শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

সাহিত্যিক সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কলমে তিন বাঙালী আইকন

সৌরভ মুখোপাধ্যায়, যুক্তি তক্কো আর গদ্য

প্রকাশকঃ অন্তরীপ পাবলিকেশন, ২০২৩

 


‘কথামুখ’-এ লেখক বলে দিয়েছেন যে তাঁর ‘আগের বইটির’ (ফোনের ওপারে নীললোহিত এবং অন্যান্য গদ্য) – যেটি ছিল ‘ব্যক্তিগত বা আত্মকথামূলক’ – তুলনায় বর্তমান সংকলনের লেখাগুলি ‘নৈর্ব্যক্তিক, বিচার-বিশ্লেষণ আর অনুসন্ধান-পর্যবেক্ষণে ঠাসা, তথ্য-যুক্তি-তর্কে খচিত।’ ন’টি লেখার মধ্যে পাঁচটিরই বিষয় বাঙালীর তিন ‘আইকন’ঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস। প্রথমে সেগুলি নিয়েই কথা হোক।

 

২য় পর্ব

বিষয় সত্যজিৎ

 

(১) সত্যজিৎ-উত্তমকুমার




একজন বিদগ্ধ উচ্চ-সংস্কৃতিমার্গী, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র-নির্মাণে বিশ্বাসী। অপরজন মূলধারার জনপ্রিয় বাংলা ছবির একমাত্র এবং অদ্বিতীয় মহানায়ক, জনগণের নয়নমণি! এক আকাশে এত ভিন্ন দুটি সূর্য একসঙ্গে, পরস্পরের দীপ্তি অক্ষুণ্ণ রেখে, কি বিরাজ করতে পারে? ‘বাস্তবতার একটু অভাব: সত্যজিতের ‘নায়ক প্রবন্ধে (‘অন্তরীপ’-‘একাই ১০০’ সংখ্যা, ১৪২৮) এই সমস্যাসঙ্কুল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। এবং তাঁর বিশ্লেষণ থেকে এটাই উঠে আসে যে এক সূর্য অতি সূক্ষ্মভাবে অপরটিকে কলঙ্কিত করতে গিয়ে, এবার ইংরেজী প্রবচন উদ্ধৃত করতেই হচ্ছে, is hoist [hoisted নয়] with its own petard, যুগপৎ ছবিতে এবং বাস্তব জীবনে!

ছবির বিষয়বস্তু বাংলা ছায়াছবির একজন ‘স্টার’। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মধ্যভাগে (নায়ক মুক্তি পায় ১৯৬৬-তে) এ ছবির কেন্দ্রে যে একজনকেই মানাতো, তা সত্যজিৎ নাকি স্বীকার করেছিলেন যখন ঐ ভূমিকায় অভিনয়েচ্ছুক আরেকজনকে তিনি বলেন, “তুমি তো উত্তম নও!” কিন্তু, ‘নায়ক’ করার সময় সত্যজিতের ‘অনেকগুলি ছবি বাণিজ্যসাফল্যবঞ্চিত অথচ টলিঊডের বক্স অফিস বারংবার ফেটে পড়ছে উত্তমকুমারের নামে’! এর মানসিক প্রতিক্রিয়া, সৌরভবাবু দেখিয়েছেন, অত্যন্ত পীড়াদায়ক অবাস্তবতার সঙ্গে (সত্যজিৎ আর অবাস্তবতা!) প্রকট ছবিটির চিত্রনাট্যে এবং তার ফলে বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্রায়নে।

ছবির মূল কাহিনি কি? জাতীয় পুরস্কার নিতে বাংলা ছবির তারকা অরিন্দম চ্যাটার্জী দিল্লী যাচ্ছে, এবং যাত্রাপথে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার নানারকম মিথষ্ক্রিয়া হচ্ছে। একজন তারকা কলকাতা থেকে দিল্লী যাবে তো প্লেনে! কিন্তু তাহলে তো খুব বেশী মানুষের সঙ্গে তার আদানপ্রদান হবে না! অতএব প্লেনের টিকিট না পাবার ছুতোয় তাকে চাপাও ট্রেনে – অবশ্য স্লিপার তো নয়ই – সেখানে সে mobbed হবেই, এমনকি এয়ার কন্ডিশনড ফার্স্ট ক্লাসেও নয়, (কারণ সে তো প্রায় প্লেনেরই সগোত্র, বেশী লোকজন কোথায়?) – এক ভেস্টিবিউল ট্রেনে, যেটিকে সৌরভবাবু সনাক্ত করেছেন ‘সম্ভবত ‘ডিলাক্স’ এক্সপ্রেস, যেটি পরে পূর্বা এক্সপ্রেসে রূপান্তরিত হয় (রাজধানী এক্সপ্রেস নয়, তা এসেছে আরও পরে)’ বলে। এই ট্রেনে অরিন্দমের সহযাত্রীরা, সৌরভবাবুর ভাষায় ‘উঁচুতলার শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও কর্পোরেট জগতের প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা – যাকে বলে enlightened community, cream of the society – এবং বাংলার বাইরে অন্য প্রদেশের লোকজন, কেউ টালিগঞ্জের সুপারস্টারের প্রতি মনোযোগী নয়! সাদা বাংলায়, এরা তাকে পোঁছে না!’

এদের বিপরীতে অরিন্দমকে নিয়ে বিমুগ্ধা কারা? ‘মূলত মহিলারা – যারা আবার [ছবিতে অনেকাংশে সত্যজিতের মানসিকতার প্রতিভূ, শর্মিলা ঠাকুর রূপায়িত সাংবাদিক অদিতির মতো] ততটা আলোকপ্রাপ্তা নয়’! কিন্তু তাদেরও মুগ্ধতায় উত্তমকুমারকে ঘিরে বাস্তব জীবনে তৎকালীন মহিলাদের লাগামছাড়া উন্মাদনা নেই, সবাই ‘বেশ সংযত … দূর থেকে সামান্য বিস্ময়-উচ্ছ্বাস, নয়তো মুখে হাত চেপে চোরা ফিসফাস!’ এর পাশাপাশি রাখব উত্তমকুমারের আত্মজীবনী ‘আমার আমি’ থেকে নায়ক ছবির এক দশক আগে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনাঃ

(ক) ‘সবার উপরে’ (১৯৫৫) ছবির শুটিং চলছে আর তার সঙ্গে উত্তমকুমার স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করছেন। এক বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগরে আউটডোর শুটিং সেরে আবার হাতিবাগানে মঞ্চাভিনয় সেরেছেন তিনি। মেক-আপ তোলার সময় এক ভদ্রমহিলা, উত্তমের ভাষায় ‘অভিজাত কোন পরিবারের কূলবধূ’, এসে উত্তমকুমারকে জানান যে তিনি সেই কৃষ্ণনগর থেকে অভিনেতার গাড়ি অনুসরণ করে স্টারে উপস্থিত হয়ে, টিকিট কেটে মঞ্চে উত্তমের অভিনয় দেখেছেন। এরপর তিনি ঘোষণা করলেন, “আমি আর বাড়ি ফিরব না!” মহিলাকে অনেক বুঝিয়ে, মিনতি জানিয়ে, বহু কষ্টে তাঁকে শান্ত করে, তাঁর ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয়।

(খ) ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭) ছবি তৈরির সময় উত্তমকুমার বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, এমন সময় তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। তাঁর শুকনো মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখমুখ উদভ্রান্ত। ক্ষিপ্তভাবে সে ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন, “আপনিই তো উত্তমকুমার? … আমার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে আজ চারদিন হ’ল বাড়ি থেকে বেরিয়েছে – আজও ফেরেনি –” … সেই ভদ্রমহিলাকে [উত্তম বলছেন] আমি চোখেও দেখিনি (দুটি ঘটনাই পাওয়া যাবে আমার আমি বইটির ১০০-১০১ নং পৃষ্ঠায়। প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮০, নতুন সংস্করণ ১৯৮৮)

এগুলো সত্যজিৎ-ভক্ত উন্নাসিকেরা উত্তমকুমারের অহমিকা-প্রসূত গালগল্প বলতেই পারেন, যেখানে উত্তম স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে ‘জনপ্রিয়তার এই নিদর্শনের কোন প্রমাণ হয়তো আজ আমি দাখিল করতে পারব না’। কিন্তু, বাস্তব জীবনে ‘নায়ক’ ছবির একটিমাত্র বিশেষ দৃশ্য শুটিং করতে গিয়েই হাওড়া স্টেশনে তুমুল জনজোয়ার ভেঙে পড়েছিল ‘গুরু’ উত্তমকুমারের জন্য, চরম নাজেহাল হতে হয়েছিল পরিচালককে। তখন কি তাঁর একটিবারও মনে হয়নি – ফিল্মে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী অরিন্দম’কে নিয়ে তিনি যা ঘটাচ্ছেন তা একেবারেই বাস্তবের বিপরীত?’

উত্তরঃ না, মনে হয়নি। মূলধারা ও তার ধারক ‘ম্যাটিনি হিরোদের সম্পর্ক’ সত্যজিতের অশ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে ‘ ‘নায়ক’-এর প্রিমিয়ারের দিন উত্তমকুমার যে ‘গণ-বিশৃঙ্খলার’ আশঙ্কা করেছিলেন, তা,  ‘এটা উত্তমকুমারের ছবি নয়, সত্যজিৎ রায়ের ছবি, এখানে ওসব কিছু হবে না’ বলে উড়িয়ে দিয়ে, ‘উপযুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা বিনাই শো-এর শেষে প্রেস মিট পর্যন্ত ডেকে দিয়েছিলেন’ বিদগ্ধ, ‘সস্তা জনপ্রিয়তার’ বাস্তবরূপ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, পরিচালক। সৌরভবাবু বর্ণনা করেছেন কিভাবে এর ফলে রীতিমত দক্ষযজ্ঞ ঘটে এবং উন্মাদ জনতার হাত থেকে জনৈক অপরিচিত ভদ্রলোক উত্তমকে উদ্ধার করার আগেই ‘স্টার’-এর কোটের হাতা ছিঁড়ে নেওয়া হয়।

তাই ছবিতে বঙ্গ সংস্কৃতি, বিশেষ ‘সৎ’ চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা, নিরলসভাবে, হলিউডের অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোর  ভাষায় ‘প্রতিশোধ’ নিয়েছেন মূলধারার বাংলা ছবি ও তার সবচেয়ে বড় প্রতিভূর ওপর। কারণ বাংলা ছবির  দর্শক – ইংরেজীতে the great unwashed masses – সত্যজিতের ‘উন্নতমানের’, ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ ছবির পৃষ্ঠপোষকতা না করে ভিড় জমায় ‘সূর্যতপা’, ‘কাল তুমি আলেয়াবা ‘রাজদ্রোহী’-র মতো ছবি যেখানে চলছে সেখানে!

এমনকি ‘নায়ক’ ছবির বহু-আলোচিত ‘খন্যান’ অংশে, অরিন্দম-উত্তম ‘প্লাটফর্মে নেমে চা-ওয়ালাকে ডেকে  চা খেলেন, কয়েকজন লোকও রয়েছে প্লাটফর্মে – কোথাও কোনও আলোড়ন হল না, নিরুপদ্রবে ভাঁড় শেষ করে মহানায়ক উঠে পড়লেন কামরায়! আবার মনে করাই … এ, কোনও সৌমিত্র-শুভেন্দু-প্রমুখ নন, এ ‘নায়ক’ কিন্তু আসলে ১৯৬৬-র জলজ্যান্ত উত্তমকুমার স্বয়ং, গ্রামবাংলার চাষিভূষিও যাকে এক-দেখায়  চিনতে ভুল করত না, ট্রেনের চা-হকারও না। সত্যজিৎ এখানেও … তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে যে চোরা statementটি রাখতে চাইলেন – দুঃখের সঙ্গে আমরা বলতে বাধ্য, তাতেও ‘বাস্তবতার একটু অভাব’!’

ছবিতে আরও অনেক সমস্যা নিয়ে সৌরভবাবু আলোচনা করেছেন। আমরা এখানে উত্তমকুমার, এবং তাঁর মাধ্যমে, মূলধারার বাংলা ছবির প্রতি সত্যজিতের প্রতিশোধ নেওয়ার প্রমাণ নিয়েই কথা বললাম। শেষ করব আমার প্রয়াতা মাতৃদেবীর মুখে শোনা একটি প্রবচন উদ্ধৃত করেঃ ‘হনুমানের ল্যাজে মোচড়’! নইলে রেল- কামরার স্টুডিওর মধ্যে তোলা দৃশ্যগুলিতে দুলুনির অভাব নিয়ে সাক্ষাৎ সত্যজিতের চিত্রায়নকে বাস্তবতার নিরিখে ‘শুন বরনারী’ (১৯৬০) ছবিতে অজয় করের চিত্রায়নের নীচে রাখা! সৌরভবাবুকে অন্তর থেকে  সাধুবাদ জানাই, বাংলা ছবি মানেই যে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক নন এই সত্যটি নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করার জন্য। অজয় কর, বিভূতি লাহা, তরুণ মজুমদার, এবং এঁদের থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র, তপন সিংহের প্রতি বাঙালী দর্শকের ঋণ অপরিশোধ্য।

এই লেখার উত্তরে জনৈক সত্যজিৎ-ভক্ত অতি-অসন্তুষ্ট হয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন, যার একটিতেও কিন্তু সৌরভবাবুর দেখানো বাস্তবতার অভাবের প্রমাণগুলি যে কোনভাবে ভুল, তা প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। ভক্ত মূলত তিনটি তথাকথিত ‘যুক্তি’ রেখেছিলেনঃ

(ক) ছবি যদি এতই ত্রুটিপূর্ণ হবে, তাহলে এত বছর পরেও লোকে ‘নায়ক’ দেখছে কেন?

উত্তরঃ এত বছর পরে লোকে শুধু ‘নায়ক’ নয়, উত্তমকুমারের মূল ধারার ছবিগুলি আরও বেশী সংখ্যায়  দেখছে, যেমন উপরে-উল্লিখিত ‘সূর্যতপা’, ‘রাজদ্রোহী’, বা অসম্ভব জনপ্রিয় ‘হারানো সুর’, যার গল্পেই অবাস্তবতা প্রকট।

(খ) ছবি যদি এতই ত্রুটিপূর্ণ, তবে তার ‘রিমেক’ হলো কেন?

উত্তরঃ সত্যজিতের মতোই তাঁর ভক্তও hoist [আবার বলি, hoisted নয়] with his own petard! হয়তো যে পরিচালক ‘অটোগ্রাফ’ বানিয়েছিলেন – সেই পরিচালক ব্যক্তি-হিসেবে যথেষ্ট আত্মম্ভরী – তিনি এইসব ত্রুটি, বা তাঁর নিজের চোখে অন্য কোন ত্রুটি, নায়ক ছবিতে দেখে সেসব ‘সংশোধন’ করে আরও ভাল একটি ছবি করতে চেয়েছিলেন! আর তা যদি নাও হয়ে থাকে, সেই একই পরিচালক উত্তমকুমারের আরও দুটি ছবি – ‘এ্যান্টনী ফিরিঙ্গী’ আর ‘সন্ন্যাসী রাজা’ - নিজের মতো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন! এতে কী প্রমাণ হয়? ছোট পর্দায় একটি চ্যানেল তো এক সময় ‘অতি-উত্তম’ শিরোপা দিয়ে মহানায়কের একের পর এক ছবি নতুন করে তৈরি করেঃ ‘হারানো সুর’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘পথে হ’ল দেরী’, ‘বিভাস’ ইত্যাদি। এগুলিও তাহলে নিখুঁত হবার দাবীতে ‘নায়ক’-এর পাশে রাখা যেতে পারে?

এবার, এই ‘যুক্তি’ যদি মেনে নেওয়া হয় যে ‘নায়ক’ এমনই নিখুঁত ছবি যে তাঁর পুনর্নির্মাণ অবধারিত – কারণ বাজারে শ্রেষ্ঠেরই নকল হয় – তাহলে সত্যজিতের বেশির ভাগ ছবিরই যে ‘রিমেক’ হয়নি, সেগুলি কি তত ভাল নয়? ‘অপুর তিনপর্ব’, ‘জলসাঘর’, কলকাতা ট্রিলজি তবে কি?

আর, চলচ্চিত্রের পুনর্নির্মাণ সারা বিশ্বের সিনেমায় অনেকবার হয়েছে ও হচ্ছে। তার মানে যে সব সময়েই ‘শ্রেষ্ঠের নকল’ তা একেবারেই নয়। ১৯৫৬ সালের The Ten Commandments এবং ১৯৫৯ সালের Ben Hur, দুটিই ছিল যথাক্রমে ঐ নামের ১৯২৩ ও, দ্বিতীয় ছবির ক্ষেত্রে ১৯০৭ আর ১৯২৫-এ হওয়া, ছবির ‘রিমেক’। এদের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে নানান মুনির নানান মত! আবার যে ছবিকে অনেকে সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ বলে থাকেন, সেই Citizen Kane কিন্তু পুনর্নির্মিত হয়নি!

(গ) সৌরভবাবু একটি অভিভাবন রেখেছেনঃ উত্তমকুমার ‘নায়ক’-এ অভিনয়কালীন সত্যজিতের উদ্দেশ্য  বুঝতে পারেন, এবং প্রত্যুত্তরে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দিয়ে উন্নাসিক (এবং ঈর্ষাকাতর) পরিচালককে মানসিকভাবে এতটাই নিরস্ত্র করেন যে মহানায়কের প্রয়াণের পর সত্যজিতের কলম থেকে বেরোয় ক্ষণজন্মা এই অভিনেতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা!

ক্ষিপ্ত সত্যজিৎ-ভক্ত এর উত্তরে শর্মিলা ঠাকুরের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে সত্যজিৎ নিজে অভিনয় করে যা দেখিয়েছিলেন, উত্তমকুমার নাকি তাঁর মাত্র ষাট শতাংশ নিজে করতে পেরেছিলেন!

উত্তরঃ তাহলে তো সত্যজিৎ নিজের ছবি এবং তার দর্শকদের প্রতি অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন! কেন তিনি এমন এক অভিনেতাকে বাছলেন যিনি সত্যজিতের প্রত্যাশার মাত্র ষাট শতাংশ পূর্ণ করতে পারবেন? পরিচালকের তো উচিৎ ছিল, হয় তাঁর প্রিয় অভিনেতাকে ব্যবহার করা, নতুবা নিজেই ক্যামেরার পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়ানো! চলচ্চিত্রে অভিনেতা-পরিচালকের তো অভাব নেই, কি হলিউডে (Orson Welles বা Clint Eastwood), কি বলিউডে (রাজ কাপুর বা দেব আনন্দ) কি টলিউডে (উত্তমকুমার বা অঞ্জন দত্ত)! সত্যজিৎ পরিচালক-অভিনেতা হয়ে দেখিয়ে দিতেই পারতেন!

আবার বলি, ভক্তের তিনটি তথাকথিত ‘যুক্তি’-র একটিও কিন্তু সৌরভবাবুর দেখানো ত্রুটিগুলির অস্তিত্ব  অস্বীকার করতে পারেনি!

আর শেষ কথা বলেছেন সৌরভবাবু স্বয়ংঃ

গোটা ব্যাপারটা ঠাকুর্দার ঝুলি-মার্কা আষাঢ়ে গপ্পোর পর্যায়ে নেমে আসছে দেখেও আমরা চুপ করে থাকি (অচলপত্রে দীপ্তেন সান্যাল যেমন বলেছিলেন একদা) – ‘কারণ পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়’! [The] King can do no wrong!’

 

(২) সত্যজিৎ-দেবব্রত বিশ্বাস




হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে সৌরভবাবুর পূর্বে-আলোচিত প্রবন্ধেই উদ্ধৃত হয়েছে ‘সঠিক’ রবীন্দ্রসঙ্গীত-গায়ন নিয়ে সত্যজিতের বিভিন্ন উক্তি। সেখানে হেমন্তর গায়ন সম্বন্ধে সত্যজিতের মতামত অনেকটা উত্তমকুমার এবং মূলধারার বাংলা ছবির প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্যের সমতুল্য। ‘পপুলার’ গাইয়েরা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূক্ষ্ম কাজগুলি … সরল সাদামাটা করে গান, কারণ তাদের গলায় সেই কাজের উপযোগী সক্ষমতা নেই’। ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় সত্যজিৎ অধিকাংশ গাইয়েদের ‘রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, মাঝারিদের দলভুক্ত’  বলে বর্ণনা করেন, এবং তার পরে সুভাষ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় নাম করেই বলেন ‘এই তো ধরো আমাদের হেমন্তই তো … তবু লোকে শুনতে চাইছে’। আবার, ঠিক উত্তমকুমারের ভক্তদের মতো সেই great  unwashed masses-এর প্রতি অলিম্পিয়ান অবজ্ঞা! আর এই একই কথোপকথনে দেবব্রতর ‘ম্যানারাইজড’ ‘আকাশ ভ-ও-রা’ যখন সুভাষ চৌধুরী ভুল উচ্চারণ বলেন, তাঁর প্রতিবাদ তো সত্যজিৎ করেনইনি, বরং সহাস্যে বলেছেন “যেন একটু বিলিতি মেজাজ…”।

এমন একজন গর্বিত ‘এলিটিস্ট’ তাহলে দেবব্রত বিশ্বাস সম্বন্ধে কী মনোভাব পোষণ করতে পারেন, যে শিল্পীর শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডের বিক্রি নাকি অন্য সব রবীন্দ্র-শিল্পীদের বিক্রি ছাড়িয়ে গিয়েছিল শিল্পীর জীবদ্দশায়? উত্তরে সৌরভবাবুর মন্তব্যঃ ‘বিনোদনদাতা হিসেবে, স্বভাবগতভাবে একজন চিরকাল massকে প্রাধান্য দিয়ে গেছেন, অন্যজন classকে।

তাই, প্রত্যাশিতভাবেই, সত্যজিতের প্রভূত রচনার মধ্যে সৌরভবাবু পাননি ‘এই কিংবদন্তিপ্রতিম গায়কের কোনও সরাসরি প্রশস্তি এমনকি নিরপেক্ষ’ মূল্যায়ন! যা পাওয়া যায় তা হলো শিল্পীর প্রয়াণের পর উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর তথ্যচিত্র ‘গান আমার পড়ে পাওয়া ধন’ থেকে সত্যজিতের ক্যামেরা-ধৃত বক্তব্য। সেখানে সত্যজিৎ  বলেছেন কিভাবে, যখন মাইকের ব্যবহার চলে আসায় অনেকেই ‘ক্রুনিং’ শুরু করেন, দেবব্রত কখনও তা করেননি। তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপির সঙ্গে মিলুক বা নাই মিলুক, সত্যজিতের মতে তিনি গানগুলি ‘খুব যথাযথভাবে, ভাবের সঙ্গে, পরিষ্কার বাচনভঙ্গিতে’ গেয়েছেন, যে গুণ নাকি সত্যজিৎ খুব বেশী লোকের মধ্যে  দেখেননি। অথচ সেই ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের ‘এক্ষণ’-এ, অর্থাৎ ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, সত্যজিৎ অধিকাংশ  রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েদের ‘মাঝারিদের দলভুক্ত’ বলছেন, সেখানে ব্যতিক্রম হিসেবে কারুরই নাম উল্লেখ  করছেন না! এই সময় দেবব্রত বিশ্বাস খ্যাতির মধ্যগগনে! এমনকি বিশ্বভারতীর সঙ্গে দেবব্রতর প্রবল সংঘাতের সময়ও সত্যজিৎ নীরব! আর ঋত্বিক ঘটক যেখানে তাঁর ছবিতে একের পর এক সিচুয়েশন সৃষ্টি করে দেবব্রতর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত রাখছেন, বিপরীতে সেরকম কোন প্রচেষ্টাই সত্যজিৎ করেননি। তাঁর ছবিতে পুরুষকন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা গেছে শুধু কিশোরকুমারের গলায়, আর ‘চারুলতা’-তে দু-এক কলি স্বকণ্ঠে গেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া আছে ‘আগন্তুক’ ছবিতে ‘বৃদ্ধ উৎপল দত্তের গলায় ততোধিক বৃদ্ধ  সত্যজিতের নিজের অশক্ত কণ্ঠের একটিমাত্র কলি (…‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ’, বেশ বেখাপ্পা শোনায়, তবু)’। এমনকি সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তথ্যচিত্রেও ‘আর্কাইভ থেকে নেওয়া কবিকণ্ঠের গান ছাড়া আলাদা করে একক পুরুষকন্ঠের গান নেই, কিন্তু একক নারীকণ্ঠে আছে’।




তথ্যের ভিত্তিতে সৌরভবাবুর সিদ্ধান্ত হলো যে, একা দেবব্রত বিশ্বাস নন, ‘অন্য কোনও পুরুষ গায়কের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কেই [সত্যজিৎ] স্বতঃস্ফূর্ত-আন্তরিক প্রশংসা করে উঠতে পারেননি, ছবিতেও ব্যবহার করেননি’। ব্যতিক্রম ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বরাবরের শুভানুধ্যায়ী’ কিশোরকুমার!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন