সমকালীন ছোটগল্প |
অধীন নয় যে
শব্দের ভেতর ঘুমন্ত একটা আকাশ। আকাশ মানেই মেঘ আর মেঘ থাকলেই বৃষ্টির সম্ভাবনাকে ছেঁটে ফেলা যায় না। পাহাড়ের ভ্রুপল্লবে বসে শ্রাবণীর এই কথাগুলোই মনে পড়ছিল। ফাঁকে ফাঁকে হাওয়া এসে এলোমেলো করছিল মগ্নতা। কিছুতেই একাগ্র হতে দিচ্ছিল না। এমন সময় তাকে দেখবার জন্যই মায়ের কোল থেকে কিশোর সূর্যের আকুলতা ভেসে আসে পাহাড়ময়। প্রলয়ের সঙ্গে কয়েক বছর আগে সে ঠিক এখানেই বসেছিল। এভাবেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল তার...
ব্ল্যাকবোর্ডে দুইটি বিন্দুকে পরস্পর চক দিয়ে জোড়া লাগাতেই মাস্টারমশাই প্রবেশ করলেন। শ্রাবণী বেঞ্চে গিয়ে বসলে ক্লাস শুরু হলো। নিউটনের ১ম সূত্র তারপর ২য় ও ৩য়।
সে হারিয়ে যায়। কোথায়? কেন?
স্বচ্ছ আয়নায় ধূলো জমে, ঘোলাটে দেখায় প্রতিবিম্ব।
সব অবভাস। মুহূর্তের আমিকে নিজেই নিজে হারিয়ে ফেলে। এক অজানা কল্পনায়।
আসলে প্রলয় বড়োই সাদামাটা স্পষ্টভাস। বাঁকা কথা সোজা করে সে বলতে যেমন পারঙ্গম ঠিক তেমনই সোজা কথা সহজ জল করে নদীকে ঠেলে দিতে কোন কৃপণতা ছিল না তার। সে বাতাসের সঙ্গে, অন্ধকারের সঙ্গে... এই শব্দগুলোর পরিচয় করাতে ব্যস্থ হয়ে পড়ে যখন--
ফুটপাথের নিচে কিছু উচ্ছিষ্টকে ঘিরে কয়েকটি কুকুরের সালিশি সভা চলছে। এইসব স্বতঃস্ফূর্ত মনে হওয়াকে কেন্দ্র করেই যিনি চেয়ারটিতে রূমাল রেখেছিলেন। এখন নালা-নর্দমা কেটে কোনো রকমে সেটাকে টিকিয়ে রাখার মরিয়া অন্ধকারে একমুঠো আলো জ্বালানোর কোনো বংশদূত এ মুহূর্তে নেই বলেই আশপাশের ঝোপঝাড় সেকথা নির্বিকার মেনেছে। শহরের পাশ দিয়ে নদী নিজের মনের আনন্দে আর কতকাল এসব সহ্য করবে, কে বলবে সে কথা? জবাব নেই। এতোক্ষণ সে প্রথম সূত্রটি মিলিয়ে নিতে নিতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
দুই: 'কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যে দিকে ক্রিয়া করে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন সেদিকেই ঘটে।' -এই বিশ্বাসে ভর করে পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক আনন্দ-হর্স প্রেম-কাম লীলা-খেলা তন্ত্র-মন্ত্র ভালো-মন্দ দ্বিধা-দন্দ্ব রাগ-রোষ সবশেষে ভালোবাসা ডাল-পালা ছড়ায় সূর্যও আলো দেয়। কাকে দেয়, কেন দেয়?
কাকে আবার! অন্ধকারকে। হ্যাঁ হ্যাঁ অন্ধকারকেই।
যদিও জবাব এখানে গৌন তবুও সহজ ভাষায় সরকারি নলকূপ অনর্গল বয়ে চলেছে ~
চারিদিকে কুকুরের পৌষ। মা ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা খুলে একটা দানা টিপে অনুভূতি নেন। কিসের অনুভূতি? সময়, সময় হয়েছে কিনা। তালে তাল মিলিয়ে অসংখ্য পা'য়েরা একই মন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছিল তখন, প্রলয় জুতো জোড়ায় পা রেখে বেড়িয়ে যায়। মানে স্বাস্থ্য দপ্তর লাল ইঁটে সাজানো অফিস। এখন স্রোতের উল্টো। তবুও ইতিহাস ভুলে গেলে চলে না, মনে রাখতে হয়, তাই পিছনে তাকানো, ফিরে দেখার অধ্যয়ন। অর্থাৎ নিজের ঐতিহ্যের পুননির্মাণ করা।
'প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া
আছে'- এটি গতির ৩য় সূত্র।
টেবিলে এককাপ র'চা রেখে ছেলেটি চলে গেল, সঙ্গে সুগার কিউব এবং প্লেটের ওপর চা-চামচ। শ্রাবণী কাপটি অন্যমনষ্ক ভাবে তুলে নেয়। অনেকটা বেলা হয়ে এসেছে রোদটা আর সহ্য হচ্ছে না। সে কোনোকিছুই ভুলতে পারে না। ভুলবেই বা কেন, ভোলার প্রয়োজনই বা কী?
কাঁধে ঝোলা নিয়ে ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, বেড়িয়েই দেখা এক সম্পাদকের সাথে, তিনি একটি কবিতা চায়লেন। ভদ্রলোক বললেন একটু দাঁড়াও। তারপর ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা কলম এবং অপেক্ষাকৃত বড়ো চেনটা খুলে একটা খাতা বের করে ফুটপাতের ধারে উচুজায়গায় ফুঁদিয়ে ঝেড়ে মানে ধূলো ঝেড়ে বসে পড়লেন। নিমেষেই দুটি কবিতা লিখে সম্পাদকের হাতে দিলেন। কিছুটা অবাক হয়েই সম্পাদক কাগজের টুকরোটিকে সযত্নে ফাইলে বন্দী করলেন। আসি আবার দেখা হবে, ভালো থাকবেন কিন্তু। ভদ্রলোক আর একটিও কথা না বলে গলির ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ তার চোখ মুখস্থ করে নিচ্ছিল সেই সব দৃশ্যদের।
শ্রাবণী ফাঁকা কাপটি রেখে... ঘরে গিয়ে... বিছানায় একটু গা এলিয়ে দেয়। গতরাতে অনেকটা ধকল সয়ে কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছেছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো কিছুতেই জানলা-দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় না। জীবনের যানজটে নাভিশ্বাস হয়ে ওঠার মতো স্মৃতিরাও...
প্রবাল প্রলয়ের পরম বন্ধু একথা বন্ধু মহলের কমবেশি সকলেরই জানা। প্রবাল মানুষের হয়ে কাজ করে আন্দোলন করে রাস্তায় নামে বক্তৃতা করে। আর প্রলয়! নিজের জন্য লেখে, নিজের জন্য বাঁচে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কিন্তু প্রলয়ের নিজের লেখাগুলো একদিন সবার লেখা মানে মানুষের লেখা হয়ে ওঠে। অন্ধকারে পথ দেখায়। সে পথ কি প্রবালের? সে পথে কি প্রবালের পায়ের গান প্রথম বেজেছিল?
বালিশ ভিজে যায় কপাল থেকে টসটস ঘাম ঝরে, উঠে বসে। কোথায়? প্রবাল কোথায়?
কোথায় প্রলয়? সে কি ঘুমিয়ে পড়েছিল?
এটা কোথায়? কী করে সে এখানে এলো?
এসব কিছুই ঠাওর করতে পারছে না কেন...
ডাক্তার বলেছে কিছুদিন আউটিংএ কাটাতে। সঙ্গে একজন পরিচায়িকা থাকেন ২৪ঘন্টা×৩৬৫দিনের জন্য।
প্রলয় ঘরে ঢুকেই...
-'এককাপ লিকার চা হবে?'
-দাঁড়াও, একটু বোসো, আনছি
-'চিনি দিও না কিন্তু'
-আচ্ছা বাবা দেব না
টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে কিছুটা জল, তারপর বোতলটা নামিয়ে রেখে আলনায় শার্টটি ঝুলিয়ে
ফ্যানের সুইচ। টেবিলটি বেশ অগোছালো হলেও সুন্দর...
জানলায় মনোরম সৌন্দর্য। মনের চঞ্চলতাকে স্থিতিশীল করে নিয়ে আসে একটি গাছ উঁহু শুধু গাছ নয় এক অপূর্ব সুন্দর ফুল নিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে ~
জানলায় হাত বাড়িয়ে একটা ফুল...
প্রলয়ের খাটের সামনের টেবিলটিও অপেক্ষা করছে। ওই টেবিলেই কতো শব্দের বিচিত্র পরম্পরা, কতো অক্ষরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির আনন্দ কতো ধ্বনির মুখরিত উৎসব একমাত্র শ্রাবণী ছাড়া কেউ ভালো বলতে পারবে না। তবে আর একজন হয়তো বলতেও পারতেন... তবে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।হঠাৎ ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে আজও হয়তো হেঁটে চলেছেন...
সন্ধা হয়ে এলে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে যাওয়া ম্যাসস্টিকের রাস্তা হোটেল থেকে সোজা চলে গেছে এমজি মার্কেট। যেন আলোগুলো অন্ধকারকে পুড়িয়ে মারছে...
যন্ত্রণা কখনও কখনও সুরে বাজে।
সবকিছুরই নিজস্ব সুর আছে তবে তার সুরের সাথে সবার
মনের তরঙ্গ সবসময় যে মিলবে ঠিক এমন নয়।
ফিতে বেঁধে নিয়েই বেড়িরে এসে সোজা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় কলেজস্কয়ার। প্রলয় আসবে, সময়ে না পৌঁছলে বক্তৃতা শোনা হবে না। সব থেকে বড় কথা... তার সাথে দেখা হবে না। দেখা হওয়াটা জরুরি বলেই...
রুদ্র নীল না লাল কিংবা সবুজ যে নামেই জানি না কেন ফিকে হবে না। নিষিদ্ধ গলির আলোয় প্রলয়ের পায়ের ছন্দ লেগে আছে। তার পায়ের ছন্দ আর প্রবালের পায়ের ছন্দ এক নয়, অথচ একাকার। একথা প্রলয়ের কাছে শোনা। সে রঙের গন্ধ শুঁকে চিনে নেয় তাস। আর প্রবাল তাসের বাক্স থেকে কাছে ডেকে আনতে পারে সমস্ত ময়ূরের বর্ষাকাল।
প্রবালের সাথে তার খুব মিল মানে এই নয় যে চেহেরার মিল রং রূপ গন্ধ বর্ণ। প্রবাল উচ্চতায় ৫ফুট১০ সাস্থ্য ভালো। তার থেকে প্রায় ৩ইঞ্চি বেশি। তবে মতাদর্শের মিল আছে, দুজনকে জানলে কোনো ভাবেই চরিত্র পৃথক করা যায় না। তাহলে প্রলয় যা লেখে প্রবাল কি সে কথাগুলোই বলেছিল, নাকি প্রলয় যা লিখবে প্রবাল সেগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে আগামীকাল? প্রচণ্ড গোলমেলে হয়ে ওঠে আলো।
পাহাড় জাগে। ঘুম ভাঙে ফুলের। ফুল মানেই সুন্দর। প্রবালেরও পছন্দ।
আচ্ছা প্রবালেরর সঙ্গে প্রলয়ের কোথায় দেখা হয়েছিল?
কখন দেখা হয়েছিল?
মনে নেই।
প্রলয়কে মনে পড়লে প্রবাল কিভাবে তখনই এসে কলিং
বেল বাজায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এসব কথাগুলোই... হঠাৎ চ্যনেলটি বদলে যেতেই--
একটা বাঘ হরিণকে তাড়া করছে...
গড়ের মাঠ-- বাচ্চারা খেলছে অন্যদিকে বড় ও মাঝারি
বয়স। ফুটবল প্রলয়ের প্রিয় খেলা, প্রবালেরও। চাঁদ ও জ্যোৎস্নার মতোই দুজন, আবার আয়না
ও প্রতিবিম্ব যেমন। তবে কোনটা কে সহজে চেনা যায় না।
ঘোড়াগুলো ঘাস খাচ্ছে। ট্রামে বসে দেখলে মনে হয়
সবসুদ্ধ মাঠটাই ছুটছে। গাছ বড়বড় বাড়ি, বিজলির তার, বাসস্টপ, সবাইকে পিছনে রেখে মাথার
ভেতরটা গোলমেলে হয়ে পড়ছে।
মসৃণ হাওয়ায় বকের ডানাখুলে একটা স্বচ্ছ সকাল জানলায় হাজির। শ্রাবণীর চোখ খোলে। প্রজাপতিগুলো লাইভ ওয়ালপেপারে~
সে দিকেই তার চোখ এই মুহূর্তে বাসা বানাতে উদ্যত।
টুলবার থেকে এককাপ ব্রু-গোল্ড কফির ডানা লোভ ছড়ায়। সংক্রমিত হয়ে ওঠে জিভ।
পুকুরের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাড়িটির ছবি এবং বাড়ির লোকজন, হয়তো ক্লিক করলেই মধ্যমস্তিকের জানালা খুলে বেড়িয়ে আসবে।
জমাট এই অন্ধকারে করোটির ভেতর লুকোনো আদান-প্রদান, এসব বোধের রাস্তায় অসংখ্য বৈচিত্র্যময় যান, দাঁড়িয়ে আছে কেউ কেউ হাওয়া ভরছে। হেডলাইট জ্বলে উঠতেই অপেক্ষাকৃত সামনের গন্ধ আঁচ করে চোখ। তারপর ইগনিশন কি-এর ওপর...
কুয়াশার আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে অজগরের কালো পিঠ।
বাম পা চেপে অ্যাক্সিলারেটর ছেড়ে ডান পা'য়ে হালকা ব্রেক। তার পর যথারীতি গিয়ার পাল্টে
ডানপা'টির পুনর্বহাল। ভুঁ উ উ উ উ...
-লিপি কোথায় তুমি?
এইইইই... লিপিপিপিপি... শুনছছছছ...
ওপার থেকে আওয়াজ আসে--
-এই তোওও
এইখানেএএএ...
- বড্ড জ্বালা তোমাকে নিয়ে, কিচ্ছু করতে দাওনা।
চোখের আড়ালেও...
হ্যাঁ অরিন্দম এমনই, লিপিকে ছাড়া সে পঙ্গু বললেও
কম হবে। লিপিও খুব কেয়ারিং। এরকম মেয়ে না পেলে অরিন্দম ভেসেই যেত...
শ্রাবণী আবার হারিয়ে যায়। জানালার বাইরে আর একটা পৃথিবী যেখানে আমিহীন এক মুক্তির পেখম। নাঃ পাখা লাগে না একটা মুক্ত হাওয়া, যেখানে খুশি উড়িয়ে নিয়ে যায়। নিরন্তর এই যাপন ও মননের বাইরে ~
পরিচায়িকা এসে দেখে শ্রাবণীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে ডাক্তার ডাকে, তারপর অনেকক্ষণ হাতের তালু পায়ের চেটোতে হাত ঘষে যতটা পারে তাপ দেয়। ততক্ষণে বেল বেজে ওঠে।
ডাক্তারবাবু~
হঠাৎ একজন রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের এক্কেবারে
সামনে চলে আসে। খুব জোর ভাগ্য... এ যাত্রায় বেঁচে গেল...
মানুষের একটা জীবন নয়, কতবার সে মরে কতবার বাঁচে
কেউ বলতে পারে না। প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি ক্ষণ লক্ষ লক্ষ আমির অস্তিত্ব বিলিন হচ্ছে
আবার বিনির্মান হচ্ছে অজস্র আমি। সমুদ্রের অজস্র জলাধারে অজানা অতলান্ত জীবন।
ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলেন এবং খেয়াল রাখতে
বললেন। শ্রাবণীর খাওয়া হয়ে গেলে মৌ তাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। খাবার পর শ্রাবণী ঘুমিয়ে পড়ল...
অরিন্দম একটা করপোরেট অফিসে কাজ করে। সে অফিস চলে যাওয়ার পর লিপি বই পড়ে - 'পরকীয়া কাহিনি' প্রলয়ের লেখা। বেশ অন্যরকম ভিন্ন ভাবনা ও একেবারে নতুন ভাব, যেন এর আগে কখনই সে এরকম পড়েনি। শুরু করলে এড়ানো যায় না। তাই সংসারের আর পাঁচটা কাজের তালিকায় এটিও লিপিবদ্ধ করে নিয়েছে লিপি। প্রতিটি বিকেলের ১ঘন্টা বরাদ্দ করে নিয়েছে প্রলয়, প্রলয় নয়, তার লেখা 'পরকীয়া কাহিনি' অনবদ্য এক মুক্তির আকাশ~
অনেকদিন আমি আকাশ দেখিনি।
দম বন্ধ
ছটফট একটু আলো-বাতাস চাই~ মুক্তি চাই~
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন