বোধিসত্ত্ব ও ক্ষান্তি
বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডারে গল্প,
উপন্যাস ও নাটক প্রভৃতি রচনার চিরন্তন উৎস হিসেবে জাতকের ভূমিকা অপরিসীম। পালি সাহিত্যে
বুদ্ধের পূর্বজন্ম বা জন্ম জন্মান্তরের জীবন কাহিনী ঘটনা প্রবাহই জাতক নামে পরিচিত।
জাতকে বুদ্ধের সমকালীন আর্থসামাজিক অবস্থার বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এর
রচনাকাল সম্পর্কে তেমন কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে বিষয়বস্তু পর্যালোচনা
করে অনুমান হয়, জাতকের রচনাকাল খ্রীষ্ট জন্মের ৩৭০ বছর পূর্বে। তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি শেষে সম্রাট অশোক ভারত
উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এবং তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের বৌদ্ধধর্ম প্রচারের
উদ্দেশ্যে ধর্মদূত প্রেরণ করেন। এর মাধ্যমে ত্রিপিটক ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী
সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী বহু দেশে পৌঁছে দেশ দেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করে। জাতক যেহেতু
ত্রিপিটকের অংশ, সেহেতু ত্রিপিটকের সাথে জাতক ও দেশ দেশান্তরে পরিব্যাপ্ত হয়। বৌদ্ধধর্মের
সাথে জাতকও প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে প্রতীচ্যে পৌঁছেছে। এর ফলে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের
কাছে বৌদ্ধচসাহিত্য ও ধর্ম সম্বন্ধীয় গ্রন্থ বিশেষ আকর্ষণীয়। সুতরাং জাতক শব্দের অর্থ হলো, যিনি উৎপন্ন বা জন্মলাভ
করেছেন। বুদ্ধের পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত বোঝাতেই জাতক শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে শিষ্যদের তাঁর অতীত জন্মের কাহিনী বর্ণনা করতেন।
বুদ্ধের পূর্ব জন্মের ওইসব কাহিনীগুলোকে 'জাতক' বলা হয়। অর্থাৎ বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন
জন্ম সম্বন্ধীয় ইতিবৃত্ত ও বোধিসত্ত্ব জীবনের পূর্ব কাহিনীকে জাতক বলা হয়।
বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে সিদ্ধার্থ গৌতমকে বহু কল্পকাল নানাকুলে জন্মগ্রহণ করে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সাধনা করতে হয়েছিল। তখন তিনি বোধিসত্ত্ব নামে খ্যাত ছিলেন। জাতকের কাহিনীগুলোতে বোধিসত্ত্বের জীবনের নানা ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। কাহিনীগুলো সব গুণাবলী সম্পন্ন এবং আদর্শ জীবন গঠনের সহায়তা করে। এগুলো নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা সমৃদ্ধ। জাতকের সংখ্যা ৫৫০। বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে পারমী পূরণার্থে ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করেন, সেই অনুসারে ৫৫০টি জাতক থাকার কথা। কিন্তু তিনটি জাতক কাহিনী কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। জাতকের সাথে নৈতিকতা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৈতিক শিক্ষার অপরিহার্য বিষয় হলো জানো জাতকে যে নৈতিক বিষয়সমূহ পাওয়া যায়, তাকে অবলম্বন করে আদর্শ জীবন ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত জাতকগ্রন্থে মোট ৫৪৭টি জাতক কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো ২২টি অধ্যায়ে বিভক্ত কথিত আছে। নৈতিক ও আদর্শ জীবন গঠনে জাতকের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি বহুমাত্রিক শিক্ষা ও নৈতিক জ্ঞানে ভরপুর। ধর্মীয় শাস্ত্রের অধীনে হলেও গুণগত বৈশিষ্ট্য তার প্রয়োজনীয়তা এবং এর বহুমাত্রিক প্রামাণিক কারণে জাতকের গুরুত্ব রয়েছে। হাজার হাজার বছরের শিক্ষাও সভ্যতার আকর গ্রন্থ জাতক। নীতি ও প্রদেশের মৌলিক আধার হিসেবে জাতকের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। জাতকের কাহিনীগুলোতে নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা পাওয়া যায়। জাতকের অন্যতম বিশেষত্ব হলো, গল্পের ছলে চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষ সাধন করা। বুদ্ধ কুশল কর্মের সুফল ও কুশল কর্মের কুফল বোঝাবার জন্য জাতকের কাহিনীগুলো বলতেন, তাই জাতকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জাতকের কাহিনী ধর্মের গভীর বিষয় সমূহকে সহজভাবে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে। কাহিনী গুলো হিতোপদেশমূলক। ভালো কাজে উৎসাহ দেয়, উদার চিত্তে দান দিতে শিক্ষা দেয়। প্রাণী হত্যা মিথ্যা বলা চুরি করা ব্যভিচার মাদকদ্রব্য গ্রহণ প্রকৃতি থেকে বিরত থাকা শিক্ষা দেয়। প্রায় বাক্য এবং মন সংযত করে।সম্যক জীবিকা অবলম্বনে উৎসাহ যোগায়। সমাজ থেকে জাতিভেদ প্রথা দূর করতে সহায়তা করে। ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। পরমত সহিষ্ণু এবং পর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয় ।তাছাড়া জাতকের কাহিনী মানুষকে শিক্ষা দেয়ত্যাগ তিতিক্ষা শান্তি সম্প্রীতি মৈত্রী করুণা প্রেম এবংহিংসা। এতে বর্ণিত উপদেশ সদ্ভাব ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে। এক কথায় বলা যায়, নৈতিক ও আদর্শ জীবন গঠনে জাতকের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের প্রত্যেকের জাতকের শিক্ষা অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য।
জাতকে অনেক ছোট ছোট গল্প বা বুদ্ধের জন্মের পূর্বেকার গল্প পাওয়া যায়। পুরাকালে বারাণসীতে কলাবুনামে এক রাজা ছিলেন। সেসময় বোধিসত্ত্ব প্রচুর সম্পদশালী এক ব্রাহ্মণের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল কুণ্ডল কুমার। তিনি তক্ষশীলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর বিপুল ধনসম্পত্তি দেখে ভাবলেন। আমার পূর্বপুরুষরা এ বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করেছে। তারা এর সামান্যই ভোগ করেছে। আমিও সামান্য ভোগ করব সময় হলে আমাকেও তাদের মত মৃত্যুবরণ করতে হবে। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দান পাওয়ার উপযোগী ব্যক্তিদের পরিমাণ মতো দান করবেন। এক সময় সব সম্পদ নিঃশেষ করে তিনি গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন। সেখানে গ্রহণ করলেন প্রব্রজ্যা। বনের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করতে লাগলেন।
কিছুদিন হিমবন্তে বসবাসের পর বোধিষত্ব লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য হিমবন্ত থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে নেমে এলেন। বিভিন্ন জনপদে ঘুরে বেরিয়ে একদিন রাজ উদ্যানে উপস্থিত হলেন সেখানে রাত্রি যাপন করে পরদিন ভিক্ষার জন্য নগরে প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথম রাজার সেনাপতির গৃহদ্বারে উপস্থিত হলেন।তাঁর আচার আচরণে খুশি হয়ে সেনাপতি তাঁর গৃহে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন।একদিন রাজা কলাবু আনন্দ উৎসব করার জন্য উদ্যানে এসে হাজির হলেন। বিপুল আয়োজনে শুরু হল আনন্দ উৎসব।কিন্তু সুরা পানের মত্ত রাজা অল্পক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনকারীরা ভাবল যার জন্য সংগীত ও নৃত্যের এত আয়োজন, তিনি যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন কি প্রয়োজন নিত্য গীতে।তারা সবকিছু ফেলে রাজ উদ্যানে তাদের খেলায় মত্ত হলো।বোধিসত্ত্ব তখন এক ফুল ফোটা শাল গাছের মূলে বসে প্রব্রজ্যা উপভোগ করছেন।গীত ও সংগীত পরিবেশনকারীরা ঘুরতে ঘুরতে তাঁকে দেখে সবাই সেখানে হাজির হলো। তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলো চলো ওই সন্ন্যাসীর নিকট ধর্মকথা শুনি। তারা সকলে বোধিসত্ত্ব কে প্রণাম করে ঘিরে বসলো।বোধিসত্ত্ব তাদের ধর্ম কথা শোনাতে লাগল।এদিকে জেগে উঠে রাজা দেখেন তার আশপাশে কেউ নেই তারা কোথায় গেছে প্রশ্নের উত্তরে রাজা যখন জানতে পারেনএক তপস্বীকে ঘিরে সবাই বসে আছে। তখন তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। ভণ্ড তপস্বী কে শাস্তি দেবেন বলে খড়্গ হাতে ছুটে। তখন কয়েকজন তার হাত থেকে খড়্গ কড়ে নিয়ে রাগ থামায়।রাজা বোধিসত্ত্বের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেন, শ্রমন! তুমি কোন মতাবলম্বী?
বোধিসত্ত্ব উত্তর দিলেন মহারাজ
আমি ক্ষান্তিবাদী। রাজা বললেন- ক্ষান্তি কাকে বলে? বিভিন্ন প্রতিরূপ পরিস্থিতিতে মনের যে অক্রোধ ভাব,তাকে বলে ক্ষান্তি।রাজা বললেন
ঠিক আছে, এখনই দেখা যাবে তোমার ক্ষান্তি আছে কিনা। এ কথা বলে রাজা ঘাতককে ডেকে পাঠালেন।
ঘাতক
কুঠার ও চাবুক নিয়ে হাজির হলো
যে কি করবে? রাজা বললেন একে মাটিতে ফেলে ২০০০ চাবুক মারো। ঘাতক
তাই করল। বোধিসত্ত্বের চামড়া ছিঁড়ে গেল মাংস
ছিঁড়ে গেল সর্বাঙ্গে রক্ত স্রোত বইতে লাগলো।
তখন রাজা তাকে প্রশ্ন করলেন। তাপস এবার বলো তুমি কোন বাদী? বোধিসত্ত্ব বললেন মহারাজ
আমি খান্তিবাদী। আপনি ভেবেছেন আমার চামড়ার নিচে বুঝি খাচ্ছি আছে। ক্ষান্তি আমার সেখানে
নেই। এটা আমার হৃদয়ের গভীরে প্রতিষ্ঠিত। আপনার সাধ্য নেই তা দেখার। ঘাতক বলল এখন কি
করবো মহারাজ। রাজা বললেন ভন্ড তপস্বীর হাত দুটো কেটে ফেলো। ঘাতক তাই করল। এর পর রাজার
আদেশে দুটি পা, নাক, কান ছেদন করা হল। ঘাতক তাই করল। রক্তস্রোতে ধরণী প্লাবিত হল। আবার
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন তুমি, কোন বাদী?? বোধিসত্ত্ব বললেন মহারাজ আমি ক্ষান্তি বাদী।
ক্ষান্তি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে থাকে না।
ক্ষান্তি আমার অন্তরের অন্তস্থলে। ভন্ড জটা ধারণ তুমি শুয়ে
ক্ষান্তির স্পর্ধা করতে থাক। রাজা বোধিসত্ত্বের
বক্ষস্থলে পদাঘাত করে প্রস্থান করলেন।তখন সেনাপতি এসে বোধিসত্বকে প্রণাম করে প্রার্থনা
করলেন প্রভু আপনার প্রতি যিনি অত্যাচার করেছেন যদি ক্রুদ্ধ হন তার ওপর হবেন অন্যের
উপর ক্রুদ্ধ হবেন না। রাজ্যের যেন বিনাশ না
সাধন না হয় তা শুনে বোধিসত্ত্ব বললেন-
হস্ত,পদ, নাশা, কর্ণ, ছেদিয়া যেজন,
করিলেন মোরে এই দারুন পীড়ন, চিরজীবী হয়ে সেই থাকুক নৃপতি মাদৃশ জনের ক্রোধ অসম্ভব
অতি।
রাজার পাপাভার সহ্য করতে না পেরে
উদ্যান দ্বারে ধরিত্রী বিদীর্ণ হয়ে রাজাকে
গ্রাস করল এবং অচিরেই মহানরকে নিক্ষিপ্ত হল। সেদিনই বোধিসত্ত্ব প্রাণত্যাগ করলেন উদ্যানের
মধ্যে।
এই তাপস জন্মে বোধিসত্ত্বের ক্ষান্তি, মৈত্রী, করুণা ,মুদিতা, উপেক্ষা, বীর্য,
অধিষ্ঠান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, অলোভ, অদ্বেষ, অমোহ, অক্রোধ,ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বহুবিধ গুণধর্মের পূর্ণতা লাভ হল। সংসারে
সকল প্রকার পাপকে ধ্বংস করে শান্তিবাদী তাপসের জন্ম সার্থক হল।জগতে এমন পরাশক্তির উৎস
উৎকৃষ্ট ধর্ম ক্ষান্তি, মৈত্রী রূপ মহাসম্পদ থাকতে আত্মধ্বংসী নিকৃষ্ট ধর্ম ক্রোধ, হিংসাকে কেন বরণ করে?
এটি বড় আশ্চর্য বিষয় (জাতক ঈশান
ঘোষ ৩১৩)
তথাগত যুদ্ধ সম্পর্কে কাকেও কোনরূপ উপদেশ দেয়নি। পালি সাহিত্যে সর্বত্র বিবাদ, কলহ ও যুদ্ধবিগ্রহের কুফল বর্ণনা দেখা যায় ।এমনকি আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের প্রেরণাও দেননি। তিনি বিনা যুদ্ধে সমগ্র বিশ্বে তার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোশল রাজ প্রসেনজিৎ এর মধ্যে কাশি গ্রাম নিয়ে যে বিবাদ, সেই ঘটনা উপলক্ষে ভিক্ষুদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন-
জয়ং বেরং পসবতি দুখং সেতি পরাজিতো,
উপসন্তো সুখং সেতি হিত্বা জয়, পরাজয়ং। (ধর্ম-সুখবর্গ- ২০১গাথা)।
অর্থাৎ,জয় শত্রুতার সৃষ্টি করে,
অপরকে পরাজিত করলে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়।পরাজিত ব্যক্তি খুবই দুঃখে ম্রিয়মান হয়।জয়
পরাজয় পরিত্যাগী উভয় অবস্থার মধ্যপন্থী পরমসুখী। রাজা প্রসেনজিৎ যুদ্ধ মনোভাব ত্যাগ
করে মিত্রতা স্বরূপ তার কন্যাকে অজাত শত্রুর সাথে বিবাহ দিয়ে কাশীগ্রাম যৌতুক হিসেবে
প্রদান করে মৈত্রী স্থাপন করে অতঃপর শান্তিতে সহাবস্থান করে রাজ্য শাসন করছিলেন।
এই মৈত্রীবাণীর আদর্শে আদর্শিত
বুদ্ধের পরি নির্মাণ হলে তার অস্থি ধাতু সংগ্রহ করার জন্য রাজাগণ যুদ্ধ-বিগ্রহে অবতীর্ণ
হয়েছিলেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণের মৈত্রী ভাষণে সবাই যুদ্ধ হতে বিরত থেকে বুদ্ধের অস্থি
ধাতু সংগ্রহ করেছিলেন।
মুক্তিপথ প্রদর্শনকারী বুদ্ধ মহাপরি
নির্বাণ লাভ করলে যথাসময়ে বিভিন্ন উপাচারের মাধ্যমে দাহকার্য সম্পাদন করা হল।
দাহকার্য সমাপ্ত হওয়ার পর অন্তরীক্ষ
থেকে জলধারা পতিত হয়ে চিতাগ্নি নির্বাপিত হল। পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ জলভাণ্ডার থেকে
জল উঠে চিতা নির্বাপিত হল। কুশীনরার মল্লগণ
নানাবিধ সুগন্ধি জল দ্বারা চিতা নির্বাপিত করল। মল্লগণ ভগবানের অস্থিগুলো সপ্তাহ কাল
মন্ত্রানাগারে রেখে চারদিকে ধনু, বানহস্তে প্রহরী নিয়োগ করে নানা প্রকার নৃত্য, গীত, বাদ্য,
মাল্য ও গন্ধ সামগ্রী দ্বারা পূজা করল।
মগধরাজ বৈশালীর লিচ্ছবিগণ, কপিলাবস্তুর
শাক্যগণ,অল্লকপ্প দেশের বুলিয়গণ, রাম গ্রামের কোলিয়গণ,বেঠদ্বীপের ব্রাহ্মগণ এবং পাবার
মল্লগণ ও দূত পাঠিয়ে ভগবানের দেহাবশেষ প্রার্থনা করলেন। তখন কুশীনারার মল্লগণ বলল-
ভগবান তাদের দেশের পরিনির্বাণ লাভ করেছেন তারা তাঁর দেহাবশেষ কাকেও দেবেন না।
এভাবে বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থা হয়েছিল ।তখন দ্রোণ নামক ব্রাহ্মণ সবাইকে বললেন আপনারা আমার কথা শ্রবণ করুন। আমাদের বুদ্ধ ছিলেন ক্ষমাশীল, অহিংসা পরায়ণ, মৈত্রী পরায়ণ। তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে বিবাদ করা ন্যায় সঙ্গত হবে না। আপনারা সকলে একমত হয়ে অস্থিসমূহ ৮ ভাগে বিভক্ত করে স্ব স্ব রাজ্যে নিয়ে গিয়ে স্তুপ প্রতিষ্ঠা করে পূজা করুন। এতে সবাই সম্মতি প্রদান করে। অতঃপর ব্রাহ্মণ মধ্যে অস্থিসমূহ ৮ ভাগে বিভক্ত করে স্ব স্ব রাজ্যে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলেন। আমাদের উচিত একে অপরকে আক্রমণ না করে মৈত্রী পূর্ণ হৃদয়ে সহাবস্থান করা। আক্রমণকারীর যে মনোবৃত্তি আক্রান্তকারীর সেই মনোবৃত্তি। আক্রমণ ব্যক্তির যেমন ক্ষতিসাধন হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিরও ক্ষতিসাধন হয়। যেমন একটি রাজ্যের রাজা যদি অন্য রাজ্যকে আক্রমণ করল। আক্রমণ করতে গিয়ে বহু অর্থ জনবল অর্থবল অস্ত্র বল বিসর্জন দিতে হয়েছে। আক্রান্ত রাজ্যটির ও অনুরূপ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় আমেরিকা ও ইরাক যুদ্ধ। আমেরিকায় ইরাক আক্রমণ করতে গিয়ে ইরাক রাষ্ট্রের বহু ক্ষতিসাধন করে জয়যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু জয়যুক্ত হওয়ার পরেও মূল যুদ্ধে আমেরিকার যত সৈন্য সামন্ত ক্ষতিষাধন হয়েছে তার চেয়ে বেশি নিহত হয়েছে আমেরিকার সৈনিক ।তাহলে দেখা যায় আক্রমণকারী ও আক্রান্ত ব্যক্তি উভয়েরই ক্ষতিসাধিত হয়। তাই আক্রমণ প্রতি আক্রমণ না করে বন্ধুত্ব স্থাপন করাই শ্রেষ্ঠ। তাতে শান্তি বজায় থাকে, সৌহার্দ্য সম্প্রীতি রক্ষা হয়। জনজীবনের উন্নতি সাধিত হয়। মানব কল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন