বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব ৭)
আসেমব্লি হল গম গম করছে সুরের ধারায় একের পর এক ঋতুর পরে ঋতু, তিমির দুয়ার খোলো... নিশার স্বপন ছুটল রে... রক্তে মিশে যাচ্ছে সুর। আর তারপর সমস্ত মন আর মনন শরীর বৃত্তের ভেতর মিশে শ্রাবণের ধারার মতো আবেগ আর চিন্তন সবটাই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গান এক ম্যাজিক। সমস্ত গ্লানি বিষাদ অপ্রেম তিক্ততা ধুয়ে মুছে যায়। কাকে বলে নাস্তিক কেই বা আস্তিক বলা সহজ নয়। নিজের জীবন দর্পণে যা সত্য পড়ে আছে তাই আমার বিশ্বাস। এই সহজ পাঠে উপলব্ধি করি আমি একক এবং আমিই বহু। আমিই ব্রহ্ম। আত্মচেতনার চেয়ে বড়ো কিছুই নেই। এই জীবন শুধু জিতে যাচ্ছি ভালোবাসা সম্বল করে। ভালোবাসার চেয়ে বড়ো আধ্যাত্মিক কিছু নেই। আমাদের হিন্দু রীতি নীতিকে আমরা ডি কোড করিনি রাজনৈতিক স্বার্থে। গোড়া থেকেই। নাহলে দেখা যেত সমাজ বিজ্ঞান, শরীর বিজ্ঞান, মনস্তত্ব ও জীববিজ্ঞানের নানা পাঠ দেওয়া হয়েছে এই ধর্মে মিথ ও রূপকের অন্তরালে।প্রেম শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই। তাই বহে নিরন্তর অনন্ত অমৃতধারা... প্রেম সঠিক হলে এবং সঠিক পাত্রে হলে তা পূজা হয়ে ওঠে। এই যে প্রেমের পথ নির্দেশ করে ধর্ম তা খেয়াল করি না। মন্দিরে প্রবেশের আগে জুতো খোলা, স্নান পরিচ্ছন্নতা, বেশিরভাগ মন্দিরে দেবতার বাস গর্ভগৃহে। প্রেম তখন পূজা হবে যখন আমার এই বাহ্যিক আড়ম্বর ফেলে, ইগো খুলে রেখে, অহং খুলে রেখে নিরাবরণ আমিই শুধু প্রেমের কাছে আসব অবনত হয়ে। বিনা সমর্পনে কোনো প্রেম নেই। এসবই যে জানে সে জানে। হিন্দুধর্ম প্রেমকে অবশ্যই শ্রেষ্ঠ মনে করে সামাজিক বন্ধনের চেয়ে। রবীন্দ্রনাথ একটি প্রতিষ্ঠান এবং আলাদাভাবেই একটি ধর্ম হতে পারে বলে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।
যে বিবাহ প্রতারণা করে মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে আইনের ভাষায় তা null and void অর্থাৎ গোড়াতেই বাতিল। তবু তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে এমন কত মেয়ে বয়ে নিয়ে চলে। বিবাহ যা প্রথম থেকেই বিচ্ছিন্ন তাকে আদালতে নিয়ে বিচ্ছিন্ন করার দায় নেই। আমারও নেই। একটা জীবন তার ভুল ত্রুটি বিচ্যুতি এবং সংশোধন এবং অতল খাদের ধার থেকে ফিরে এসে সংগ্রামের জীবন। একার কৃতিত্ব এই অহমিকা না আসে কখনও শুধু আত্মীয় পরিজন নয়, আত্মার আত্মীয় আছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ অপার বিষাদেও। কোথায় কখন কাঙ্ক্ষিত গুপ্তধন লুকিয়ে আছে তা ধৈর্য ধরলে তবেই তো পাওয়া যায়। এটুকু বলতেই পারি আজ।
সুদেষ্ণাদির সঙ্গে বালিগঞ্জ শিক্ষা সদনের পাশে একটি ফ্ল্যাটে। ছোটোখাটো মানুষটি। শাড়িতে হলুদের দাগ মুছে পাশে। আমি মোহিত হয়ে চেয়ে থাকি। তারপরেও। সুচিত্রা দির মতো করে এই গানটা আর কোনও কন্ঠে আমার জীবন বীণা হয়ে ওঠেনি তো আজও এই কথা, "যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে সবাই করে ভয়_
তবে পরান খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর
মনের কথা একলা বলো রে”।
যদি সবাই ফিরে যায়,ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায় --
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাখা চরণে একলা দলো রে।"
আমার জীবনের এবং আরো অনেকের জীবন
এভাবে গেঁথে আছে রবীন্দ্রনাথে। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন এক অন্য কোনো বোধ এক বিস্ময়ের
কথা একা রাত্রে তা অনুভব সত্যিই করা যায় বাতাসে, ঘুমন্ত পাখির ডানায়, পাতায় পাতায়
চাঁদ এসে গেলে এবং না গেলেও।
এই জীবন যাপন করা সহজ ছিলো না এক
আশ্চর্য পুরুষ ছাড়াও। আনন্দ কান্তি এক পুরুষ__পীযুষকান্তি সরকার। দুঃখকে আনন্দে বদলে
দিতে বিরহকে মিলনে বদলে দিতে এসে যিনি চলেও গেছেন। তবু প্রতিদিন তিনি আছেন আমার হৃদয়নন্দনবনে।
রবীন্দ্রসদনের আকাশ তাকে ভুলে গেছে।প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে দেওয়া তাঁর নামটি ভুলে
গেছে।বেঁচে থাকার কথা।
🌳🌳🌳🌳
ছোটোবেলার খেলা হতো রুমালচোর, কিৎ
কিৎ খেলা ঘর কেটে কেটে, ক্লাসে একটু শুধু চোখ এড়িয়ে কাটাকুটি খেলা, ও হাতে হাত বাজিয়ে
একটা ছড়া ছিল যা stone paper scissors gum... মা আসতেন স্কুলে ভাই জন্মানোর আগে অবধি।
খুব ছোটোবেলায় সব খুব বড় আর ধরা
ছোঁয়ার বাইরে, অসাধারণ লাগে, বড়ো হয়ে গেলে কেমন করে যেন সেগুলো ছোটো আর সাদামাটা হয়ে
যায়।
বাঘাযতীন পেরোলেই হাওয়াবদল। সাঁই
সাঁই করে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটত ট্রেন। একেবারে ফাঁকা প্রান্তর, দূরে দূরে
ঝিল, আচমকা কোনো একলা বাড়ি। ভাবতাম সে বাড়িতে কে থাকে। মেঘগুলো নানা জন্তু জানোয়ারের
মতো, কোনোটা যেন মানুষ, পরিপাটি মেয়ে বা কৃষ্ণ যেন। দিগন্ত ছুঁয়ে সবুজ নীলে মাখামাখি
সে রাজ্য কল্পনা করতাম বাঘ সিংহ পরিপূর্ণ আফ্রিকা, অথবা অচিন কোনো দেশ।
আজ তার তিলমাত্র আর চিহ্ন নেই। বিলীন হয়ে গেছে নগর সভ্যতার রাক্ষুসে
পেটে।
খোলা সবুজ সেই স্কুলের মাঠটাও ছোটো
অনেক। টিফিনের সময় চিলগুলো নির্ভয়ে উড়ে এসে বসত আমাদের আশেপাশেই, কী বিশাল মনে হতো।
যেন টেরোড্যাক্টাইল।
সেই চিল রোদ পড়ে সত্যি সোনালী ডানার
চিল ছিল, আমাদের সঙ্গে সমঝোতায়।
তারাও বড়ো সাদামাটা চিল বই তো নয়
এখন!
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন