সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস   

 

দিগন্তসেনা




 

(১৫)

ফলে শকুন্তলা আর রেঁনোয়া বত্তিচেল্লী অনেকখানি সময় পেয়ে গেল নিরিবিলিতে তাদের নিজেদের মত সময় কাটাবার ও প্রেম করবার। তার ফলাফল গিয়ে পড়ল তাদের কাজের ওপর। দেখা গেল মাত্র ক’মাসের মধ্যেই শ্যামাঙ্গী শকুন্তলা আর চৈতির পরামর্শে ও সহযোগিতায়  তুপাক ইউপানকি ও মানকো আপারুর সঙ্গে রেঁনোয়া আগামেননকে নিয়ে মূল ভূখন্ডের যে কটা জায়গায় ওরা রাজ্য স্তরে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে, সেই সব জায়গা গুলোতেই একটি করে সরকারী ভবন তৈরী করে ফেলল, যেগুলো কিনা স্থাপত্য ও শিল্পকলায় এত উৎকর্ষের অধিকারী যে সেখানে কখনও রোম, কখনও কোনটায় গ্রীস, আবার কোনও কোনও জায়গায় মায়া আর ইনকা সভ্যতার শিল্প ও স্থাপত্য নৈপুণের ছোঁয়া পাওয়া গেল। মূল ভূখন্ডের অধিবাসীরা সেগুলো দেখে এত অভিভূত হয়ে গেল যে সেগুলো দেখবার জন্য রীতিমত মানুষের ভীড় উপচে পড়তে লাগল। ফলে সেই বাবদ প্রচুর অর্থ আয় হতে থাকে আর তা দিয়ে রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় আরও সব ভবন নির্মিত হতে থাকল যাতে করে পর্যটন শিল্প এমন জায়গায় পৌঁছালো যে দেশ বিদেশ থেকে অনবরতই এত এত লোক আসতে থাকল। গোটা পৃথিবীতেই সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল ওদের শিল্পনৈপুণ্য ও শিল্পপ্রীতির কথা। ওরা তখন প্রতিটি রাজ্যের অন্যান্য জেলাগুলোতেও ওদের কাজকর্ম শুরু করার পরিকল্পনা করল। আর এভাবেই ওরা তৈরী করে ফেলল এমন বিশেষ কিছু জিনিস যে গুলো শিল্পনৈপুণ্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও আনন্দ দেবার ক্ষেত্রেও এক বিশেষ অবদানের কাজ করে যেতে লাগল। পশ্চিম দিকের একটা গ্রামে ওরা শুরু করল এমন একটা ভবন নির্মানের কাজ যাতে যে কেউই মহাকাশের সবটা পর্যবেক্ষণ করে রীতিমত ছো্টোখাটো ভাবে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান আহরণ করে ফেলতে পারে। শহরের কেন্দ্রস্থলে তারা এত বড় একটা যাদুঘর তৈরী করল যেখানে গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার এক একটি চলমান, ছোট ও নকল নিদর্শন তৈরী করে তার বর্ণনা দেবার জন্য একজন করে ব্যক্তিকে নিযুক্ত করল। ফলে ছেলেমেয়েরা ক্লাসঘরে বসে জ্ঞান অর্জন করার বদলে সেখানে এসেই সতস্ফুর্তভাবে  নিজেরাই অনেক কিছু শিখে গেল। মহেঞ্জদরো সভ্যতার অনুকরণে এমন একটি সার্বজনীন স্নানাগার তৈরী করা হল মধ্যাঞ্চলের একটি রাজ্যে যে সেটাও সকলের কাছে একটা খুব আকর্ষনীয় ব্যপার হয়ে দাঁড়াল। টিকিট কেটে স্নান করবার সুযোগ পেয়ে সকলেই একটা বিশেষ আনন্দ অনুভব করল। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়গুলোকে নিয়ে তৈরী করা হল একটা বিজ্ঞানের শহর যেখানে টিকিট কেটে মহাকাশ যানে চড়ে মহাকাশ ভ্রমণ ও চন্দ্র ও মঙ্গলগ্রহ ভ্রমনেরও একটা বিশেষ ব্যবস্থা করা হল। প্রাগৈতিহাসিক কালের জীবরা যাতে সহজে হেঁটে বেড়াতে পারে আর ইচ্ছে করলেই মানুষ তার পিঠে সওয়ার হতে পারে সেজন্যও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জমি নিয়ে সেগুলোর একটা কেন্দ্রীয় ভবন নির্মাণ করা হল। প্রাচীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নব সংযোজন স্বরুপ সেগুলো আবার নতুন করে একই স্থাপত্যরীতি ব্যবহার করে তৈরী করা হল। শিক্ষা দপ্তরের কল্যাণে সেখানে অসংখ্য বিদেশী শিক্ষার্থী পড়াশুনোর জন্য আসতে লাগল ও জ্ঞান আদান প্রদানের সেগুলো এক একটি বড় কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠল। 

চৈতি উপত্যকার সঙ্গে যৌথজীবন যাপন করতে করতে প্রতিরক্ষা দপ্তরে আরও কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে ভাবতে থাকল। উপত্যকার দাদাবৌদির সূত্র ধরে ইতালি থেকে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আসতে চাইল এখানকার আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনোর জন্য। কিন্তু তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া আর পারিপার্শ্বিক ব্যপারগুলো নিয়ে। তাই বিদ্যালয়ে পড়াশুনোর শেষে তারা অন্য কোনও নির্ভরযোগ্য স্থানে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থেকে যেতে চায়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল এতে তাদের কোনও আপত্তি নেই। চৈতি বলল ওরা পেয়িং গেস্ট হিসেবে তার বাড়িতেই ইচ্ছে করলে থাকতে পারে। এর ফলে সে বছর জানুয়ারীর গোড়াতেই দিগন্তসেনায় নতুন একদল কিশোর কিশোরীর কলকাকলিতে সেখানকার রাস্তাঘাট মুখরিত হয়ে উঠল। তারা হল ঋক ভেসকোভো, হেলেন মানফ্রেদি, ইলিনা লোরেল, আলেসসান্দ্রো ম্যারাইনি, উদাচা পিক্কো, ইলেয়ানা বারিক্কো, আয়ুষ পিক্কো, কলা সেভেরন্যিনি, অজন্তা চিতারিস্তি, অ্যানজেলা ব্রাউন, অগ্নি রোসারিও, শিলালিপি মোরেত্তি, অনুস্কা বারিক্কো এবং ধানী লোলাব্রিগিদা। নিজের ছেলেমেয়েরা বাদেও এই চোদ্দজন বিদেশী ছাত্রছাত্রীর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য আলাদা একজন রান্নার আর ঘর মোছামুছি ও অন্যান্য কাজের জন্য আরও দুজন, মোট তিনজন কাজের লোক রাখা হল। একতলাটা  পুরোটাই ওই ছাত্রছাত্রী দলের জন্য ছেড়ে  দেওয়া হল। ইতিমধ্যে নীলনদও দিগঙ্গনাকে নিয়ে ফিরে এল আর নতুন একটা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করল। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাজে নীলনদও যুক্ত হয়ে গেল আর পাঁচ মাস যেতে না যেতেই দুজন সদস্য তাদের সংসারে এসে পড়ল, দুটি যমজ কন্যা। ওদের নাম রাখা হল ঋতাভরী ও অগ্নিমিত্রা। চৈতির ছেলেরা তীর্থ আর বেদ উপত্যকার কাছে দিব্যি বড় হতে থাকল। মাঝে মাঝে রজতাভ ওদের এসে দেখে যায়। গোটা বাড়িটা নবাগত চারটে ছেলে আর দশটা মেয়ের পড়াশুনো, হাসিঠাট্টা তামাশায় এতটাই ভরে থাকে যে মাঝে মাঝেই তীর্থ আর বেদ ওদের কৌতুহলী চোখে উঁকি দিয়ে দেখেই খ্যান্ত হয় তাইই নয়, মাঝেমাঝে সোজা নীচে নেমে ওদের কাছে চলে যায়। ওরা দুজনেই ছাত্রছাত্রী দলের চেয়ে ছোট হলেও ওদের দলেও বেশ কয়েকজনই আছে যারা প্রায় তীর্থ আর বেদের কাছাকাছি বয়সের। ভাব জমে যেতে বেশি সময় লাগে না তাই। বিশেষ করে আলেসসান্দ্রো বলে ছেলেটি ওর থেকে বছর দুয়েকের বড় হলেও সে বেদকে খুবই ভালোবাসে আর ভালোবাসার টানেই তাদের ওপর নীচের দূরত্ব ঘুচিয়ে বেদ একদিন ওকে টানতে টানতে ওপরে নিয়ে আসে তার ঘরে। তারপর থেকেই দুজনে বেশির ভাগ সময় ওখানেই গল্প করে। আলেসসান্দ্রো ওকে পড়া বুঝিয়ে দেয়, অংক করিয়ে দেয়। ব্যপারটা শেষ পর্যন্ত এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে বেদ ওকে ছাড়া কোনও কিছু করতেই চায় না। আলেসসান্দ্রোও যেন বেদ চাইলে আকাশ থেকে চাঁদটাকেও পেড়ে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।  ক্রমশ ক্রমশ বেদ ওকে ছাড়া খাওয়া, শোওয়া, স্কুলে যাওয়া সব কিছুতেই অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে আস্তে আস্তে চৈতি আর উপত্যকার অনুরোধে সেই ছেলেটা বেশির ভাগ সময়ই বেদের সঙ্গে থাকতে শুরু করে দেয়। ব্যপারটা ঠিক তার দিদি যাজ্ঞসেনীর মতই হয়, যেমন সে লিপিকাকে ছাড়া একবিন্দুও থাকতে পারে না। লিপিকার ওপর যাজ্ঞগসেনী আর যাজ্ঞসেনীর ওপর লিপিকার একধরনের একাধিপত্য প্রকাশ পায় যেটা বেদ ও আলেসসান্দ্রোর মধ্যেও তৈরী হয়। 

একদিন চৈতি আর উপত্যকা বাড়ি ফিরে দেখে বাড়িটাকে যেন আর বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। বরং সেটা যেন খানিকটা একটা বড় সড় জাহাজের মত হয়ে উঠেছে। ওরা বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই সেটা দুলতে শুরু করেছে একটা বড় সড় জাহাজের মত, যার ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অই চোদ্দ জন ছাত্রছাত্রীদের দল আর চৈতির ছেলেমেয়েরা, জাহাজেরভেতরে ঢুকে নানান রকম কাজকর্ম সারতে লেগেছে ওদের কাজের লোকেরা। একটা গোপন কুঠুরি থেকে মেয়েদের হাসির আওয়াজ শুনে সেখানে গিয়ে দেখতেই দেখা যায় যাজ্ঞসেনী আর লিপিকাকে, দুজনেই নগ্ন অবস্থায়। জাহাজটা ভেসে যেতে থাকে আর ভাসতে ভাসতে ওরা একটা ফেরিঘাটে পৌঁছে গিয়ে নোঙর ফেলে। সেখান থেকেই  এক জায়গায় হঠাৎ  দেখে ওদের মন্ত্রীসভার দুই মন্ত্রী, মানকো আপারু ও তুপাক ইউপানকি একটা লোককে ধরে বেধরক  মারছে। মার খেতে খেতেও লোকটা হাত পা নেড়ে ইশারা করছে আর একজনকে। চৈতি আর উপত্যকা দেখে মানকো আপারু আর ইউপানকি এগিয়ে এসে জানায় যে ওই লোকটার নাম এরনান কোর্তেস আর তার পাশের লোকটা ওরই সহচর আর ওরা দুটোই আসলে নাকি দালাল। ওরা দুজনেই এখানকার অসংখ্য  মানুষের ঘরবাড়ি থেকে মেয়েবউকে তুলে নিয়ে গেছে আর কিছুই নয় স্রেফ বাজারে তাদের মাংস বিক্রি করে দেদার টাকা মুনাফা হিসেবে লুঠ করবার জন্য। সেই সব মেয়েদের রাখা হয়েছে একটা বিরাট বড় আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরী চব্বিশ তলা বাড়ির মধ্যে। সেখানে দিনরাত তারা দেহ বিক্রি করে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য লোকের শরীর ও মনোরঞ্জন করে চলেছে। তারপর যেই তাদের বিক্রয়যোগ্য রমনযোগ্যতা শেষ হয়ে যায়, তাদের ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় আস্তাকুড়ে বাঘ সিংহদের মুখের সামনে। আর সেই সব ভয়ঙ্কর জন্তু-জানোয়ারগুলো তাদের হাড় গোড়  শুধ্বু চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে। মানকো আপারু ডাকতেই ছাত্রছাত্রীদের দলটা হৈ হৈ করে দৌঁড়ে গেল আর মানকো ওদের হাতে ধরিয়ে দিল বস্তা বস্তা সোনা ও রুপোর মোহর, যেগুলো ও এরনান  কোর্তেসের কাছ থেকে এইমাত্র আদায় করেছে আর ছেলেমেয়েগুলো সেইসব ভারী ভারী বস্তা প্রবল উল্লাসে টানতে টানতে নিয়ে এল জাহাজের ওপর মানকো আপারুর নির্দেশ মত সেগুলো যাতে তারা পৌঁছে দিতে পারে দিগন্তসেনার অর্থ তহবিলে, আর তা দিয়ে নবদিগন্তউন্মোচনহিসেব ঠিকঠাক তার লক্ষ্যভেদ করতে পারে। কিছুটা দুরেই দাঁড়িয়ে আছে নীলনদ দিগঙ্গনার সঙ্গে। তাদের দুজনের কোলেই একই রকম দেখতে দুটো শিশু রয়েছে আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ওরা যেন বা অনেক কিছু  বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওদের কেউই সেগুলো বুঝতে পারছে না। ছাত্রছাত্রীদের দলের মধ্যে থেকে দুটো মেয়ে গুড়গুড় করে হেঁটে গিয়ে ওদের কোলে নিয়ে জাহাজের ওপর চলে আসে। ওদের পেছনে পেছনে দিগঙ্গনাও  জাহাজে উঠে আসে নীলনদের এঁকে দেওয়া একটা যুদ্ধজাহাজের নক্সা হাতে নিয়ে। নীলনদ কিন্তু আসে না। বরং আরও ধনসম্পত্তি  হাতাবার জন্যে মানকো আপারু আর তুপাক ইউপানকির সঙ্গে হাত লাগায় এরনান কোর্তেস আর তার সহকারীকে  চাবকানোর কাজে যাতে তার কাছ থেকে সে আরও অনেক অনেক ওইরকম সোনা রুপোর মোহরের বস্তা পেতে পারে যা দিয়ে সে আরও সাতাশটা ঊড়োজাহাজ বানাতে পারবে দিগন্তসেনার বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষার জন্যে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটা দিগন্তসেনায় নোঙর  ফেলল আর বস্তাগুলোকে যাতে যথাস্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হয় সে জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের কয়েকজন অফিসারদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চৈতি আর উপত্যকা সবাইকে নিয়ে ফিরে যায় যে যার নিজের নিজের নির্দিষ্ট ঘরে। ঘরে ঢুকেই চৈতি হাতে পায় এমন একটা চিঠি যাতে লেখা আছে মানময়ী খুবই অসুস্থ আর সঙ্গে সঙ্গেই অনঙ্গর ততোধিক অসুস্থ আচার আচরণের কথা যা তার বোধগম্য হতে বেশ খানিকটা সময় কেটে যায় আর সে মাথা নিচু করে বসে ভাবতে থাকে তার সমাধানটা কী হতে পারে।

(ক্রমশ)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন