শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

শুক্তি ঘোষ

 

কবিতার কালিমাটি ১৩০


তমস্বিনী

 

তমস্বিনী রাত

হাত রাখো আমার কপালে,

তোমার হিমেল ছোঁয়ায়

আতপ্ত কপোল

ভিজে যাক শিশির অশ্রুতে;

বিবর্ণ আ-ফোটা যুঁই,

পাণ্ডুর দু’ঠোঁট --

নরম ঘাসের মত

ঢাকো তাকে শীতল চুমোয়।

নক্ষত্রনীল রাত

সুগন্ধী এলোচুলে ঢেকে রাখো আমার শরীর

নিবিড় স্বপ্নের মত,

আকাশ উজাড় করে

ছেয়ে থাকা অন্ধকার --

নীল সেই অন্ধকারে, পরতে পরতে

পরম নিশ্চিন্ত ঘুম,

মৃত্যুর মতই

অনায়াস গভীর মৌনতা;

ধীরে ধীরে দু’চোখের পাতা

ভারি হয়ে আসে --

রাত্রির বুক জুড়ে

শীতল স্নেহের ধারা

ছুঁয়ে থাকে মাটির শরীর।

 

তমস্বিনী রাত

রাখো হাত আমার কপালে,

শিশুর মতন

অকলুষ প্রথম উন্মেষ

প্রগাঢ় ঐ অন্ধকার --

আমাকেও শিশু হতে দাও!

অন্ধকার মানে

একসাথে মাটি ও আকাশ --

আমি তো ছোঁবই

শিশুর আর্তি নিয়ে!

শতাব্দী পার হয়ে আসা

নীলাক্ত, নিবিড় --

তোমার ও অন্ধকার,

মায়ের কোলের মত

স্নেহময় পরম নির্ভর,

অনাদি সে অন্ধকারে আমিও নির্ভয়

একান্ত শিশুর মত।

 

তমস্বিনী রাত,

ছুঁয়ে থাকো আমার শরীর,

তোমার শীতল ছোঁয়া --

ঘুম আসে,

দুই চোখ হিম,

সুগন্ধী এলোচুল সমুদ্রের মত --

ডূবে যাই, ডুবতেই থাকি

আধো ঘুমে টের পাই

তোমার নিঃশব্দ আনাগোণা --

আতপ্ত পাণ্ডুর ঠোঁটে,

বিবর্ণ কপোলে,

তোমার সস্নেহ চুমো;

জানি, আমি জানি,

তোমাকে আসতেই হবে --

তমস্বিনী রাত,

ছুঁয়ে থাকো,

ছুঁয়ে থাকো অস্তিত্ব আমার,

তোমার ছোঁয়ায়

এখন নির্ভয় আমি --

ঘন অন্ধকার

এলোচুলে মুখ ঢেকে

এখন ঘুমাবো আমি --

গাঢ়তম অন্ধকারে,

সবচেয়ে নির্ভয় আমি!

একদিন, কোন এক মুহূর্তে নিশ্চিত,

আমিও তোমার মত,

হে রাত্রি,

তোমারই মত

বিশ্বব্যাপিনী হতে পারি।

 

পাশবিক

 

পাখিপড়া করে তোমরা আমাকে শেখালে,

“তোমার শরীর পবিত্র

তাকে রক্ষা করো!”

আমার ইচ্ছা? আমার প্রয়োজন? আমার সিদ্ধান্ত?

না!

সে বড় লজ্জা,

পাপ!

অশ্লীলতা!

 

তোমরা তাকে পাখিপড়া করে বোঝালে

“তোমার নারী, তোমার অধিকার;

আনখশির --

তোমারই ইচ্ছাধীন”।

সম্পূর্ণ প্রশ্নহীন

তার আনুগত্য,

আর তার অর্জন?

আশ্চর্য!

এমন অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নও কেউ করে?

 

আমাকে দিলে দায়িত্ব,

সারাজীবন --

কাচের চেয়েও ভঙ্গুর এক পবিত্রতা

আগলে চলার।

 

সে জানল,

সগর্ব রোপণই পৌরুষ;

আর সব

নিছক দুর্বলতা।

 

আমাকে সাজালে

মাতৃত্বের আলপনায়,

আমার জন্য

তৈরি করলে স্তুতির মালা।

 

তার চারপাশ ঘিরে

রচনা করে দিলে অমোঘ মন্ত্র

“মা-বোনের ইজ্জৎ”!

 

প্রতি পল, অনুপক, বিপল

সম্পর্কের নিক্তিতে

মাপা হতে থাকে আমার অস্তিত্ব।

তাই

প্রতিদিনের সমাজসম্মত ধর্ষণ

আমার জন্য স্বাভাবিক --

এমন কি কাম্য,

গৌরবও!

 

তোমরা আমাকে ঘিরে

তৈরি করে চল তোমাদের ব্যূহ,

টান টান তোমাদের সজাগ প্রহরা

চুঁইয়ে পড়ে আমার মজ্জার গভীরে --

তোমাদের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব

আমার হাতে পায়ে সোনার শিকল হয়ে

ঝনঝনিয়ে বাজে;

আর আমি

আমার অস্তিত্বের গ্লানিতে

প্রতি মুহূর্তে

লজ্জিত হতে থাকি!

 

তোমরা আমার নাম দিলে

‘প্রকৃতি’;

বললে, ‘লজ্জা’ আমার ভূষণ।

 

মানুষ যা চায়,

মানুষ যা করে,

মানুষ যা পারে --

তার কিছুই আমার নিজস্ব নয়,

এই আমার পরম শ্লাঘা!

 

ইচ্ছাহীন, সিদ্ধান্তহীন, নিয়ন্ত্রণহীন, অমানুষী

আমার অস্তিত্ব --

নিছক কিছু মাংসল ঘটনাপঞ্জীতে

আটকা পড়ে থাকে।

 

আর সবাইকেই

সঙ্গিনীর সম্মতি

অর্জন করে নিতে হয় --

‘সভ্য’ মানুষ কি একটুও ‘পাশবিক’ হতে পারে না?                                                      

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন