন্য। এদিকে দাসগিণ্ণীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে দিন কে দিন। সে জানালো তার আশঙ্কার কথা। এর আগে যে সাধুরা এসেছে তারা বড়োজোর তিন থেকে চারদিন
পরই বিদায় নিয়েছে। অথচ এ বাবার দেখি তেমন কোন ইচ্ছেই নেই! গানের আসর জমছে,
শিষ্যসংখ্যা বাড়ছে, ফলমূল দুধঘিয়ে বাবার স্বর্ণবর্ণ এখন দ্যুতিময়। দাসবাবু বুঝলেন তার স্ত্রীর আশংকা কোথায়। এমন চলতে থাকলে তো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা লাটে উঠবে! দাসবাবু আশ্বস্ত করলেন গিন্নীকে। বললেন, ‘চিন্তা করো না,
কালই একটা ব্যবস্থা করবো’। বাবা তখন স্নান–আহ্নিক সেরে প্রাতঃরাশের প্রতীক্ষা করছেন। দাসবাবু করজোড়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লেন বাবার সম্মুখে। দাসবাবুর চোখমুখে একটা অপ্রস্তুতভাব দানা বাঁধছে
যেন। লোকচড়ানো বাবার চোখে যেন ধরা পড়ে গেছেন
তিনি, তাও কোন রকমে বলে ফেললেন, ‘বাবা, আমার গুরুভাই এইমাত্র ফোনে জানালো, আমার গুরুদেব দু’একদিনের মধ্যেই আমার ঘরে পদধূলি দেবার
ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন,
তা বাবা আমার এইটুকু কোয়ার্টারে
তো দুই বাবার ব্যবস্থা সম্ভব নয়,
তাই-! বাবা হাত তুলে তাকে থামতে বললেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে এমন দৃষ্টিতে
তাকালেন দাসবাবুর দিকে,
যেন পড়ে ফেলছেন দাসবাবুর
ভেতরটা। দাসবাবুর মুখমন্ডলে তখন ঘর্মবিন্দুর প্রাদুর্ভাব। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারলে বেঁচে
যান আর কি। কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল নিঃশব্দে। এবার কথা বলে উঠলেন ব্রহ্মচারীবাবা, ‘আমি বুঝতে পেরেছি দাস, তুমি নিরুপায়,
তোমার স্ত্রীর ধর্মকর্মে
তেমন একটা মতি নেই, তাকে কীর্তনের আসরে দেখাও যায় না তেমন
একটা, অসুবিধা হচ্ছে তার’। দাসবাবু কিছু একটা বলতে যাবেন, বাবা হাত তুলে আবার থামিয়ে দিলেন তাকে এবং বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘আমি কাল সকালেই বৃন্দাবনের দিকে যাত্রা করবো। একথা যেন দু’কান না হয়।
আমার শিষ্যদের কানে একথা
পৌঁছলে তুমি অসুবিধায় পড়ে যাবে।
আমি জানি ধর্মের প্রতি তোমার অনুরাগের কথা, তাই আমি চাই, তোমার মঙ্গল কামনায় আজ রাতে আমি ধ্যানে বসবো। কোনভাবে যেন আমার ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটে। এর অন্যথা হলে কিন্তু ঘোর অমঙ্গল নেমে আসবে
তোমার সংসারে।
তোমরা নিশ্চিন্তে নিদ্রা
যাও। আমি ধ্যান সমাপ্তির পর নীরবে প্রস্থান
করবো। আমি চাই না আমার বিদায়কালে কেউ সেখানে
উপস্থিত থাকুক, চোখের জল দেখে যাত্রা আমার পক্ষে শুভ নয়’। সরল বিশ্বাসে সব কথা নিজের মধ্যেই রেখে দিলেন দাসমশাই। তার মস্তিষ্কে একটা কথাই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে , ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলে ঘোর অমঙ্গল।
গভীর রাত তখন। সারা জগত নিদ্রামগ্ন, কিন্তু দাসবাবুকে জাগিয়ে রেখেছে সেই এক ভীতি, ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলে ঘোর অমঙ্গল। ঘড়িতে তখন আড়াইটে কি পৌনে
তিনটে হবে,
দরজায় জোর ধাক্কা। ধড়মড় করে উঠে
পড়লেন দাসবাবু। কেবল ধাক্কা নয়, তার নাম ধরে অনবরত ডেকে যাচ্ছে কেউ!
বলছে দরজা খুলতে। সর্বনাশ! অমঙ্গল
তবে কিছুতেই এড়ানো গেল না? নিশ্চিত বাবার ধ্যান ভেঙে গেছে। ভাবছেন দাসবাবু, বাবার দুটো পা জড়িয়ে ধরে অশ্রুবিগলিত চক্ষে ক্ষমা চেয়ে নেবেন,
যদি তাতে অমঙ্গলের মাত্রা কিছুটা হলেও কম হয়। ওদিকে ক্রমাগত দরজায় ধাক্কা আর দাসবাবুকে দরজা খোলার অনুরোধ। দাসবাবু শুনতে পেলেন বাইরে আরো দু’দশজন জমা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। কারণটা ঠাহর করতে পারলেন না দাসবাবু। নাঃ, দরজা
না খুলে উপায় নেই, যা হবার হোক বলে শেষ পর্যন্ত দরজাটা খুলেই দিলেন তিনি। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এল পাহারাদার কুন্দন সিং। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাঙা বাংলায় জানতে চাইল, ‘আপনাদের বাবা কহাঁ’?
হতভম্ব দাসবাবু কোনমতে বলতে পারলেন, ‘বাবা পাশের
ঘরে ধ্যানে আছেন’। কুন্দনের চোখে
অবিশ্বাস,
বলল, ‘চলিয়ে তো, দেখেঁ,
কী রোকম ধ্যান কোরছেন বাবা’! বাবার ঘরের দরজায় ধাক্কা মুহুর্মুহুঃ কিন্তু এত আওয়াজেও দরজা
খুলছেন না কেন? দরজা
ছেড়ে ঘরের অন্যদিকে গিয়ে তো সকলের চক্ষু কপালে, একমাত্র কুন্দন
সিংয়ের মুখে কৌতুকের আভাস। দেখা গেল, ঘরে বাবার
চিহ্নমাত্র নেই, গরাদেবিহীন জানালা হাট করে খোলা। এতক্ষণে আশপাশের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে মেয়েপুরুষ অনেকেই। দাসগিন্নী জানতে চাইলেন, ব্যাপারটা কী? কুন্দনের
এককথা, ‘চলিয়ে মেরে সাথ, আপনা আঁখোসে দেখিয়েগা
সবকুছ’। কৌতূহলে উত্তেজনায় সবার রক্তচাপ বেড়ে যাবার জোগাড়। ভোর হতে তখনও অনেকটাই বাকী। না, কোন মহিলা
নয়, কেবল পুরুষেরাই সঙ্গী হল কুন্দন সিং-এর। সোজা হাসপাতালে
গিয়ে হাজির সকলে। মাথায় ব্যান্ডেজবাঁধা
বাবা তখন হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে বলতে থাকলেন, ‘দ্যাখ, দ্যাখ তোরা, তোদের সুন্দরী পাগলী কী হাল করেছে আমার!
আমি জানতে গিয়েছিলাম, ও সত্যিই পাগল কিনা, আর পাগল
যদি হয়ই তবে সারিয়ে তোলার মন্ত্র তো জানাই আছে আমার। ভেবেছিলাম কৃষ্ণকীর্তন করে ওকে সুস্থ করে তুলবো, তা’-!
কথা বলার সাথে সাথে তিনি জরীপ করছিলেন শ্রোতাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি। বাবার কথা যখন প্রায় আধগেলা অবস্থায়, ঠিক সে সময়ে বাধ সাধলো কুন্দন। প্রায় ধমকের সুরেই বলে উঠল সে, ‘ইতনা বড়া ঝুট মত বোলো বাবা, মৈনে দেখা না পুরা পিকচার! পাগলী জব পত্থর ফেকি,
ঔর তুম ঘায়ল হো গয়ে তব কৌন তুমকো উঠাকে লে আয়া ঔর হাসপাতাল মে ভর্তি
কর দিয়া, মৈনে না?’ অপরাধী ধরা পড়ে গেছে
যেন। আর একটিও কথা নেই বাবার মুখে। বাবার শিষ্যরা লজ্জায় অনুতাপে অধোবদন। একে একে বেরিয়ে গেল সবাই। বিরোধী পক্ষের
কেউ একজন বলে উঠল, ‘লিবিডো লিবিডো! আরে বাবা উনি তো আর চৈতন্য
বিবেকানন্দ নন! এতক্ষণে দাসবাবুর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হল। গতকাল অমঙ্গলের
কথা বলে তার মনে ভীতির সঞ্চার করা, ধ্যানে বিঘ্ন না ঘটানোর জন্য সকলকে দূরে সরিয়ে রাখা, এই ধূর্ত পরিকল্পনা যে বাবার এই অশালীন উদ্দেশ্যের মূলে,
সে কথা তার থেকে আর কে ভাল জানবে
যে যার
মত করে চর্চা করে চলেছে ঘটনাটি নিয়ে। ব্ল্যাক বিউটিকে শহর ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। আর পাঁচজনের মত সেও শহরের একজন হয়ে গেছে এতদিনে।
কালীমন্দিরের বারান্দাই তার রাতের আস্তানা একথা জানে সবাই, এর থেকে বেশী খবর আর কেউ
রাখেনি তার সম্পর্কে। অভাবিত এই ঘটনাটিই আবার ফিরিয়ে দিল তাকে খবরের শিরোনামে। নতুন
করে জিজ্ঞাসা জাগে সবার মনে, এত সুন্দরী এক মহিলা পাগল হল কেন? কী তার পরিচয়? আমার
মনে তখন অন্য ভাবনা। ব্ল্যাক বিউটি কে, সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। পাগল হলেও আত্মরক্ষার ইন্সটিংক্ট তার মধ্যে কাজ করেছে কিনা সে প্রশ্নেরও বা কি প্রয়োজন?
খসে পড়েছে ব্রহ্মচারীবাবার মুখোশটা, তার ভন্ড চেহারাটা অনাবৃত
হয়ে পড়েছে সর্বসমক্ষে এবং সেটা ঘটেছে ব্ল্যাক বিউটিরই কারণে, সেটাই তো বিবেচ্য এখন। নিন্দা প্রশংসা কোনটাতেই তার কিছু এসে যায় না জানি, তবু অবচেতনায় মাথাটা নত হয়ে গেল তার উদ্দেশে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন