শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৩

 


অনেক বিশ্বভ্রমণ হয়েছে। এবার আমরা পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালকদের নিয়ে, তাঁদের কাজ নিয়ে কিছুদিন কাটাছেঁড়া করব। শুরু করব নিজের মহাদেশ এশিয়া দিয়ে। আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে এশিয়া দিয়ে শুরু করছি কেন? আমার বিনীত উত্তর, charity begins at home. এবং এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশ যদিও আমি দফায় দফায় কভার করেছি, অনেক নাম-না-জানা দেশ থেকেও অদ্ভুত সব সিনেমা তুলে এনেছি, আজ কিন্তু স্ট্রেট ড্রাইভ ছাড়া অন্য কোন শট মারব না। ফলে একদম ক্লাসিক পরিচালকদের নিয়েই আলোচনা। আমার আলোচনায় আজ যাঁরা যাঁরা আসবেন, তাঁদের নিয়েও কিন্তু ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পর্বে বলা হয়ে গেছে। দেখুন, ত্রয়ী হিসেবে এঁদের এভাবে যদি সাজাই -

১) জাপানের আকিরা কুরোশাওয়া, ইয়াসুজিরো ওজু, কেঞ্জি মিজোগুচি

২) ভারতের সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক

৩) চিনের চেন কাইগে, শ্যাং ইমো, ওয়াং কার-ওয়াই

৪) ইরানের কিয়ারোস্তামি, মখ্‌মলবাফ্‌, মজিদ মজিদি

৫) দক্ষিণ কোরিয়ার লি চাং-ডং, কিম কি-ডুক, পার্ক চান-উক

শুধুমাত্র ভারতের তিনজন বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে আমি কিন্তু কোন না কোন পর্বে ছুঁয়ে গেছি। এবং আজ এইসমস্ত ত্রয়ীদের মধ্যে থেকে কোন একজনকে বাছতে বাছতে যাব। হতেই পারে, আপনার পছন্দ অন্যজন, এবং আমিও সেটাই চাইব। প্রায় তিনবছর এই ধারাবাহিক চলছে, এবার আর আমার কথা শুনবেন না, বরং নিজের পছন্দের ওপর, নিজের স্বাদের ওপর ভরসা রাখুন।

জাপানি ছবির প্রায় প্রতি শটে ল্যান্ডস্কেপিং ফুটে ওঠে। ফলে জীবন বা রহস্য বা জটিলতা বা ফিকশন, সব কিছুই প্রকৃতির মাঝে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভাবুন, জাপানি ছবির স্বর্ণযুগে একদিকে যেমন আকিরা কুরোশাওয়া রশোমন (১৯৫০), ইকিরু (১৯৫২), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪)-এর মত অনবদ্য ছবি বানিয়ে চলেছেন, আরেকদিকে ইয়াসুজিরো ওজু লেট স্প্রিং (১৯৪৯), আর্লি সামার (১৯৫১), টোকিয়ো স্টোরি (১৯৫৩) বানাচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে কেঞ্জি মিজোগুচি তৈরি করছেন দ্য লাইফ অব ওহারু (১৯৫২), উগেৎসু (১৯৫৩), সানশো দ্য বেইলিফ (১৯৫৪) ইত্যাদি। গায়ে কাঁটা দেয়। দুর্ভাগ্য, মিজোগুচি বেশিদিন বাঁচেননি। বাঁচলে আরো অনেক মনে রাখার মত সিনেমা আমরা পেতাম। তবে জাপানে আমার প্রথম পছন্দ আকিরা কুরোশাওয়া। কারণ আমার মতে, রশোমনের যাত্রা দিয়েই জাপানের সিনেমা আন্তর্জাতিক হয়।  এক হত্যা আর এক ধর্ষণ, সেই নিয়ে চারজন সাক্ষীর চার রকম ভিন্ন বয়ান, যা থেকে পরবর্ত্তীকালে ‘রশোমন এফেক্ট’ আইনের চোখে এক স্বীকৃত তত্ত্ব হয়ে ওঠে। কুরোশাওয়ার ছবি ভাললাগার প্রধান কারণ  তিনটে। এক, ভিস্যুয়াল এফেক্ট। অনবদ্য ক্যামেরা। দুই, বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে হয়। তিন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এই তিন মিলে কুরোশাওয়ার ক্যানভাস যেন জীবন্ত কবিতা। আসলে, কুরোশাওয়া, কিউব্রিক, বার্গম্যানের মত পরিচালকেরা ক্যামেরার পেছনে চোখ লাগিয়ে সেলুলয়েডে রং-তুলি নিয়ে খেলতে ভালবাসেন। তাই তাঁদের ছবি অনুভব করতে হয়, বুদ্ধি দিয়ে ধরতে হয়। ভাবলে অবাক লাগে, কুরোশাওয়া জাপানি হয়েও রাশিয়ান ছবি (দারসু উজালা) পরিচালনা করেছেন, সেটাও এক পর্বে লিখেছিলাম।

সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিককে নিয়ে এখানে কিছু লিখব না। কারণ এঁদের ছবির বিষয়ে আমরা সবাই জানি, হয়ত আপনারা আমার থেকেও বেশি জানেন। তাই চর্বি চিবোব না। কিন্তু হ্যাঁ, এই ধারাবাহিক শেষ হবার পর আলাদা এক লেখায় এঁদের নিয়ে অন্য এক অ্যাঙ্গল থেকে লিখব, আশা করছি সেটা আপনাদের মনে  ধরবে। আপাতত এটাই বলতে পারি, সত্যজিৎ যেমন গ্রাম্য ও মফস্বল বাংলাকে জীবন্ত করেছেন, মৃণাল মানুষের এক শ্রেণীর না পাওয়ার বেদনাকে ক্যামেরার আয়নার সামনে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে এনেছেন, তেমনি ঋত্বিক দেশভাগের যন্ত্রণাকে বয়ে বেড়িয়েছেন সেলুলয়েডের ফ্রেম থেকে ফ্রেমে। কিন্তু আমাকে যদি এঁদের  ভেতর থেকে কাউকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি টেকনিকাল লোক হিসেবে টেকনিকালি পারফেক্ট সত্যজিতকেই বাছব।

এই লেখার ১৯তম পর্বে বলেছিলাম, চিনের ছবি সাহসী হতে পারেনি, কিন্তু তাই বলে চিনের ছবি দুর্বল নয়, বরং মূলত ইতিহাস আশ্রয়ী। এবং সেই কারণেই চিনের ছায়াছবির সিনেমাটোগ্রাফি কিন্তু বেশ শক্তিশালী। চিনের যে তিনজন পরিচালকের নাম আমি ওপরে লিখেছি, তাঁরা সবাই কমবেশি ঐতিহাসিক ছবি বানিয়েছেন। চেন কাইগে ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ করেই পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে গেলেন, এবং কার-ওয়াই ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ করে, কিন্তু শ্যাং ইমো আস্তে আস্তে উঠেছেন। রেড সোরঘাম থেকে শুরু করে জু দো, রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন, টু লিভ, দ্য রোড হোম হয়ে হিরো হয়ে কামিং হোম অব্ধি। ইতিহাস, পারিবারিক ড্রামা, যুদ্ধের ছবি, যৌনদাসী প্রথা, রাজনৈতিক বন্দী। সবধরনের ছবি। আজ তাই আমি বেছে নিলাম শ্যাং ইমো-কে। অবশ্য আমি জানি আমার নিন্দুক পাঠক, যাঁরা ১৯ নং পর্ব খুঁটিয়ে পড়েছেন, বলবেন যে, গং লি এর প্রধান কারণ। হ্যাঁ, শ্যাং ইমো-কে বাছার আরেক কারণ হল উনি আমার অন্যতম  প্রিয় নায়িকা গং লি-কে ওনার ছবির মধ্যে দিয়েই বিখ্যাত করেছিলেন। কিন্তু যে কারণে শ্যাং ইমোকে আমি এগিয়ে রাখব, তা হল সিনেমাটোগ্রাফি। উনি নিজে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে শুরু করেছিলেন। এবং সময় যত এগিয়েছে, ওনার ছবিতে রং-এর ব্যবহার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গল্প বলার ধরন যেন প্রা্ণ  পেয়েছে। রেইজ দ্য রেড ল্যান্টার্ন দেখুন। বুঝবেন। চিন জাপান যুদ্ধের পটভূমিকায় জু দো দেখুন, চিনের প্রাচীন রীতি নীতির বর্ণনা, আবার উল্টোদিকে সম্প্রতি তৈরি ওয়ান সেকেন্ড (২০২০) দেখুন, সত্তরের রাজনীতির আবহে গল্প কী ভাবে বলতে হয়, সিনেমার গুরুত্ব কাকে বলে, সিনেমা মানুষের জীবন কি করে বদলে দেয়।

ইরানে কিয়ারোস্তামির সিনেমা যেমন বেশিরভাগ সোশাল স্যাটায়ার – বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে চাবুক, মজিদির ছবি যেমন গ্রাম্য ইরানের পটভূমি ফুটিয়ে তোলে, ভাললাগার রেশ রেখে যায়, মখ্‌মলবাফের ছবি উল্টোদিকে রাজনৈতিক, জটিল ও সাহসী। আর সেজন্যই আজ আমি মোহসেন মখ্‌মলবাফকেই বেছে নিলাম। কিয়ারোস্তামির সিনেমাতেও এক জায়গায় মখ্‌মলবাফের রেফারেন্স এসেছে। ৯০এর দশকে মখ্‌মলবাফ্‌ হয়ে ওঠেন ইরানের সিনেমার প্রধান মুখ। ক্রিটিকাল কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। দ্য সাইক্লিস্ট (১৯৮৯), ওয়ান্স আপন এ টাইম, সিনেমা (১৯৯২), হ্যালো সিনেমা (১৯৯৫), এ মোমেন্ট অব ইনোসেন্স (১৯৯৬), দ্য সাইলেন্স (১৯৯৮), কান্দাহার (২০০১), সেক্স অ্যান্ড ফিলজফি (২০০৫) ইত্যাদি অদ্ভুত এবং সাহসী সব সিনেমা। এর মধ্যে আমার ফেভারিট ‘সেক্স অ্যান্ড ফিলজফি’। সেটাও আগেই বিস্তারিত লিখেছি। ১৮ নম্বর পর্বে। আসলে আমি সাহস খুব পছন্দ করি। মখ্‌মলবাফ্‌ যেমন আদ্যান্ত ভয়ডরহীন, তেমনি তাঁর সিনেমার স্টাইল। বনিবনা হয়নি বলে মখমলবাফ্‌ ইরান ছেড়ে চলে যেতেও দ্বিধা করেননি। এটাই তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। ওনার মেয়ে সমীরার বানানো কয়েকটা ছবিও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত,  ক্রিটিকাল।

আগেই বলেছি, দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমার কয়েকটা ধাঁচ আছে। বেশিরভাগ ছবি এখানে কোন এক ফ্যামিলি ঘিরে তৈরি হয়, যার শেষে লুকিয়ে থাকে রহস্য বা সূক্ষ্ম অনুভূতি। অথবা সমাজের দু’একজন দলছুটকে নিয়ে তৈরি হয়, যারা বিভিন্নভাবে কাছাকাছি আসে এবং সেখানেও থাকে রহস্য। অথবা কোন রহস্যঘেরা ঘটনা নিয়ে আদ্যান্ত অনুভূতির সিনেমা। আর এই কারণেই আজ আমি কোরিয়ার তিনজনের মধ্যে থেকে বেছে নেব ভার্সেটাইল পরিচালক লি চাং-ডং কে, কারণ একদিকে পোয়েট্রি, ওয়েসিস, টু দ্য স্টারি আইল্যান্ড, অন্যদিকে পেপারমিন্ট ক্যান্ডি, আবার আরেকদিকে বার্নিং আর হার্টবিটের মত ছবি। ওনার পোয়েট্রি, পেপারমিন্ট ক্যান্ডি আর বার্নিং নিয়ে আমি ৫ নম্বর পর্বে লিখেছি। উৎসাহী পাঠককে অনুরোধ, সেই রেফারেন্স ঘেঁটে একটু দেখে নিন। আর ওনার এই তিনখানা সিনেমাও দেখুন। আমি আজ অব্ধি ঐ ‘বার্নিং’ নামের মানে খুঁজে ফিরছি। ধাঁধাঁ।

হ্যাঁ, কোরিয়ার ছবির কথা বললে এখনো ভারাক্রান্ত লাগে। এই ধারাবাহিক শুরু করেছিলাম ২০২০ সালে, কোভিড ও লকডাউনের আবহে, সেই সমস্ত সিনেমা কলমের ডগায় তুলে এনে। যখন সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করলাম, এবং প্রথম যে দেশের সিনেমা নিয়ে কাটাছেঁড়া করলাম – কোরিয়া, এখনো মনে আছে সেটা ডিসেম্বর ২০২০। কিম কি-ডুকের রহস্যময় ‘দ্য আইল’ দেখছি আর ভাবছি এই সিনেমাটা আমার লেখায় আনব কিনা, খবর পেলাম, উনি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা কোভিডাচ্ছন্ন হওয়ার পর বুঝেছিলাম, জীবনানন্দের কবিতা ‘সৃষ্টির মনের কথা, মনে হয় – দ্বেষ’ কত মর্মান্তিকভাবে সত্যি।

(ক্রমশ)


1 টি মন্তব্য:

  1. মাননীয় অভিজিৎ_দা, হ্যাটস অফ আপনাকে কুর্ণিশ। এমনতর লেখার জন্যে। চোখ বেঁধে যে সিনেমা দেখে বেড়েছে নোলা, তারমধ্যে হিন্দি ছবি কি জয়! কত মন ধাঁধানো। তবুও ব্যাপার হল যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ফিকে হয়ে গেছে। মুষ্টিমেয় কটা সিনেমা বারবার দেখে নিজেকে সিনেমার হামবড়া দর্শক ভেবে অনেক ফাটিয়েছি। আপনার লেখা খনি থেকে তুলে আনা... আজকাল পড়ছি। পড়তেই থাকছি। সাধুবাদ পড়তে সুযোগ দিলেন বলে...

    উত্তরমুছুন