সমকালীন ছোটগল্প |
খেলার ছলে
বাবলুর জ্বর হয়েছিল। প্রায়ই জ্বর হয় ওর। আর জ্বর হলেই নানান ওষুধ আর দুধসাবু খাওয়ায় ওকে মাসি। বাবলুর খাওয়ার ব্যাপারে আর কারো কথা খাটবে না। আর একটা জিনিস মাসি মাঝেমধ্যে দেয়। সেটা হচ্ছে আদানুন দিয়ে মুচমুচে চিড়ে আলুভাজা। বাবলুর খাওয়া নিয়ে মা কোন কথা বলে না। জানে, বলে কোনো লাভ নেই।
এখন সে রকম এক বাটি চিড়ে আলুভাজা
নিয়ে বাবলু বসেছে ব্যালকনিতে। জ্বর এখনো আছে, তবে মায়ের মুখ দেখে মনে হ’ল, তেমন বেশি
কিছু নয়। ওর এখন স্ট্যান্ডার্ড সেভেন্থ। তবু থার্মোমিটার বুঝতে পারে না। মা বলেছে,
আজ দুপুরে ওকে সুজির রুটি আর চিকেন স্ট্যু দেবে। মাসি এ কথা শুনে হ্যাঁ বা না, কিছুই
বলে নি। তার মানে বাবলুর আজ এটাই বরাদ্দ।
রোদ্দুর এখনো এতদূর আসে নি। তবে
আসবে। একটু পরেই আসবে। আর সঙ্গে আসবে বুড়ো। বুড়ো সব সময়ে মায়ের পায়ে পায়েই ঘোরে। শুধু
বাবলুর জ্বর হলে ও যেন কি করে টের পায়! ওর
কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। একটু আগেও ছিল বসে। বিড়াল বাবলুর খুব একটা ভালো লাগে না। ভালো
লাগে কাঠবিড়ালী। তপনদাদার একটা আছে। সব সময়ে তপনদাদা ওটাকে পাঞ্জাবীর পকেটে নিয়ে ঘোরে।
বাবলু দেখেছে, ক্ষিদে পেলে বা কোন শব্দে ভয় পেলেই ও প্রানপনে চিকির চিকির শব্দ করতে
থাকে। তপনদাদা ওর নাম রেখেছে চিচি। তাই বলে বুড়োকে বাবলু একটুও বকাবকি করে না। রোদ
মেখে বুড়ো যখন বাবলুর পায়ের কাছে দু থাবার উপরে মুখ রেখে টানটান হয় আর গলা দিয়ে ঘর্ঘর্ শব্দ করে, বাবলুর বেশ মজাই লাগে।
পায়ের দিকে চাদরটা একটু টেনে নিল।
বাতাসে শীতশীত ভাব এসে গিয়েছে। বাতাসেই এসেছে, জ্বর নিশ্চয়ই ওর আর আসছে না। খুশি মনে
এক চামচ চিড়ে মুখে দিল বাবলু। গোলমরিচের ঝালটা আর একটু বেশি হলে যেন ভাল হত।
আঙুল গুনলো। আর আট দিন পর মহালয়া।
ক্লাসের বন্ধুরা ঠিক করেছে, ঐ দিন সকালে পাশের পাড়ার সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ হবে। বাবলু
ব্যাট ফিল্ডিং দুটোই ভাল করে। বাবলুর এই জ্বরফর নিয়ে তাই বন্ধুরা এখন খুবই চিন্তিত।
কাল রাতে মা-কে ফোন করে অভীক জানতে চাইছিল, বাবলু এখন কেমন আছে। বাবলু ছাড়া টিমটা নাকি
ঠিক দাঁড়াচ্ছে না। বাবলু খেলতে পারবে তো! এইসব মায়ের কাছে শুনে ও খুব মজা পাচ্ছিল।
বাবলু তো জানেই, ও খেলবে আর পাশের পাড়া হেরে যাবেই। বাবলুর চিন্তা অন্য জায়গায়। মহালয়ার
ভোরে মাসি ওকে এবার বেরোতে দেবে তো! এই সকালটা যে ওর কি ভাল লাগে! দু দিন আগে উপরের
ফ্ল্যাটের রিমলিকে এই আনন্দটা বোঝাতে গিয়ে
কি বোকাই না হয়েছে! মনের দুঃখে ই ভি এস খাতার
শেষ পাতায় ও একটা পদ্যই লিখে ফেলেছে। পরে কি রকম যেন লজ্জ্বা হচ্ছিল। মাসিকেও
বলতে পারে নি এই কান্ড। ঐ যে বাতাসে একটু ভেজাভেজা ভাব, হালকা কুয়াশার মতন কিছু একটা, নির্জন রাস্তাসব আর
ওরা কয়েকজন বন্ধু হেঁটে যাচ্ছে বোসবাড়ি থেকে শিউলি আর স্থলপদ্ম তুলতে, এর রোমাঞ্চই
আলাদা। এই ক’দিনে ও নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে পুরোপুরি আর বাবলু কষ্ট পাবে, এমন কিছু মাসি
করবেই না।
বাবা অফিসের কি একটা কাজে কলকাতা
গিয়েছে। সেই সকালবেলায়। ও তখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। পরে মায়ের কাছে শুনলো। বাবলু জানে,
বাবা কলকাতা গেলেই কিছু না কিছু নিয়ে আসবে ওর জন্য। একবার বাবা খুব ভোরবেলা ফিরেছিল
লালগোলা প্যাসেঞ্জারে। ওর জন্য নিয়ে এসেছিল ছোট ছোট লাল টুকটুকে আপেল। অনেকগুলো। এনে
বাবলুর বালিশের পাশে রেখে দিয়েছিল। নিশ্চয়ই ধুয়েটুয়ে। ঘুম থেকে উঠে ঐ আপেল দেখে বাবলুর
কি যে আনন্দ! ওর বোধহয় ভালো লেগেছিল ওগুলোর রঙ আর সাইজ। বিছানার উপরেই স্বদেশদার সঙ্গে
ক্যাচ ক্যাচ খেলা শুরু করে দিয়েছিল। ওগুলো যেন কাঠের বল। এ ঘটনা অনেকদিন আগের। বাবলু
তখন বোধহয় সিস্টার নিবেদিতায় পড়তো।
দেখতে দেখতে এসে পড়ল মহালয়া। রাত
গেলেই মহালয়ার ভোর। টিভি দেখে মাসির পোষায়
না। বাবা ব্যাটারি নিয়ে এসেছে নতুন। মাসি রেডিওতে মহালয়া শুনবে। পুজোর বাজার হয়ে গ্যাছে।
বাবলুর জামা এসেছে। প্যান্ট সন্ধ্যায় টেলারের কাছ থেকে বাবা আনবে। মাসি কিনে দিয়েছে সুন্দর একটা টি শার্ট। আজ মা কিনে
দেবে জুতো। মা বলছিল বাবাকে, বাবলুর জন্য আরেকটা জামা কিনবে। বাবা আপত্তি করেছে। কোন
বিষয়ে বাবা বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। এমন কি টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে বাবলু যদি চিৎকার
করে ওঠে, বাবা রেগে যায়। জামাকাপড়ে অবশ্য বাবলুর কিছু আসে যায় না। যা দরকার মানে অন্তত
দুটো বেশ ভালো কলম আর পিওর উইলো কাঠের ক্রিকেট ব্যাট। তা ওর আছে। মা অবশ্য একটু শাড়িশাড়ি
করে। বাবা শোনে কিনা, বোঝা যায় না। শাড়ি আসে না।
তিনদিন হ’ল বাবলু স্কুলে যাচ্ছে।
রীতিমতো ফিট এখন ও। প্র্যাকটিস বেশ ভালোই হয়েছে।
আজো হবে। সবে জ্বর থেকে উঠেছে বলে বাবলুর ফিল্ডিং প্লেসমেন্ট পাল্টে দিয়েছে অভীক, ওদের
ক্যাপ্টেন। টিমটা বেশ জমে গিয়েছে।
ভোর চারটের সময়ে মাসি ডেকে দিল
ওকে।
-কি রে? বেড়োবি না!
দু চোখ জুড়ে ঘুম। তবু উঠে বসল বাবলু।
রেডিওতে শুরু হয়ে গিয়েছে মহালয়া। মহালয়া শুনবে
বলে এই ভোরেই স্নান সেরে মাসি নতুন শাড়ি পড়েছে। বাবলুর ইচ্ছে হ’ল, আজ ও মাসির পাশে
বসে মহালয়া শুনবে। মা বাবাও নিশ্চয়ই এক্ষুনি উঠে আসবে। সবাই মিলে চা খেতে খেতে এবার
শুনবে মহালয়া। গত চার পাঁচ দিন হ’ল, মাসি ওকে সারাদিনে একবার চা খেতে পারমিশন দিয়েছে।
-নাঃ এবার আর বেড়োবো না। তোমার
কাছে বসে রেডিও শুনবো।
একটু অবাক হলেও মাসি বোধহয় একটু
খুশিই হ’ল।
-তা হলে যা। মুখচোখ ধুয়ে এখানে
বসে পড়। খালি মাটিতে বসিস না। আসন দিচ্ছি।
বাবলু চট করে তৈরি হয়ে এল।
রেডিও, সামনে চার কাপ চা। লম্বা
আসন পাতা হয়েছে। তার মানে মা বাবা-ও তৈরি। বাবলু বসতেই মাসি একটা হালকা চাদর এনে জড়িয়ে
দিল ওর গায়ে। বাবলু জানে, বাবা দেখলেই গজগজ করবে। ছেলেকে এত আতুপুতু করে বড় করা তাঁর
একদম পছন্দ নয়। কিন্তু মাসি বাবাকে পাত্তা দিলে তো! বড় হয়ে মাসিকে ও একদিন ঠিক বেনারস
বেড়াতে নিয়ে যাবে আর সুন্দর দেখে একটা রুদ্রাক্ষের মালা কিনে দেবে। ও শুনেছে, রুদ্রাক্ষ
নাকি শরীরের পক্ষে ভালো।
মহালয়া শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘুম
পাচ্ছে। একটু যেন শীতের মতো কাঁপুনি। চাদরটা জড়িয়ে নিলো। মাসি বাবলুকে কোলের কাছে টেনে
নিলো।
মাঠ বেশ সাজানো হয়েছে। একপাশে সামিয়ানা
খাটিয়ে প্যাভিলিয়ন। মাঠের চারপাশেই প্রচুর ছেলে। খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে। সকালে হালকা
বৃষ্টি হয়েছে। একবার দুই আম্পায়ার আর দু দলের ক্যাপ্টেন পিচ দেখে এসেছে। এখন রোদ উঠেছে
চমৎকার। আবার ওরা চারজন মাঠে ঢুকলেন। অভীক একটু পরেই হাত তুললো। তার মানে খেলা শুরু
হবে।
কুটু পাশে এসে দাঁড়াল।
-কি বাবলুদা, আজ কিন্তু জিততেই
হবে।
-কেন! আমরা তো প্রত্যেকবারই জিতি।
-আরে, এবার ওরা তিনজন ছেলেকে নিয়ে
এসেছে শ্যামপুর থেকে। কাল ওদের প্র্যাকটিস দেখেছি। একটা ছেলে তো সাঁইসাঁই ফাস্ট বল
করছিল! তা অবশ্য করুক। আমরাই বা কম কিসে, তাই না বাবলুদা?
কুটুর চোখের দিকে তাকাল বাবলু।
কালো রোগা কুটুর চোখদুটো দেখে কি রকম যেন ভাল লাগল। ক্রিকেট খুব ভালবাসে ছেলেটা। কিন্তু
খেলা আর ওর হয়ে ওঠে না। ওর বাবার একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে ঘুগনি আলুর চপ-ও পাওয়া
যায়। বাবলু একদিন খেয়েছে। চমৎকার! স্কুলের সময়টাতে কুটুকে হয় বাবার সঙ্গে দোকানে থাকতে
হয়, না হলে বাড়িতে মায়ের সঙ্গে ঠোঙা বানায়।
- তুই আজকে খেলা দেখবি তো?
-নাঃ। কাল রাত থেকে বাবার শরীর
খুব খারাপ হয়েছে আবার। দোকান খুলেছে মা। তোমার সঙ্গে দেখা করেই এবার দোকানে যাব।
বাবলুর ভালো লাগলো না। মাঠের দিকে
তাকালো। ওরা টস করছে।
ওদের দলের ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে
ফিরছে। অভীকও হাসছে। হাসতে হাসতেই অভীক ইঙ্গিত করল। বাবলুরা বুঝল, ওদের ফিল্ডিং করতে
হবে। অভীকও সেটাই চেয়েছিল।
-তা হলে যাও। আমিও চললাম। যদি পারি,
সময়মত এসে তোমার ব্যাট দেখব।
বাবলু কুটুর কথায় মাথা নাড়ল।
-জিততে কিন্তু তোমাদের হবেই।
বাবলু কুটুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার
চেষ্টা করল। ও ততক্ষণে জোর কদমে হাঁটা লাগিয়েছে। বেচারি!
ওরা কিন্তু খুব খারাপ স্কোর করল
না। পনেরো ওভারে পাঁচ উইকেটে ১৩৩। বেদম মার খেয়েছে নীলু আর শমীক। অভীকই যা একটু ভাল
বল করেছে। ওরা খুশি। বাবলুদের কোচ মিলনকাকু ওদের নিয়ে মিনিট কয়েক বসলেন। বললেন স্ট্র্যাটেজি
নিয়ে কিছু কথা। অভিক আর মনোজ ওপেন করল। আর তার পরেই শুরু হল যাতায়াত। বাবলু যখন নামলো,
৫৯ রানে চার উইকেট। বেশ টেনশন মাঠের বাইরে। প্রথম বলটাই বাউন্সার। বাবলু হুক করল। বলটা মাঠের বাইরে। ওদের শ্যামল যখন রান আপ শুরু করল,
ধরনটা বাবলুর ভাল লাগলো না। কিছু বোঝার আগেই বলটা শর্ট পিচ করে ছুটে এল। বাবলু ব্যাকফুটে
খেললো। মিস করল। বলটা বাবলুর তলপেটে লাগলো। এতক্ষণ গোটা মাঠ উত্তেজনায়, চিৎকারে ফুটছিল।
হঠাৎ সব শব্দ যেন নিভে গেল। মাঠে শুয়ে পড়ার আগে বাবলু দেখলো, অনেকে ছুটে আসছে। কুটু
সবার আগে। কুটু! ও কোথা থেকে এলো! আর কিছু দেখতে পারলো না বাবলু।
যখন চোখ খুলল, চোখের সামনে কুটুর
মুখ। চোখদুটো জলে ভরে আছে।
-বাবলুদা, পারবে তুমি ব্যাট করতে?
মিলনদা ধমকে উঠল।
-কেন পারবে না! ওকে পারতেই হবে।
ম্যাসাজের আর ব্যথার ওষুধপত্র গুটিয়ে
নিতে নিতে মিলনদা বলল, ক্রিজে যা। কিচ্ছু হয় নি।
ব্যথাটা এখনো আছে বেশ। তবু বাবলু
উঠে দাঁড়াল। ওর খুব রাগ হচ্ছে। কেন ও বলটা মিস করল! কোন কথা বলল না। মিলনকাকু আর সবাইকে
নিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেল। ওকে একজন রানার দেওয়া হয়েছে।
-মিডল্ স্ট্যাম্প।
আম্পায়ার মাথা নাড়লেন।
শ্যামল ছুটে আসছে।
এর পর খেলাটা গল্পের মতো হল। একটা
সিঙ্গল নিয়ে বাবলু যখন রামুর সঙ্গে মাঠ ছাড়ছে, ওরা তখন ১৪ ওভারে ৮ উইকেটে ১৩৪। বাবলুকে
শুধু এখনো একটু খোঁড়াতে হচ্ছে।
সবার আগে দৌড়ে এলো কুটু। বাবলুকে
জড়িয়ে কেঁদেই ফেলল। বাবলু এতটা আশা করে নি। ডান হাতে কুটুকে সামলাতে সামলাতে জিজ্ঞেস
করল, কাকু এখন কেমন আছে রে?
-ভালো একটু। মা বলল, যা মাঠ থেকে
ঘুরে আয় একটু। এসে দেখি, তোমার এইসব কান্ড। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর একটু ফ্রেশ হয়ে ঘরের দিকে
রওনা হতে গিয়ে বাবলু দেখে, কুটু তখনো দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হল একটু।
-কি রে তুই এখনো যাস নি! কাকিমা
ভাববে যে!
-এই যাব। তোমার ব্যাটটায় একটু হাত
দেব বাবলুদা?
ও ব্যাট বাড়িয়ে দিল। কি এক গভীর
ভালবাসায় কুটু ছুঁয়ে দেখছে ব্যাটটা। আহা! ও কোনদিন কিনতে পারবে না হয়ত এই ব্যাট।
-তুই নিবি এটা? নে। রেখে দে। আমার
তো আছে আরও দুটো।
-ধুস্। কি যে বলো তুমি! ব্যাট
নিয়ে কি করব আমি! এই ব্যাটটাকে তুমি ভালবাস তো, তাই আমিও একটু আদর করলাম আর মনে মনে
বললাম...
-কি বললি মনে মনে!
-কোনদিন বাবলুদাকে ঠকাবি না। আসছি।
দেরি হয়ে গেল।
অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাবলু বুঝতে
পারল না, কুটুর চোখে জল দেখল কিনা।
শুধু বলল, আয়। কাল স্কুলের গেটে
দেখা হবে।
যেতে যেতে কুটু হাত তুললো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন