ধারাবাহিক
উপন্যাস
রূটম্যান
(১৬)
নিঃশ্বাসটা ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে সাংবাদিকের। অথচ মাথার মধ্যে চিন্তাটা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘ন যযৌ, ন তস্থৌ অবস্থায়!’ সাংবাদিক পাশ ফিরে শুতে গিয়েও পারে না। বুকের উপরে চেপে বসা হাত দুটো পথ আগলে দাঁড়ায়। আর তখনই মুখরাটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে!
একসাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়া লোকগুলোর মুখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে। এদের আগে কখনও সে সামনে থেকে দেখেনি। যা দেখেছে তা তাদেরই কাগজের ছবিতে। কিন্তু কি অদ্ভুত! এরা সবাই একসাথে কোথায় চলেছে! সবার প্রথমে রয়েছে আমেনুল, তারপর কুমার সাব, তারপর রয়েছে মাজিবাবু আর তারও পেছনে রয়েছে যুবক মিশ্রজি! সে এদের মধ্যে সব থেকে কম বয়সি। ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত ও ধূর্ত চোখের চাউনি। একেবারে সঠিক নির্বাচন। কিন্তু ওরা বার বার পেছনের দিকে তাকাচ্ছে কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে কি আরো কারোর আসার সম্ভাবনা রয়েছে নাকি! ওরা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। একে অপরকে মনে মনে বলে-চিন্তার কোন কারণ নেই। আরো একশোর উপরে আসবে। কিন্তু অফিসে তো একসাথে অতজনের জায়গা হবার কথা নয়! এরপর ওরা সামনে দন্ডায়মান বিশাল বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। কিন্তু অদ্ভুত কায়দায় প্রায় ভোজবাজির মতোই মাজিবাবু আর মিশ্রজি উবে যায়! বিশাল ফটকের সামনে কর্তব্যরত পাহারাদার বিস্মিত হয়ে ভাবে-কিরে বাবা! চারজনের মধ্যে বাকি দু’জন গেল কোথায়! আমি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি নাকি! এখনই সাহেবকে খবর দিতে হবে। চারজনের মধ্যে দু’জন ভাগলবা!
সত্যিই তখন দু’জন লোক প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে! অথচ তাদের নাকি কেউ দেখতেই পাচ্ছে না! কিছুদূর গিয়ে ওরা অদ্ভুত ভাবেই দু’দিকে আলাদা হয়ে যায়। ওদের পেছনে বেশ ক’জন সুটেড-বুটেড অফিসার গোছের লোকও ওদের উদ্দেশেই দৌড়াচ্ছিল। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অর্থাৎ যেখানে রাস্তাটা চারদিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে তেমনি একটা চৌমাথায় এসে অফিসার গোছের লোকগুলো ভ্যাবলার মতো একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল যে লোকদুটো গেল কোথায়! ওরা কি কোন ম্যাজেসিয়ান ছিল! তা না হলে এমন দিনের আলোয় জনাকীর্ণ রাজপথে উবে যাবে কীভাবে! অফিসারেরা বার কয়েক নিজেদের গাল চুলকে একে অপরের সাথে কিছুটা খেজুরে আলাপ করে আবার ফিরে গেল সেই বিশাল বাড়িটার কন্দরে।
যে দু’জন ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায় ছুটছিল অথচ তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছিল না তাদের কানে হঠাৎ বাতাস এসে বলে গেল আর দৌড়ে লাভ নেই। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে যে কোন দিকে চলে যেতে পার। এমন দৈববাণীর অমর্যাদা করা ঠিক নয়। দু’জনেই ছুটতে ছুটতেই নিজেদের গাড়িকে ডেকে নিয়েছে। কাজেই তাদের ছোটার গতির সাথেই প্রায় পাশাপাশি গাড়ি দুটোও চলছিল। এবার একজন টুপ করে একটা সাদা গাড়িতে এক লাফে উঠে বলল-জলদি এয়ারপোর্ট। দ্বিতীয় জনও একই কায়দায় একটা কালো রঙের গাড়িতে কোনমতে নিজের গোল শরীরটাকে ছুঁড়ে দিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল- জলদি বিশ নম্বর মে চল।
প্রথমজন গাড়িতে বসেই সরাসরি দুবাইয়ের প্রথম ফ্ল্যাইটে একটি মহার্ঘ টিকিট বুক করে নিল। আর মনে মনে ঈশ্বরকে বার বার প্রণাম করে বলল, হে ভগবান, মুঝে একবার লিফট করা দিজিয়ে। একবার ফ্ল্যাইটমে ঘুস জানেকে বাদ উ আদমি লোগনে পাগলা কুত্তাকে তরহ ভুকেঙ্গে! ইসকে অলাবা উ লোগকো অর কুছ করনা না মুমকিন হ্যাঁয়। ওর ভগবান কেন মুচকি হাসলেন তা তিনিই জানেন। কিন্তু তিনি সত্যিই আপাতত তাকে উড়িয়ে দিলেন দুবাই। দ্বিতীয় জনের নির্দেশ মতো কালো গাড়িটি প্রায় ঝড়ের বেগে ছুটে চলল বিশ নম্বর বাড়ির উদ্দেশে। আর গাড়িতে বসেই লোকটি কাকে যেন নির্দেশ দিতে লাগল-কান খুলকর শুনলে, আভি ম্যায় পৌছ যায়ুঙ্গা বিশমে। সামমে নিকলকর চবিশমে। এক রাত গুজারকে নেক্সট ডে সিধা তিরিশ নাম্বারমে। তু এক কাম কর সবকো ফোন লাগাকে তৈয়ার রাখনে বোল। ম্যায় বাদমে বাতাউঙ্গা কৌন দিন কিসমে ঘুসেঙ্গে। ইসবার দেখেঙ্গে শালে অফিসার লোগনে মুঝে ক্যাঁইসে অর কিধার কিধার ঢুনেঙ্গে! মেরে সাথ ইতনে গদ্দারী! হর সপ্তাহ কলকাত্তা রুপিয়া ভেজা থা। একশো কুত্তা পুলিশকো পালপোষ কিয়া। আজ ম্যাঁয় সবকো বড়া দুশমন বন গিয়া! আব মেরা পিছে সিবিআই লাগাকে তুম লোগনে মেরা জিনা হারাম কর দিয়া। আজ নেতা লোগোনে মোবাইলকা সিমভি বদল লিয়া। কভি ম্যাঁয় পাকড় যাউ তো সব নেতা লোগোকো পর্দা ফাঁস কর দুঙ্গা। সবকো জিনা ম্যাঁয় ভি হারাম কর দুঙ্গা।
এটা যে আসল ছবির টেলার ছিল তা প্রথমে বোঝা না গেলেও বোঝা গেল কয়েকদিন পরেই। হঠাৎ করে আমেনুল অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিছুটা সুস্থ হতেই একদিন সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে গুটি গুটি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে দে ছুট। লোকটি ছুটতে ছুটতে দেখল আরো দু’জন হঠাৎ করে দুটি ভিন্ন গলি থেকে বেরিয়ে তার সাথে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে! এতো বড় তাজ্জব ব্যাপার! পাশাপাশি তখন তিনজন ছুটছে। এ যেন কয়েক হাজার মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে ওদের মধ্যে। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার তিনজনই সমান্তরাল ভাবেই দৌড়াচ্ছে। কেউ কাউকে এক চুলও বিট করতে পারছে না! তিনজনেরই জিভ বুল ডগের মতো সামনে ঝুলে পড়েছে। ওরা এক সময় একে অপরের মুখ দেখতে পেয়ে বড় নিশ্চিন্ত হয়। বুঝতে পারে তিনজনই একে অপরের ভীষণ ভীষণ পরিচিত। প্রথমজন তার অসুস্থ শরীর নিয়ে বোধ হয় আর দৌড়াতে পারছিল না। সে একটা ব্রিজের উপর থেকে দেখতে পায় যে নিচ দিয়ে উত্তাল বেগে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। বড় পুণ্যবতী এই নদী। হিন্দুরা এই নদীকে দেবী বলে মেনে থাকে। এই দেবীর কাছে কোন জাত বিচার নেই। আর তাই তো তিনি পতিতোদ্ধারিনী সর্বং সহা মা গঙ্গে। আর বেশি কিছু সে ভাবতে পারল না। সে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তাল গঙ্গার বুকে। যতটুকু সময় আমেনুল শূন্যে ভাসমান ছিল ওর মনে হল লক্ষ লক্ষ অবলার কবন্ধ যেন ওর দিকে ধেয়ে আসছে! ওদের বাঁকানো শিংগুলো সজোরে এসে ওর শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আমেনুল শেষ মুহূর্তে আল্লার নামটুকু নেওয়ার আগেই তার শরীরটা তলিয়ে গেল গঙ্গার অতলে!
বাকি দু’জন তখনও প্রাণপণে ছুটে চলেছে। রাস্তাটাও আজ বেশ সুনসান। কখন যে কলকাতার কোলাহল থেকে তারা একেবারে আদিগন্ত বিস্তৃত শুষ্ক জায়গায় চলে এসেছে তা টের পায়নি। তবুও ওদের ছোটার কোন বিরাম নেই। সামনেই যে নদীটা বয়ে চলেছে তা দেখে মিশ্রজি তাকে চিনতে পারে। সে চিৎকার করে বলে- আরে ইয়ে দরিয়াকা বারে মে্রা পুরা জানকারি হ্যাঁয়। আরে দেখো দেখো ইধার বহুতসা খাদানভি হ্যাঁয়। অব ম্যাঁয় ইসকে অন্দর কুদকে ছুপ যায়েগা। শালে সিবিআই কভি মুঝে ঢুন্ড নহি পায়েগা। এই বলে পাগলের মতো মিশরজি এক লাফে বিশাল বিশাল বালি খাদানের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই মুহূর্তে মাজিবাবু একেবারে একা হয়ে গিয়ে বড় বিপন্ন বোধ করে। তার আশে পাশে আর কেউ নেই! গা ছমছম করে! মনে হয় এত দীর্ঘ বছর ধরে ওর চারদিকে হাজার হাজার লোকেরা মৌ্মাছির মতো সব সময় ওকে ঘিরে রাখত আজ তারা কি সবাই ভোঁ কাট্টা হয়ে গেল! যাদের প্রত্যেক মাসে মোটা মোটা খামে করে পর্যাপ্ত টাকা পাঠানো হত, অথচ আজ তারা একবারও খোঁজ নিচ্ছে না সে কেমন আছে! এর থেকে আশ্চর্য আর কি হতে পারে! এক মুহূর্তেই সব কীভাবে উবে গেল! তাহলে সবার সাথেই কি শুধু অর্থের সম্পর্কই ছিল! গৃহপালিত পোষ্যও তো এমনটা হয় না। সে তো গৃহস্বামী না ফেরা পর্যন্ত এ ঘর ও ঘর ছটফট করে কাটায়। অথচ যারা এতগুলো বছর আমার অর্থেই পালিত হল, আমার অর্থেই বিশাল অট্টালিকা বানিয়ে ফুটানি করল, আজ সবাই যখন দেখল চাকের মধু শেষ হয়ে গেছে আর তখনই ঝাঁকে ঝাঁকে সব্বাই উড়ে গেল অন্য কোন ডালে নতুন করে বাসা বাঁধবে বলে!
সে সঙ্গিহীন হয়ে ছুটতে ছুটতে যে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এত বৈভব গড়ে তুলেছিল, সেইসব অট্টালিকার সামনে এসে দেখতে পেল সবগুলোরই দরজা বন্ধ! কারা যেন সিল করে দিয়ে গেছে! অথচ তাকে জানানোর প্রয়োজনটুকু বোধ করেনি। যে সাধের প্রাসাদটাকে নিজের হাতে বিদেশি মার্বেল দিয়ে মুড়ে একেবারে রাজ বাড়ির মতো সাজিয়েছিল আজ সেটাতেও সিল করে দিয়ে গিয়েছে!
এখন শুধু চারদিকে গভীর জমাট অন্ধকার! সারা জেলাটাই কি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে নাকি! তাহলে ও নিজের জেলায় ফিরে এলেও কেউ একজনও তার সাথে দেখা করতে আসছে না কেন! যারা তার সুসজ্জিত-সুবিশাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ড্রয়িংরুমে ঢুকে বসতে পেলে নিজেকে ধন্য মনে করত, তারা কি আজ তার ফিরে আসাটা জানতে পারেনি! এমনটা তো হওয়ার কথা নয়!
কিছুক্ষণ নিজের প্রাসাদের শ্বেত শুভ্র অথচ ধুলি ধুসরিত সোপানে বসে এবার সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। অথচ সামান্য এক গেলাস জল নিয়ে দশ দশটি কাজের লোকের মধ্যে একজনও ছুটে এল না! কেউ পাশে দাঁড়িয়ে বলল না-সাব, আপকা তবিয়ত ঠিক হ্যাঁয়?
হাতের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সে উঠে দাঁড়ালো। যে রাস্তা সে নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে আজ সেই রাস্তা চিনতে হচ্ছে জোনাকির ঝাঁককে অনুসরণ করে। তবু ভালো যে ওরা অন্তত তার সাথে আছে। কিন্তু নিজের মুখের ভিতরটা ক্রমশই শুকিয়ে যেতে যেতে যখন আর মুখের মধ্যে এক বিন্দুও লালা অবশিষ্ট নেই, ঠিক তখনই সে সামান্য হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। নিকষ অন্ধকারেও সে বুঝতে পারল যে এ তার বহু পরিচিত কোন এক খাদান। খাদানের মুখগুলো আজো হাঁ করে চেয়ে রয়েছে! সেই সুগভীর মুখের অমোঘ টানে আস্তে আস্তে মাজিবাবু কয়লা খাদানের অপরিস্রুত কালো জলে তলিয়ে যেতে লাগল। একবার চেষ্টা করেছিল ওর হাত দুটোকে উপরে তুলে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে। কিন্তু মনে পড়ল এখন আর কেউ তাকে টেনে তোলার জন্য খাদানের উপর দাঁড়িয়ে নেই! হয়তো তাকে একাই আজীবন এই খাদানের গভীরে যক্ষ হয়ে পাহারা দিতে হবে।
ঘুমটা হঠাৎ এমন ভয়ানক স্বপ্নে ভেঙে গেল সাংবাদিকের। সে তাড়াতাড়ি তার কলমটাকে টেনে নিয়ে সাদা পাতায় আঁচড় কাটতে কাটতে লিখে ফেলল তার দেখা ঘটনার পরম্পরাগুলো। পাতার পর পাতা লিখে ফেলল। আছড়ে পড়া লহরির মতো তার মন থেকে হুড়মুড় করে সব দেখা-অদেখা ঘটনাগুলো মুহূর্তের মধ্যে ভরিয়ে তুলল তার সাদা পাতাগুলো।
সাংবাদিক বড় নিশ্চিন্ত মনে একটা সিগারেট ধরাল। এবার আর তার বস তাকে কিছুই বলতে পারবেন না। উপরন্তু তাকে ধন্যবাদ জানাবেন বলেই তার বিশ্বাস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন